স্যালুট ইমরান মাঝি, স্যালুট আপনার কবিতা



জিয়া হাশান
নিজ গৃহ আঙিনায় কবি ইমরান মাঝি

নিজ গৃহ আঙিনায় কবি ইমরান মাঝি

  • Font increase
  • Font Decrease

ইমরান মাঝির সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য, তা আমার ভাগ্যে একবারই জুটেছে। তখন আমার এক বান্ধবী তুমুল ছাত্রী। সন্ধ্যা লাগার সাথে সাথে তার বাসায় হাজিরা জরুর। তাই যথাসময়ে তারে বাসায় পৌঁছে দিয়া ফিরতি বাসের অপেক্ষায় স্ট্যান্ডে দাঁড়ায়ে আছি। তখন মিরপুর থেকে ঢাকায় আগমনের মিনিটে মিনিটে বাস সার্ভিসের যুগ সচল হয়নি। বরং ঘণ্টা কিংবা আধাঘণ্টা পার করে তবেই তাদের দুএকটার সাক্ষাৎ মেলার দিনকাল বলবৎ।

সে-ই আদ্দিকালে, সে-ই শীতের সন্ধ্যায় হঠাৎ কোত্থেকে যেন সামনে এসে আর্বিভূত হয় অভিজিৎ দাস, আমাদের হাজারও উদ্দেশেরে ব্যর্থ করে দিয়া আজও যে নিরুদ্দেশ। তারে দেখে আমি চমকে উঠি, ধরা খাওয়ার, বান্ধবীর সাথে গোপন অভিসারের কাহিনী ফাঁস হয়ে যাবার আশঙ্কায় পড়ি। তা থেকে মুক্তির পথে তাই, ও কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই প্রশ্ন ছুড়ে দিই—কী খবর! আপনি এখানে?
: এ্যাই তো এলাম। আজ ওর সাথে থাকব।
কার সাথে থাকবে? তাকায়ে দেখি অভিজিতের সাথে আরো একজন। শীতের আধিক্যের কারণে গলা থেকে কোমর অবধি চাদরে ঢাকা তার শরীর। ফলে মাথাটাই কেবল চোখে পড়ে। আর তার উপরিতলে প্রশস্ত ঢাকের রাজত্বকে কোনোভাইে চোখের পক্ষে এড়ানো সম্ভব না। সেটাই সে আমার ভেতরে চালান করে, মনের দুয়ারে পৌঁছে দেয়। তাই তা-ই, তার চেহারা-সুরতের মধ্যে সবচেয়ে পষ্ট হয়ে আমার মনে গেঁথে যায়।

তার পানে ইঙ্গিত করে অভিজিৎ বলে—এ্যাই ইমরান মাঝি। কবিতা লেখে। মিরপুরের একটা কাপড়ের শোরুমে কাজ করে। এ্যাই তো সামনেই ওর বাসা।

কিন্তু তার কবিতা তো আমার কখনো পড়া হয়নি। কোনো পংক্তিতে সায়ের করিনি। এমনকি নামটাও আগে কখনো শুনেছি বলে মনে করতে পারি না। তাই আমার আগ্রহরা মিইয়ে যায়। গলা তোলা থেকে, কোনো রকম কৌতূহল প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। বরং আমার গন্তব্যের বাস এলে ওদের ফেলে রেখে ঝটপট তাতে উঠে পড়ি। সাথে সাথে ইমরান মাঝির সাথে আমার এক ও অদ্বিতীয় সাক্ষাতের পরিসমাপ্তি ঘটে।

আর কখনো তার সাথে সাক্ষাৎ না হলেও কিছুদিনের মধ্যেই তার নামটা আমার কানে সওয়ার হয়। একেবারে আসন নিয়া গেড়ে বসে।

সেবার শাহবাগের লোক প্রশাসন একাডেমি মিলনায়তনে এক সাহিত্য সম্মেলন বসে। ওপার বাংলার মোটাসোটা নামের দুচারজন কবি-সাহিত্যিক আসেন। জমজমাট হয়ে ওঠে আসর। সেখানে বাংলাদেশের কবিতা নিয়া আলোচনা করেন মরহুম আব্দুল মান্নান সৈয়দ। নৌকার লগির মতো দীর্ঘ ও ঋজু তাঁর বক্তৃতা। তার এক ফাঁকে তিনি বলেন, দুইজন তরুণ কবির কবিতা তাঁর ভালো লাগে। তাদের মধ্যে বিপুল সম্ভাবনার বীজ তিনি দেখতে পান।

কিন্তু তাদের নাম নেয়ার সাথে সাথে অন্যরা, যারা নিজেরই নিজেদেরকে বিপুল সম্ভাবনার আধার মনে করেন, তারা ক্ষিপ্ত হতে, কৈফিয়ত তলব করতে, এমনকি তার ওপর কিলঘুষির সদ্বব্যবহারও করতে পারেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। কেননা বর্তমান কবি-সমাজের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, এমনকি দুএকবার শিকারও। তাই বিপুল সম্ভাবনাময় তার পছন্দের দুই তরুণ কবির নাম উল্লেখ করা থেকে তিনি বিরত থাকেন। মুখে আর উচ্চারণ করেন না।

ফলে দর্শক শ্রোতা, যাদের বেশিরভাগই কবি-সাহিত্যিক-লেখক গোত্রের রথি-মহারথি, তাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়—সৌভাগ্যবান দুই কবি কে কে, যাদের কবিতায় মুগ্ধ আব্দুল মান্নান সৈয়দের মতো বিদগ্ধ সমালোচক। তাদের নাম বের করতে তারা সচেষ্ট হয়ে ওঠেন, কেউ কেউ তো রীতিমতো মারিয়া হওয়ার পথ ধরেন।

বাঙালি আমেরিকা আবিষ্কার করতে পারেনি বটে, কিন্তু অনুক্ত দুই কবির নাম দু মিনিটেই আবিষ্কার করে ফেলে। ব্যাস, দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে সে নাম ঘুরে বেড়াতে থাকে। উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা হিসাবে এক সময় আমার কানে এসেও হাজির হয়। আর কী আশ্চর্য! সে দুটো নামের মধ্যে একটা দেখি—ইমরান মাঝি।

