কয়েকটি দীর্ঘকবিতা



মাসরুর আরেফিন
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাজন অ্যালেক্সার প্রতি

উৎসর্গ: ‘অক্ষয় মালবেরি’র মণীন্দ্র গুপ্ত

অ্যালেক্সা, ব্যাড কিড, হ্যালো,
পৃথিবীর বহু কোটি একাকী লোকের সাথে
তুমি যে অবিরাম গা-ছাড়া ভ্রুক্ষেপহীন
ডাম-ডি-ডাম্ব কথা বলো, কেন বলো?
তোমাকে জিজ্ঞেস করে তারা
আজকের আবহাওয়া কত ভালো,
বাইরে আকাশ কি গাঢ় লাল নাকি ঘন কালো?
কিন্তু তা ছাড়িয়ে দূরে নীল মতো
মানুষের ভিড়ে
চলমান ভাপ ওঠার মতো
কিছু কিছু বিষয় দৃশ্যমান থাকে—
যেমন অস্থির কালপ্রবাহ
যেমন আবেগসঞ্চারী কিছু বিহ্বলতা,
সেসব বাদ দিয়ে কী করে ঝড় বাতাস নিয়ে
তোমার উত্তর পূর্ণাঙ্গ হতে পারে বলো?

অ্যালেক্সা যদি পারো বলো—
আউশভিৎস ও বিরকেনাউ একই গ্রামের নাম নাকি,
রায়েরবাজারকে তখন তো গ্রাম বলাটাই ছিল বাকি
আর এখন উড়াল ট্রেনে চেপে গেলে
সেই জায়গাটা কোন স্টেশনে গিয়ে ওঠে,
এবং জ্যাকারান্ডা যে পৃথিবীতে এরকম অবলীলায় ফোটে,
তা কি কখনো শেষ হয় হবে,
ইংরেজিতে প্লেগ বানানে ই ইউয়ের আগে না পরে তবে,
এবং এই এক দেশে কেন তিনখানা ইছামতি নদী?
অ্যালেক্সা বলো,
সেইসব প্লেগ বা অন্য মহামারী যদি
এইভাবে পৃথিবীকে বেড় দিয়ে ধরে
যদি শহরে ঢেউখেলা ছাদে চিকিৎসাগৃহের পরে
ফের, পরে, একসার হাসপাতালই চলে আসে
যা দেখে রিলকে একদিন লিখেছিল
মানুষ এখানে, এইখানে, কোনোদিন কিভাবে
বাঁচতে আসে, ফুহ! কিম্বা ধেততেরি!
কাতিন ফরেস্টে বিশ হাজার
হাহ, জেনে কী হবে মেরি কি তেরি,
পোলিশ সেনা অফিসার
কিভাবে মারা গেল
কিভাবে এনকেভিডি কিভাবে স্তালিন-বেরিয়া
বা অন্য কেউ অত নিষ্ঠুর হতে পারে, হয়,
কিভাবে গাছের শিকড় গাছ বেড় দিয়ে মরে গেল, মরে যায়?
নিচে মাটিতে কিভাবে তারা এখন
মূল গাছ থেকে দূরে
পর্যুদস্ত ভাঙা ভাস্কর্যের মতো, আর
পুকুরের পাড়ে ঘন সান্দ্র পাতার
আড়ালে কোন পাখি ডাকে,
কুয়োর পাশটাতে যার হাঁস ঘোরে সেটা কার হাঁস
কার বিড়াল কাদের গিরগিটি ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে,
এবং অ্যালেক্সা বলো,
আমি যে বেলে মাছ ধরলাম বিল থেকে
মাকে এনে দিতে
সেই বিলের নাম বিহারিরা চলে যেতে যেতে
‘ফক্কিকার বিল‘ নাম দিয়ে গিয়েছিল কেন?
কেন পারম্পর্যহীন হাওয়া,
কোনো স্থির বিন্যাস ছাড়া, আহা, চারদিকে ওড়ে
আমি চোখে অন্ধকার দেখি
সেসব অন্তঃসারশূন্য পথে পথে—
অ্যালেক্সা,
সেই ধুম্রকেশী পথের নাম বলো,
বেড়াবেনী জুলফিওয়ালা পথ চুলের ফিতের মতো
বাতাসের মত্ততা ভরা, দিনে সুনশান
আর বিকেলে সেটা হতে হতে হচ্ছে এমন জাফরান।

বলো অ্যালেক্সা ঝড়, পৃথিবীকে থাবা দিয়ে
চিবুকে রক্ত লাগা টকটকে যেই ঝড়,
তার নাম কে দিয়েছে তুফান, কে দিয়েছে আন্ধিয়া?
বিহারিরা বলতো ‘দিন-কি পুরিয়া’—
ইমনভুপালি, শাহানাও হতে পারে!
কী এই কালের প্রবাহ, এই এভাকুয়েশন,
সাতপুরুষের ভিটে ছেড়ে যাওয়া?
এই-ই কি অতিবাহিত সময়ের ঘনীভূত দ্রুত সঞ্চালন?

অ্যালেক্সা দেখি বলো, মানুষের আয়ু
সময়ের আস্তানার পাশে
আনুষঙ্গিক এক লহমার ফাঁসে
আটকানো ঘোড়ার লাফের মতো কেন?
কেন অন্য মাত্রা পেল তাই শুশুকের উঠেই ডুব দেওয়া?
কেন এ কথাটাই বলেছিল আমার বেঁচে থাকতে পিতা
তার নিজের ডুবের আগে,
যে হে পুত্র তুমি তোমার অ্যালেক্সাকে বলো—
বাতাস ঝির ঝির করে বইছে কিন্তু দূরে
ওই প্রতীক্ষাটুকু কী ক্ষিপ্রগতি ঘুরছে ঠকিয়ে
আসছে এইদিকে ঘুরে ঘুরে
নিজস্ব একতরফা-করা তালিকা অনুসারে!
ঘুরুক, পিতা বলেছিল, ওকে শুধু জিজ্ঞেস করো,
কেন দূরে হেমন্তের ছাড়া-ছাড়া বন অকারণে—কিম্বা ওটাতেই সব কারণ মাখা—দিগন্তপ্রসারী?

অ্যালেক্সা, যদি পারো আমার এই
সাময়িক বিশেষ চৈতন্য নিয়ে বলো—
বলো আমাদের মাঝে অমর কেউ আছে নাকি
আর মানুষ কোথায় যায়—কোথায় কোথায়
মানুষের চেতনা হারায়,
তারা জীবিত যখন আর যখন মৃত...

এবং কপোতাক্ষ নদী কিম্বা নদ
বলো কারা কারা সেইদিন আমার সাথে ছিল
যেইদিন মাইকেল মধুর আলোয়ান দেখা হলো,
তারপরে কপোতাক্ষেরই নিচে
ব্রোঞ্জের রঙ সবুজ হয়ে আসা
ব্রিটিশ সাবমেরিন
আর কিভাবে তার গায়ে মহাকাব্যিক মন্ত্রপূত প্রেত
টলমল ঝুলে ছিল রাবণের ছায়া ছায়া রঙ,
বড় হা, দাঁত, সব নিন্দনীয় কাজের সংকেত?

