বস্তির বস্ত্রশিল্প ও অলিম্পিক ভিলেজ



মঈনুস সুলতান
অলিম্পিক ভিলেজ

অলিম্পিক ভিলেজ

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রচুর পর্বত ও হালকা বনানীতে পূর্ণ আফ্রিকার ছোট্ট রাজ্য লিসোটোতে কিছুদিন হলো আমি বাস করছি। লিসোটোর রাজধানী হচ্ছে মাসেরু। কিছু দিন আগে আমি মাসেরুতে বেড়াতে আসি। তখন খুঁজে বের করি বছর দুয়েক আগে জিম্বাবুয়ের কবি সন্মেলনে পরিচয় হওয়া এক তরুণী—কবি নাকাতুলে মোপালেসাকে। নাকাতুলের সাথে আমার জানাশোনা বন্ধুত্বের পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তাই এ যাত্রায় তার দরাজ হাতে সঙ্গদানের ওপর ভরসা করেছিলাম। কিন্তু নসিব খারাপ, ইতিমধ্যে লিসোটোতে কর্মরত জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির এক বিপত্নীক কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ড. সাইমন ইনগ্রাম হিলের সাথে তরুণী কবিটির জোরালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মাসেরুতে এসে আমি নাকাতুলের সঙ্গ পেয়েছি স্বল্প, তবে সে একটি উপকার করেছে, ড. ইনগ্রাম হিলের সাথে আমার যোগসূত্র ঘটিয়ে দিয়ে কনসালটেন্ট হিসাবে ছোটখাট কিছু কাজ পাইয়ে দিয়েছে।

এধরনের একটি কনসালটেন্সি জাতীয় কাজের হিল্লা ধরে আমি এ মুহূর্তে মাসেরু শহরের একটি হোটেলের লবিতে বসে আছি। লবির দেয়াল জুড়ে ঝুলছে চমৎকার সব চিত্রিত বস্ত্র। কোনো কোনো কাপড়ে ছাপ দিয়ে করা নকশা। অন্যগুলোতে আছে সুইসুতা দিয়ে আঁকা ছবি। আমি নোটবুকে এসবের একটি ডিটেল বর্ণনা লিপিবদ্ধ করছি। ইউএনডিপির কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ড. ইনগ্রাম-হিল আমাকে এ কাজের অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি কয়েকদিনের জন্য জোহানেসবার্গে গিয়েছেন। আগামী বুধবারের ফ্লাইটে তার ফিরে আসার কথা। গেল বছরের প্রচুর সময় তিনি কাটিয়েছেন স্থানীয় একটি বস্তিতে হস্তশিল্পের প্রকল্প বাস্তবায়নে। বস্তির মানুষজনরা সকলে একসময় বাস করতেন মাসেরু শহরের প্রান্তিকে বেশ উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে। তারপর ব্যাপক ভূমিধসে তারা বাস্তুহারা হয়ে শহরের অন্য একটি বস্তিতে আশ্রয় নেন। ড. ইনগ্রাম-হিল এদের মাঝে যে সব নারী খানিকটা হাতের কাজ জানেন, তাদের জড়ো করে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছেন এ প্রকল্প। ইউএনডিপি সচরাচর এধরনের মাইক্রো প্রজেক্টে জড়ায় না। পুরা ব্যাপারটা হচ্ছে তার নিজের উদ্যোগে। তবে তিনি ইউএনডিপির কানেকশন ব্যবহার করে বস্তির হস্তশিল্প প্রকল্পের ফান্ডের সংকুলান করে দিচ্ছেন। উইকএন্ডের ছুটিতে তিনি বস্তিতে নিজে কাজের তত্ত্বাবধান করেন। আজ মাসেরুর একটি হোটেলে বস্তি প্রকল্পের হস্তশিল্পের নমুনার প্রদর্শনী হতে যাচ্ছে। আরো ঘণ্টা দেড়েক বাদে দাওয়াতি দেখনেওয়ালারা হাতের কাজ দেখতে আসবে। উদ্যোক্তারা দেয়ালে সূচিকর্ম ও চিত্রিত বাটিক ঝুলিয়ে বিরতি নিয়ে বাইরে গেছেন লাঞ্চ সারতে।

