দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
টিপু সুলতান

টিপু সুলতান

  • Font increase
  • Font Decrease

‘টিপু সুলতানের তরবারি’ বা ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’ ছিল ঔপনিবেশিক ইংরেজ দখলদারদের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের স্বাধীনতার শেষ হাতিয়ার। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ নামীয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় বাংলা দখল করলেও দক্ষিণের টিপু সুলতানের তরবারি লুটেরা ইংরেজদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।

তবে বাংলার মতো দাক্ষিণাত্যেও চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উপমহাদেশের স্বাধীনতার শেষস্তম্ভ টিপু সুলতানকে হত্যা করে দখলদার ইংরেজরা। ইতিহাসের সেই কলঙ্কিত দিনটি ছিল ৪ মে, ১৭৯৯ সাল, যেদিন করুণ রাজনৈতিক উপাখ্যানটি সংঘটিত হয়। আর তা ছিল পলাশীর প্রায়-অর্ধশত বছর পরের ঘটনা এবং ইংরেজ-বিরোধী সর্বশেষ সশস্ত্র প্রচেষ্টা।

ফতেহ আলী টিপু সুলতান জন্মগ্রহণ করেন ১৭৫০ সালের ২০ নভেম্বর। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের বর্তমান কর্ণাটকের অন্তর্গত মহীশূর রাজ্যের শাসনকর্তা, যে রাজ্য দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য অঞ্চলেও প্রসারিত ছিল।

টিপু ছিলেন প্রকৃতই একজন সাহসী, বীরযোদ্ধা। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি বীরত্ব সহকারে যুদ্ধ করেন। তিনি তার শৌর্যবীর্যের কারণে 'শের-ই-মহীশূর' বা 'মহীশূরের বাঘ' নামে সুপরিচিত ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতাকামীতার জন্য তাকে 'ভারতের বীরপুত্র' বলা হয়। তিনি বিশ্বের প্রথম রণাঙ্গনে রকেট আর্টিলারি এবং বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করেছিল। তিনি তার শাসনকালে বেশ কয়েকটি প্রশাসনিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন এবং একটি নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা ও ক্যালেন্ডার চালুর পাশাপাশি একটি নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রচলন করেন, যা মহীশূরের রেশম শিল্পের বিকাশের সূচনা করেছিল।

টিপুর সংগ্রামী ও স্বাধীনতাকামী জীবন নিয়ে বহু গবেষণা, গ্রন্থ রচনা এবং নাটক, চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এসবের মধ্যে 'দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান' অন্যতম। নাটকটি যে কোম্পানি কর্তৃক নির্মিত হয়, তার মালিক ছিলেন ভারতীয় নির্মাতা ও পরিচালক সঞ্জয় খান। সঞ্জয় খানের ভাই আকবর খান এটি পরিচালনা করেন, যার সঙ্গীত পরিচালনা করেন কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ, 'মুঘল-ই-আজম' খ্যাত নৌশাদ আর চিত্রধারন করেন প্রখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার বশির আলি। সঞ্জয় খান নিজেই টিপু সুলতানের মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন।

ঐতিহাসিক নাটকটি কানাডার মন্ট্রিয়াল-ভিত্তিক লেখক ভগবান এস গিদওয়ানির লেখা একই নামের উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয়। উপন্যাসটি একটি অন্যতম বেস্ট-সেলার বই ছিল, যার প্রায় ২,৫০,০০০ কপি বিক্রি হয়, বহু ভাষায় অনুবাদ প্রকাশিত হয় এবং পঞ্চাশের অধিক সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হয়। লেখক হওয়ার পাশাপাশি, গিদওয়ানি ৬০ পর্বের একটি স্ক্রিপ্টও লিখেছিলেন। শেষের অল্প কিছু পর্ব অগ্নি দুর্ঘটনার কারণে কয়েক বছর পর ধারণ করা হয়। উক্ত নাটকের জন্য নির্বাচিত অন্যান্য অভিনয়শিল্পীরা ছিলেন সীমা কেলকার, অনন্ত মহাদেভান, মুকেশ রিশি, শাহবাজ খান, পাপ্পু কেলকার ও দীপিকা ছিখালিয়া। নাটকে নিজের বহুমাত্রিক অবদানের জন্য টিপু সুলতান চরিত্রের সঞ্জয় খান 'দ্য জেম অব ইন্ডিয়া' পুরস্কার লাভ করেন