অ্যালেক্সা, যুদ্ধ কি বাস্তবেই হয়েছিল,
বাস্তবেই অগ্নিশালায় কুশাসনের ওরা
কথা বলছিল ক্রুজার ডেস্ট্রয়ার নিয়ে?
তুমি সেই নদীর নামটুকুই জানো
কপোতাক্ষ সেটা,
দেখি ক্রুজারের নাম কী ছিল বলো,
সেই সাবমেরিন সেই টর্পেডো-বুলেট...
তোমার কথামেশিনও কি ওদেরকে ডাকে ‘কমরেড’?
ওকে!
দেখি বলো তাহলে তোমার ওই একঘেয়ে সুরে একটানে
এই জীবনের মানে,
প্রতি ভোরে পৃথিবী শীত শীত হয়ে এলে
কাঁথার নিচে লুকিয়ে কেন সবচাইতে ভালো
বোধ হয়—
আবার হায় ফের একটা দিন
অন্যের সূত্রমতো বাঁচা শুরু করতে হবে, এই ভয়?

আর তখনই কিনা তোমার ‘গুড মর্নিং’,
তোমার ‘সুপ্রভাত’,
তোমার ‘আজকের দিনটা যাক ভালো’,—
আর তখনই,
যখন ঘাসে ঘাসে জেগে উঠছে ময়াল সাপগুলো,
ছোট সৈন্য লাইকাওন ভোরের আলোর নিচে
দু টুকরো হয় হতে বাধ্য বীর একিলিসের কিরিচে
—চিরকাল?
এই একই মৃত্যুদৃশ্য সেই হোমারের কাল থেকে,
তবু তুমি বলবে যে, ‘এক নতুন দিন শুরু কাল’!
আহা, এই কথা তুমি,
মেশিন লার্নিংয়ের এই গান,
কিভাবে পুরোটাই
তোমার ক্লান্তি থেকে বলছো দিনমান।

বলো দেখি এরকম
এবং আরো যত রকম সকম আছে সেরকম
যত বর্শা ও তরবারি,
সব না হলেও কিছু তো অ্যালেক্সা বোন তুমি, নারীকণ্ঠ,
তাই তোমাকে প্রহেলিকাও সম্ভবত বলতে পারি,
বলো তুমি
কিছু তো জীবনের তাৎপর্যটুকু নিয়ে বলো,
যে কোথায় খোদা থাকতে পারে
এবং কেন মানুষের এইরকম ক্ষুধা
এই আপাতব্যাখ্যাহীন যার শক্তি তারই বেঁচে থাকা?
অ্যালেক্সা ধুর, যাক তবে সেক্সটক করো,
আহহ-উহহ-করো-ধরো এইসব বিপ্লবী কথা
এই বিপ্লবীসত্তা এই বিশ্বাসঘাতকতা;
এবং অগ্নিযুগে (অগ্নিযুগই বলে একে)
তুমি আমি একই রূপ, ডান কিম্বা বাম
টুইডলডি ও টুইডলডাম।

তো, অ্যালেক্সা বলো, খেলনা পুতুলের নাম তুমি,
আমাকে আরেকবার ভোরের নদীর কথা বলো
আরেকবার যে পাখি নির্লিপ্ত ডাকে বলো তার নাম
যে নদী সে কি শান্ত ইছামতি
আর তাতে যে গান তা কি ভাটিয়ালি
এবং যে ঢেউ তাতে কিসের হিজিবিজি
এবং পাখিদের আবহসঙ্গীতে
কাদের কুশপুত্তলিকা দাহ
তাই তাতে তাই তাতে পানিতে সলিলে ও জলে,
কোন মেঘের লাল মেশা অগ্নিপ্রবাহ?

তুমি কোনো বনের কিনারে

ধরো সন্ধ্যাবেলায়
তুমি কোনো বনের কিনারে
আকাশ সহিষ্ণু আর তার রক্তিম ছায়া
মিশে গেছে গাড়িটির কাচে
তোমার পাশে জায়া, সংসারসঙ্গিনী
জায়গাটা গাজীপুর, রাজেন্দ্রপুরও হতে পারে
কিম্বা কাপাসিয়া—
একটা হবে কিছু হবে ওদিকেই,
তাতে তফাৎ হয় না কোনো, কারণ চারপাশে
ঘন বন শালবন বনতুলসী অলীক কুচফল,
পারুল জারুল ইত্যাদি আর অর্জুন
ওহ, মাটি কী রকম তৃণাচ্ছাদিত এবং অর্জুন—
চিরায়ত প্রতাপশালী দানব আকৃতি।

ধরো সব মিলে শান্তি মিশে আছে বুকে
আর আজকের দিনটাকে “ভালো গেল” বলে পত্রপল্লব ধরে পাখির চিৎকারে
বলা যায় সময়টা এত শান্তির এতটা মায়াভরা যে তোমাদের নিজেদের এ-পৃথিবীতে লাগছে
আতিথ্য-পাওয়া পথ খুঁজে পাওয়া
দুই আদম-হাওয়া
আর গাড়ির স্টেরিওতে গুন্ডেচা ব্রাদার্স জোরে
রাগ শ্যামকল্যাণ জয়জয়ন্ত
বাইরে শান্ত স্থির সব যদিও যথেষ্ট কলকাকলিত
আকাশ স্বচ্ছ ও পাখিরা সে আকাশে শামিয়ানা মতো,
এতো পাখি—হতে পারে সময়টা গোধূলি,
হতে পারে সন্ধ্যাবেলা, হতে পারে শেষ বিকেল কিম্বা মঙ্গলা রাত্রির শুরু,
সময়, এসব সময় এমনই আঠা আঠা মতো
সুল ফাখতা...
আর তোমার যে হাত ধরে আছে, বড় রাস্তা থেকে গাড়ি ধাপে ধাপে কেঁপে
এদিকটায় নেমে যাবার স্বনিত শব্দমুখরিত মুহূর্তটা থেকে যে তোমার আধা ঘণ্টা হাত ধরে আছে,
ধরে ছিল, তুমি গাড়ি চালাচ্ছিলে,
চালাচ্ছো এখন ধীরে উদ্দেশ্যবিহীন
সে বলল তোমাকে যে কতদিন
দুইজনে এভাবে ঘোরোনি উদ্দেশ্যবিহীন
তাই কী হয় যদি আরো দূরে চলে যাই বনের ভেতরদিকে
যেখানে সন্ধ্যা নামছে তো
পাখিরা আসছে তো ফিরে
প্রকৃতি এখানে সুন্দর খুব সুন্দরের থেকে বেশি গাঢ়, দ্যাখো দ্যাখো দুটো খরগোশ চলে গেল দূরে
দৌড়ে পালিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কী রকম
পানিতে হাঁস ডুব দেবার মতো।

আর তখনই দেখলে তুমি
যখন গাড়ির চারপাশে গাছ ঘন পাতা
পথ যেন বাঙময়—শাল-অর্জুনদের
অলৌকিক সরসর-পা-চালানো গুঞ্জরণ তোলা
সরু গলি, মাটিতে পাতার কার্পেট পাতা—
ঠিক যখন তার এইভাবে হাত ধরা দেখে
মনে হচ্ছিল জীবন তবে কাটিয়ে দেবারই মতো কিছু, যেমন সংসারে নিয়তই ভাবো
জীবন ওভাররেটেড, তা সত্য নয় মোটে,
একসাথে থাকা কষ্ট নয় অত,
আর যাই বলো বাচ্চাও তো আছে,
এমনকি বিড়ালও এবং তানসেনের সিডি
আর আনুশকা শঙ্কর তার বুক উঁচু পোস্টারসহ
আর যথেষ্টই কবিতার বই, পর্যাপ্ত পুরাণও
যেমন কালেভালা এমনকি কালেভালা
এবং গোপন ড্রয়ারে যা থাকার কথা তাও—