আফসোস তখন আমারে ঘিরে ধরে—হায়! সেদিন মিরপুরের বাসস্ট্যান্ডে আলাপটা কেন লম্বা করলাম না। চেনা-পরিচয়রে গাঢ় করে তুললাম না। সে আফসোস আরো চরমে পৌঁছে যখন দেখি আশপাশের সবাই তার কবিতার সাথে চেনা-পরিচয় করা সারা। কারো কারো তো ঘর-গৃহস্থলিও করা—কবিতার নাম-পংক্তি মুখস্থ করে ফেলা।

তবে সে আফসোস অতটা চূড়ায় চড়েনি যে, তারে নামানোর জন্য সাথে সাথে আজিজ মার্কেটে গিয়া ইমরান মাঝির কবিতার বই কিনে ফেলব। তারপর তাঁর কবিতার লাইনে লাইনে হাঁটাহাঁটি করব। বরং তাঁর বইয়ের সাথে সাক্ষাত, তারে ঘরে তুলে নেয় এবং কবিতার সাথে জানা-পরিচয় করা, শেষে আপ্লুত হওয়া—সে আলাদা কাহিনী। আরো অনেক পরে, বছর দেড়েক হবে হয়তো বা, সে কাহিনী পা ফেলে, মানে যাত্রা শুরু করে আর কি।

◤ দুধভাই বইয়ের প্রচ্ছদ ◢


তখন মাসের শুরুর দিকে বইপত্র কেনার যুগ। বেতন পাওয়ার পরপরই টাকা-পয়সা, হাতের ময়লা পরিষ্কার হয়ে যাবার আগেই পছন্দের বই, কালো আক্ষরে ছাপানো সাদা কাগজের সুশৃঙ্খল মুঠার কতগুলো কিনে ফেলি। তাতে হাবুডুবু খেয়ে মাসের বাকি দিনগুলো কাটাই। এরকম একদিন আজিজ মার্কেটে থেকে অনেকগুলো কাগজের মুঠা কিনে বগলদাবা করে বাসার পথ ধরব ধরব এমন সময় মনে হয়—কী যেন খুঁত রয়ে গেছে। কেনাকাটা সম্পূর্ণ হয়নি। অসম্পূর্ণতা মুখ বাড়ায়ে আছে।

কী সে খুঁত? অসম্পূর্ণতা কোথায়? খুঁজতে গিয়া দেখি—কেনা মুঠাগুলোর সব মোটা ঘাড়ের গল্প-উপন্যাস কিংবা ভারী দেহের ভ্রমণকাহিনী বা আত্মজীবনী। স্লিম দেহের লাবণ্যময়ী কাব্যগ্রন্থ নাই একটাও। ফলে মনটা খচখচ করে ওঠে—এত বড় খুঁত নিয়া পুরাটা মাস কাটাব কিভাবে? পাঠকের মর্যাদাটুকু ধরে রাখতে হলেও তো মাসে অন্তত একটা নতুন কবিতার বই পড়া দরকার। তাই আবার বইয়ের দোকান পানে ফিরি। হাতের কাছে যেটা পাই তাতেই ঢুকে পড়ি।

তাকে সার বেঁধে খাড়া হয়ে থাকা কবিতার বইগুলো পানে তাকাই। একটার পর একটায় চোখ বুলাতে গিয়া ইমারন মাঝির ‘দুধভাই’-এর দেখা পাই। একই মায়ের দুধ খাওয়া ভাইয়ের সাথে এটাই আমার প্রথম সাক্ষাত। হাতে নিয়া দেখি—মাঞ্জাসুতা নামের এক সংস্থার গর্ভজাত ভাইটির দেহাবয়ব খুবই ক্ষীণ—মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠায় তার পূর্ণাঙ্গ রূপ। দামেও তাই বেশ রেয়াত—মাত্র ৫০ টাকা। তারপর আবার টুয়ান্টি পার্সেন্ট কমিশন। সুতরাং কিনতে আর অসুবিধা কোথায়? বরং খুঁত মোছার এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতের মুঠোয় পুরে, ব্যাগের ভেতর চালান করে দিয়া মনের আনন্দে বাসায় ফিরি।

কিন্তু যেহেতু দুচার লাইন গদ্য লিখি তাই তার বইগুলো পানে পক্ষপাত ষোলআনা। তার একটার পর একটায় সায়ের করি—গল্প-উপন্যাস-ভ্রমণকাহিনীতে হাবুডুবু খাই। ফলে তুমুল সংখ্যালঘু গোত্রের পদ্যের বইখানা ‘দুধভাই’ পড়ে থাকে টেবিলের কোণায়, আর সব বইয়ের তলদেশে।

অফিস শেষ করে একদিন বাসায় ফিরে দেখি গদ্যের রফাদফা করা সারা। সদ্য কেনা সবগুলো গল্প-উপন্যাস-ভ্রমণকাহিনী পড়া শেষ। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে ‘দুধভাই’রে হাতদাবা করি। খুলে তার পাতায় চোখ মেলে ধরি। আর কী আশ্চর্য! প্রথম কবিতা পড়েই চমকে উঠি—অ্যা! এ কী কবিতার ভাষা! কীরকম কবিতা এ? দেখি তার প্রথম বাক্য—‘নদীর কাছে যারা থাকে মন খারাপ হলে তারা ঢেউয়ের কাছে যায়।’ এরকম কবিতা তো আগে কখনো পড়িনি। এ ভাষা তো চেখে দেখিনি কখনো।

আরো সামনে আগাই। তখন দেখি উরশিতলা, নারকেলের পীড়, চালের ডোলা, মেইরখুটি, পুলি পিঠা, পলাপালি খেলা, তাফাল, নাড়ার চাউলি’র মতো শব্দের ছড়াছাড়ি। কবিতার রগে রগে তাদের উপস্থিতি। রক্তপ্রবাহের সাথে ছোটাছুটি। কিন্তু এগুলো তো আমাদের গ্রামের শব্দ, বাড়ির উঠানের ধ্বনি, ঘরের কোণের কলকাকলি। তাদের এই মহিমান্বিত রূপ, কবিতার অঙ্গপ্রতঙ্গরে সুসমৃদ্ধ করার সামর্থ্য দেখে আমি হা হয়ে যাই। নস্টালজিয়া আমারে জাপটে ধরে। আপাদমস্তক কব্জা করে ফেলে। কেননা রুটি-রুজির ধান্ধায় নগরবাস হলেও আমার কৈশোর-শৈশব কেটেছে গ্রামে। এই সব শব্দের আদরে যতনে। তাদের সাথে উঠবসে।