আমি এখানে লবির নিরিবিলিতে নোটবুক নিয়ে একটি টেবিলে বসেছি। লিসোটো খুবই ছোট্ট দেশ। পথঘাট দুর্গম, মাসেরু শহরে পর্যটক আসে অল্প। তাই বস্তির হস্তশিল্প চড়া দামে বিক্রি হাওয়ার সম্ভাবনা কম। ড. ইনগ্রাম-হিল চাচ্ছেন এসব পণ্য সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ বা কেপ টাউনের মতো বড় শহরে বাজারজাত করতে। ওখানে আছে হস্তশিল্পের ওপর বেশ কয়েকটি পর্যটকভোগ্য ম্যাগাজিন। তিনি আমাকে অনুরোধ করেছেন ‘ভূমিধসে বাস্তুহারা মানুষের হাতের কাজ’ শিরোনামে বর্ণনাত্মক স্টোরি তৈরি করে দিতে; যা তিনি একটি ম্যাগাজিনে ছাপাবেন। আমাকে অনুরোধ করার পেছনে কারণ হচ্ছে কয়েক দিন আগে তার সক্রিয় সাপোর্টে আমি মাসেরুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ‘অলটারনেটিভ টু ভায়োলেন্স’-এর ওপর একটি প্রশিক্ষণ করেছি। ওই সময় কিছু কয়েদিদের সাথে কথাবার্তা বলে কারাগারে কিভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হচ্ছে সে বিষয়ে বর্ণনাত্মক রিপোর্ট তৈরি করে দিয়েছি। বর্ণনা তার পছন্দ হয়েছে, তাই তিনি আমাকে বস্তির বস্ত্রশিল্পের ওপর স্টোরি তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। আমি অপেক্ষা করছি লাঞ্চের পর প্রদর্শনীর উদ্যোক্তারা সাথে করে নিয়ে আসবেন বস্তির কয়েকজন নারীকে যারা মূলত নিজ হাতে এ কাজগুলো করেছেন; আমি তাদের সাথে একটু কথাবার্তা বলব।

লবিতে বস্ত্রশিল্পের নমুনা

হাতে সময় আছে দেখে আমি নোটবুকে অন্য একটি বিষয় নিয়ে লিখতে শুরু করি। এ ঘটনায় জড়িয়ে ছিলাম গতকাল ও তার আগের দিন। যার সাথে মাসেরু শহরের বাইরে গিয়েছিলাম তার সঙ্গ কোর্তায় লেগে থাকা বাসি আতরের মতো এখনো মনে ছড়াচ্ছে মৃদু মৃদু সৌরভ। কোনো প্রস্তুতি ছিল না। কবি নাকাতুলে মোপালেসার অপেক্ষায় সকালবেলা দাঁড়িয়ে ছিলাম গুড টাইম ক্যাফের সামনে। ঝকঝকে একখানা সাদাটে ক্রিমকালারের ভেসপা চালিয়ে সে আসে। অফ হোয়াইট জিন্সের সাথে একই কালারের জ্যাকেট ও হেলমেট পরাতে মেয়েটিকে খানিকটা নভশ্চরের মতো দেখাচ্ছিল। সে ড. ইনগ্রাম-হিলের ভেসপা চালিয়ে এসেছে। তিনি তো এখন জোহানেসবার্গে। নাকাতুলে ভেসপাখানা ক্যাফের মালিকের গ্যারাজে নিরাপদে পার্ক করে আমাকে বেশ খানিকটা দূরে পাহাড়ি এলাকায় আউটিংয়ে যাওয়ার তথ্য দেয়। যেতে আমার আপত্তি আছে, তা নয়। তবে আমি তো বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ওভার-নাইট ব্যাগ ইত্যাদিসহ আসিনি। সে তার ব্যাকপ্যাক দেখিয়ে বলে, এতে সব ব্যবস্থা আছে। একটু খটকার মাঝে পড়ি। পার্কিংলটে হর্ন বাজিয়ে এসে দাঁড়ায় বেজায় বড় লাল রঙের একটি গাড়ি।

ভ্যান গাড়িটি যিনি ড্রাইভ করছেন তিনি গায়ে গতরে বিশাল এক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ। ভদ্রসন্তান কম্বল কেটে তৈরি একটি হুডওয়ালা কানমাথা ঢাকা কালচে লোমশ জ্যাকেট পরে আছেন, তাই তাকে কেমন যেন আধবুড়ো গরিলার মতো দেখায়। তার পাশের সিটে লাল টিশার্ট পরে বসে আছেন আরেক ব্যক্তি। তার গলা থেকে ঝুলছে সাদা পুতির সাতনরী হার, তাতে গাঁথা জানোয়ারের দুটি শিং। তিনি নেমে এসে আমার সাথে হাত মিলিয়ে নিজেকে মাকগথলা মাবই নামে পরিচয় দেন। পেশায় তিনি জংগল গাইড। ছোটখাট কথায়বার্তায় বুঝতে পারি, আমার আন্দাজ বেঠিক নয়, ভ্যানখানা একসময় ফায়ার ব্রিগেডের অগ্নি নির্বাপক গ্যাস বহন করার গাড়ি ছিল। ইঞ্জিন বিকল হলে তা নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এখন যিনি ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন তিনি ছিলেন মাসেরু ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী। মাইনা যথেষ্ট নয় বলে তিনি সার্ভিসে ইস্তেফা দিয়ে জংগল ট্যুরের কোম্পানি খুলেছেন। নিজের শরীর-গতর বেমক্কা কিসিমের ওজনদার, তাই সচরাচর পর্যটক নিয়ে তিনি বনজংগলের আশেপাশে গাড়ি পার্ক করে তাতে বসে বসে ঝিমান। মাকগথলা মাবই দেখনেওয়ালাদের পায়ে হাঁটিয়ে পাহাড়-পর্বত, হ্রদ-গণ্ডার, হাতি ও জিরাপ দেখান। গাড়িতে চড়ার সময় দেখি, তার দরোজায় লালের ওপর কালো আলকাতরা দিয়ে সৃজনশীল বানানে লেখা ‘জ্যংগোল ট্যুর লিমিলেড’, পাশে মাথা হেট করা দুটি জেব্রার ছবি।