ঠিক তখন তোমার সঙ্গিনী তোমার হাতে
নখ বসিয়ে দিল, ভয়ে,
তুমি শুনলে এক ছুরির ধারের মতো
চোখা আর্তচিৎকার
এবং তোমার হাত বেয়ে জিব্রাল্টার
অসফিয়েনচিম মিউনিখ মনে পড়ে গেল
এক মুহূর্তমতো—
রক্ত গড়াল গিয়ারবক্সের দিকে,
গাড়িতে স্পষ্ট সালফার, ক্রুরগন্ধ
আর গাড়িতে বেশ কটা টোকা
গাড়ি এক বাঁকে ঘোরার দরকার থেকে
দাঁড়ানোই ছিল আর এরা দুজন ষণ্ডা যেন
উমাকান্ত গুন্ডেচা রামাকান্ত গুন্ডেচা নাকি
এবং দেখলে যে আর একজন রোগাপটকা
দূর থেকে হেঁটে আসছে তাদের দলপতি
হাতে তার সস্তা চিয়াপ্পা এম-নাইন-টুয়েন্টি-টু
মানে যা থাকে ঢাকার আশপাশে
উপশহরের গরিলাদের হাতে—
বেরেটার নকল ভার্শন
প্রথম শটে যা ডবল অ্যাকশন
পরেরগুলো এক রাউন্ড করে;
সময়ের সাথে মিলিয়ে সহিংসতা নিয়ে
ব্যক্তিগত নেশা থেকে জেনে গেছো
কিসে কে কিভাবে মরতে পারে—

ওই তার হাতে চিয়াপ্পা গাড়ির আলোয় স্পষ্ট
আসছে সে এইদিকে
জিজ্জি, নোভাক স্টাইল ফাইবার অপটিক সাইট
জিজ্জি, কালো প্লাস্টিক গ্রিপ
তোমার মনে হচ্ছে হতে পারে তোমার স্ত্রীর নাম
হতে পারে তার নাম ইয়াসমিন জেসমিন নাসরিন কিম্বা বকুল
আহ, কী করে তার নাম হয়ে যাচ্ছে ভুল?
কতখানি আতঙ্কিত তুমি, এক্ষুনি কত খুশি ছিলে কারণ এভাবে বেড়ানো হয় না বহুদিন বাচ্চাদের ছাড়া শুধুই দুইজনে এবং ওই দলপতি ধরো
বলে দিল চিয়াপ্পা তোমার মাথার সাথে ধরে
যে চারদিকে বিশ মাইলের মাঝে
পাখি ও কিছু দিকভ্রান্ত এই বা সেই পশু ছাড়া
আর কিছু নেই অতএব আপনি চলে যান
আর আপনার বান্ধবী, স্ত্রীও হতে পারে,
মাফ করবেন আজ রাতটা এখানে থেকে যাবে
আমরা বড় একা এবং কাল দুপুরের দিকে
মাফ করবেন এই কালো মেহগনি, এক শাল
ও দুই ইন্ডিয়ান রোজউডের ত্রিভুজটার মাঝে
তাকে পেয়ে যাবেন ভালো আছে ভালোভাবে
বৃত্ত হয়ে
আর গাড়ির স্টেরিওতে তখন গুন্ডেচা শেষ
তখন আসগেইর এইনারসসন তার বিখ্যাত ‘গোয়িং হোম’ নিয়ে, সম্ভবত সংসার নিয়ে
বলছে যে এটা কত বড় বোঝা
এর ওজন সবচেয়ে বেশি
এর ওজনের ভার
এবং গানের এই করকোষ্ঠীবিচারের কথা শুনে
সে হাত ছেড়ে দিল, ধরো,
যদিও রক্ত তখনও প্রবাহিত
মধ্যপদলোপী কী এক কী জিনিসের ফেরে
ভালোই একা থাকা তবে কি ধরো শুরু হলো তবে?

রাত অনিঃশেষ

রাত অনিঃশেষ, রোববারের রাত
আর সব রাত্রিরই মতো
কক্ষপথ তার ধীর ও নির্ধারিত—
এখনো বাচ্চারা শুতে যাওয়া দূরে থাক
রাতের খাওয়াই তারা শেষ করেনি ভালোমতো,
এখনো গান বাজছে তাতে
জোরে শব্দ করে গান বাজে যাতে,
সেখানে গলায় বেদনা ভরে
গায়ক বলে যাচ্ছে ইয়াসগার্স পার্কের কথা
মানে উডস্টক ফেস্টিভ্যাল খুব মিস করছে কেউ,
এখনো রাত অবধারিত গাঢ় হওয়া বাকি,
এখনো দূর থেকে দূরে কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ
শুরু করেনি গভীর রাতে তারা যেটা করে
ভোর আর হবে না এই ভয়ে,
এখনো আমার ব্যক্তিগত রাত নিয়ে ভয়টুকু
শুরু হয়নি মনে,
যে এই বুঝি নির্ঘুম রাতের প্রগাঢ় কোনো ক্ষণে
কারো জোর চিৎকার শুনব কোথাও চাপা স্বরে,
যেন কোনো বাইসন পড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের থেকে যেভাবে সাধারণ বড় পাথর খণ্ড হেলে পড়ে,
আর এখনো জেসাস ক্রাইস্ট (যত যাই বলো
তার চেহারাটা বেশ ভালো),
পৃথিবীর অন্যপাশে এখনো তাকে,
তেত্রিশ বছরের এই পাগল ছেলেটাকে,
ঝাড়ামোছা করাই শেষ হয়নিকো,
পশ্চিমে রোববারের প্রার্থনার আগে—
তার মানে আমাদের এইখানে এখনো সময়
থেমে আছে রাত দশটা বা দশটা দশের দাগে।

তাহলে কিভাবে তা হয়—
কিভাবে হিসাব মেলে সন্ধ্যা যে কত দূরে ছিল, কত আগে!
কেমন সন্ধ্যা ছিল এটা আজ?
আকাশে অ্যানড্রমিডা অরিয়ন কিছুই দেখিনি তো,
আকাশ ক্রিমসন ছিল, আকাশ মার্বেলের ভেতরটার মতো;
তাই আজ মনে হচ্ছিল আদতেই কোনো সন্ধ্যা নয়,
বরং অন্য কিছু নাম, মারাত্মক অন্য কোনো নামে তাকে ডাকা যেত।
যাহোক, ডাকিনি, তবে তার মানে
অত দূর সন্ধ্যার পরে
তার মানে এখনো সময় বেশি যায়নিকো।

