বাংলা নববর্ষ ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য



ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম
বাংলা নববর্ষ ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য

বাংলা নববর্ষ ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পহেলা বৈশাখ। শুভ নববর্ষ। বৈশাখের উৎসব সার্বজনীন। এটা বাঙালির উৎসব। বর্ষ বরণের উৎসব প্রতিটি দেশেই আছে। ১৯৫২ সালের ১লা বৈশাখে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় কিশোর কিশোরীদের বাংলা নববর্ষ জানাতে লিখেছিল: “ আজ ১ লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের সূচনা হল আজ। এই নূতন দিনটিতে প্রাণভরা শুভেচ্ছা জানাচ্ছি তোমাদের। বাংলা তারিখ গণনাকে আমরা অনেকেই প্রায় ভূলে যেতে বসেছিলাম। ইংরাজের অধীনে থেকে থেকে ইংরাজী আদব কায়দা রফত করার সাথে সাথে আরো অনেক কারণে বাধ্য হয়েই ইংরাজী সনকে আমরা দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়েছিলাম। বাংলা সন মাস কালের অনুসন্ধান গ্রাম্য পন্ডিতদের পাঁজি পুথির ভেতরেই প্রায় সীমাবদ্ধ হতে চলেছিল। কিন্তু এই বাংলা মাস ও সালের পেছনে আমাদের যে অন্তরের যোগ, তা কিছুতেই মুছে যাবার নয়।… আমাদের মনের মাঝে উকি দেয় বাংলা মাসগুলোর আগমনবার্তা। কিন্তু নতুন বছর কেবল এই দিক দিয়েই নতুন নয়। বাংলা ইংরাজী যে কোনো মাসই হোক না কেন, তার প্রথম দিনটিতে আমাদের মনপ্রাণ ভরে দেয় নতুন উৎসাহ, নতুন উদ্দীপনা।” ( দৈনিক আজাদ ১৪ এপ্রিল ১৯৫২)

বাংলাদেশের মানুষ উৎসব প্রিয় । নানান রকমের উৎসব আমাদের জাতীয় জীবনে জড়িয়ে আছে। তেমনি বাংলা নববর্ষ আমাদের আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের দাবীদার । বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর আর্থ সামাজিক কাঠামোর সাথে বাংলা দিনপঞ্জীর সম্পর্ক গভীর। এখনো এদেশের কৃষকরা বাংলা তারিখের হিসেবেই বীজ বোনে, ফসল কাটে। বাংলা সনের প্রবর্তন কবে হয়েছিল, কে তার প্রবর্তক তা নিয়ে নানান বিতর্ক রয়েছে। তবে বাংলা সন সৃষ্টির পেছনে দুইজন মুসলমান শাসকের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এদের একজন সুলতান হোসেন শাহ ও অন্যজন মোগল সম্রাট আকবর। তবে অধিকাংশের মতামত হলো মোগল সম্রাট আকবরই বাংলা সনের প্রধান প্রবর্তক।

প্রাচীনকাল থেকে ভারতে বহুলভাবে প্রচলিত ছিল শকাব্দ। যেটা গণনা শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টিয় ৭৮ সাল থেকে এবং এটি ছিল সৌরমাস। এছাড়া আরো ছিল বিক্রমাদিত্য প্রবর্তিত সম্বৎ বা অব্দ। এটিও খ্রিষ্টিয় সন গণনার ৫৭ বছর আগে প্রবর্তিত ছিল। কিন্তু বাংলা প্রদেশে প্রচলিত ছিল মঘী সন, ত্রিপুরাব্দ, এবং লক্ষণাব্দ। মঘীসন: ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে এ সনের শুরু। বাংলা সন থেকে ৪৫ বাদ দিলে মঘী সন পাওয়া যায়। ত্রিপুরাব্দ : খ্রিষ্টিয় সন থেকে ৫৯০ বাদ দিলে ত্রিপুরাব্দ মিলে। লক্ষণাব্দ : ১১৭৮ খ্রিষ্টিয় সন থেকে লক্ষনাব্দ শুরু। বাংলা প্রদেশের সনগুলি ছিল কৃষি রীতি ভিত্তিক। বিশেষ করে ফসল বোনা, বাৎসরিক ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগের দিনক্ষণ গণনা, খাজনা দেয়া ইত্যাদি কাজে ব্যবহার হতো।

