ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৬



মাহফুজ পারভেজ
ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৬

ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৬

  • Font increase
  • Font Decrease

[ষষ্ঠ কিস্তি]

"আমার নাম ক্যাভিন। আমি মার্কিন দেশের বাসিন্দা, যে দেশ এক সময় ছিল রাশিয়ার ঘোরতর শত্রু। আমার পূর্বপুরুষের ভিটা ভূমধ্যসাগরের তীরে, রুশ ও মার্কিন দেশের মাঝখানের একটি দেশে। কিন্তু আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা মার্কিন দেশে। জন্ম থেকেই জেনেছি রুশরা গণতন্ত্রের শত্রু, আমাদের মিত্র নয়। তবু আমি রুশ দেশকে ভালোবেসেছি প্রধানত তাদের সাহিত্যিকদের জন্য।"

মহান সাধক ও মরমী কবি জালালউদ্দিন বলখি রুমির একটি কথা ক্যাভিন সুযোগ পেলেই বলতো। কথাটি ম্যারি কানে এখনো বাজে, "What you seek is seeking you."

আসলেই তো, "আপনি যা খুঁজছেন তা আপনাকেই খুঁজছে", রুমির এই কথাটি ক্যাভিনের ক্ষেত্রে শতভাগ সত্য। ম্যারি নিশ্চিত, ক্যাভিন যেমন রুশ দেশের আত্মার অন্বেষণ করছে, সেদেশও ক্যাভিনকে খুঁজছে। সেইসব আত্মান্বেষী কথায় ভরপুর ক্যাভিনের বইটি।

ক্যাভিন লিখেছে আত্মজীবনীর শৈলীতে, বইয়ের সূচনার লাইনগুলো:

এক সময়ের বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়নের বড় অংশ আজকের রাশিয়ার মাত্র ছয় জন নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেলেও পুরস্কার পেতে পারতেন আরও অনেক সাহিত্যিক। রাজনৈতিক কারণে নোবেল পাওয়া ও না-পাওয়া রুশ সাহিত্যিকের তালিকাটি দীর্ঘ। এ কথা বলার কারণ হলো, 'রুশরা বিশ্বের সবচেয়ে পড়ুয়া জাতি' হিসেবে স্বীকৃত। আমি এই সত্যের স্বীকৃতি দিচ্ছি।

আমার বক্তব্যের দৃষ্টান্ত নিন। রুশ দেশের ইভান বুনিন (১৯৩৩), বরিস পাস্তারনাক (১৯৫৮), মিখাইল শলোখভ (১৯৬৫), আলেক্সান্দার সোলজেনিৎসিন (১৯৭০), জোসেফ ব্রডস্কি (১৯৮৭) এবং সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ (২০১৫) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

রুশ লেখকদের মধ্যে এমন আরও বহুজন আছেন, যারা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। অথচ তারা নোবেল পুরস্কার পাননি। যেমন তাদের মধ্যে লিও তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০) এবং ম্যাক্সিম গোর্কি ( ২৮ মার্চ ১৮৬৮-১৮ জুন ১৯৩৬) অন্যতম।

'মা' উপন্যাসের জন্য গোর্কি বিশ্ববিশ্রুত। রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অন্যতম সাহিত্য প্রতিভা গোর্কির অবস্থান রুশ ও বিশ্ব সাহিত্যে অসামান্য; অবদান অপরিসীম। গোর্কির প্রসঙ্গে আলোচনাকালে আমরা দেখতে পাব সুপ্রাচীন রুশ সাহিত্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ দিগন্তরেখা।

আধুনিক রুশ সাহিত্যের গোড়াপত্তন হয় মধ্যযুগে, যদিও রুশদের রয়েছে প্রাচীন মহাকাব্য, লোককথা, রূপকথা ও ইতিবৃত্ত।

রুশ আধুনিক সাহিত্যের আলোকিত যুগ বলে গণ্য করা হয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরবর্তীকালকে। বিশেষত ১৯৩০-এর দশকের শুরুর দিকে রুশ সাহিত্যের সুবর্ণ যুগ শুরু হয়। এ সময় কাব্যিক প্রতিভা ভাসিলি ঝুকভ্‌স্কি ও পরে তাঁর দ্বারা প্রভাবিত আলেক্সান্ডার পুশকিন কাব্যচর্চায় নেতৃত্ব দেন।