রাত তাই নিশ্চিত আজ অনেক লম্বা ও বড়,
তবে তুমি বিষয়টাকে দীর্ঘ যেহেতু বলো,
তাই দীর্ঘই বলতে পারো।
আমি বলতে চাই কেবল এই কথাটুকু—
আমি তোমার মন পড়তে পারি, মন পড়তে থাকি,
ভাবি কী কী তুমি দেখেছো এই পৃথিবীতে
আর তোমার আরো কী কী দেখা বাকি;
তোমার চোখে চোখ রেখে যেমন বলতে পারি:
রাত আসলেই অনিঃশেষ, রাত এক অতল রাস্তার সিঁড়ি,
আর দেখো আমাদের শেষটা আসবে শিগগিরই,
এবং খেয়াল কোরো মানুষ মরে না দল বা জোড়া বেঁধে—
মরে সে একাকী, একাকীই দেয়
স্তব্ধতার বাঁকা ও অমল সেতু পাড়ি;
মৃত্যু একজন করে করে যার যার জন্যই আসে,
আর এ-নিয়ম ভালো না খারাপ তা সম্ভবত
লেখা থাকে জেসাস ক্রাইস্টের মতো লোকদেরই
শ্বাসে ও বিশ্বাসে।

বাইরে কি রাত ঘন হলো?
কোনো বিড়াল পড়ল কি স্লিপারি এলম্ গাছ থেকে?
প্রশ্ন থেকে যায় এই বিদেশি গাছগুলো
কিভাবে ও কোথা থেকে ঘর ছেড়ে এলো?
যাক, বাইরে বিড়াল পড়ল সেই স্লিপারি এলম্ গাছ থেকে—
আহা, দ্যাখো, স্লিপারি এলম্ বলো যাকে
সে তার নামের মধ্যেই কিভাবে বদনাম নিয়ে থাকে।
তো, বাচ্চারা বড় হচ্ছে কত পিচ্ছিল লোকদের মাঝে,
পৃথিবী ঘৃণার কারখানা, জুডাস ব্রুটাসে
কে এই ঘর যথেষ্ট ভরে দিল?
বলবে যে তোমার বাচ্চাদের পৃথিবীতে
জন্ম দেওয়াই তাহলে ভুল ছিল!
তবু মানুষ মানুষের জন্ম দেয় সব জেনেবুঝে।
মেরির কথা অতএব মনে পড়ে গেল—জিসাসের মাতা—
জিসাস বুঝেছিল, তার চেহারাটা নিঃসন্দেহে ভালো, সে বুঝেছিল কী বলতে চাচ্ছি আমি
সে সেটা ভালোই বুঝেছিল।

লেখা শেষ হয়ে আসে, আমার চোখ রক্ত লাল
রাত দশটা তাহলে পার হয়ে গেছে,
মুনিয়া পাখিগুলো ওইভাবে কেন কাঁপে?
স্বপ্নে একসাথে দল বেঁধে একই লোভী বিড়ালটাকে দেখে?
কিম্বা টিভিতে দেখা—ওরা কি আর অত কিছু বোঝে!—মাতাল হায়েনা বা খুনি এলিফেন্ট সিলও হতে পারে,
সত্যি মুনিয়া পাখিগুলো সারাদিন এত টিভি দ্যাখে!
আর আমরা দুজনে একসাথে
দেখি, দেখেছি এ পৃথিবীর এমন সব কিছু,
এমন জিনিস কিছু কিছু, যা না দেখলেই ভালো হতো—
যেমন সে দেখেছে আমার গোপন চিঠি
যিশুর কাছে লেখা, কোন মুহূর্তের ভুলে,
যে জুডাসই ত্রাতা, তুমি বাচ্চা ছেলে,
মাথা ঠান্ডা করো
জুডাসই তোমাকে বানাল এত বড়,
এবং যে আমরা সকলেই যাব একা একা
সকলেই শেষ হবে আলাদা আলাদা করে, কোনোভাবে দল বেঁধে নয়,
এটাই লেখা ছিল জুডাসের তিরিশ মুদ্রার গায়!

হেইল মেরি, তোমার ছেলে ক্রুশকাঠে ঝুলে
মুক্তি নিয়ে এসেছিল আমাদের চরাচর
দেখবার চোখে,
রাতও যথেষ্টই হয়ে গেল, চোখ লাল এবং ভারী
এবং অন্ধকার প্রগাঢ় হতে হতে সামান্য আলো
যখন তিরোহিত, যখন আঁধারে অসংখ্য
ট্রিগার ও অসংখ্য তরবারি,
তখন তেত্রিশ বছরের এই বাচ্চা ছেলে,
তার মোমের মতো ত্বক, আমাদেরকে নাচাল এমনভাবে যেন আমরা ছেঁড়া ঘুড়ি;
এই রাত অনিঃশেষ—আমাদের শেষটা আসবে শিগগিরই।

জেসাস ক্রাইস্ট, হাহ্, তার চেহারাটা ভালো,
এমন দেখতে যে মনে হয় তাকে আমি তাকে
চাইলেই বাঁচাতে পারতাম তার ভেড়াগুলো সহ,
আর সবকিছু যা ভালো তা ঘটছে অন্য কোথাও
এই পৃথিবীতে নয়, এই পৃথিবী দুর্বহ—
এখানে রাতের বিছানায় সাথে কেউ নেই
রাত কঠিন যায় একা, সাথে কেউ থাকলেও।

পশুগুলো ডেকে উঠল দ্যাখো

মেলার রাস্তায়, ষাঁড়জবাই হয়ে যাচ্ছে মেলার রাস্তায়।
এখন এই পংক্তি টেনে বড় করো,
যাতে এর পেছনে চলে আসে স্কুলবালকদের নেশা—রক্ত দেখার;
আর আসে হেডমাস্টার এবং তার নালিশ যে,
সময় প্রস্ফুরিত, সংক্ষুব্ধ, থরোথরো।

“পশু-মারা রাস্তার পাশে জীবনের ব্রহ্মজ্ঞান
ঘটে”...

এই তো পংক্তি এসে যাচ্ছে বেশ!
এর কথাই বলা হয়েছিল,
সেইসাথে বেঞ্চি ও নীলডাউনের কথা,
বলা হয়েছিল এখানে শত্রুতার বিষয় নেই কোনো,
আছে ছাত্র-শিক্ষক মিল,
আছে স্কুলের নীলরঙ বাস,
আছে বালকের লালাগ্রন্থি যাতে
এই তো চকলেটের শেষটা মাখামাখি,
এই তো হলুদ মসকেটগুলোয় ফুল
এই তো গোল-পাতা ডগউডগুলি, ঝনঝন, রীতিমতো—
এই তো লিবার্টি রোড, আকাশ কুণ্ঠিত!

এই এত আবেগের ঢেউ,
এত সান্ত্বনার কথা,
নিজেকেই বলছি তবু ভালো লাগছে না কিছু।
কারণ, ছাত্রকে দেওয়া
প্রতিজ্ঞা রাখেনি কোনো শিক্ষকের কেউ—
নীল বাস খাকি হয়ে গেছে,
ধ্যাবড়া-জ্যাবড়া মতো সেটা,
আর এই শাস্তি, এই শীত, এই স্ফীত বিস্তারিত
শীত—শৈশবে কথা ছিল না এটা।

তুমি তার চেয়ে আমাকে তোমার বাসায় নিয়ে চলো
সেখানে অন্তত নীরবতা ভাগ করে বসে থাকা যাবে।
এই তো মনে হচ্ছে নীরবতার থেকে
আবর্জনাহীন আর কি কিছু আছে?
মনে হচ্ছে পড়ে যাব,
মনে হচ্ছে কপালে বেত্রাঘাত-ভর্ৎসনা-অগৌরব লেখা,
মনে হচ্ছে লেন্সের মধ্য দিয়ে যেন পৃথিবীকে দেখা—
ষাঁড় ও ষাঁড়ের চিৎকার,
পনেরো কুড়ি লোক,
তারা আছে মানবমোর্চার ন্যায়ানুগ সাজে,
তবে তাদের বিপরীতে একটাই ষাঁড়, এবং
এবং—এই তো মনে হচ্ছে—ড্রাম বাজে বাজে।