নাকাতুলের সাথে আমি পেছনের দিকে বসি। ভ্যান গাড়িটির এদিকে খোলা জায়গা প্রচুর। তাতে রাখা খনিতে পাথর ভাঙার হাতিয়ার, তীরধনুক, বল্লম, দোনলা বন্দুক, ও বোধ করি পর্যটকদের ভয় দেখানোর জন্য কোনো জানোয়ারের দাঁতমুখ খিঁচানো খটখটে করোটি। আমি হাতিয়ারগুলোর দিকে কৌতূহলী নজরে তাকাই। অতীতে আমি আফ্রিকার ট্যুর কোম্পানির গাড়িতে বনেলা জানোয়ার দেখার সুবিধার জন্য বাইনোকুলার রাখা দেখেছি, তীরধনুক ও বল্লমের অভিজ্ঞতা এই প্রথম হতে যাচ্ছে। তবে কি আজকের কর্মসূচীতে বন্যপশুর সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহের আশঙ্কা আছে?

যাই হোক, প্যাত প্যাত করে হর্ন বাজিয়ে ভ্যান স্টার্ট দিতেই আমি জাঁকিয়ে নাকাতুলের পাশে বসি। পেছনে সিট বলতে যে সুপরিসর কাঠামোটিতে আমরা বসেছি, তা বোধ করি কাঠমিস্ত্রি দিয়ে তৈরি করা। তাতে জাজিমের মতো পুরু গদি পাতা। বালিশ, কুশন ও কম্বলের ঢালাও বন্দোবস্ত আছে। চাইলে পা ছড়িয়ে শোওয়া যায়। সিটটি এমনই আরামদায়ক যে মওকা পেলে এখানে সঙ্গম সেরে নেওয়া যায়।

নাকাতুলের সাথে আউটিংয়ে আমি আগেও গিয়েছি। তখন অবশ্য ট্যুর কোম্পানি বা ড্রাইভারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে দামদর, কোথায় যাব, কী করতে বাসনা হচ্ছে—এসব আমিই ঠিক করেছি। এবারের আয়োজনে সে উদ্যোগ নিয়েছে। তা নিক, পুরুষ হিসাবে বিল তো আমাকে পে করতে হবে। লিসোটোতে ক্রেডিট কার্ডের চল কম। তাই মাসেরু শহর থেকে তোড়ে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বলি, “তুলিকা সুইট লিটিল গার্ল, ড্রাইভারকে বলো গাড়ি ঘোরাতে। শহরের মধ্যিখানের স্কোয়ারে আছে সাউথ আফ্রিকান নেড ব্যাংক, ওখানকার এটিএম মেশিন থেকে একটু টাকাপয়সা তুলতে হচ্ছে যে।” সে গোলাপি রঙ মাখানো পূর্ণ ঠোঁট খানিক বাঁকা করে বলে, “হোয়াই? এ ট্যুরের জন্য তোমাকে কিছু পে করতে হচ্ছে না, অল আর এডভান্স পেইড ফর।” আমি না বলে পারি না, “তুমি হঠাৎ করে এত টাকাপয়সা পেলে কোথায়?” সে মাথা ঝাঁকায়, তাতে তার কিন্তিলি চুলের মৌচাকাকৃতিতে যেন মধুভুক পতঙ্গের ভেতর মৃদু আলোড়ন শুরু হয়। সে দুহাতে চুলের শেইপকে অগোছালো হতে না দিয়ে বলে, “ড. ইনগ্রাম-হিল পেইড ফর এভরিথিং, আমার বার্থ-ডে গিফ্ট হিসাবে তিনি এ ট্যুরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।” কোথায় দূরের কোন তেপান্তরের মাঠে আমার ওড়ানো ঘুড়িটিকে অদৃশ্য কেউ যেন কাচ-গুড়োর মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় কেটে নেয়। আমি কান্নি খেয়ে পড়ে যেতে থাকা ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে ফাস্টট্রেটেড হয়ে বলি, “তুলিকা, আমাকে জিঞ্জেস করবে তো, আমি ড. ইনগ্রাম-হিলের তোমাকে দেওয়া ট্যুরে যেতে চাচ্ছি কিনা?” সে চোখমুখে কপট কঠিন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বলে, “তুমি আমার কাছে জানতে চেয়েছো আমি জন্মদিনে মার্বেল পাথরের টেবিল চাই কি না? গতকাল ফার্নিচারের একটি কোম্পানি থেকে পিকাপ ট্রাকে করে টেবিলটি আমার দিদিমার ঘরে পৌঁছে দিয়েছে, লুক হোয়াট হেপেনড? ভারি টেবিলটি টানাটানি করতে গিয়ে..।”