এ সময়ে গদ্যও বিকাশ লাভ করে, যার পুরোধা ছিলেন 'প্রথম মহান রুশ ঔপন্যাসিক' নামে প্রসিদ্ধ নিকোলাই গোগোল। পরবর্তীতে আসেন ইভান তুর্গেনেভ, যিনি ছোটগল্প ও উপন্যাসে আলোড়ন আনেন। তারপর গোর্কি, লেভ তলস্তয়, ফিওদর দস্তয়ভস্কি প্রমুখ লেখক রুশ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন।

আন্তন চেখভ উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ছোটগল্পে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে অন্যতম প্রধান নাট্যকার হয়ে ওঠেন। মায়াকভ্স্কি নব্য বাস্তবতা নিয়ে কাজ করেন। তার রচনা 'ওড টু দ্য রিভলূশন ও লেফট মার্চ' (১৯১৮) কাব্যে নতুনত্ব নিয়ে আসে।

নিকোলাই অস্ত্রভস্কি'র 'কাক' উপন্যাসে তাঁরই কষ্টদায়ক জীবনীচিত্র ধারণ করা হয়েছে। উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র পাভেল কর্চাগিন রুশ সাহিত্যের এই 'তরুণ বীর'-এর প্রতিচ্ছবি, যে রাজনীতিতে তার জীবন উৎসর্গ করে তার দুঃখগুলো অতিক্রম করে। উপন্যাসটিতে সারা বিশ্বের তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণা ছিল, যা রাশিয়ার স্বদেশপ্রেমী যুদ্ধে গতিশীল ভূমিকা পালন করে।

সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা যখন রুশ সাহিত্যের প্রধান উপজীব্যে পরিণত হয়, তখন তার নেতৃত্ব দেন গোর্কি। তিনি ছিলেন সে সময়ের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, যিনি তার কালজয়ী 'মাত' (মা) উপন্যাস এবং 'দ্য এনেমিস' নাটক দিয়ে এই ধারার ভিত্তি স্থাপন করেন।

গোর্কির আত্মজীবনীমূলক ত্রয়ীতে সমাজের দরিদ্রতর স্তর থেকে তাঁর রাজনৈতিক বিবেকের উন্নয়নের উত্থান বিবৃত হয়েছে। তাঁর উপন্যাস 'দ্য আর্তামানভ বিজনেস' (১৯২৫) ও নাটক 'এগর বুলিশভ' (১৯৩২) রুশ সামন্ত শ্রেণির পতনকে চিত্রায়িত করে।

গোর্কি সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাকে 'পৃথিবীর পুনঃগঠনরত জনগণের বাস্তবতা' বলে উল্লেখ করেন। গোর্কির সাহিত্যকর্ম রাশিয়ার সাহিত্যিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। তিনি পরিণত হন 'সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাহিত্যিক ভাষ্যকার'-এ।

গোর্কি নামে সমধিক পরিচিত হলেও এটি তার নাম ছিল না। তার মূল নাম আলেক্সেই ম্যাক্সিমোবিচ পেশকভ। তিনি নিজেই তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম রূপে নির্ধারণ করেন 'গোর্কি', যে রুশ শব্দটির অর্থ তিক্ত বা তিতা। সমাজের অন্যায় ও অসঙ্গতিকে তিক্ত ও কঠোরভাবে আঘাত করতেন বলেই তিনি নিজের এমন নাম ধারণ করেন।

অদ্ভুত জীবন ছিল গোর্কির। রুশ দেশের নিঞ্জি নভগরদ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি পিতৃমাতৃহীন হন। অথচ এই এতিম ছেলেটির ছিল অদম্য সাহস। ১৮৮০ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি তার দাদীমাকে খুঁজতে গৃহত্যাগ করেন। আবার তিনিই ১৮৮৭ সালে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, যখন তার বয়স ১৯ বছর।

এমন নানান ঘটনাবলির পর গোর্কি এক সময় পূর্ণ বাউণ্ডুলে ও সংসারত্যাগী মানুষের কাতারে নিজের নাম যুক্ত করেন। চিরকালের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে তিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে পায়ে হেঁটে সমগ্র রাশিয়া ভ্রমণ করেন। আহরণ করেন মানুষ, প্রকৃতি, সমাজ ও জনপদ সম্পর্কে সরাসরি আহরিত বাস্তব অভিজ্ঞতা। তাঁর লেখাগুলোতে রয়েছে সেইসব বাস্তবতা ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার বিচ্চুরণ।