সত্যি এসবই এড়াতে চেয়েছি চিরকাল
সত্যি সেই স্কুলবয়স থেকে চেষ্টা করে গেছি
বুঝতে যে, কখন থামতে হবে যখন নাকাল।
কিন্তু স্কুলবালকেরা ঠিক অসভ্যতাই শেখে আগে,
আর এই বালকের মাথার ভেতরে শুধু
ঝমঝম বৃষ্টির রাতে অবিরাম ভয়ার্ত পংক্তিই জাগে,
যেমন শোয়া থেকে উঠে এই নিয়ে তার বিশবার হলো,
আসলে হয়েছে দশ, কিন্তু অলংকার মনে রেখে বিশই বলা ভালো,
কারণ বিশের সাথে অন্য এক শব্দের পুরো
ধ্বনির মিল আছে।

সেটা ভালো, এই যে মিলেমিশে থাকা—
যেমন পুকুর ও এক বালকের পাড় থেকে পিছলে মারা যাওয়া
যেমন কোরবানির রাতে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে
ষাঁড়গুলি মারা, আইনসম্মতভাবে—অন্য এক মিলমিশই হেতু।

পশুগুলো ডেকে উঠল দ্যাখো,
ওরা কি মৃত্যুভয়ে ভীত, ওরা কি ছমছম?

   

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

বাংলাদেশের বৈশাখি মেলা

  ‘এসো হে বৈশাখ’



সাইমন জাকারিয়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ হাজারো মেলার দেশ। এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রাম-শহর জুড়ে প্রতি বছর এখনও প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত প্রতিটি মেলা আয়োজনের পিছনে কোনো না কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। সেটি হয় ধর্মীয়, নয় ব্রত-পালা-পার্বন অথবা যে কোনো একটি নির্ধারিত বিষয় বা ঐতিহ্যকে স্মরণ করে।

মেলার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে- নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত তারিখ বা তিথি-লগ্নে এক একটি মেলাতে নর-নারী, শিশু-কিশোর এমনকি আবাল বৃদ্ধরাও সমাগম ও সমাবেশ করে থাকে। উল্লেখ্য, একটি জায়গায় অনেক লোকের সমাবেশ ও সমাগম মানেই সাধারণ বাংলা অর্থে মেলা বলা হয়। তবে, মেলার বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে- ব্যবহার্য পণ্য ও গৃহ সামগ্রীর বিরাট সমাবেশ এবং চিত্তবিনোদনের জন্যে যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ ইত্যাদির আসর।

আধুনিক এই যুগের খেয়ালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাসমূহ এখন অনেকটাই তার চরিত্র বদলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এরমাঝে তাকে নানা উত্থানপতন ও অবক্ষয়ের ধকল সইতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের মেলাগুলো কিছুতেই তার ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে পুরোপুরি যেতে নারাজ। বাংলাদেশের মেলাগুলো এখন আগের সনাতন চেহারা থেকে রূপান্তরিত হয়ে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও অতিমারি কালে বাংলাদেশের বহু ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির মতো মেলাগুলোও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি। তবে, মানুষের জীবিকার চাহিদা ও মননশীল মনের তাগিদে ঐতিহ্যগত মেলাগুলো আয়োজনে সাময়িক বাধাপ্রাপ্ত হলেও কোভিড-১৯ উত্তরকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যগত মেলাগুলো আবার আগের মতো অনুষ্ঠিত হতে শুরু করেছে।

উল্লেখ্য, এদেশের প্রচলিত মেলাগুলির প্রকৃতি বহুবিধ ধরনের। এক বাক্যে তার প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণী করণ দুঃসাধ্য। আলোচনার সুবিধার্থে এখানে এদেশে প্রচলিত মেলাগুলির একটি সরল শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশের মেলা প্রায় সর্বাংশই ছিল গ্রামকেন্দ্রিক, যুগের পরিবর্তনে ধীরে ধীরে সেই চিত্র পাল্টে গিয়ে এদেশের মেলা বর্তমানে গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই ছড়িয়ে পড়েছে।

চারিত্র্য বিচারে এদেশে প্রচলিত মেলাসমূহকে মোটামুটি সাতটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যেতে পারে, যথা- ১. ধর্মীয় উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ২. কৃষি উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ৩. ঋতুভিত্তিক মেলা, ৪. সাধু-সন্তের ওরশ উপলক্ষে ফকিরী মেলা ৫. জাতীয় জীবনের বিভিন্ন বরেণ্য ব্যক্তি যেমন, কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ইত্যাদির স্মরণোৎসব উপলক্ষে স্মারক মেলা, ৬. জাতীয় দিবসসমূহ উদ্যাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃৃতিক মেলা, ৭. বাণিজ্যিক সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় মেলা। উল্লেখ্য, যেসকল মেলার ঐতিহ্য বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচলিত আছে এই শ্রেণীবিন্যাসে কেবল সেসকল মেলাগুলিকেই বিবেচনায় আনা হয়েছে। তবে, ভিন্ন বিবেচনায় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মেলাসমূহের এমন সরলকৃত শ্রেণীবিভাগকে যে কেউ নতুনভাবেও পুনর্বিন্যস্ত করতে পারেন।

এক

উপলক্ষই বাংলাদেশের মেলা উদ্যাপনের স্বাভাবিক উৎস কথা। কিন্তু উপলক্ষ যা-ই থাকুক বাংলাদেশের মেলার একটা সার্বজনীন রূপ কিন্তু আছেই। এদেশের মেলায় অংশগ্রহণে সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিন্নতা কোনো দিনই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বাংলাদেশের সবগুলো মেলাই আর্থ-সাংস্কৃৃতিক বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে মানুষের মধ্যে মিলন কথাকেই প্রকাশ করে থাকে। সে কারণে এদেশের মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল ধর্ম ও শ্রেণীর মানুষের আনাগোনা ঘটে। অতএব, বাংলাদেশের মেলা মানে মৈত্রী সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র। নারী-পুরুষ, শিশু -কিশোর সকলেই আসে এই মেলাতে।

এখানে সকলের অভিন্ন আকাক্সক্ষা একটিই, আর তা হলো- মেলা বা আড়ৎ দেখা। যার সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে আরেকটি বিষয় জড়িয়ে থাকে, তা হচ্ছে-বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। মেলাতে গাঁয়ের বধুর ঝোঁক থাকে আলতা-সিঁদুর-স্নো-পাউডার-সাবান আর ঘর-গৃহস্থালির টুকিটাকি সামগ্রীর প্রতি। আরেকটি আকর্ষণ থাকে বিনোদনের প্রতি, আর তা হচ্ছে- যাত্রা, পুতুল নাচ বা সার্কাস প্রদর্শনী দেখা।

তবে, শিশু-কিশোরদের টান থাকে মূলত খেলনার দিকে, যেমন- মাটির পুতুল, কাঠের ঘোড়া, টিনের জাহাজ। শিশু-কিশোরদের আরেক আকর্ষণের বস্তু হচ্ছে- খই, বাতাসা, রসগোল্লা, চমচম, কদমা, খাগড়াই, মুড়ি-মুড়কি, জিলিপি আর দানাদার। তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের খেলনা বাঁশির কথাও বলা যায়। মেলার প্রাঙ্গণে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু-কিশোরই বাঁশি কিনে থাকে।