নাকাতুলে ডিজাইনার স্নিকার খুলে মোজা গুটিয়ে তার পা-টি বাড়িয়ে তুলে দেয় আমার ঊরুর ওপর। চামড়া খানিক ছড়ে গিয়ে পায়ের গুছিতে বেগুনি হয়ে আছে। আমি ওখানে মৃদু আঙুল বুলিয়ে বলি, “এ ট্যুর ছাড়া ড. ইনগ্রাম-হিল তোমাকে জন্মদিনে আর কিছু দেয়নি?” সে কুশনে আধশোয়া হয়ে ঝুঁকে ব্যাকপ্যাকের জিপার খুলতে খুলতে ফিচেল হেসে বলে, “আর ইউ শিওর ইউ ওয়ান্ট টু সি দিস?” আমি “লেট মি সি” বলে হাত বাড়াই। খুব বড় না, এ-ফোর সাইজের সেলোফোনে মোড়া সাদা কাডবোর্ডে পেন্সিল দিয়ে আঁকা...প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় পালকে ঠোঁট-মাথা গুঁজে বসা দুটি কপোতের ছবি। তার নিচে সিসোটো ভাষায় লেখা ‘লেবা লা-কা’, বা ‘মাই পিজিওন’। আমি কার্ডবোর্ডটি ঘুরিয়ে অন্য পারসপেক্টিভ থেকে তাকাই। তখনই বিষয়টা পরিষ্কার হয়, যা দেখছি তা কিন্তু আদপে জোড়া কবুতরের চিত্র নয়, আমার চোখে পরিষ্কার হয়ে ওঠে পরস্পরের সাথে সন্নিবেশিত হয়ে থাকা যুগল স্তনের দৃশ্য। আমি তার দিকে তাকাই। সে আধশোয়া হয়ে কিন্তিলি চুলে দুহাতে বিলি কাটলে তার ভরাট বুক তীব্রভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে শরীরের ভঙ্গি বদলিয়ে তা আড়াল করার চেষ্টা না করে বোধ করি নীরবে আমার রিএকশন শোনার জন্য অপেক্ষা করে। তো আমি বলি, “সো, আই আন্ডারস্ট্যান্ড ড. ইনগ্রাম-হিল লাভস্ ইউ।” সে ফিনকি দিয়ে হেসে বলে, “হি ইজ মাই সুগার ড্যাডি। সে আমাকে নিয়ে কী ভাবে.. আই সিম্পলি ডোন্ট কেয়ার। তাকে যে পছন্দ করি না, তাও না। হি ইজ মাই টুথসিওটসি বাটার কাপ। এক্সপেনসিভ গিফ্ট দেওয়াই তো তার কাজ।” বলে সে আমার সিনিওর সার্ভিসের প্যাকেট থেকে একটি সিগ্রেট বের করে তাতে লাইটারে আগুন দেয়।

আমি ‘সুগার ড্যাডি’ টার্মটি নিয়ে মনে মনে তর্পণ করি। সুগার ড্যাডি হচ্ছে মূলত মাঝবয়সী বা বয়োবৃদ্ধ বিত্তবান পুরুষ, যিনি অল্পবয়সী কোনো মেয়েকে সঙ্গদান ও দৈহিক ভালোবাসার বিনিময়ে প্রদান করেন দরাজ হাতে গিফ্ট ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে টাকাপয়সা। ধোঁয়ার রিং ছুড়তে ছুড়তে নাকাতুলে যেন স্বগতোক্তি করে, “হি ইজ ভেরি গুড, বাট আ বিট অব আ সেক্স ডেভিল।” আমি সাবধানে সেলোফোনের র‌্যাপার মুড়িয়ে পেন্সিল স্কেচটি তার ব্যাকপ্যাকে রাখি। তারপর কল্পনায় জুতা দিয়ে আধপোড়া সিগ্রেটকে পিষে নেভানোর মতো প্রতিক্রিয়াকে প্রশমিত করি।