একটুু দেরিতে সাহিত্যসাধনা শুরু করেন ম্যাক্সিম গোর্কি। তার সর্বপ্রথম রচনা 'মাকার চুদ্রা'। রুশ কথাসাহিত্যে তাঁর অমর উপন্যাস 'মা' ১৯০৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। রুশ ভাষায় লিখিত এই উপন্যাসটি পরবর্তী একশত বছরে পেরিয়েও সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও পঠিত হয়ে চলেছে।

উপন্যাসটি বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত এবং উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্র হল পাভেল ও তার মা। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের পাশাপাশি 'মা' উপন্যাসের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি সিনেমা নির্মিত হয়েছে।

কালজয়ী 'মা' উপন্যাসের জন্য গোর্কি রুশ সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যের অন্যতম আইকন আর বিশ্বসাহিত্যের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব রূপে চিহ্নিত হয়ে আছেন।

প্রথম অধ্যায় শেষ করার আগে আগে ক্যাভিনের লেখা সমাপ্তিজ্ঞাপক লাইনগুলো ম্যারির বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হয়। ক্যাভিন লিখেছে:

“আমি বলেছি, রুশ দেশে আমি আমার নায়িকা ম্যারিকে খুঁজবো। পাঠক, এতো কথা আমি এজন্যই লিখেছি। তার কারণ, আমার প্রেমিকা ম্যারি একজন সত্যিকারের মা। আমার সন্তান টমাসের মা। এবং তার বাবাও। স্বপ্নে আমি ম্যারির সঙ্গে প্রায়ই কথা বলি। আমি সব সময়ই তাকে একটি কথা বলি, বিশ্বজনীন মায়ের মতো আমার অভাব তুমি আমার সন্তানকে বুঝতে দিও না।”

পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার।

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘রংধনু’-৫

   

দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন



রামকৃষ্ণ জানা
দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন

দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন

  • Font increase
  • Font Decrease

রামকৃষ্ণ জানা

[বিশ্ব নদী দিবস প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রোববার। বিশ্ব নদী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘রাইটস অব রিভার'। বিশ্বেরা অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিবসটি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। ইতিহাসবিদ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপক ড.  রূপকুমার বর্মণ নদী ও ইতিহাসের চর্চায় উন্মোচন করেছেন মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বাহুমাত্রিক বিন্যাস।]

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্য দিয়ে অসংখ্য নদী প্রবাহিত হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত নদী-অববাহিকাগুলোতে ঘটে চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন যা বিশ্বব্যাপী অভিবাসনচর্চার অন্যতম বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে নদীকে বহুমুখী ব্যবহারের মাত্রাবৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত নদীজনিত সমস্যার কারণে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের াা অঞ্চলের মানুষেরা নিজেদের জীবনকে রক্ষা করতে জোরপূর্বক অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছে। এইরকম একটি প্রেক্ষাপটকে ড. রূপকুমার বর্মণ তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ইতিহাসচর্চায় এক বিশেষ স্থান দিয়েছেন।   

মোট তিনটি অধ্যায় এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক সারণীসহ এই বইটিতে একই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে। গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে নদীমাতৃক বাংলার জেলেসম্প্রদায়ের মানুষের জীবনজীবিকার ওপরে নদীর অপরিসীম প্রভাব। ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে লিখিত বিভিন্ন সাহিত্যগুলি যে তৎকালীন সমাজের দর্পণ-লেখক তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সাহিত্যের নিরিখে  বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামক উপন্যাসকে লেখক উক্ত অঞ্চলের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে শুধু নদীর সম্পর্কের আলোচনায় সীমাবদ্ধ না রেখে একে কেন্দ্র করে নদী-উপকূলবর্তী মানুষের জীবনসংকট ও তারই প্রভাবে যে তাদের অভিবাসন ঘটেছিল সেই প্রেক্ষিতকে নদীর ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে নতুনভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে তিতাস-অববাহিকায় মালোসম্প্রদায়-অধ্যুষিত চরটি একে একে জনশূন্য হয়ে উঠেছিল-তাও এতে পরিস্ফুটিত। বর্তমানে পরিবেশ-ইতিহাসচর্চায় আভ্যন্তরীণ অভিবাসনের একটি প্রামাণ্য দলিল রূপে বর্ণিত এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করে মানুষের আভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি ও অভিবাসন সংকটের কথাকে স্মরণ করিয়ে ডঃ বর্মণ এই সাহিত্যকে ইতিহাসের এক অন্যতম আধারে পরিণত করেছেন। 