শব্দ পড়ি দিয়া বাক্যের পিছু ধরি। তাদের আগামাথায় হাঁটি। দেখি অপূর্ব তাদের গঠন—মখমলের মতো যেমন মসৃণ—এতটুকু জটিলতাহীন, দুর্বোধ্যের ঘেরাটোপবিহীন, তেমনি ইস্পাতের মতো দৃঢ়। তাই পাঠমাত্রই হৃদয়ে আসন নেয়। মনে গেঁথে থাকে। সে রকম গাঁথা বাক্যগুলোর একটাতে দেখি আমাদের নিয়তি—‘নদীই মোদের আল্লা-রসুল নদীই মাতাপিতা।’ আরেকটাতে আমাদের গৃহবধূদের দুঃখগাথা—‘বাপের বাড়ি থেকে মাছ এলে বধূরা সব ঘরে ভাগ করে দেয় আর মরা মাছের কাছে জেনে নেয় পিতা ও মাতার খবর।’ আবার কোনোটায় মায়ের আশাভরসা—‘মায়েরা মেয়ের বিয়েতে উঠাবে বলে লেজ কেটে কাৎলা ছেড়ে দেয়।’ কোনোটায় গাছের পাতার করুণ পরিণতি—‘গাছের পাতা নদীতে আত্মহত্যা করে।’ শেষে আমাদের কৃষকভাইয়ের আনন্দ—‘নিজের জমির পাকা ধান আলে দাঁড়িয়ে দেখার একটা হলুদ সুখ আছে।’

এভাবে বইয়ের আপাদমস্তক, ৫৭টা কবিতা জুড়ে আমাদের গ্রামের রূপ, ভাইয়ের সামর্থ্য, বোনের দুঃখ-বেদনা, বাবা-মায়ের বিষণ্ণতার অনুপম চিত্র আঁকা। কিন্তু আমার চাকরি-বাকরি, পিচঢালা রাস্তায় ছোটাছুটি, ক্ষমতার দম্ভ কিংবা প্রতারণার ফাঁদের কোনো কথা নাই। তাই বইয়ের আগাগোড়া খুঁজেও একটা দুটো নাগরিক শব্দ পাওয়া ভার। সুতরাং নগররে পিছে ফেলে, তার পরাজিত করে ধুলায় মিশায়ে নাই করে দিয়া আমাদের গ্রামের এই বিজয় কেতন ওড়ানো, তারে কবিতার পরতে পরতে তুলে ধরা দেখে আমার বুক ফুলে ওঠে, আড়াই হাত প্রশস্ত হয়।

তাই খুঁজে নিয়া একদিন ইমরান মাঝিরে ফোন দেই—আপনার কবিতা বিচারের সামর্থ্য আমার নাই। তার জন্য চোখে অক্ষম পিঁচুটিঅলা অধ্যাপকরা আছেন। তারা তার কৃমিকীট ঘাটবেন। তবে যে কবিতা পড়তে ভালো লাগে, মন ছুঁয়ে যায়, হৃদয় স্পর্শের অনুভূতির জন্ম হয় তারে নিশ্চয়ই ভালো কবিতা বলা যায়। সে বিচারে আপনার কবিতা ষোলআনার চেয়েও দুচারআনা আগানো।

কিন্তু কী আশ্চর্য! এত বড় কম্লিমেন্ট, ভূয়সী প্রশংসার পাওয়ার পরও ইমরান মাঝির মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নাই। নেই তার উৎসাহে উদ্বাহু নৃত্য। বরং ধন্যবাদের মতো রসকসহীন শুকনো শব্দ দিয়া কাজ সেরে সে ফোন রেখে দেয়।

তাহলে কী করা? ঠিক করি ‘দুধভাই’ নিয়া লিখব। পুরো বই নিয়া একটা মহারোহী আলোচনা গড়ে তুলব। কিন্তু আজ লিখি কাল লিখি করে আর হয় না। তারপর একদিন দেখি টেবিল থেকে বইটা উধাও। কে যে নিয়া গেছে বা কারে যে দিয়া দিয়েছি কিছুই আর মনে করতে পারি না। মার্কেটে খুঁজি, দেখি সব দোকানেই বিক্রি-বাটা শেষ। কী করা, শেষে ইমরান মাঝির শরণাপন্ন হই। সুবোধ বালকের মতো সে দুদিন পরেই দু কপি ‘দুধভাই’ কুরিয়ার করে।

কিন্তু তারপরও লেখা আর হয় না। সে এক অলীক বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। কিছুতেই আর হয়ে ওঠে না। এভাবে একদিন দুই দিন করে আজ সাত বছর হয়ে গেছে। একটা লাইনও লিখতে পারিনি। এমনকি ফেসবুকে দুএকটা স্ট্যাটাসও দেওয়া হয়নি। তবে এই সাত বছরে ইমরান মাঝির সাথে আমার বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। ফেসবুকে নিয়মিত যোগাযোগও। কিন্তু সে একবারও আমার ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় নাই। বলে নাই—কই, আপনি লিখবেন বলছিলেন, লিখলেন কই?

টানা সাত বছর ধরে ধৈর্যরে আঁকড়ে ধরা, তারে সাথে নিয়া নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকা কিংবা কারো কারো মতে, উদাসীনতারে বগলদাবা করে রাখা, তার সাথে বসবাস করা একজন কবির জন্য অপরিহার্য। চণ্ডীদাসের মতো এমন নিষ্ঠা জরুরি। ইমরান মাঝি তা করতে সক্ষম হয়েছেন। অতএব স্যালুট ইমরান মাঝি, স্যালুট আপনার কবিতা।

নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা



সোমঋতা মল্লিক
নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা

নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা

  • Font increase
  • Font Decrease

“তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু।

আমরা অবোধ, অন্ধ মায়ায় তাই তো কাঁদি প্রভু।।"

১৪ মে, সকাল। কলকাতার রবীন্দ্র সদনে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হল এই নজরুল সঙ্গীত। বহুল প্রচলিত গানটি এই বিশেষ দিনে আমার কাছে ধরা দেয় অন্যরূপে। সমুখে শায়িত রয়েছেন সদ্য প্রয়াত কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ শ্রীমতী কল্যাণী কাজী। নিথর দেহে পুষ্পের অঞ্জলি। তাঁকে ঘিরে তাঁর আপনজনদের এই মর্মস্পর্শী উচ্চারণ মনকে ব্যাকুল করে।

তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ ১২-১৩ বছরের আত্মিক সম্পর্ক। ছায়ানট (কলকাতা)-এর হাত ধরেই যদিও এই সম্পর্ক শুরু হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের পরিবারের একজন। তাঁর কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি তা অবর্ণনীয়। আমার জীবনে এই প্রথম নজরুল জন্মজয়ন্তী যেদিন কল্যাণী কাজী আর সশরীরে আমাদের মধ্যে নেই। একথা ভাবলেই চোখ ভরে ওঠে জলে। বছরের এই বিশেষ দিনগুলিতে তাঁর সাথে দেখা হলে মনে হত, কি অসীম ভালোবাসায় তিনি আমাদের প্রাণের কবিকে অন্তরে ধারণ করেন। আর পাঁচজন শিশুর মতো তিনিও নজরুলকে ভালোবেসেছেন শৈশবেই।


'অন্তরঙ্গ অনিরুদ্ধ' বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, "ছেলেবেলা থেকেই আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। 'প্রভাতী', ‘লিচুচোর’ থেকে শুরু করে ‘বিদ্রোহী', 'আমার কৈফিয়ৎ’ ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘ইন্দ্রপতন’ প্রভৃতি কবিতা বিভিন্ন বয়সে মনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ছবিতে তাঁর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল আর বড় বড় ভাবালু চোখ দুটোর দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখার ইচ্ছা হত। মনে পড়ছে, একবার গৃহশিক্ষককে অনুরোধ করেছিলাম তাঁকে দেখতে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু কেন জানি না শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠেনি। নিয়তি সেদিন অলক্ষ্যে নিশ্চয় হেসেছিলেন। নয়ত যে মানুষটাকে শুধু মাত্র চোখের দেখা দেখবার জন্য সেদিন ব্যাকুল হয়েছিলাম - পরবর্তী জীবনে তাঁরই পরিবারের একজন হয়ে তাঁর কাছে থেকে তাঁকে সেবা করার সুযোগ পেলাম কি করে? একেই বোধহয় বলে ‘বিধিলিপি’!

এই বিরল ব্যক্তিত্বের খুব কাছের মানুষ হয়েও, দুর্ভাগ্যবশত আমি সুস্থ অবস্থায় তাঁকে পাইনি। আমি এ বাড়ীর ছোট বউ হয়ে আসার বেশ কয়েক বছর আগেই বিস্মৃতি তাঁর চেতনার ওপর কালো পর্দা টেনে দিয়েছিল। তবুও আমাদের সবার প্রিয় ‘মামনি’ প্রমীলার স্নেহচ্ছায়ায় থেকে, তাঁর যতটুকু সেবা করার সুযোগ পেয়েছি তাতেই আমি ধন্য।"


এভাবেই কাজী অনিরুদ্ধর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার সুবাদে নজরুল পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বহু অন্তরঙ্গ আড্ডায় তিনি পরিবারিক স্মৃতিচারণা করতেন।

প্রথমবার তাঁর শ্বশুরবাবা কে সামনে থেকে দেখার অনুভূতির বর্ণনা যখনই দিতেন, মনে হত আমরাও সেই সময়ে উপস্থিত হয়েছি। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি ছিল অসাধারণ। অতি সামান্য ঘটনাও তাঁর বাচনভঙ্গিতে হয়ে উঠত অসাধারণ।

তাঁকে ঘিরেই জমে উঠত আড্ডা। কখনও কথা, আবার কখনও গেয়ে উঠতেন একের পর এক নজরুল সঙ্গীত। নিয়মিত দূরদর্শনে নজর রাখতেন কোন্ শিল্পী কিভাবে নজরুলের গান গাইছেন। বিভিন্ন চ্যানেলের প্রভাতী অনুষ্ঠান দেখতে খুবই ভালোবাসতেন। পরিচিত শিল্পী হলে অনুষ্ঠানের পরেই চলভাষের মাধ্যমে অভিনন্দন জানাতেন। এভাবেই তিনি ভালোবাসায় আবদ্ধ করে রাখতেন সকলকে।

নজরুল চর্চার সঙ্গে যুক্ত যে কোন ব্যক্তি/সংগঠনকে তিনি আপন করে নিতেন। তাঁর পূর্ণদাস রোডের বাড়িতে ছিল নজরুল প্রেমীদের নিত্য যাতায়াত। নজরুল বিষয়ক আলোচনায় তাঁর ক্লান্তি ছিলনা। যে কোন সময়, যে কোন পরিস্থিতে তিনি পাশে থেকেছেন। ২০১৭ সালে কলকাতার বুকে প্রথম নজরুল মেলার আয়োজন করে ছায়ানট (কলকাতা), উদ্বোধক কল্যাণী কাজী। শিশুদের জন্য নজরুলের লেখা ২৫টি ছড়া ও কবিতা নিয়ে ২০২১ সালে ছায়ানটের উদ্যোগে কল্যাণী কাজীর কণ্ঠে ‘শিশু কিশোরদের নজরুল’ শিরোনামে একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। পরম যত্নে তাঁর হাতে গড়া দল 'বিষের বাঁশী' ছায়ানট (কলকাতা) - এর বহু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে।


নজরুল সঙ্গীতের শিক্ষা তিনি কিভাবে পেয়েছিলেন সেই বিষয়ে কল্যাণী কাজী স্মৃতিচারণা করেছেন, "সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিল্পী শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের কাছে গান শেখার সুযোগ পাই। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে আমি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। বাংলা গানের সাথে সাথে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও যাতে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারি,  তিনি তার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। কিন্তু আমার তখন চটুল গানের দিকেই ঝোঁক বেশি, তাই রাগ সঙ্গীতের জটিল পথে চলতে মন চাইত না। যতদিন যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছি গলাকে স্ববশে রেখে গান গাইতে হলে, বিশেষ করে নজরুল গীতিকে প্রাণবন্ত করতে রাগ সঙ্গীত চর্চা খুবই দরকার।