১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট আকবর সিংহাসন আরোহনের পর ভারতের বিভিন্ন সুবা বা প্রদেশের খাজনা আদায়ের দিন তারিখের একটি অভিন্ন সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেন। তিনি লক্ষ করলেন চান্দ্র বৎসরের গণনানুযায়ী সৌর বছরের সাথে দিনের পার্থক্য অনেক। ফলে চান্দ্র বৎসরের রীতি অনুযায়ী বছরেররাজস্ব আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট দিন ধার্য করা সম্ভব ছিল না। সেকালে ফসলে রাজস্ব আদায় করা হতো। কোনো কোনো বছর ফসল তোলার আগেই খাজনা দেবার দিনটি এসে যেত। এতে করে প্রজারা খাজনা দিতে অসুবিধার সম্মুখীন হত। সম্রাট আকবর প্রজা সাধারণের এই অসুবিধা দূর করার জন্য নতুন সন প্রবর্তনের চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবেরর শাসন ক্ষমতা গ্রহণের সময় হিজরী সন ছিল ৯৬৩। আর এ বছর থেকেই তিনি হিজরী সনকেই সৌর সনে পরিবর্তিত করে বাংলা সন চালু করেন। বাংলা প্রদেশ ছাড়াও অন্যান্য প্রদেশে নতুন সন প্রবর্তন করা হয় যেমন উড়িষ্যাতে আমলি সন, বিলায়েতি সন, সুরাসানি সন ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো এতটা জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। ব্যতিক্রম শুধুমাত্র বাংলা সন, যা প্রচলিত হয় বাংলাদেশ ও জাতির নামে এবং নতুন এই সন ‘বঙ্গাব্দ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

পহেলা বৈশাখ কিংবা বাংলা বৈশাখ মাস এদেশবাসীর নিকট ব্যাপকভাবে পরিচিতি পায় নবাবী শাসনামলে, বিশেষ করে নবাব মুর্শিদ কুলী খানের সময়। তিনি বাংলার কৃষকের নিকট বৈশাখ মাসকে খাজনা দেয়ার নির্দিষ্ট মাস শুরু করায় এতে নতুন মাত্রা যোগ হয় । নবাব মুর্শিদ কুলী খানের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থা বৃদ্ধি করা। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত হবার সময় তিনি লক্ষ করলেন বাংলার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাতে অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে। সুবা বাংলা বা বাংলা প্রদেশের তিনি ভূমি রাজস্ব বিভাগের আমূল সংস্কার করলেন। তাঁর ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল একদিকে ভূমি থেকে যতবেশী সম্ভব রাজস্ব আদায় অন্যদিকে কৃষকদের সন্তুষ্ট রাখা। এছাড়াও আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি এবং কৃষি উৎপাদরে উন্নতি বিধানের চেষ্টা করলেন। মুর্শিদকুলি খান বাংলার সকল আবাদী ও অনাবাদী জমি জরিপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তি বিশেষে হিসেব না করে জমির উৎপাদন ক্ষমতা অনুসারে রাজস্ব ধার্য করেন। এক একটি জমির বিবরণের লিপিবদ্ধকরণেরপাশাপাশি কৃষকদের নাম ঠিকানাও লিখে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তখন। পাশাপাশি কৃষকরা কি পরিমাণ কর দিয়েছে
সেটাও যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন।

সম্রাট আকবরের সূত্র ধরেই বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলি খান খাজনা আদায়ে প্রজাদের অনুরোধে বৈশাখের প্রথমদিনে পুন্যাহ রীতি চালু করেন। প্রজারা এ দিনে খাজনা দিতে আসতেন এবং পরবর্তী নতুন বছরের জন্য জমি পত্তন নিতেন। এই উপলক্ষে জমিদারগণ প্রজাদের খাজনা আদায়সহ নানা ধরণের সুস্বাদু মহাভোজের আয়োজনের ব্যবস্থা করতেন। নবাব মুর্শিদ কুলি খানের এই প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল। ১৭০২ সাল থেকে তিনি প্রতি বছর নিয়মিতভাবে বাংলা প্রদেশ থেকে রাজস্ব হিসাবে মোগল বাদশাহকে ১ কোটি টাকা করে পাঠাতে থাকেন।