ই. এইচ. কার(E. H. Carr)-এর ইতিহাসচর্চার মূল নির্যাস-‘ইতিহাসকে জানার আগে ঐতিহাসিক কে. জানো’-এ সম্পর্কে গ্রন্থকার পূর্ণমাত্রায় সচেতন। তিনি মালোজাতির ইতিহাসকে তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে বুকানন হ্যামিল্টন(Francis Buchanan-Hamilton), নৃতত্ত্ববিদ জেমস(Dr.James Wise) ও রিসলে(H.H. Risley) প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জেলেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ করেছেন। পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক সরকারের হীনবিভাজন নীতি থেকে মুক্তি পেতে তারা যে ১৯১৩ সালে ‘ঝালো-মালো ক্ষত্রিয় সমিতি’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতায়ন ঘটিয়েছিল লেখক তা বর্ণনা করেছেন।   

অধ্যাপক বর্মণ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে আসাম ও বাংলার নদী-উপত্যকাগুলিতে বসবাসকারী মানুষদের সার্বিক জীবনের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে ঐ অঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক সাহিত্যগুলোকে তাঁর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে ব্যবহার করেছেন। দেবেশ রায় রচিত ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’-কে লেখক একজন ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিয়েছেন যে একটি নদী  কীভাবে আঞ্চলিক স্তরের সংগ্রাম থেকে মানুষকে আন্তর্জাতিক স্তরের সংগ্রামে উত্তীর্ণ করতে পারে। তিস্তা নদী রাজবংশী সম্প্রদায়ের কাছে ছিল এক দেবীস্বরূপা আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ থেকে আগত প্রভূত মানুষের কাছে এই নদী-উপকূল হয়ে উঠেছিল আশ্রয়দাত্রী জননীস্বরূপা। এই প্রসঙ্গে লেখক অত্যন্ত সুচারুভাবে এই অঞ্চলের আদিবাসিন্দা রাজবংশী সম্প্রদায় ও আগন্তুক উদ্বাস্তু বাঙ্গালীর দ্বন্দ্বকে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তুলে  ধরেছেন। যুক্তফ্রন্ট সরকার ও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গৃহীত বিভিন্ন ভূমিসংস্কারমূলক পদক্ষেপ (যেমন-‘অপারেশন বর্গা’) এই রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায় এবং ইউ. কে. ডি. (UKD) ও ইউ. টি. জে. এ. এস. (UTJAS)-নামক আঞ্চলিক দলগুলি অচিরেই তাদের পূর্বতন দাবী তথা কামতাপুর রাজ্যগঠনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তিনি দেখিয়েছেন ভারত ও বাংলাদেশ জলবণ্টনচুক্তি অনুযায়ী তিস্তা নদীতে বাঁধ নির্মাণের দ্বারা সরকার মানুষের উন্নতি ঘটাতে সচেষ্ট হলেও সেই উন্নয়নযজ্ঞই কীভাবে নদী-উপকূলবর্তী মানুষগুলোকে বঞ্চনার শিকারে পরিণত করেছিল। অবশেষে ডঃ বর্মণ প্রশ্ন তুলেছেন-বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ কি তবে তিস্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে নাকি এখনও  মানুষ তিস্তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে?  

এরই সঙ্গে গ্রন্থকার সাহিত্যিক জিতেন্দ্র দাস লিখিত ‘কলহি নদীর একুল হিকুল’-গ্রন্থের ইতিহাসনির্ভর বিশ্লেষণের মাধ্যমে তৎকালীন আসামের বিশেষত দিপার বিলসংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন। কালক্রমে এই নদীর চরে অশান্তির বার্তা বহন করে আনে বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন এবং এরই  ফলশ্রুতিতে এখানে শুরু হয় বহিরাগত ও স্থানীয় মানুষদের সমাজের সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য স্থাপনের এক তীব্র অসম লড়াই। অসমের একটি নদীচরের মানুষের আভ্যন্তরীণ সংকট কীভাবে একটি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল তা লেখক বর্ণনা করেছেন। 