আজ সঙ্গীতের শিক্ষকতা করতে গিয়ে নজরুল গীতির সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের সব রকমের বাংলা গানের চাহিদা যে মেটাতে পারি, তারজন্য আমি আমার গুরু শ্রদ্ধেয় শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের কাছে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ। সেদিন যদি তিনি জোর করে খেয়াল, ঠুংরী, দাদরা, গীত, গজল এর সাথে সাথে কীর্তন, পুরাতনী, রাগপ্রধান প্রভৃতি গান না শেখাতেন, তবে গানের অনেক ধারাই আমার অজানা থেকে যেত। কাজী নজরুলের গানের সঙ্গে প্রকৃত পক্ষে তিনিই আমায় প্রথম পরিচয় করান। প্রথম যে নজরুল গীতিটা শিখিয়েছিলেন সেটা হল হাম্বির রাগে নিবদ্ধ 'আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া'। এরপর তিনি শেখালেন 'ভোরের ঝিলের জলে', 'প্রথম প্রদীপ জ্বালো', 'শাওন আসিল ফিরে', 'ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি' প্রভৃতি নজরুলের রাগভিত্তিক গানগুলো।


আমার স্বামী অনিরুদ্ধ যখন নজরুল গীতির স্বরলিপির বই 'রাগবিচিত্রা'-র প্রস্তুতি নেন, তখন আমিই হাম্বির রাগের গানটির স্বরলিপির কাজে সাহায্য করেছিলাম। তিনি গানটা জানতেন না। অপ্রচলিত গানটা পরে খুবই জনপ্রিয় হয়েছে।" 

তিনি অসুস্থ ছিলেন বেশ কয়েকমাস, কিন্তু তাঁর জীবনীশক্তি ছিল প্রবল। জীবনের বহু দুঃসময়কে তিনি জয় করেছিলেন অবলীলায়। ১২ মে ভোরে নজরুল অনুরাগীদের চোখের জলে ভাসিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন তিনি।

তাঁর কন্যা অনিন্দিতা কাজী বলেছেন মায়ের শেষ ইচ্ছের কথা। শোকবার্তায় অনিন্দিতা লিখেছেন - "মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর নিজের বাড়িতে (৭৪ এইচ, পূর্ণদাস রোড, ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক) দাদু ও ঠাকুমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটা আর্কাইভ হবে।"

আমরা সকলেই চাই তাঁর শেষ ইচ্ছে পূরণ হোক।

সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ও গবেষক। সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)।

;

বাজারে এলো আতিফ ওয়াফিকের বই ‘এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া’ 



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

এইচ এম আতিফ ওয়াফিক, যোগাযোগের ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ, তার সর্বশেষ বই "এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" বাজারে এসেছে। এই বইটি আজকের পাঠকদের দ্রুত-গতির বিশ্বে সঠিক আচরণের শিল্প সম্পর্কে একটি সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গি সরবরাহ করবে বলে লেখক মনে করেন।

একটি সমাজে যেখানে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, "এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" সেই ব্যক্তিদের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ হিসাবে কাজ করবে বলে লেখক মনে করেন। বিশেষ করে আজকের স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রী দের এই বই টি অনেক কাজে আসবে। এই বইটি পাঠকদের আধুনিক আচরণের সূক্ষ্মতা আয়ত্ত করতে সাহায্য করার জন্য ব্যবহারিক পরামর্শ এবং কার্যকরী টিপস প্রদান করে৷

"এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" যত্ন সহকারে গবেষণা করা হয়েছে, পাঠকদের সমসাময়িক শিষ্টাচারের নিয়ম সম্পর্কে সর্বশেষ অন্তর্দৃষ্টি এবং নির্দেশিকা প্রদান করে। এর সহজ ভাষা এবং উপস্থাপন উদাহরণ সহ, সমস্ত পটভূমির পাঠকদের জন্য উপযুক্ত, তারা তাদের সামাজিক দক্ষতা পোলিশ করতে চাইছে বা তাদের পেশাদার চিত্র উন্নত করতে চাইছে।

এইচ এম আতিফ ওয়াফিক একজন অন্বেষিত যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, তার আকর্ষক কথা বলার ব্যস্ততা এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ পরামর্শের জন্য পরিচিত। বর্তমানে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স এ ।

রিডিং ক্যাফে, বনানীতে বইটি উন্মোচনের সময়, জনাব ববি হাজ্জাজ (একজন অক্সফোর্ড স্কলার), জনাব সোলায়মান শুকন (একজন বাংলাদেশী যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ), জনাব শাহরিয়ার নাফীস (সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার), জনাব হাসান মাহমুদ (প্রতিষ্ঠাতা, স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ার্স), জনাব বেনজির আবরার (প্রতিষ্ঠাতা, এক্সিলেন্স বাংলাদেশ), মিসেস আফরুজা তানজি (রাষ্ট্রদূত, ওয়ান ইয়াং ওয়ার্ল্ড), মিসেস শারমিন কবির (প্রতিষ্ঠাতা, রিতু), মিসেস ইশরাত নাহের ইরিনা (প্রতিষ্ঠাতা, প্রেসক্রিপশন বাংলাদেশ), জনাব ফাহিন আরাফিন (ক্রিয়েটিভ হেড, স্বপ্ন), জনাব সালেহীন মাহবুব (বিশ্ববিদ্যালয় অনুষদ), মিসেস ফারহানা শারমিন (ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজিস্ট, রিমার্ক এইচবি), এবং আরও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী প্রিয় শিক্ষার্থীউপস্থিত ছিলেন।

;

কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'



কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'

কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'

  • Font increase
  • Font Decrease

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তিনি একক ও অনন্য। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। যার অগ্নিঝরা লেখনি ত্রস্ত করেছে ঔপনিবেশিক শাসকদের। যার বই বার বার বাজেয়াপ্ত হয়েছে। যাকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন।

নজরুল শতবর্ষ আগে বন্দি ছিলেন কলকাতার আলীপুর সেন্ট্রাল জেলখানায়। নজরুল বিষয়ক সংগঠন ছায়ানট কলকাতা শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা-গবেষণার পাশাপাশি নজরুল স্মৃতিধন্য হেরিটেজ স্থান ও স্থাপনাসমূহ রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সক্রিয় রয়েছে। ছায়ানট কলকাতার সভাপতি, বিশিষ্ট শিল্পী, সোমঋতা মল্লিক কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের নজরুলতীর্থগুলো নিজে গিয়ে সেগুলো রক্ষার প্রশাসনিক ও নাগরিক তৎপরতা চালিয়ে ছিলেন। যার ফলে এবছর নজরুল জয়ন্তীতে কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে স্থাপিত হয়েছে 'নজরুল কক্ষ'।