উপনিবেশিক শাসনামলে বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ঘটে পহেলা বৈশাখের। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংযোজন হয় হালখাতা নামের এক অনুষ্ঠানের। এই অনুষ্ঠানটি ছিল মূলত ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ও লাভজনক পদ্ধতির একটি নতুন কৌশল। সারা বছর ক্রেতারা বাকিতে কেনাকাটা করে বছরের নতুন দিনে অর্থ্যাৎ পহেলা বৈশাখে পাওনা পরিশোধ করবে। বিনিময়ে ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের সুস্বাদু মিষ্টি এবং খাবারের ব্যবস্থা করতেন। হালখাতার মাধ্যমে ছোটখাট অনুষ্ঠান বাঙালি সাংস্কৃতিক জীবনকে আকর্ষণীয় করে তোলে। হালখাতার প্রসঙ্গটি সবার জীবনেই নানাভাবে দোলা দেয়। ঠিক যেভাবে কবি সিকানদার আবু জাফরের স্মৃতিতে ধরা দিয়েছে। পহেলা বৈশাখ এবং হালখাতাকে তিনি চিত্রিত করেছেন এভাবে-
“ ছেলেবেলায় কিন্তু পয়লা বৈশাখের ওপরে আমার একটা বিশেষ মোহ ছিলো। কারণটা এমন কিছু জটিল নয়। স্কুল যেখানে বসত, তার পাশেই ছিল বাজার। পয়লা বৈশাখে বাজারের দোকানে হত ‘ হালখাতা’। হালখাতা জিনিষটা বুঝতাম না, বুঝবার কোনো আগ্রহও ছিলো না। তবে হালখাতা উপলক্ষে দোকানদাররা যে মিষ্টি খাওয়াত গ্রাহক অনুগ্রাহকদের, সেটাই ছিল পয়লা বৈশাখ সম্বন্ধে আমার মোহ এবং হালখাতা সম্বন্ধে আমার জ্ঞানের শেষ সীমানা। হাড় কৃপণ সাধু ময়রা পর্য্যন্ত সেদিন দাম না নিয়ে দু’একটা কদমা অথবা দু’চারখানা গজা অম্লান বদনে খাইয়ে দিত। তখন এইটুকু সৌভাগ্যের জন্যেই পয়লা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে দ্বিধা হয় নি।” ( সিকানদার আবু জাফর, হালখাতা, দৈনিক আজাদ ,১৫ এপ্রিল ১৯৫৫)

কালক্রমে এভাবে পহেলা বৈশাখ আর নববর্ষ আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনধারার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। বৈশাখের এ ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে জমে উঠে বৈশাখী মেলা ও উৎসব। নতুন উৎসবের আনন্দে মুখর হয়ে উঠে সমগ্র বাংলাদেশ।

সাম্প্রতিক সময়ে পহেলা বৈশাখ, বর্ষবরণ এগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের অনুষঙ্গে আরও আনন্দময় হয়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি কারণে। প্রথমত এটি সরকারি ছুটির দিন এবং উৎসব পালনের জন্য ভাতা পাওয়া। পহেলা বৈশাখকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণার দাবি আসে সেই পাকিস্তান আমলেই। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হলে শেরে বাংলা ফজলুল হক পহেলা বৈশাখ দিনটিকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয়, বাঙালি হিসেবে বাংলা নববর্ষ বরণে তাঁর দেয়া বাণীও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
১৯৫৪ সালের পহেলা বৈশাখে পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক তিনি সেদিন যে বাণী দিয়েছিলেন তাতে একজন বাঙালি হিসেবেই সমগ্র বিশ্ববাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। তাঁর বাণীতে উল্লেখ করেছিলেন:
“ আজ (বুধবার) বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। এই উপলক্ষে আমি আমার একান্ত প্রিয় পূর্ব্ববঙ্গবাসীদিগকে জানাইতেছি আন্তরিক অভিনন্দন। আর তাহাদের পক্ষ হইতে পশ্চিম পাকিস্তানের ভ্রাতৃবৃন্দকে জানাইতেছি প্রীতি ও ভালোবাসা এবং বহির্ব্বিশ্বের জনসাধারণকে শুভেচ্ছা। নূতন পরিবেশে আমাদের যাত্রা হইল শুরু। পুরাতনকে পশ্চাতে ফেলিয়া নবযুগ প্রবর্ত্তনের সঙ্কল্প লইয়া আমরা নববর্ষে পদার্পণ করিলাম।” ( দৈনিক আজাদ, ১৪ এপ্রিল ১৯৫৪)