কিছুক্ষণ আমরা কোনো কথাবার্তা বলি না। ফায়ার ব্রিগেডের ভ্যানটি অনেকক্ষণ হয় পাড়ি দিয়েছে উপত্যকার দিগন্তে ছাড়ানো প্রান্তর। এখন আঁকাবাকাঁ সড়ক বেয়ে ভ্যানটি ছুটে যাচ্ছে পাহাড় থেকে পাহাড়ে। পর্বতগুলোতে গাছপালা বৃক্ষলতা তেমন কিছু নেই। কী রকম যেন খাঁ খাঁ শূন্যতার ভেতর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমাচ্ছে শিলা পাথরের মন্সস্টারগুলো। দেখতে দেখতে পাথরের কালচে খয়েরি শরীর ধূসর হতে হতে ভরে ওঠে শুভ্রতায়। মাসেরু শহর থেকে যখন এ ভ্যানে চাপি, তখন নগরীর জনপদে ছলকে যাচ্ছিল ঝকঝকে রোদ। এখন ঘুম ভাঙতে দুস্বপ্নের মতো তা উবে গিয়ে আকাশ হয়ে এসেছে ভারী মেঘলা। আর গুঁড়িগুঁড়ি তুষারের শুভ্র হালকা পালকে ভরে যাচ্ছে গিরিকন্দর। নাকাতুলে গাড়ি স্লো করতে বলে। আমরা মালিবামাটসো নদীর সাদা ফেনায় জলচর পাখিদের সাঁতার কাটতে দেখি। সামনের সিট থেকে জংগল গাইড মাকগথলা মাবই ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চান, আমি ‘পিডিপিডি’ বা বেলেহাঁসের ছবি তুলতে চাই কি না? আমার ভেতরে কেন জানি উৎসাহ মরে আসছে, তাই কোনো জবাব দিই না।

ভ্যান স্পিড পিক করে আবার ছুটে চলে। পহাড়ের ঠিক কার্নিশে ঝুলে আছে টেনিস কোর্টের সমান একটি শিলাপাথরের সমতল চাকলা। ওখানে ভ্যান পার্ক করলে আমরা নেমে আসি। জায়গাটি অনেকটা লুক আউটের মতো। দূরে পরিষ্কার দেখা যায় কাটসে ড্যাম। টারবাইনে চূর্ণিত হয়ে জলবিদ্যুতের এ প্রকল্প থেকে পানি নেমে আসছে প্রপাতের ধারা প্রবাহে। তুষার ঝরা তীব্র শীতে কাবু হয়ে আমরা ফিরে আসি গাড়িতে। ড্রাইভার তীব্র দক্ষতায় মিনিট পনেরোর ভেতর আরেকটি বাঁক ঘুরে আমাদের নিয়ে আসেন কাটসে ড্যামের বেশ কাছাকাছি। বাঁকানো ব্রিজের মতো করে তৈরি একটি সিমেন্টের সড়ক লিসোটো হাইল্যান্ড ওয়াটার প্রজেক্টের বিখ্যাত বাঁধটিকে ঘিরে আছে। তার ওপর দিয়ে একজন মানুষকে অলস পায়ে হেঁটে যেতে দেখি। এদিকে কোনো তুষারপাত কিছু হচ্ছে না, ঘাসপাতা সমস্ত কিছু খটখটে শুকনা দেখে বড় অবাক লাগে।

বাঁধ ঘিরে সিমেন্টের সড়ক

ভ্যান গাড়িটি আবার চড়াই উৎরাই ভাঙে। আরো মিনিট তিরিশেক আমরা পথ চলি। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি হ্রদের জল, তার অতলে প্রতিফলিত হচ্ছে বিশাল মেঘভাসা আকাশ। আমি গাড়ি থেকে নেমে হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে তার ভেতরবাগে জেগে ওঠা ছোট্ট দ্বীপাণুর দিকে তাকাই। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে গাড়িতে পোশাক চেঞ্জ করে নীলাভ ট্র্যাকস্যুট পরে বেরিয়ে আসে নাকাতুলে। তার পকেটে বাজছে সিডি ওয়াকম্যান। মৃদু মৃদু সুরধ্বনি শুনে আমি লিরিকটি চিনতে পারি—‘নো মোর ওয়াক ইন দ্য উড/ দ্য ট্রিজ হ্যাভ অল বিন কাট ডাউন।’ ১৯৭১ সালে লস এ্যঞ্জেলসে ‘দ্যা ঈগলস্’ নামে একটি আমেরিকান রক ব্যান্ডের গাওয়া গান। বছর তিন বা চারেক আগে জিম্বাবুয়েতে যখন নাকাতুলের সাথে প্রথম দেখা হয়, তখন আমি তাকে এ সিডিটি গিফ্ট হিসাবে দিই। সে কান থেকে ইয়ারফোন খুলে বলে, “এ জায়গাটি তুমি দেখতে চেয়েছিলে। ডু ইউ রিমেমবার?” বিষয়টি এবার আমার মনে পড়ে।