বর্তমানে অনেকগুলো রাজ্য হলেও (কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, অন্ধ ও মালাবার বা কেরালা) অখণ্ড ডেকান বা দাক্ষিণাত্যের বিশাল এলাকা এবং আরব সাগরের তীরের পশ্চিমঘাট আর বঙ্গোপসাগরের উপকূলের পূর্বঘাট পর্যন্ত সমগ্র বৃহত্তর দক্ষিণ ভারতে অন্যতম শাসক ছিলেন টিপু সুলতান, যার শাসনকেন্দ্র ছিল তৎকালীন মহীশূর রাজ্য ৷ তার পিতা হায়দার আলীও মহীশূর রাজ্যের শাসক ছিলেন এবং ফরাসি বীর নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মিত্র ছিলেন। যে কারণে ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে ফরাসিরা সাহায্য করেছিল।

টিপু সুলতান মহীশূরের শ্রীরঙ্গপত্তনম এলাকাস্থ কাবেরী নদীর ব-দ্বীপে নির্মিত একটি দুর্গ থেকে রাজ্য শাসন করতেন৷ বর্তমানে শ্রীরঙ্গপত্তনম গ্রাম দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের মান্ডিয়া জেলার অন্তর্গত৷ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধে ১৭৯৯ সালে নিহত হন টিপু। এক সেনাপতি মীর সাদিক বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলানোয় পরাজয় ঘটে টিপুর৷ পরে তার পরিবারের লোকজনকে তামিলনাড়ুর ভেলোরের দুর্গে বন্দী করে রাখে ব্রিটিশ শাসকরা৷

জানা যায়, ভেলোরে রাজ পরিবারের সদস্যদের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি করার পর ১৮০৬ সালে একটি বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। সেই বিদ্রোহে ভেতর এবং বাহিরের প্রচণ্ড আক্রমণে শতাধিক ইংরেজ সৈন্য সেদিন নিহত হয়। এমন ঘটনা ইংরেজদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সঞ্চার করে। পরবর্তীতে মাদ্রাজ এবং আশপাশের সৈন্য নিয়ে তারা আবার দুর্গটি দখল করে নেয়। ইংরেজরা ওই সময় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। প্রতিশোধের নেশায় প্রায় ছয় শতাধিক মানুষকে তারা হত্যা করে।

ইংরেজরা এই বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার জন্য টিপুর পরিবার এবং রাজপুত্রদের সন্দেহ করে। পরবর্তীতে টিপু সুলতানের পরিবারের একটি বড় অংশকে কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর যাদের সন্দেহ করা হয়নি তাদের ভেলোরে রেখে দেওয়া হয়। এখানে যারা নিহত ও মারা যায় তাদেরকে দুর্গ থেকে দুই কিমি দূরের এই টিপু সুলতান গ্রান্ড মসজিদ এর প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।

কলকাতা নিয়ে যাওয়ার সময় টিপু সুলতানের সর্ব কনিষ্ট পুত্র শাহজাদা ওয়াহিদ উল্লাহ সুলতান ঐখান থেকে পালিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ এর সুনামগঞ্জে পরিচয় গোপন করে ওয়াহিদ উল্লাহ নামে সেখানে আশ্রয় নেন । এভাবেই হত্যা, রক্ত আর বিভক্তির ক্ষত নিয়ে টিপু সুলতানের বংশধরেরা ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ হয়ে ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়। তবে কলকাতার কেন্দ্রস্থলের ধর্মতলায় এবং দক্ষিণের টালিগঞ্জে টিপু সুলতান মসজিদ এবং প্রিন্স আনোয়ার শাহ সড়ক দাক্ষিণাত্যের স্বাধীনতাকামী বীরদের স্মৃতি জাগরিত রেখেছে।