বাংলা নববর্ষ বাঙালির আত্মঅহংকার এবং গর্বের বিষয়। তবে বাংলা সন হিসেবে ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বাংলা সনেই বাঙালি ঝাপিয়ে পড়েছিল মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য। রুখে দিয়েছিল পাকিস্তানী হানাদারবাহিনীকে। ১৩৭৯ বঙ্গাব্দকে বরণ করতে গিয়ে ১লা বৈশাখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বাণী দিয়েছিলেন সেখানে উল্লেখ করেছিলেন- “ আজ ‘ পয়লা বৈশাখ’। বাংলা ১৩৭৮ সালের অতীত দু:খ যাতনা এবং ত্যাগের লয়প্রাপ্ত অধ্যায় শেষ করে আজ ১৩৭৯ সালের শুভ যাত্রা শুরু। অনন্ত নীল সীমায় পাড়ি জমিয়েছে আরেকটি বছর, তবে বহুবিধ কারণে এ বছরটি মানব ইতিহাসে চিরভাস্বর ও অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ এ বছরটিতেই সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর প্রিয় মাতৃভূমি আমাদের বাংলাদেশ ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে নিজস্ব আসন প্রতিষ্ঠিত করেছে।”

আমাদের বাংলা নববর্ষকে আরও আনন্দময় করে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো চালু হয় পয়লা বৈশাখের উৎসব ভাতা।১৪২৩ বঙ্গাব্দ হতে ‘ বাংলা নববর্ষ ভাতা’ প্রবর্তিত হয়েছে। যা বাংলা নববর্ষ পালনে উৎসাহ সৃষ্টি করেছে।
বাংলা নববর্ষের আরেকটি আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা শহরের শাহবাগ রমনা এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের আয়োজন এখন দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই আনন্দ শোভাযাত্রায় চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। এছাড়াও বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ, বিভিন্ন রঙ-এর মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়। এটি এখন বাংলাদেশের নববর্ষ পালনে নতুন সর্বজনীন সংস্কৃতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০১৬ ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করেছে।

মানুষের জীবনে যেমন সুখ দু:খ একে অপরের সাথী। জাতীয় জীবনেও তাই। সুখ দু:খ চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে আসে যায়। পহেলা বৈশাখের উৎসব কে নিয়েও আমাদের জাতীয় জীবনেও আজ এক অচিন্তনীয় সন্দেহের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে। পরস্পর পরস্পরে অবিশ্বাস ও অহেতুক ঘৃণা ও হিংসার যে মনোভাবের অভিব্যক্তি তা সুস্থ জাতীয় জীবনের অপমৃত্যু। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই এই জনপদে গড়ে উঠেছে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি এবং কালক্রমে আমরা পেয়েছি স্বাধীন ভূখণ্ড। বাঙালির সমৃদ্ধযাত্রায় কালক্রমে এটি আরো বিকশিত হবে, নানান বাধা উপেক্ষা করেও।

বাঙালি সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আরো পরিস্কার হওয়া উচিত। কেননা এটা বাঙালি সংস্কৃতির একটি গৌরবোজ্জ্বল দিক। আজকের এই পহেলা বৈশাখে, আধুনিক প্রযুক্তিময় বিশ্বের প্রেক্ষাপটে আমাদের সংস্কৃতিকে আরও উর্ধ্বে তোলা ধরার চেষ্টা করা উচিত। দেশজ সংস্কৃতি যদি প্রাণ ফিরে পায় তাহলেই প্রকৃত বাংলাদেশকে আমরা বিশ্বে তুলে ধরতে পারবো।