কয়েক বছর আগে আমি ইউরোপীয় এক রাজকুমারের লেখা লিসোটো নিয়ে একটি ট্র্যাবেল একাউন্ট পড়ি। লিসোটোর রাজা গ্রিফিথ লিরোথলির মেহমান হয়ে রাজকুমার এখানে তিনদিন তাঁবু খাটিয়ে বাস করেন। তার বর্ণনাতে হ্রদের কোনো উল্লেখ নেই। তবে তিনি এখানে প্রচুর কনিফার বৃক্ষের চিরহরিৎ একটি উপবনের দৃশ্য বর্ণনা করেছেন। লিসোটোর এ অঞ্চলের পাহাড়ে গাছপালা তেমন কিছু জন্মায় না। তবে এখানে হঠাৎ করে সবুজের বিপুল সমারোহ দেখে রাজকুমার অবাক হয়েছিলেন তীব্রভাবে। তার তাঁবুর চারদিকে ছিল ‘ইরিকাস’ নামে এক ধরনের ঝোপ। তাতে ওড়াউড়ি করছিল অজস্র পাখি। তিনি ‘টুসোক’ বলে এক ধরনের দীর্ঘ ঘাসের উল্লেখ করেছেন যেখানে লুকোচুরি করছিল খরগোস। জলবিদ্যুত প্রকল্পের কারণে এখানে ওয়াটার রিজারভার হিসাবে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম সরোবর। উপবনটি বরফে ডুবে গেছে তার তলায়। আমি নিসর্গপটের এ পরিবর্তন নিয়ে ভাবতে ভাবতে ভ্যান গাড়িতে ফিরে যাই। নাকাতুলে গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলে, “লিসেন, উপবনের জলে নিমজ্জন নিয়ে আমি বাঁধতে চাচ্ছি একটি পালা গান। ঈগল নামে রক ব্যান্ডের করা গানটির স্ট্রাকচার থেকে সুরের অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। কিন্তু লিরিকের কথাগুলো ঠিক মতো সাজিয়ে উঠতে পারছি না। উইল ইউ হেল্প মি আ বিট?” আমি নোটবুক খুলে তাতে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বলি, “জাস্ট ট্রাই টু ডেসক্রাইব ইন প্লেইন এন্ড সিম্পল সিসোটো লেংগুয়েজ...ইউরোপের রাজকুমার আবার যদি ফিরে আসেন, হোয়াট হি উইল সি..।” তখনই জংগল গাইড মাকগথলা মাবই ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন, “পিডিপিডি.. পিডিপিডি...” আমরা জানালা দিয়ে তাকাই, দেখি সরোবরের জলে ঝাপিয়ে পড়ছে এক ঝাঁক বেলেহাঁস। আমি নাকাতুলের হাতে নোটবুক দিয়ে বলি, “ট্রাই টু ইউজ দিস ইমেজ এ্যজ ইয়োর হুক। সরোবরের জলে বেলেহাঁসের জল ঝাপটানো নিয়ে শুরু করো। তারপর ফিরে যাও আরেকটু পেছনে, বর্ণনা করো উপবনে তাঁবু খাটিয়ে রাজকুমারের বসবাস, আর টুসোক গ্রাসে খরগোসের ছোটাছুটি। চাইলে এ গাঁথাতে তুমি মেশাতে পারো খানিক কল্পনা, রাজকুমারের এনগেজমেন্ট রিংটি যে ঘাসের গুচ্ছে হারিয়ে গিয়েছিল সে কাহিনী।” সে চোখ বড় বড় করে জানতে চায়, “ওয়াজ দ্য প্রিন্স রিয়েলি লস্ট হিজ এনগেজমেন্ট রিং হিয়ার?” আমি বলি, “তুলিকা, নট রিয়েলি, ইন ফ্যাক্ট হি লস্ট হিজ রোলেক্স ওয়াচ। ঘাসের আড়ালে বসে থাকা খরগোসের ছবি তুলতে গিয়ে তার কব্জি থেকে চেন লুজ হয়ে খসে পড়ে ঘড়িটি। নাও ডিসাইড, গানের পালায় তুমি রোলেক্স ঘড়ির ডিটেল ব্যবহার করবে, নাকি জুড়ে দেবে এনগেজমেন্ট রিং হারিয়ে যাওয়ার কাল্পনিক গল্প? অল ইজ নাউ আপ টু ইউ।”