এই গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে ড.  রূপ কুমার বর্মণ তাঁর বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন যে, ভুটানের ওয়াং-চু (পশ্চিমবঙ্গে রায়ডাক ও বাংলাদেশে দুধকুমার নামে পরিচিত) নদী কীভাবে ভুটানের প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রমশ সমগ্র ভুটানবাসীর জীবনের অবলম্বন হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ভুটানের বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করে কীভাবে এই নদী ভুটানবাসীর মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল তার ইতিহাস লেখক তুলে ধরেছেন।  লেখকের বর্ণনায় প্রাধান্য পেয়েছে রায়ডাক-১ ও রায়ডাক-২ নদীর গতিপথে অসম ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় উদ্ভূত ঝাউকুঠি, বলাভুত ও রামরাই কুঠির মত অসংখ্য চরে বসবাসকারী মানুষের জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। তিনি দেখিয়েছেন যে এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে কোচ, মেচ, রাভা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর সাথে সাথে এখানকার অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে রাজবংশী মানুষের বসতি। ঔপনিবেশিক আমলে ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুন্ডাদের শ্রমিক হিসেবে আগমনের ফলে এই নদী-অববাহিকার বসতিগুলি এক মিশ্র সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব-পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকেও অনেক মানুষকে এই অঞ্চল সাদরে গ্রহণ  করে নিয়েছিল। ডঃ বর্মণের নৃ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এইভাবেই এই নদী-অববাহিকা হয়ে উঠেছিল এক টুকরো ভারতবর্ষ।  

লেখক এই অধ্যায়ে আরও দেখিয়েছেন যে একই নদীর জল বহুধর্ম ও বহুসংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে আবহমানকাল ধরে। কোচবিহারের রাজাদের অনুগ্রহে কামাক্ষ্যা মন্দিরের ভিত্তিস্থাপনের ইতিহাস লেখক তুলে ধরেছেন। পরবর্তীতে আবার এই রাজারা এই অঞ্চলেই একাধিক শিবমন্দির স্থাপন করে কোচবিহারের প্রধান দেবতা হিসেবে শিবকে স্থান দেন। অন্যদিকে এখানেই শঙ্করদেবের হাত ধরে একসময় যে বৈষ্ণবধর্মের উত্থান ঘটেছিল তা পরবর্তীতে কোচসাম্রাজ্যের রাজধর্মে পরিণত হয়। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে বৈষ্ণবসত্রগুলি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছিল। একদা কোচপ্রশাসনের ওপর বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তাঁরা নিজেদের নামের সাথে ‘নারায়ণ’ উপাধি সংযোগ করেছিলেন ও কোচমুদ্রার নাম ‘নারায়ণী মুদ্রা’ রেখেছিলেন। সেইসঙ্গে এই অঞ্চলে লৌকিক দেবদেবীরও পূজা-পাঠ প্রচলিত ছিল। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে ঔপনিবেশিককালে খ্রিষ্টান মিশনারীরা ‘ইভানজেলিকালিজম্’ ধারণার বশবর্তী হয়ে রাভা ও মেচ উপজাতিদের কীভাবে খ্রিষ্টানধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং এইসকল প্রান্তিক মানুষদের জীবনে পাশ্চাত্য ধর্ম ও শিক্ষা প্রবেশের সাথে সাথে তাদের নিজেদের চিরায়ত ঐতিহ্য, ধর্ম-সংস্কৃতির যে পরিবর্তনগুলি ঘটেছিল সে বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেছেন।

তবে আলোচ্য গ্রন্থে এই অঞ্চলের অন্যান্য অনেক নদীর কথা লেখকের আলোচনায় স্থান পায় নি। তিনি এই অঞ্চলের নিম্নবর্গের মানুষের ইতিহাসকে তুলে ধরলেও তাঁর লেখায় একটি বিশেষ জনজাতির কথা প্রাধান্য পেয়েছে। নদীর অভিশাপ তাহলে কি শুধুমাত্র জেলেসম্প্রদায়ের ওপর পড়েছিল কিংবা ঝালো-মালো সম্প্রদায়ের বর্তমান সামাজিক অবস্থান কেমন-এসকল প্রশ্নের উত্তরসন্ধানে লেখক নীরব থেকেছেন। তিনি অভিবাসনের ফলে সৃষ্ট এই অঞ্চলের আদি-অধিবাসীদের ক্ষোভের কথা উল্লেখ করলেও বাঙ্গালী উদবাস্তুর যন্ত্রণার কথা তাঁর লেখায় উহ্য থেকেছে। নদীকেন্দ্রিক উন্নয়নযজ্ঞ এই অঞ্চলের জনজাতিবিন্যাসকে কতখানি প্রভাবিত করেছিল তা আরও স্পষ্টভাবে পরিস্ফুটিত হলে তা পাঠকের মনে অধিক আগ্রহের সঞ্চার করত। কামতাপুর রাজ্যের দাবী উত্থানের পশ্চাতে অন্যান্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ভূমিকা এবং অসমের বঙ্গাল খেদাও আন্দোলনের ফলে দেশের অভ্যন্তরে বাঙ্গালীদের অভিবাসনের ঘটনা লেখক ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে ধরেছেন।