লেখক: অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

   

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

  • Font increase
  • Font Decrease

মানবিকভাবে বিপর্যস্ত গাজ়ার ঘটনাবলি ইসরায়েল সম্পর্কে কয়েকটি মারাত্মক বিষয় উন্মোচিত করেছে। কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বিশ্ববাসীকে। যেমন: ১. গণহত্যা কাকে বলে, ২. নব্য-বর্ণবাদের স্বরূপ কেমন, ৩. জাতিগত হিংসার নৃশংস চেহারা কত ভয়াবহ।

এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে, বাস্তব গবেষণাগার ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায়, যেখানে প্রশ্নগুলোর ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস‘ বা ‘মডেল টেস্ট‘ করছে, ইসরায়েল। রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের ইসরায়েলি পাইলট প্রজেক্ট তথাকথিক মুক্ত-গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিকারহীনভাবে দেখছে। আরব তথা মুসলিম বিশ্বও এত বড় একটি গণহত্যার বিষয়ে নির্বিকার। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা‘ (প্রকাশক: শিশুকানন/রকমারি) শিরোনামে আমার প্রকাশিত বইটিতে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পটভূমিতে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ও জায়নবাদী নীতির ঐতিহাসিক ধারাক্রমের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সময়ে গণ-নিষ্ক্রমণের ছবিটা বাস্তবে আসলে কেমন হয় আর প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, বা রাষ্ট্র, বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, এসব কথাও আলোচিত হয়েছে।

বাস্তবে ইসরায়েলের হিংস্রতা কল্পনার দানবকেও হার মানিয়ে গেছে। ‘গাজায় গণহত্যা বন্ধ হবে‘, মানবিক বিশ্বের এমন শুভ-আশাকে দুরাশায় পর্যবসিত করেছে, ইসরায়েল। গত অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছেন মোট ৩২ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৭৪ হাজার ২শ ৯৮ জন। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমায় গড়ে নিহত হচ্ছেন ১০০ জন এবং আহত হচ্ছেন ১৫০ ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২২ লাখ বাসিন্দার ৮৫ শতাংশ।

গাজায় ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন’ সংঘাতকে 'যুদ্ধ' বলা হচ্ছে। আসলে তা মোটেও ‘যুদ্ধ’ নয়, স্রেফ ‘গণহত্যা’। যুদ্ধে সৈন্য মারা যায়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাজায় মরছে সাধারণ মানুষ, জনতা। জনতাকে বেপরোয়া হত্যা করা যুদ্ধ নয়, নগ্ন গণহত্যা। যুদ্ধের ছদ্মাবরণে গণহত্যায় মেতে গত ৭৫ বছর ইসরাইল নব্য-বর্ণবাদী আগ্রাসন, জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, যার সর্বসাম্প্রতিক হিংস্রতম পর্যায় চলছে গাজায়। সেখানে অসুস্থ রোগী, ডাক্তার, শিশু, বৃদ্ধ, নারী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। খ্রিস্টানদের বড়দিনে এবং মুসলমানদের  রমজান মাসের পবিত্রতাকেও পরোয়া করা হচ্ছে না। রমজানে গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে, জায়নবাদী ইসরায়েলি বাহিনী। বুলেটের আঘাতে আর খাদ্য, পথ্য ও ঔষধের অভাবে মরছে মানুষ গাজা উপত্যকায়।

বিশ্বের ইতিহাসে, সভ্যতার পথ-পরিক্রমায়, এমনকী, যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরেও যা ঘটেনি কোনোদিনও, তেমন অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও অদৃশ্যপূর্ব বর্বরতা-নারকীয়তা প্রদর্শন করছে ইসরায়েল। জীবিত মানুষদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের পর লাশের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়েছে। এতদিন ইসরাইলি নৃশংসতা ছিল জীবিত গাজাবাসীর ওপর। এবার তা-ও অতিক্রম করেছে। কমপক্ষে চারটি মৃতদেহ ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়ে তা থেঁতলে দিয়েছে।

বীভৎস, ন্যক্কারজনক এই ঘটনা ঘটছে মুসলিমদের ঘরের ভিতরে, চোখের সামনে। চারপাশে মুসলিম দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, ইরান, ইরাক, কাতার, তুরস্কসহ আরও কত দেশ। তারা কীভাবে এই নৃশংসতাকে সহ্য করছে!