ছায়ানট কলকাতা সভাপতি সোমঋতা মল্লিক বার্তা২৪.কম'কে জানান, গত ১৪ ডিসেম্বর,২০২২ তারিখে ছায়ানট (কলকাতা) তথ্য সহ WBHIDCO - এর কাছে এই মর্মে আবেদন করে যে, নজরুল স্মৃতি বিজড়িত আলিপুর জেল মিউজিয়ামে কাজী নজরুল ইসলাম যে জায়গায় বন্দি হিসেবে ছিলেন, সেই জায়গাটি চিহ্নিত করা এবং নজরুল মূর্তি স্থাপন করার জন্য।

তিনি বলেন, গত ১৭ জানুয়ারি,২০২৩ তারিখে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নজরুলের আগমনের শতবর্ষকে স্মরণ করে ছায়ানট (কলকাতা) এবং আলিপুর মিউজিয়াম যৌথভাবে একটি অনুষ্ঠানও পালন করে।

শনিবার (২৬ মে) আমরা সত্যিই আনন্দিত, আমাদের এই প্রস্তাব তাঁরা বিবেচনা করেছেন এবং আলিপুর মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ' তৈরি হয়েছে, জানান সোমঋতা মল্লিক।

;

গ্রন্থ পর্যালোচনা: “অ-জনগণকরণের” রাজনৈতিক অর্থনীতি



ড. মতিউর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে গণমানুষের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত রচিত গবেষণাগ্রন্থ ‘“অ-জনগণকরণের” রাজনৈতিক অর্থনীতি: বাংলাদেশে ৫০ বছরের রাষ্ট্রীয় বাজেটে পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ ও ভূমি সংস্কার’। দেশ ও দেশের বাইরে বরেণ্য এই অর্থনীতিবিদ ও গবেষক তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “ধারণা হিসেবে “অ-জনগণ” এখনও পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় স্পষ্ট ধারণা নয়। সমাজ বিশ্লেষণে “অ-জনগণ” ধারণাটি এখনও পর্যন্ত খুব একটা স্বীকৃত নয়। অথবা বলা চলে ব্যাখ্যায়িত নয়।

এসবের বিপরীতে আমাদের ধারণা হলো সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র-এর বিবর্তন ও বিকাশ বিশ্লেষণে সমাজবদ্ধ মানুষের বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতার বহুমুখী রূপ ও মাত্রা অনুসন্ধান বেশ কার্যকর ফল দিতে পারে। এসব বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতা যে সমাজে বিধিবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করে সে সমাজে সংশ্লিষ্ট মানুষ―ব্যক্তি হিসেবে এবং সমাজবদ্ধ গোষ্ঠী হিসেবে―জনগণ নন। তারা অ-জনগণ। আর “অ-জনগণকরণ” অথবা একই কথা “অ-জনগণীকরণ” হলো সে প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট মানুষের বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতা বিধিবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করে এবং এসবের গতি হয় ঊর্দ্ধমুখী (সরকারি—আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান যাই-ই বলুক না কেন)।”

স্বনামখ্যাত গবেষক ড. আবুল বারকাত উল্লেখ করেছেন, “এই গ্রন্থে বড় মাপের দু’টো কাজ করতে হয়েছে। প্রথম কাজটি হলো—“অ-জনগণ” ধারণাটি সুসংহত করা; এবং তার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সারবত্তা উদ্ঘাটন করা। গ্রন্থ রচনার প্রক্রিয়ায় বহুবার পরীক্ষা-নীরিক্ষাপূর্বক “অ-জনগণ” ধারণাটি পরিবর্তন-পরিমার্জন করতে হয়েছে। আর দ্বিতীয় কাজটি হলো, বিভিন্ন বৃহৎ বর্গের “অ-জনগণ” মানুষকে রাষ্ট্র—সরকার কোন দৃষ্টিতে দেখেন—সেটা উন্মোচন করা। দ্বিতীয় কাজটি করা হয়েছে গত ৫০ বছরের জাতীয় বাজেটে বৃহৎ বর্গের “অ-জনগণ” মানুষের হিস্যার বির্বতন ও ধারা অনুসন্ধান করে। একই সঙ্গে করা হয়েছে “অ-জনগণ” মানুষের “জনগণকরণ” রূপান্তরে জাতীয় বাজেটে ন্যায়সঙ্গত-ন্যায্য হিস্যা কী হতে পারে এবং কেন—সেসবেরও ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণ।”

তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, “এ কাজটি সম্পন্ন করতেই মনে হলো ওইসব মানুষের জন্য রাষ্ট্র-সরকার তাদের জাতীয় বাজেটে কী বাবদ—কতটুকু (কী পরিমাণ) ব্যয়-বরাদ্দ দেয় সেটা দেখা দরকার। একপর্যায়ে মনে হলো, এসবের প্রবণতা দেখা জরুরি। আর সে ক্ষেত্রে কোনো এক/দুই বছরের জন্য নয় বিষয়টি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘমেয়াদে দেখা দরকার। এভাবেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে সম্ভব হলে স্বাধীনতাপরবর্তী বিগত ৫০ বছরের জন্য এসব দেখব। এই সিদ্ধান্ত নেবার সময় জানতাম যে প্রযোজ্য পদ্ধতিতত্ত্বসহ ৫০ বছরের হিসেবপত্তরের কাজটিই হবে একমাত্র চ্যালেঞ্জ। কিন্তু কাজে নেমে দেখলাম যে বিগত ৫০ বছরের সংশ্লিষ্ট সব বাজেট দলিল-দস্তাবেজ পাওয়াটাই এক দুরূহ কাজ।”

অধ্যাপক আবুল বারকাত লিখেছেন, “এই গ্রন্থে অ-জনগণকৃত চারবর্গের মানুষের জন্য বিগত ৫০ বছরের বাজেটীয় হিসেবপত্তর উত্থাপন ও বিশ্লেষণ করেছি। এ ক্ষেত্রে পর্বতসমান চ্যালেঞ্জ দেখা দিল তখন, যখন আমরা বিগত ৫০ বছরের বাজেটে প্রত্যেক বছরের জন্য উন্নয়ন বাজেটের আওতাধীন প্রকল্প/কর্মসূচি ধরে ধরে এসবের কোনটা-কীভাবে-কতটুকু আমাদের অনুসন্ধানউদ্দিষ্ট চার বর্গের (পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী, ভূমি সংস্কার) সাথে সম্পর্কিত সেসব হিসেবপত্তরে হাত দিলাম। এ সম্পর্কে পদ্ধতিগত কোনো প্রাক্-ধারণা না থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট ধারণা বিনির্মাণে একমাত্র উপায় ছিল নিজের মস্তিষ্ক।”