বাংলাদেশের মেলার একটি দিকে থাকে অনিবার্যভাবেই বিনোদনের ব্যবস্থা। যেমন- নাগরদোলা, পুতুলনাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, যাত্রা, বাউল-ফকির বা কবি গান, বায়োস্কোপ, লাঠিখেলা, কুস্তি, জারিগান ইত্যাদি। কিছু কিছু মেলাকে মাতিয়ে রাখে সঙ-এর কৌতুক ও মশকরা, তারা স্বাধীনভাবে মেলাতে ঘুরে ঘুরে রঙ্গ করে থাকে। এছাড়া, মেলায় বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাড়ি-মদ আর জুয়ার আসর বসে থাকে। নেশায় এমন ডুবে এবং জুয়ার খেলায় সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে অনেকেই। এটা বাংলাদেশের মেলার একটি প্রাত্যহিক চিত্র।

তবে, বাংলাদেশে বর্তমানে চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। এদেশের মেলায় এখন হর-হামেশাই মাইকে বা সাউন্ড বক্সে উচ্চ আওয়াজে গান বাজে। মেলায় পসরা সাজিয়ে বসা দোকানে দোকানে এখন মোবাইল বা ল্যাপটপের মাধ্যমে ইউটিউব থেকে পছন্দমতো গান বেছে নিয়ে তা সাউন্ডবক্সে বাজানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো করা হয়।

সময় বদলের সঙ্গে এদেশের মেলার চিত্র-চরিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ মেলার রূপ ও মেজাজ অনেকখানিই বদলে গেছে। সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষে এইদেশে যে সকল মেলার আয়োজন হতো তার মধ্যে অনেক মেলার আয়োজন এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এবং অনেক মেলা এখন বিলুপ্তির পথে, কিছু মেলা এরই মাঝে রূপান্তরিত হয়ে নতুন রূপ গ্রহণ করে বেঁচে আছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামীণ মেলাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এদেশের গ্রামীণ মেলার স্বাভাবিক ও সাধারণ চিত্র কুটির শিল্পজাত গ্রামীণ পণ্যের বদলে দেশী-বিদেশী চোখ ধাঁধানো বাহারি পণ্যের জৌলূস ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি চ্যানেলে প্রচলিত কাটুনের চরিত্রের মুখ ও নকশা এখন প্লাস্টিক ও বাতাস দিয়ে ফোলানো বেলুনের উপর শহর থেকে গ্রামের মেলায় বাতাসে উড়তে দেখা যায়। বিশেষ করে জনপ্রিয় কাটুন চরিত্র মটু-পাতলু সারা বাংলাদেশের মেলাগুলোতে প্রত্যক্ষ করা যায়। এগুলোই এখন শিশুদের প্রধান আকর্ষণের বস্তু হয়ে গেছে।

এদেশের বহু নাগরিক প্রয়াসের সঙ্গেই বাংলায় প্রচলিত মেলার লৌকিক ধারা এসে মিশেছে। যেমন- বৈশাখীমেলা, ঈদমেলা, বইমেলা, বিজয় মেলা ইত্যাদি মূলত এদেশে প্রচলিত মেলার লোকধারার প্রেরণা নিয়ে নতুন আঙ্গিক ও মাত্রায় আজ নগরজীবনে প্রতিষ্ঠিত এবং তা এর মধ্যেই ঐতিহ্যে পরিণতি লাভ করেছে। এমত ধারায় সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে বিজয়মালা, যা যথার্থ অর্থেই ‘ঐতিহ্য ও আধুনিক চেতনার.. অপূর্ব সমন্বয়’।

দুই

বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর শুরু উপলক্ষে এখানে এদেশের বৈশাখি মেলার অতীত ও বর্তমান চালচিত্র সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই।
বৈশাখ হচ্ছে বাংলা সনের প্রথম মাস। ঐতিহাসিকদের তথ্যমতে, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল থেকে যখন বাংলা সনের গণনা শুরু হয় তখন বছর সূচনার মাস হিসেবে বৈশাখকেই প্রথমে রাখা হয়। অনেকের ধারণা, সম্ভবত তখন থেকেই নববর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে বৈশাখী মেলার সূচনা। বৈশাখী মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এ মেলা ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাঙালির মেলা।

বৈশাখি মেলার অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যকে কোনো দিনই কোনো ধর্মের গোঁড়ামী খর্ব করতে পারেনি। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এই বৈশাখী মেলারও রয়েছে অন্যান্য মেলার মতো দুটো দিক। একটি বাণিজ্যিক আর একটি সাংস্কৃতিক। বাংলার ব্যবসায়ীরা চৈত্রের শেষ দিন বা ‘চৈত্রসংক্রান্তি’তে এবং বৈশাখের প্রথম দিনে ‘হালখাতা’ করে থাকে। আসলে ‘চৈত্রসংক্রান্তি’র দিনটা পালন করে বাংলাদেশের মানুষেরা পুরনো বছরকে বিদায় দেওয়ার উৎসব করে থাকে।

এতে মেলা, গান-বাজনা ও খাওয়া-দাওয়ার মধ্য দিয়ে এক আনন্দঘন পরিবেশে বাংলার একটা বছর বিদায় নেয় এবং নতুন একটা বছরের সূচনা হয়। এই দেশে তাই বৈশাখি মেলার সূচনা হয় বৈশাখের আগে থেকেই মানে চৈত্রের শেষ দিক থেকে। তবে, বৈশাখের প্রথম দিনটিই আসলে উৎসবের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সবাই পরিষ্কার ও সুন্দর জামা-কাপড় পরে। ঘরে ঘরে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। আর ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ছোটে মেলাতে।

বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে কৃষক, কামার, কুমোর, তাঁতি, ময়রা এবং অন্যান্য শিল্পী-কারিগরেরা যে সব সামগ্রী তৈরি করে, বৈশাখী মেলায় তা প্রদর্শন ও বিক্রি করার সুযোগ এনে দেয়। গ্রামীণ কৃষিজাত পণ্য, মিষ্টান্ন দ্রব্য, কুটির শিল্পজাত পণ্য, মাটি ও বেতের তৈরি শিল্পসামগ্রী প্রভৃতি নিয়ে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা দোকান সাজায় এই মেলায়। বাঁশ ও তালপাতার রঙিন বাঁশি, ভেঁপু, একতারা, দোতারা, ডুগডুগি, বেলুন, লাটিম, মার্বেল, ঘুড়ি-লাটাই, চরকি, পুতুল, মাটির ঘোড়া, কাঠের ঘোড়া, কাঠ, কাগজ ও বাঁশের পাখি, মাটির হাড়ি-বাসন, কলস, কাচের চুরি, পুঁতির মালা ইত্যাদি জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে ছোট ছোট দোকানিরা।