ভ্যান গাড়িটি আবার ছুটে চলছে বাঁকা হয়ে তিমি মাছের পেটের মতো ছোট ছোট উপত্যকা মাড়িয়ে ভিন্ন এক পাহাড়ের দিকে। নাকাতুলে উডপেন্সিলে পালাগানের লিরিকের বাক্য সাজাচ্ছে। আর থেকে থেকে পেন্সিলের গোড়ার রাবার দিয়ে কণ্ঠার কাছে চুলকাচ্ছে। তাতে লালচে বেগুনি হয়ে উঠছে তার ত্বক। এদিককার একটি পাহাড়ে গড়ে উঠেছে আধুনিক কেতার অনেকগুলো কটেজ। আমরা গাড়ি থেকে নামি। ড্রাইভারও তার বেমক্কা কিসিমের ভারী শরীর নিয়ে নেমে পড়েছেন। তিনি শরীর বাঁকিয়ে হাতপা ছুড়ে বাতাসে ঘুষাঘুষির ভঙ্গি করে হাতপায়ের খিল ছোটাচ্ছেন। চোখ মুদে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে মুখ ব্যাদান করে হাঁপানি ও শ্লেষা জড়ানো কণ্ঠে তিনি গ-র-র-র আওয়াজ করছেন। ভদ্রলোকের অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হয়, তিনি গণ্ডার ফন্ডারের সাথে মল্লযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

জংগল গাইড মাকগথলা মাবই

নাকাতুলে ও আমি কটেজগুলোর মাঝ বরাবর তৈরি পিচঢালা পথে একটু হাঁটি। সাউথ আফ্রিকার এক তেজারতি কোম্পানি এ গ্রামটি তৈরি করেছে অনেকটা অলিম্পিক ভিলেজের কায়দায়। আমাদের পাশ দিয়ে জগিং করে ছুটে চলে শ্বেতাঙ্গ স্পোর্টসম্যানদের তিন চার জনের ট্রুপস্। কোনো কোনো কটেজের সামনের লনে শর্টস্ পরে স্বর্ণকেশী যুবতীরা খেলছে স্কিপরোপ। বারান্দায় বুকডন দিচ্ছেন মাথা কামানো তিনজন নওজওয়ান কিসিমের সাহেব। তাদের একজন আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লে তার মুখমণ্ডলকে দেখায়, প্রচুর মাখন আর গুঁড়ামরিচ দিয়ে ভাজা কাঁকড়ার মতো লালচে। নাকাতুলে বলে, জলবিদ্যুত প্রকল্প গড়ে ওঠার আগে এখানে ছিল দরিদ্র বাসোটো সম্প্রদায়ের মানুষদের টমালেতালি নামে একটি গ্রাম। এরা সকলে উচ্ছেদ হয়ে বর্তমানে বাস করছে মাসেরু শহরের বস্তিতে। তাদের সনাতনী কেতার কুটিরগুলো ভেঙেচুরে সাফসুতরা করে গড়ে তোলা হয়েছে অলিম্পিক ভিলেজের রেপ্লিকা। ইউরোপের স্পোর্টস করনেওয়ালা সাহেব মেমদের সন্তানাদি এখানে আসছে সস্তায় উইন্টার অলিম্পিকের প্রস্তুতি নিতে। আমি এবার নির্দ্দিষ্টভাবে জানতে চাই, “হোয়াট এলজ্ ডু ইউ নো তুলিকা আবাউট দিজ ভিলেজ? এ গ্রাম সম্পর্কে আমাকে কিছু তথ্য দিতে পারবে কি?” সে জবাব দেয়, “ড. ইনগ্রাম-হিল একটি স্থানীয় এনজিওকে নিযুক্ত করেছেন টমালেতালি গ্রামের বাস্তুহারাদের মাঝে ত্রাণ প্রকল্প করার জন্য। তারা ছোট্ট একটা সার্ভে করে রিপোর্ট তৈরি করেছে। তাতে কিছু দুঃখজনক তথ্য আছে—এ গ্রামের কেউ কোম্পানির কাছ থেকে এখনো খেসারত হিসাবে কোনো টাকাপয়সা পায়নি। আর তরুণী মেয়েরা প্রায় সকলে শরীর বিক্রি করছে পর্যটকদের কাছে।”