ডঃ বর্মণ তাঁর লেখা এই বইটিতে দেখিয়েছেন যে কোন অঞ্চলের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে সেই অঞ্চলকেন্দ্রিক রচিত সাহিত্যগুলি কীভাবে ইতিহাস রচনার প্রামান্য দলিল হয়ে উঠতে পারে। সাহিত্যে প্রতিভাত দলিত মানুষের জীবনসংগ্রামকে নদীকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় স্থান দিয়ে লেখক তাঁর অনন্য রচনাশৈলীর পরিচয় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। নদী কীভাবে জনমানসের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং সেইসঙ্গে মানুষের জীবনধারণের অর্থনৈতিক কাণ্ডারী হয়ে উঠতে পারে তা লেখক তাঁর সুদক্ষ লেখনীর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। তাঁর লেখায় নদী হয়ে উঠেছে নদী-অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর গোষ্ঠীগত এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রতীক। আবহমানকাল ধরে নদী মানুষের অভিবাসনের ফলে উদ্ভূত বিভিন্ন আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সাক্ষী থেকেছে এবং দ্বন্দ্বপ্রসূত অভিবাসনের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট আদি-অধিবাসী ও আগন্তুক সম্প্রদায়ের লোকেদের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্কের দলিল এই উপন্যাসকেন্দ্রিক ইতিহাস-বিশ্লেষণ। উত্তরবঙ্গের কামতাপুরি আন্দোলন(১৯৬৯) এবং অসমের বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন(১৯৭৯-১৯৮৫) উদ্ভবের ক্ষেত্রে নদী কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হয়ে ওঠে তা লেখকের ইতিহাসচর্চায় এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। সেইসঙ্গে নদী কীভাবে ধর্ম-সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে তার এক নির্ভরযোগ্য ইতিহাস-বিশ্লেষণ লেখকের লেখনীতে পরিস্ফুটিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গ ও অসমের পরিবেশ-ইতিহাসচর্চায় এই বই যে কতখানি মূল্যবান তা পাঠক  বইখানি পাঠের পর সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন।     

......

গ্রন্থ সমালোচনা

Rup Kumar Barman, River, Society and Culture: Environmental Perspectives on The Rivers of Assam and Bengal. Delhi: Primus Books, 2023, xix+95pp, ISBN: 978-93-5687-835-8(Paperback)

.........

রামকৃষ্ণ জানা ,গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

;

গড়তে চান বই পড়ার অভ্যাস?



মোঃ শরীফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

  • Font increase
  • Font Decrease

লাইব্রেরিগুলো আজকাল ফাঁকা পড়ে থাকে। ক্যাম্পাসের আড্ডায় বই, সে বড়ই হাস্যকর! বই পড়ার মতো সময় হয়ে ওঠে না কারোরই! আমাদের বর্তমান সময়টা কেড়ে নিয়েছে মোবাইল আর ইন্টারনেট। অথচ বই পড়ার গুরুত্ব কমবেশ সকলেরই জানা।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য বই কতটা জরুরি সেটা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু একটি বই পড়ার জন্য যে সময় প্রয়োজন, প্রয়োজন উপযুক্ত স্থান। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সঠিক বই নির্বাচন।

বই পড়া শুরুর ক্ষেত্রে নতুন পাঠকরা নানান সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পেরে অনেকের আর বই পড়াই হয় না। আজকের আলোচনায় আমরা জানব কীভাবে একটি বই পাঠ করা যায়, গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস।

সময়: বই পড়ার কথা বললেই সবাই এক বাক্যে বলবে, ‘সময় নেই!’ সময় নিয়ে আমাদের অভিযোগের বড় কারণ হলো, নিজের কাজগুলো গুছিয়ে না করা। প্রতিদিন মাত্র ২০-৩০ মিনিট সময় দিয়েই কিন্তু গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস। সময় না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া। তাই, সকাল কিংবা সন্ধ্যা হাতের ফোনটা দূরে সরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসে যান বই নিয়ে।