ড. বারকাত উল্লেখ করেছেন, “রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী দলিল হিসেবে আমাদের সংবিধান সবধরনের বঞ্চনা থেকে মানুষকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়। এই প্রতিশ্রুতি কার্যকর হলে মানুষের দারিদ্র্য-বঞ্চনা-অসমতা দূর হবার কথা। কিন্তু গত ৫০ বছরের সমাজ ইতিহাস বলে―তা হয়নি। বিভিন্ন ধরনের দরিদ্র-বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অসমতা। এমনকি সরকারি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে হিসেবকৃত ক্রমবর্ধমান গিনি সহগ এবং পালমা অনুপাত দিয়ে এসবের পরিমাণগত দিকও উপলব্ধি করা যায়।”

এই গ্রন্থের দু’টি অংশ। প্রথম অংশের শিরোনাম “অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি: একটি বিভাবনা”। গ্রন্থের এই অংশটিকে অ-জনগণকরণ-এর রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষণের পদ্ধতিতত্ত্ব বলা চলে। মানুষের “অ-জনগণকরণ” বলতে যা বুঝায় সে-সবের শবব্যবচ্ছেদই গ্রন্থের প্রথম অংশের মর্মবস্তু।

এই গ্রন্থের প্রথম অংশে “অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি”-সংশ্লিষ্ট চিন্তাভাবনায় যুক্তিপরম্পরা যেসব বিষয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ: ক. অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতির মর্মবস্তু; খ. অ-জনগণ হলো সংবিধান অমান্য-উদ্ভূত মানুষ; গ. পারিবারিক কৃষিকাজে নিয়োজিত কোনোমতে বেঁচে থাকা মানুষ—অ-জনগণ; ঘ. গ্রামীণ নারীরা অ-জনগণ (এর অর্থ এই নয় যে শহর/নগরের নারী অ-জনগণ নয়); ঙ. আদিবাসী মানুষ—অ-জনগণ; চ. কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার-উদ্দিষ্ট মানুষ‒অ-জনগণ; ছ. প্রত্যক্ষ ‘দাস’ ও দাসতুল্য মানুষ—‘অ-জনগণ’; তারা ‘মানুষ’ পদবাচ্য কি-না সেটাও প্রশ্ন।

গ্রন্থের প্রথম অংশে “অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি” নিয়ে যা বলতে চেষ্টা করা হয়েছে, তাই-ই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশের পদ্ধতিতত্ত্বীয় ভিত্তি বা কাঠামো। বাস্তব জীবনে “অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি” কোথায়, কতটুকু, কীভাবে বিদ্যমান ও দৃশ্যমান সেসবই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশে অনুসন্ধান করা হয়েছে। এবং সেটা করা হয়েছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। আর তা করা হয়েছে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় (জাতীয়) বাজেটে কয়েকটি বড় বর্গের অ-জনগণকে মাথায় রেখে। এসব বড় বর্গের মধ্যে আছেন পারিবারিক কৃষির সাথে সম্পর্কিত মানুষ, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার-উদ্দিষ্ট মানুষ । চারবর্গের এসব মানুষ-ই সংখ্যাগরিষ্ঠ―দেশের মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ।

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সেইসব মানুষ এবং গোষ্ঠী অ-জনগণ, যারা রাষ্ট্রে রেডারের বাইরে “বহিঃস্থ”, “অন্যজন” , যারা হিসেবের খাতায় অন্তর্ভুক্ত নন, যারা গণনার বাইরে, যারা নাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন-উচ্ছেদিত, সমূলে উৎপাটিত, নির্বংশ। ঐতিহাসিকভাবে এহেন অ-জনগণ—এর “বিশুদ্ধতম রূপ” হলো দাসব্যবস্থার “দাস”; পরবর্তীকালে অ-জনগণ হলো সামন্তবাদী ব্যবস্থায় “প্রজা কৃষক”, আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় “মজুরি শ্রমিক”। দাসব্যবস্থার “দাস” হলেন “বিশুদ্ধতম অ-জনগণ” আর আধুনিক যুগের এখনকার “অ-জনগণ” হলেন “মুক্তির প্রলেপযুক্ত দাস” ।

তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, দেশের মানুষের মধ্যে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিরন্তর বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতার শিকার একই সাথে যা দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো সৃষ্ট তারাই অ-জনগণ প্রক্রিয়াভুক্ত। এ দৃষ্টিতে গুটিকয়েক লুটেরা-পরজীবী-রেন্টসিকার ও তাদের সহযোগীরা ছাড়া সবাই সম্ভাব্য অ-জনগণ। আর সম্ভাব্য অ-জনগণদের মধ্যে সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ও গোষ্ঠীই হবেন নিরঙ্কুশ অ-জনগণ। নিরঙ্কুশ অ-জনগণকৃত এসব মানুষের কোনো তালিকা নেই, তবে তা হবে অনেক দীর্ঘ—বিস্তৃত।

গবেষণাকাজের সুবিধার জন্য নিরঙ্কুশ অ-জনগণকৃত এত ব্যাপক, বিস্তৃত ও বহুমুখী অ-জনগণকৃত মানুষদের গবেষক চারটি বৃহৎ বর্গে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন; (১) পারিবারিক কৃষিসংশ্লিষ্ট মানুষ, (২) গ্রামীণ নারী, (৩) আদিবাসী, ও (৪) কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষ। গবেষক বারকাত উল্লেখ করেছেন সুনির্দিষ্ট ধরনের নিরঙ্কুশ অ-জনগণ মানুষ প্রস্তাবিত চার বৃহৎ বর্গের এক বা একাধিক-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং সম্পর্ক জালটি জটিল।