ভ্যান গাড়ির দিকে হেঁটে ফিরতে ফিরতে আমরা আবার ঘাড় ঘুরিয়ে অলিম্পিক ভিলেজের পিকচারাস দৃশ্যপটের দিকে তাকাই। নাকাতুলে মন্তব্য করে, “ড. ইনগ্রাম-হিল ইজ রিয়েলি কাইন্ড টু দি পুওর হোমলেস পিপুল্ অব টমালেতালি ভিলেজ।” আমি বিরক্ত হয়ে বলি, “উনার প্রসঙ্গ পরে আলাপ করলে হয় না।” সে প্রথমে অবাক হয়, তারপর মুখে কঠিন ভাব ফুটিয়ে তুলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমাকে মোকাবেলা করে, “আই থিংক আই নিড টু ক্লারিফাই মাই রিলেশনশিপ টু ড. ইনগ্রাম-হিল।” আমি জবাব দিই, “নো, ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু। তুমি তো বলেছো হি ইজ ইয়োর সুগার ড্যাডি। আর সুগার ড্যাডি হলে কী ধরনের সম্পর্ক হতে পারে এটা আমি বুঝতে পারি।” এবার সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে সে বলে, “আই লাইক ইউ টু আন্ডারস্ট্যান্ড দিস ইজ আফ্রিকা। লিসোটোতে মেয়েদের মনোগমাস হওয়ার কোনো রীতি নেই, শুনেছি ভারতবর্ষে এখনো অনেক মেয়ের এমন কি বিবাহবহির্ভূত একজন প্রেমিক থাকলেও তা নেগেটিভভাবে দেখা হয়।” আমি এবার অসহিষ্ণু হয়ে বলি, “তুলিকা, হোয়াই আর উই টকিং আবাউট দিস?” সে জবাব দেয়, “বিকজ, আই লাইক ইউ টু আন্ডারস্ট্যান্ড মি, আই অ্যাম আ বাসোটো গার্ল ইউথ নো মানি। ড. ইনগ্রাম-হিল হচ্ছেন মাকগোওয়া বা বিত্তবান শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। বিয়ের আগে একটি বাসোটো মেয়ের নিইয়াটসি বা মিসট্রেস হতে সামাজিক আপত্তি কিছু নেই। ১৯০১ সালে আমাদের রাজা মহান লিটসে লিরোথলি এধরনের সম্পর্ক অনুমোদন করে ফরমান জারি করে গেছেন।” আমি এবার আলোচনার কনক্লুসনে আসতে চেয়ে পকেট ডিকশনারি বের করে সরাসরি সিসোটো ভাষায় জানতে চাই, “ও থাবিলে” বা “আর ইউ হেপি তুলিকা?” সে ঠোঁট কামড়ে জবাব দেয়, “আই অ্যাম নট গোয়িং টু আনসার দিস টু ইউ, আন্ডারস্ট্যান্ড?” আমি মাথা হেলিয়ে বলি, “ইয়েস, আই ডু।”

আমরা চলে আসি ভ্যানের পাশে। ড্রাইভার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের তীব্রটানে দারুণভাবে হাঁপাচ্ছেন। মাকগথলা মাবই দেখি উবু হয়ে বসেছেন পাহাড়ের কার্নিশে। ভাবি এ ভদ্রসন্তানের প্রক্ষালনের প্রয়োজন হয়েছে। একটু পর তিনি হাঁটু ভাঁজ করা দু পায়ের ভেতর দিয়ে হাত গলিয়ে কানের লতি ছুঁয়ে কোলাব্যাঙের মতো লাফিয়ে ওঠেন। আর থেকে থেকে তার কন্ঠস্বর থেকে বেরিয়ে আসে, “কা-ট-ছো পো-লা না-লা” ধ্বনি। ব্যাপার কী জানতে চাইলে নাকাতুলে বলে, “মাবই প্রার্থনা করছেন যেন ঝরে বৃষ্টি অজোর ধারায়, জংগল ভরে ওঠে পত্রপল্লব ও ঘাসপাতায়, আর প্রাণীদের যেন অনটন হয়না খাবারের।” এ ব্যাখ্যার পরও আমি তার আচরণ ভালো করে না বুঝলে সে আবার বলে, “একটু পর মাবই আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন জংগলে রাজার খাস মহালে। বাসোটো সম্প্রদায়ের মাঝে শিকারে যাওয়ার আগে বনানীর মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করার রেওয়াজ আছে। এতে করে বন্যপ্রাণীর সাথে সাক্ষাতের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।” মাকগথলা মাবই এবার তার গলায় ঝোলানো শিঙ্গা বাজিয়ে আমাদের ভ্যানে উঠে পড়ার ইশারা দেন। আমি বিরস বদনে নাকাতুলের পাশে বসতেই সে চোখের পাঁপড়ি কাঁপিয়ে বলে, “তোমার মতো যারা ঘুরে বেড়ায়, ট্র্যাবেল করতে ভালোবাসে, সিসোটো ভাষায় তাদের বলা হয় মোয়েতি। ইউ আর আ ফাইন মোয়েতি, এন্ড আই লাভ টু ট্রাবেল উইথ ইউ”—বলে হাত বাড়ালে আমি তার করতল স্পর্শ করি।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;