পরিবেশ: উপযুক্ত পরিবেশ বই পড়ার মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়। জানালার পাশে, বেলকনিতে কিংবা বাসার ছাদে বই পড়ার স্থানটি যেন হয় নির্জন এবং শান্ত। আজকাল বিভিন্ন পার্কে ‘নীরব বই পাঠ কর্মসূচি’ দেখা যায়। চাইলে যোগ দিতে পারেন তাঁদের দলেও। বই পড়ার পাশাপাশি পরিচয় হবে বইপ্রেমী মানুষদের সাথে।

বই নির্বাচন: বই পড়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছে যেমন জরুরি তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক বই নির্বাচন। এক্ষেত্রে নিজের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিন। যেসব গল্প আপনাকে আকর্ষণ করে শুরুতে সেই বইগুলোকেই আপনার পাঠ্য তালিকায় রাখুন। 

পাঠাগার: পাঠাগারে গেলেই যে বই পড়তেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বইয়ের সাথে সময় কাটালে এক সময় সেটা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হবে। আর ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে কখন যে দু’য়েক পাতা পড়ে ফেলবেন, নিজেই টের পাবেন না! তাই বই পড়ার অভ্যাস গড়তে চলে যান পাঠাগারে। বই না পড়ুন, অন্তত সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা তো হবে!

সোশ্যাল মিডিয়া: আমরা সবকিছুতেই সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার সুষ্ঠু ব্যবহার আপনার অভ্যাস গড়ার বড় সহায়ক। ফেসবুকে সাহিত্য তথা বই বিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা হয়, হয় বই বিষয়ক আড্ডাও। এসব গ্রুপে যুক্ত হয়ে বাড়াতে পারেন বইয়ের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা।

ধারাবাহিকতা: বলা হয়ে থাকে টানা ২১ দিন কোনো কাজ করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। বই পড়ার ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। অভ্যাস গড়তে হলে ধরে রাখতে হবে ধারাবাহিকতা। সামান্য হলেও প্রতিদিন পড়ুন। এই ধারাবাহিকতায় আপনার বই পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করবে। 

বই পড়ার অভ্যাস রাতারাতি তৈরি হবে না। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়। নতুন পাঠকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছুদূর পড়ার পর বইটি আর ভালো লাগে না। এক্ষেত্রে ধৈর্য্যহারা হওয়া যাবে। জোর করে সে বই পড়ার প্রয়োজন নেই।

বই মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ায়। বই পড়ার অভ্যাস গড়তে পারলে জীবনে উন্নতি সাধন অবধারিত। একাডেমিক পড়ার বাইরেও বইয়ের বিশাল একটি জগত রয়েছে। সেই জগতে মানুষ জানার জন্য পড়ে, পড়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য। বই পড়লে মানসিক চাপ হ্রাস পায়, হয় মস্তিস্কের ব্যায়াম, বাড়ে শব্দ ভান্ডার ও স্মৃতি শক্তি। বই পাঠকের চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করে, বৃদ্ধি করে বিশ্লেষণ ক্ষমতা। বই পড়ার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশ হয়। তাই বই হোক প্রত্যেক মানুষের উত্তম বন্ধু এবং বইয়ের সঙ্গে হোক আমাদের মিতালি।

;