এছাড়া আছে কাঠের আসবাবপত্র, খাট, পালঙ্ক, চৌকি, চেয়ার-টেবিল, আলনা, আলমারি, ঢেঁকি, পিঁড়ি, গাড়ির চাকা প্রভৃতি। মেলায় আরও পাওয়া যায় পিতলের হাড়ি, কলস, বাসন-কোসন, লাঙল-জোয়াল, লোহার দা, বটি, কুড়–ল, খন্তা, কাচি, নিড়ানি, গরুর গলার ঘুঙুর। ময়রারা তৈরী করে নানা রকমের মিষ্টান্নদ্রব্যÑ কদমা, জিলিপি, বাতাসা, খাজা, ছাঁচের মিঠাই, খাগড়াই আরো কতো কি। বলে রাখা ভালো এসব মিষ্টান্নদ্রব্য মেলাতে আগেও যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে মেলার প্রচলিত রীতিকে ধরে। মুড়ি, মুড়কি, খই, চিড়ে, ছাচ খাজা, মোয়া, নারিকেলের নাড়–, বুট, চানাচুর, বাদাম ভাজা আর দিল্লির লাড্ডু, মটরভাজা, তিলের খাজা আজও মেলা আগত মানুষের প্রিয় খাবার।

বৈশাখি মেলার আরেক আকর্ষণ হচ্ছে তাঁতবস্ত্র। এই মেলাতে তাঁতিরা নিয়ে আসে নক্সীপাড়ের শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি, গামছা, বিছানের চাদর প্রভৃতি। মেলার একপাশে ছেলেমেয়েদের জন্য তৈরি জামা-কাপড়ও পাওয়া যায়। স্যাকরার দোকানে মেয়েরা ভীড় জমায় রূপা, তামা ও পিতলের গহনা কিনতে। বৈশাখী মেলায় গ্রামের কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের উন্নত জীবন গঠনের উপযোগী কিছু শিক্ষামূলক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকে।

এরমধ্যে রয়েছেÑ পশু প্রদর্শনী, চরকায় সুতা কাটা, গালার কারিগরি, গাছের চারা বা নার্সারি এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক প্রদর্শনী। গ্রামের মেয়েদের তৈরি নানাপ্রকার পাখা, মাদুর, কাঁথা, শিকে, বেত ও বাঁশের তৈরি হরেক রকম জিনিসপত্র সাজানো হয়। আর থাকে উন্নত ধরনের শাক-সবজি,উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, শস্যের বীজ প্রদর্শনী ও কেনার ব্যবস্থা।

যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মেলার যে রীতি ও ধরন আমাদের দেশে চালু রয়েছে, বৈশাখি মেলা তার সবটাই ধারণ করে আছে। যেমনÑ ১. বহু মানুষের সমাবেশ, ২. গানবাজনাসহ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, ৩. গ্রামীণ ব্যবহারিক শিল্পসামগ্রীর প্রদর্শনী ও বিক্রয়, ৪. বিভিন্ন রকমের খেলার আয়োজন।

মেলায় এসে মানুষ আনন্দের উপকরণ খোঁজে। তাই এখানে থাকে আনন্দলাভের নানা আয়োজন। পালাগান, বাউলগান, যাত্রা, কবিগান, গম্ভীরা, আলকাপ, জারিগান, পুতুলনাচ, সার্কাস প্রভৃতি বৈশাখি মেলার প্রধানতম সাংস্কৃতিক দিক। দেশজ খেলাধূলাও যে মানুষকে আনন্দ দিতে পারে তার প্রমাণ মেলে আমাদের বৈশাখি মেলায়। লাঠিখেলা, কুস্তি, হা-ডু-ডু, ঘুড়ি ওড়ানো, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড়, মোরগের লড়াই, বানেরর খেলা ইত্যাদি দেশজ মজার খেলা সবাইকে মাতিয়ে রাখে।

গ্রামই ছিল একসময় বৈশাখি মেলার প্রধান ক্ষেত্র। সাধারণত পথের তেমাথায়, তিন নদীর মিলনস্থানে, ফাঁকা মাঠে, কিংবা বিশাল অশ্বত্থ বা বট গাছের নিচে এই মেলা বসত। যেখানে নানান দিক থেকে অনেক লোক এসে জড়ো হতে পারত। কালক্রমে মেলার স্থান গ্রাম থেকে শহরে বি¯তৃত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

এখন তাই পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ সারাদেশের সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তবে, রাজধানী ঢাকা থাকে এই উৎসবের কেন্দ্রস্থলে। ছায়ানট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ঢাকায় নববর্ষের উৎসব উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা (বিসিক) বৈশাখি মেলার আয়োজন করে আসছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত বিসিকের বৈশাখি মেলা দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগিয়েছে। কয়েকটি লক্ষ্য সামনে রেখে বিসিক বৈশাখী মেলার আয়োজন করে, যেমন- ১. কুটির ও হস্তশিল্পজাত পন্যের বাজার সৃষ্টি,

২. গ্রামীণ কারুপণ্য শহুরে মানুষ ও বিদেশীদের সামনে তুলে ধরা, ৩. ক্রেতার চাহিদা সম্বন্ধে উৎপাদকদের অবহিত করা, ৪. কারুশিল্পীদের বিভিন্ন পণ্য, নক্সা ও নমুনার সঙ্গে মানুষের পরিচিতি ঘটানো। এবছর ঈদের ছুটির পর পরই পহেলা বৈশাখ পড়ে গেছে বিধায় বিসিক বৈশাখী মেলা ঈদের পর সুবিধাজনক সময়ে করবে বলে আশা করা যায়।

মনে রাখা দরকার, বৈশাখি মেলা কেবল একদিনেই শেষ হয় না। একদিন, তিনদিন, সাতদিন, পক্ষকাল, পুরো মাস আবার কোথাও-বা দুই মাসব্যাপীও বৈশাখি মেলা চলে। সারা বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই কোনো না কোনো স্থানে বৈশাখি মেলা বসে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, যশোর, বরিশালসহ আরো অনেক জেলায় পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে মাসব্যাপী বৈশাখি মেলা চলতে থাকে।

উত্তরবঙ্গের উল্লেখযোগ্য বৈশাখি মেলার মধ্যে দিনাজপুরের আমবাড়ির মেলা, বগুড়ার গাঙনগরমেলা, যশোরের নিশিনাথ তলার মেলা, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা-বিত্তিপাড়ার ঘোড়াপীরের মেলা এবং বরিশালের বাকালের মেলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ।

কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়ার চান্দনা গ্রামের বৈশাখি মেলা ছিল বিখ্যাত। এই মেলার আড়ম্বর, জাঁকজমক অন্যান্য মেলার চেয়ে বেশি হতো। এছাড়া, কুমিল্লা জেলার সিদলাই, কান্দুঘর, ময়নামতিসহ বিভিন্ন স্থানে বৈশাখি মেলার ঐতিহ্যের সুখ্যাতি রয়েছে। এ অঞ্চলে বৈশাখি মেলায় বিক্রির জন্য বাঁশের বাঁশি তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘর, গোকর্ণঘাট, নবীনগর, খড়মপুর প্রভৃতি স্থানে বৈশাখি মেলা বসে।

চট্টগ্রামে বৈশাখী মেলার অন্যতম পর্ব ‘জব্বারের বলীখেলা’। একদিনের এই বলীখেলা উপভোগ করতে সমবেত হয় অসংখ্য মানুষ। চৈত্রের শেষে চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা আয়োজন করে ‘মহামুনির মেলা’। এই মেলা বর্ষবরণেরই অংশ। চট্টগ্রামের আদিবাসী মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসব পরিচিত সাংগ্রাই, বিঝু বা বিষু নামে। এই উৎসব উপলক্ষেও মেলা জমে ওঠে।