ইতিহাসের বর্ণনায় টিপু সুলতানের অপর নাম 'শের-ই-মহীশূর', যে উপাধি খোদ ইংরেজদেরই দেয়া। তার এই বাঘ (শের) হয়ে ওঠার পিছনে অনেকগুলো বিষয় সম্পর্কিত ছিলো। মূল কারণ ছিলো তার অসাধারণ ক্ষীপ্রতা, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা আর কৌশলপূর্ণ রাজ্য পরিচালনা - বাবার সুযোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন টিপু সুলতান। বাবা হায়দার ১৭৪৯ সালে টিপু নামে এক ফকিরের দোয়ায় এক পুত্রসন্তান লাভ করেন এবং আনন্দচিত্তে ঐ ফকিরের নামেই ছেলের নাম রাখেন "টিপু"। মহীশূরের স্থানীয় ভাষায় (কানাড়ী ভাষা) 'টিপু' শব্দের অর্থ হলো 'বাঘ'। হয়তো তাকে 'শের-ই-মহীশূর' ডাকার পিছনে এটাও একটা কারণ ছিলো। তবে ইতিহাসে আরও অনেক কারণের উল্লেখ রয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই টিপু বাঘের গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। বাবাই তাকে বাঘের গল্প শোনাতেন। কিশোর বয়সে টিপু সুলতান বাঘ পুষতে শুরু করেন। বাঘ নিয়ে তার ব্যঘ্রতার শেষ ছিলো না। বাবার মৃত্যুর পর তিনি যখন সিংহাসনে আরোহণ করলেন, তখন বাবার পুরোন সিংহাসনটি তিনি ঠিক পছন্দ করলেন না। তাই তিনি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ কারিগর দিয়ে কাঠের ফ্রেমের উপর সোনার পাত বসিয়ে তার উপর মণিমুক্তা ও রত্নখচিত একটি সিংহাসন বানিয়ে নিলেন, যাকে বরং "ব্যাঘ্রাসন"ই (Tiger throne) বলা যায়। কারণ আট কোণা ঐ আসনটির ঠিক মাঝখানে ছিলো একটি বাঘের মূর্তি। ৮ ফুট চওড়া আসনটির রেলিংয়ের মাথায় বসানো ছিলো সম্পূর্ণ স্বর্ণে তৈরি দশটি বাঘের মাথা, আর উপরে উঠার জন্য ছিলো দুধারে, রূপার তৈরি সিঁড়ি। আর পুরো ব্যাঘ্রাসনটাই ছিলো বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা

টিপু সুলতানের উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন পণ্ডিত পুরণাইয়া।টিপু সুলতান সামরিক তালিম নেন সরদার গাজী খান এর কাছ থেকে।টিপু সুলতান ছিলেন বহুভাষায় পারদর্শী। আর তার রাজ্যের প্রতীক ছিলো বাঘ। এই বাঘ ছিলো তার অনুপ্রেরণার মতো। তার রাজ্যের পতাকায় কানাড়ী ভাষায় লেখা ছিলো বাঘের কথা। তিনি সিংহাসনে বসে মাঝে মাঝেই বলতেন: 'ভেড়া বা শিয়ালের মতো দু'শ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দু'দিন বেঁচে থাকাও ভালো'।

টিপু সুলতানের সমস্ত পরিধেয় পোশাক ছিলো হলুদ-কালো রঙে ছাপানো আর বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা। তিনি যে তলোয়ার ব্যবহার করতেন, তার গায়েও ছিলো ডোরা দাগ এবং হাতলে ছিলো খোদাই করা বাঘের মূর্তি। তার ব্যবহৃত রুমালও ছিলো বাঘের মতো ডোরাকাটা। তার রাজ্যের সমস্ত সৈনিকের পোশাকে থাকতো বাঘের ছবি। সৈন্যদের ব্যবহার্য তলোয়ার, বল্লম, বন্দুকগুলোর নল, কুদো, হ্যামারেও আঁকা থাকতো বিভিন্ন আকারের বাঘের প্রতিরূপ কিংবা মূর্তি। এমনকি তিনি তার রাজ্যের প্রধান প্রধান সড়কের পাশে, বাড়ির মালিকদেরকে বাড়ির দেয়ালে বাঘের ছবি আঁকার নির্দেশ জারি করেছিলেন। তখনও তার বাঘ পোষার বাতিক যায়নি এবং রাজবাড়িতে বেশ কয়েকটি পোষা বাঘ ছিলো। তার কয়েকটি আবার তার ঘরের দরজার সামনে বাঁধা থাকতো বলে কথিত আছে।

১৭৮১ সালে ইংরেজ সেনাপতি হেক্টর মুনরোর ও তার বাহিনীর কাছে ২য় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে টিপু ও তার বাবা মারাত্মক নাজেহাল হন এবং টিপুর রাজ্যে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়, নিহত হয় অনেক সৈন্য। এমনিতেই তিনি প্রচণ্ড ইংরেজ বিরোধী ছিলেন, তদুপরি এই পরাজয়ে তিনি আরও বেশি তেজদীপ্ত হয়ে ওঠেন। ঘটনাক্রমে ১৭৯৩ সালে হেক্টর মুনরোর একমাত্র পুত্র সুন্দরবনের সাগর দ্বীপে বাঘ শিকার করতে গিয়ে বাঘ আক্রমণে নিহত হয়। এই সংবাদ পেয়ে টিপুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়।