মায়ের সমাধির খোঁজে



মহীবুল আজিজ
মায়ের সমাধির খোঁজে

মায়ের সমাধির খোঁজে

  • Font increase
  • Font Decrease

কন্ডাক্টরকে বললাম, এখানে নামিয়ে দিন,
এখানে এই মিয়াপাড়ায় আমি নামবো—
মিয়াপাড়া কবরস্থানে শুয়ে আছে আমার মা।
মায়ের কবর দেখতে এলাম আটান্ন বছর পরে,
জ্যাঠা বলেছিলেন, গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটু গেলে
একটা গোলাপ গাছ ঘেঁষে কবরটা,
কবরের আগে আমাকে গোলাপ গাছ খুঁজতে হয়—
জ্যাঠা চলে গেছেন তা-ও বত্রিশ বছর।
ডানদিকে ঘুরতেই জড়িয়ে ধরে তাজা গোলাপের ঘ্রাণ,
পাশাপাশি চারটা কবর, চারটাতেই গোলাপের পাহারা;
এত কবর এত কবর, কবরে ভর্তি কবরস্থান—
কোথায় শেষ শয্যা নিয়েছিলেন আমার মা!
হাওয়ায় পাতা দোলে গোলাপের, চারটাই একসঙ্গে,
চারটা গাছ থেকেই মুখবাড়ানো গোলাপ ডাক দেয়—
এইখানে এইখানে এইখানে—কোন্খানে!
উবু হবো কবরের মাটি নিতে
কিন্তু চারটাই ডানদিকে, চারটাই গোলাপের পাশে,
প্রতিটি কবর থেকে একটি একটি মুঠো নিয়ে
পলিথিনের চারটে ব্যাগে রাখি।
একবার মনে হয় প্রথমটাতে,
তারপর মনে হয় দ্বিতীয়টাতে,
আবার মনে হয় তৃতীয়টাতে
এবং মনে হয় চতুর্থটাতে সন্ধান রয়েছে মায়ের।
মা সুপ্ত থেকে যান অনির্দিষ্ট মাটিতে ,
তবে কোন্ মানবের মাটি ধরে রাখি বুকের কাছে!
ঠিক তখন বিস্ময়ের মতন একটি ফুটন্ত গোলাপ
গাছ থেকে ঝরে পড়ে দ্বিতীয় কবরে,
সংশয়ী মন বলে, তবে কী গোলাপই বার্তাবহ মায়ের!
অদৃষ্টে অবিশ্বাসী মন দোলে সংশয়ে,
তখন আরেকটি গোলাপ ঝরে পড়ে চতুর্থ কবরে।
অর্থাৎ দুই যোগ দুইয়ে এসে আমার আর হিসেব মেলে না,
জ্যাঠা বলেছিলেন, কবরটা গেটের ডানদিকে ঘুরতেই
এবং গোলাপের পাশে।
বত্রিশ বছরে চতুর্গুণ হয়েছে গোলাপ
কিন্তু এক ও অবিভাজ্য আমার মা’কে
এই গোলাপের কারণেই খুঁজে পাই না আমি—
ফিরে আসি শুধু গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে।

১১-০৯-২০২৩

;

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল



শরীফুল আলম
অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

  • Font increase
  • Font Decrease

 

আমি সীজার হতে চাইনি
তবুও তুমি ক্লিওপেট্রাই থেকে গেলে
অহেতুক লড়াইয়ে তুমি জয়ী হতে চেয়েছিলে
সম্ভবত একেই পরিযায়ী প্রেম বলে
আলো আঁধারীর খেলা বলে
স্বপ্ন আর জেগে থাকা বলে ,
সমাপ্তি কিম্বা বিবিধ, তা সে যাই হউক
এই সহজ কথাটি
আমরা কেউ কাউকে সহজ ভাবে বলতে পারিনি
অথচ তুমি ফ্রিজিডেয়ারটি বন্ধ করে রাখলে
আর বললে, "নোটেড ",

নিউইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
হ্যাঁ, এটাই সত্যি
তুমি লৌহশৃংখলে অনুজ্জ্বল এক ডিমলাইট
সুচারু মোহের অভাবে তুমি প্রমত্তা নদী
বাবুই পাখীর বাসার ন্যায় তুমি ঝুলে থাক আমার স্বপ্নে
যা হতে পারতো নির্মল এক সবুজের প্রান্তর ।

তুমি ওঁত পেতে থাকা বাঁশপাতার ফাঁকে পূর্ণিমা
আমি তোলপাড় করে ছুটে চলা এক্সপ্রেস ট্রেন
দলছুট শালিক,
আজ কোন বৈভব নেই
ভালোবাসাবাসি নেই ,
কবিতাও ইদানিং প্রিয় লাগেনা
তবু স্নায়ুরা জেগে থাকে
মনে হয় হলুদ পাতায় যেন ক্লোরোফিল
আমিও প্রবণতায় ফিরে যাই সাইবেরিয়া ।

আনচান মনে কত আকুলতা
কালবৈশাখীর তান্ডব
যেন বাতাসে কাঁপন ধরে,
এসো সখা,
এই শ্রাবণে আবার রিডিজাইন করি,
স্যাটেলাইটে প্যারালাল বার্তা পাঠাই
ভুলে যাই অর্ধেক রিয়েল আর অর্ধেক ভুল
প্লাবনে অবাধ্য ঢেউয়ের উছ্বল ।

________________________________________

 ৯ সেপ্টেম্বর । ২০২৩।
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

 

;