বর্তমানে প্রচলিত বৈশাখিমেলার তালিকা প্রণয়ন ও তার সম্পূর্ণ বিবরণসহ আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্রে নথিভুক্ত করা জরুরি। ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিম-লে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এই বৈচিত্র্যময় রূপ তুলে ধরতে পারলে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের সময় এদেশে যেমন প্রচুর বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটতো, তেমনি নতুন প্রজন্ম বৈশাখি মেলার ঐতিহ্য সুরক্ষায় সচেতন হতো।

বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতো এবং বৈশাখি মেলায় অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা উদ্ধুদ্ধ হতেন ঐতিহ্যপ্রেমে। এমনকি এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির সাধনা বিস্তার ঘটতো এবং বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তো।

লেখক: বিশিষ্ট লোক-ঐতিহ্য গবেষক, নাট্যকার ও উপ-পরিচালক, সংস্কৃতি উপবিভাগ, বাংলা একাডেমি। 

;

কায়মনে বাঙালি হবার বড়ো অনুপ্রেরণার উৎস বাংলা নববর্ষ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



ড. আতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৬৭ সনে রমনার বটমূলে এই অনুষ্ঠানের সূচনা ছায়ানটকে বৃহত্তর জনসম্মূখে আনতে সাহায্য করেছে। এ কথা তো সত্যি রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সংস্কৃতিকে হিমালয়ের মতো রক্ষা করে চলেছেন। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই বলে এসেছেন যে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে হলে এর ভেতরের শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে সমাজে, সংস্কৃতিতে। তাই বাঙালির উৎসবগুলোর পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন তিনি। গ্রামীণ মেলাগুলো পরিচালনা করতে তিনিই বলেছেন।

এর ফলে বাঙালির সামাজিক বন্ধন পোক্ত হবে বলে তিনি মনে করতেন। সেই অভিপ্রায়েই ছায়ানট বাঙালির নিজস্ব ‘শুভ নববর্ষ’ উদযাপনের এই আয়োজনের সূত্রপাত করে। বলা যায় ছায়ানট রবীন্দ্রনাথের সেই জাগরণের অগ্রগামী এক প্রতিষ্ঠানের নাম। এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনের ভাবনাটির কথা সনজীদা খাতুন এভাবে জানিয়েছেন, “আমরা এক সময় ‘শ্রোতার আসর’ নামে একটা অনুষ্ঠান করতাম। গান শুনিয়ে আমরা ‘অতীতচারী’ করতে চাইতাম। সেইসব গান বাঙালির বলে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে দেখা গেল, আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। কারণ শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তখন শুধুমাত্র ঐ বুলবুল একাডেমী ছিল। সেইজন্য আমরা একটা স্কুল করা দরকার বলে মনে করতাম। ... গান মানুষের জীবনে সংস্কৃতির বড় একটা ছাপ ফেলে।” 

সেই ছায়ানট এখন এক মহিরূহে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া জমিতে সকলের প্রচেষ্টায় এক কর্মচঞ্চল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নাম ছায়ানট। এর সঙ্গে সম্পূরক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাঙালির মননকে সিক্ত করে চলেছে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ। এই পরিষদের সাথে আমি গভীরভাবে যুক্ত। সারাদেশে রবীন্দ্রচর্চা ও রবীন্দ্রসংগীত প্রসারে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।

এই সংস্কৃতিভবন উদ্বোধনের দিন প্রয়াত ওয়াহিদুল হক বলেছিলেন, “নগরের মানুষদের অসাম্প্রদায়িক করার আন্দোলনে ছায়ানট খানিকটা সফল হয়েছে। এবারে গ্রামের সাধারণ মানুষকেও শুদ্ধ সংস্কৃতির পরশ দিতে হবে। সকলকে সঙ্গে নিতে পারলে সম্পূর্ণ বাঙালি হওয়া যাবে।”

সুদীর্ঘ তিপ্পান্ন বছরে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। রমনা বটমূলের এই নববর্ষ উদ্যাপন এখন সারা দেশ এবং বাঙালি অধ্যুষিত বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ বাঙালি বাংলা নববর্ষে পথে নেমে পড়ে। নুতন জামা-কাপড় পড়ে এক উজ্জ্বল সকালে তাদের আনন্দঘন উপস্থিতি বাঙালির অস্তিত্বের জানান দেয়। পাশাপাশি চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের এক অসাধরণ অগ্রযাত্রার প্রতীক বাঙালির এসব আয়োজন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্প্রতি ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের আলোর পথযাত্রাকে পুরোনো সেই সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহ অন্ধকারাচ্ছন্ন করতে চাইছে। কোমলমতি তরুণদের বিভ্রান্ত করে ফেলতে চাইছে। অথচ সেই কতো আগে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোন বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। মানুষ বলেই মানুষের যে মুল্য সেইটেকেই সহজপ্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি।” (রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৬৬৬)। বড়ই দুর্ভাগ্য আমাদের পাঠক্রম নির্ণয়েও ধর্মীয় বিভেদ বিতর্ক আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনকে কুলষিত করে চলেছে।

এমন বিভেদকে ঠেকানোর একটা বড়ো উপায় হতে পারে সংগীত চর্চা। কেননা, সংগীতই পারে জীবনের অসামঞ্জস্যগুলোর অবসান ঘটিয়ে এক নয়া পারসপেকটিভ দিতে। সংগীত শিল্পের এই অসাধারণ ক্ষমতার কথা রবীন্দ্রনাথই তাঁর ছিন্নপত্রে বলে গেছেন ।

কিন্তু সংস্কৃতির এই সক্ষমতার কথা অনুদার বিভেদকামীরাও জানে। তাই তো এই বটমূলেই নিক্ষিপ্ত হয়েছিল মানবতা বিধ্বংসী বোমা। সংস্কৃতি প্রিয় কয়েকজনের প্রাণ যায় ওই বোমা হামলায়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই আমিও। যেখানে বোমাটি পড়েছিল সেখানেই দাঁড়িছিলাম সস্ত্রীক আমি। তাড়া ছিল বলে মাত্র কয়েক মিনিট আগেই সেখান থেকে বের হয়েছিলাম আমরা। তবে উদার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আক্রমণ কিন্তু এখনও থামে নি।

প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে মানবতার শত্রুরা বড়ই সোচ্চার এই ক্ষণে। আর সে কারণেই মুক্তমনা মানুষের শক্তি সঞ্চয়ের উৎস হতে পারে বাঙালির পহেলা বৈশাখ উদযাপন। আশার কথা স্বদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করা হচ্ছে বেশ জোরেসোরেই। এ বছর নিউইর্য়কের টাইমস্কোয়ারে সহ¯্র কণ্ঠে উচ্চারিত হতে যাচ্ছে পহেলা বৈশাখের গান। বাংলা নববর্ষের আয়োজন সারা বিশ্বেই এখন প্রবাসীদের মনে ফেলে আসা বাংলা মায়ের জন্য বিশেষ দরদ ও আকর্ষণ বাড়ায়। কায়মনে বাঙালি হবার, সম্পূর্ণ বাঙালি হবার অসাম্প্রদায়িক বাঙালি হবার বড়ো অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে বাংলা নববর্ষ।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু গবেষক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

;