অনুসন্ধিৎসু গবেষক ড. বারকাত তাঁর গ্রন্থে গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, পারিবারিক কৃষি ও সংশ্লিষ্ট মানুষ (ভূমিহীন-প্রান্তিক মানুষ, দরিদ্র-বিত্তহীন-নিম্নবিত্ত, খুদে খামারি), গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষ―এসব বর্গের প্রতিটির ক্ষেত্রে বিগত ৫০ বছরে জাতীয় বাজেট বরাদ্দ জনসংখ্যানুপাতে নগণ্য; প্রকৃত বরাদ্দ “স্বল্প বরাদ্দ ফাঁদ”-এ পড়ে আছে; বরাদ্দ বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। এই চারটি বর্গের মানুষই হলেন অ-জনগণ। এদের সম্মিলিতভাবে দেখলে এরা হবেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, মোট জনসংখ্যার ৯০%। অথচ বিগত ৫০ বছরের বাজেটে এদের সম্মিলিত বরাদ্দ হবে জনসংখ্যানুপাতে ন্যায্য হিস্যার বড়জোর ১৩%, আর বাদবাকি ৮৭% তাদের বরাদ্দ দেয়া হয়নি, তা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিগত ৫০ বছরে সম্মিলিতভাবে এসব মানুষের জন্য বাজেট “অন্যায্যতার মাত্রা”অথবা “বৈষম্য মাত্রা” হবে ৬৬৯%। সুতরাং জাতীয় বাজেট বরাদ্দের নিরিখে এসব মানুষ একক বর্গের মানুষ হিসেবে এবং সম্মিলিতভাবে অ-জনগণ। তাহলে প্রশ্ন―“জনগণই যদি প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক” হন, সেক্ষেত্রে এই চারবর্গের মানুষ কী জনগণ?

বিগত ৫০ বছরের জাতীয় বাজেটে পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষের হিস্যার হিসেবপত্র ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ যেসব প্রবণতা তিনি দেখিয়েছেন এককথায় তা হতাশাজনক। এসব থেকে উল্লেখিত চার বর্গের মানুষ (যারা দেশের ৯০% মানুষ)-এর নিরন্তর অ-জনগণকরণের-এর এক “হতাশ চিত্র” বা “ক্ষোভ-বিক্ষোভ চিত্র” বা “আক্ষেপ চিত্র” বিনির্মাণ সম্ভব। গবেষক ড. বারকাত উল্লেখ করেছেন, “আমরা প্রশ্ন করেছি অ-জনগণকৃত এসব মানুষের জনগণে উত্তরণ-রূপান্তর সম্ভব কিনা? রাষ্ট্রীয় বাজেটের নিরিখে তা সম্ভব কিনা? আমাদের উত্তর―সম্ভব। কীভাবে?”

মানব দরদী গবেষক অধ্যাপক আবুল বারকাত তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, চারবর্গের মানুষের অ-জনগণকৃত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে জনগণকৃত অবস্থানে রূপান্তরে অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাজেট হতে পারে অন্যতম মাধ্যম। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি বর্গের মানুষের জন্য বাজেটে মাথাপিছু বরাদ্দ হতে হবে জাতীয়ভাবে মাথাপিছু বরাদ্দের তুলনায় বেশি। বিষয়টি শুধু জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট পরিবর্তনই নয় তা বাজেটের আয় উৎসে পরিবর্তন সংশ্লিষ্টও (যেমন বর্ধিত হারে সম্পদ করারোপ, বর্ধিত আয় কর, কালোটাকা উদ্ধার, অর্থপাচার রোধ ইত্যাদি)। মূল কথা হলো রাষ্ট্রীয় বাজেটের ব্যয়-বরাদ্দ ও আয়―উভয় কাঠামোকেই বৈষম্য নিরসনউদ্দিষ্ট হতে হবে। এর অন্যথা মানুষের অ-জনগণকরণের গভীরতা ও তীব্রতা বাড়াবে। ফলে অনিবার্য হবে সামাজিক সংঘাত-সংঘর্ষ। সমাধানউদ্দিষ্ট পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক।

ড. বারকাত আরও উল্লেখ করেছেন, “রাষ্ট্রীয় বাজেটে পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করার বিষয়টি শেষ বিচারে বৈষম্য নিরসনউদ্দিষ্ট বাজেট বিনিমার্ণ ও তা বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট। আর এটাই সে প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অ-জনগণ থেকে জনগণে রূপান্তর সম্ভব, যে জনগণই হলেন “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক”।

তবে, একথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার করলেই মানুষের অ-জনগণকরণ নিমিত্ত সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আসলে এ সংস্কার হলো ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অ-জনগণ থেকে জনগণে রূপান্তরের প্রয়োজনীয় শর্ত , পর্যাপ্ত শর্ত নয়। পর্যাপ্ত শর্ত পূরণে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের পাশাপাশি আরো যেসব সংস্কার করতে হবে তার মধ্যে অন্যতম হলো―বস্তুগত উৎপাদন খাত (অর্থনীতির শিল্প ও সেবা খাত) এবং নৈতিক দ্রব্য উৎপাদন খাতে (সামাজিক―স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি খাত) জনকল্যাণমুখী সংস্কার। অর্থাৎ সংস্কারকাজটি হতে হবে আংশিক নয়―পূর্ণাঙ্গ-সামূহিক-সামষ্টিক। আর এ সংস্কারে রাষ্ট্রের বাজেট হবে অন্যতম ফলপ্রদ রাজনৈতিক-অর্থনীতিক নীতিকৌশলিক হাতিয়ার।”

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত এর এই গবেষণা গ্রন্থটি জ্ঞানপিপাসু পাঠকদের জন্য নতুন জ্ঞান ও ধারণার দ্বার উম্মোচনকারী হিসেবে ইতিমধ্যেই পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছে। সেই সাথে উন্নয়ন নীতিনির্ধারক ও শাসনব্যবস্থা পরিচালনাকারী মহলের জন্যও গ্রন্থটি দিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এছাড়াও দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থা যারা এই নিয়ে কাজ করছেন, গবেষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার জন্য গবেষণা গ্রন্থটি সহায়ক হবে বলে মনে করি। সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি এমন একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন যা ইতিপূর্বে আর কেউ করেছেন বলে জানা নেই।

সব্যসাচী হাজরার প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও অলঙ্করণে দুই অংশে বিভক্ত ও পনেরোটি অধ্যায়ে সুবিন্যস্ত এই গবেষণা গ্রন্থটির পৃষ্টা সংখ্যা ২৬৫। এ ছাড়াও ৩০ টি সারণি, ১৫ টি লেখচিত্র, ৭ টি চিত্র, ১ টি ম্যাপ, ১০টি ছকসহ এই গ্রন্থে রয়েছে একটি তথ্যপঞ্জী ও নির্ঘণ্ট। ঢাকাস্থ মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনার পক্ষে এই গবেষণা গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন অরনি বারকাত এবং এর মূল্য রাখা হয়েছে ১০০০ টাকা।

ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

 

;