সহ্য করছে, রাজনৈতিক স্বার্থগত কারণে। অধিকাংশ আরব দেশই স্বৈরশাসকের কব্জায় রয়েছে, যারা টিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ইচ্ছায়। মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও শক্তি আরব দেশগুলোর নেই। অনুগত দাসের মতো তারা মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গণহত্যার দর্শক হয়ে আছে। আরব দেশগুলোর এই হলো বাস্তবচিত্র।

তুরস্ককে বেশ সাহসী ও উদ্যোগী মনে করা হলেও বাস্তবে তুরস্ক কৌশলজনক অবস্থানে থেকে ‘না ধরি মাছ, না ছুঁই পানি‘ নীতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখছে। নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায় না তুরস্ক। 

বাদ থাকে ইরান। ইরান ও তার সহযোগী সিরিয়া, লেবানন ও ইয়ামেনের কিছু গ্রুপ মাঝে মাঝে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান নিজে মাঠে নামছে না। নানা গ্রুপকে কাজে লাগাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ-ইসরায়েল সমর্থনের বিপরীতে রাশিয়া ও চীন সুস্পষ্ট কোনো ভূমিকা নিয়ে সংঘাতের অবসানে কাজ করছে না। তারা নিজ নিজ স্বার্থ ও কৌশলের আলোকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বড় ও শক্তিশালী দেশ দুটি ফিলিস্তিনে গণহত্যার ঘটনায় মোটেও কাতর হচ্ছে না এবং বাস্তবক্ষেত্রে ইসরায়েলকে বিন্দুমাত্রও অসন্তুষ্ট করছে না।

বস্তুতপক্ষে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ হলেও মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি জাতি (আরব, তুর্কি, ইরানি) আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য  পারস্পরিক লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ঐক্য ও সংহতিতে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়েছে, যার ফায়দা লুটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে এবং পশ্চিমাদের দোসর ইসরায়েল একতরফাভাবে ফিলিস্তিনে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার মাধ্যমে। আর  অধিকাংশ আরব দেশই অবৈধ শাসকের অধীনে থাকায় বৈধতার অভাবের জন্য কোনো পদক্ষেপ তো দূরের বিষয়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। 

রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে দুর্বলতা। ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানের মধ্যেই তীব্র ‘আবেগ‘ আছে, কিন্তু ‘অনুধ্যান‘ নেই। 'অনুধ্যান' শব্দটি আমি এখানে খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি, যার অর্থ: সর্বদা চিন্তা বা স্মরণ, শুভচিন্তা, নিরন্তর চিন্তা, অনুচিন্তন, সর্বদা স্মরণ, সর্বদা ধ্যান করা। অনুধ্যান শব্দে অর্থ ও প্রতিশব্দগুলো ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হচ্ছে না। চিন্তা ও গবেষণায় ফিলিস্তিনের ঘটনাবলি এবং সেখানকার গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ ও জাতিগত হিংসার জায়নবাদী চক্রান্তের বিষয়গুলো উন্মোচিত করা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। ফিলিস্তিন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অনুধ্যান বাড়ছে না।

বরং আমজনতা ও নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিন প্রশ্নে কাজে লাগিয়েছে আবেগকে। প্রচণ্ড আবেগে মিছিল, সমাবেশ, দোয়া করার পর অনেক দিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ মেরে থাকাই হলো নির্মম বাস্তবতা। এমনটি কতটুকু সঠিক, তা চিন্তার বিষয়। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুচিন্তিত কার্যক্রমের দ্বারা ইসরায়েল যা করে চলেছে, তা ধারাবাহিক গবেষণা-অধ্যয়নের পথে গভীরভাবে অনুধ্যান ও আত্মস্থ করাই ছিল জরুরি। তাহলেই আবেগ আর যুক্তির সমন্বয়ে বিপন্ন-নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং জায়নবাদী, বর্ণবাদী ইসরায়েলের জাতিগত হিংসা ও গণহত্যার অর্থবহ প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;