টিপু একটি ধারণা কাজে লাগিয়ে একটি বিচিত্র খেলনা বানিয়েছিলেন, যা সারা দুনিয়ায় "টিপু'স টাইগার" (Tipu's Tiger) নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। ফরাসি যন্ত্রকুশলীদের দ্বারা নির্মিত প্রমাণ আকারের এই খেলনাটিতে ক্লকওয়ার্ক সিস্টেম ব্যবহৃত হয়েছিলো। খেলনায় দম দিয়ে ছেড়ে দিলে এর সাথে লাগানো একটি অর্গান পাইপ থেকে রক্ত হীম করা বাঘের প্রচণ্ড গর্জন, আর এক ইংরেজের প্রচণ্ড গোঙানির আওয়াজ বের হতো। পুরো খেলনাটি ছিলো এরকম: একজন ইংরেজ একটি বাঘের থাবার মধ্যে অসহায়ভাবে পড়ে গোঙাচ্ছে আর একটা বাঘ প্রচণ্ড আওয়াজ করে সেই ইংরেজের বুকের উপর চেপে গলা কামড়ে ধরতো। তখন ইংরেজটি তার হাত উঠিয়ে চেষ্টা করতো বাঘের মাথাটি এদিক-ওদিক সরিয়ে দিতে। ভিতরকার অর্গান থেকে আরো বেরিয়ে আসতো মহীশূর সুলতানের প্রিয় গজলের সুর। "টিপু'স টাইগার" বানানোর পিছনে একদিকে যেমন ছিলো তার ইংরেজদের প্রতি উষ্মা, তেমনি অন্যদিকে ছিলো প্রচন্ড ব্যঘ্রপ্রীতি। সময় পেলেই তিনি বাঘটিতে দম দিতেন; কখনও কখনও রাতের পর রাত একই জিনিস দেখে আনন্দ ও বিনোদন উপভোগ করতেন।

টিপু সুলতানের ৪ জন স্ত্রী, ১৫ জন পুত্র এবং কমপক্ষে ৮ জন কন্যা সন্তান ছিল। কন্যাদের পরিচিতি অজানাই রয়ে যায়। ১৮০৬ সালে বিদ্রোহের পর যখন টিপু সুলতানের পরিবার কে ভেলোর থেকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয় তখন তার সর্ব কনিষ্ট পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ ওয়াহিদ উল্লাহ সুলতান সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন পরে বর্তমান বাংলাদেশ এর সুনামগঞ্জে এসে পরিচয় গোপন করে আশ্রয় নেন। তাদের পরবর্তী অবস্থান সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় নি। ২০১৫ সালে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দলের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধরামাইয়ের নেতৃত্বে কর্ণাটক সরকার টিপুর জন্মবার্ষিকীকে 'টিপু সুলতান জয়ন্তী' হিসাবে পালন করা শুরু করে। কংগ্রেস সরকার এই জয়ন্তি বার্ষিক অনুষ্ঠান হিসাবে ঘোষণা করেছিল। তবে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদিউরপ্পা, যিনি ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-এর সদস্য, এই জয়ন্তী বাতিল করার আদেশ দেন।

ঐতিহাসিকভাবে টিপু সুলতান মহীশূর তথা দক্ষিণ ভারতের এমন একজন শাসক ছিলেন, যিনি স্বাধীনতাকামী ও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তার সময়ে কৃষ্ণ রাজা সাগর বাঁধের ভিত্তি স্থাপন তৈরি হয়েছিল। তিনি শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্যের উন্নতিরও চেষ্টা করেছিলেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে টিপু ধার্মিক মুসলিম ছিলেন। নিয়মিত প্রার্থনা করতেন এবং এবং তার এলাকার মসজিদগুলোর উপর তার বিশেষ নজরদারি ছিল। তবে, একটি হিন্দু রাষ্ট্রের মুসলিম শাসক হিসেবে টিপু সুলতানের শাসনব্যবস্থা সহনশীল ছিল। তার শাসনকালে তিনি ১৫৬ টা হিন্দু মন্দিরে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ দিতেন। বরাদ্দ পাওয়া এরকম এক বিখ্যাত মন্দির হলো শ্রীরঙ্গপত্তনমের রঙ্গন অষ্টমী মন্দির।

টিপু সুলতান ছিলেন হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল প্রজার হিতৈষী ও কল্যাণকামী এবং জন্মভূমির স্বাধীনতার জন্য সাহসী যোদ্ধা ও আত্মউৎসর্গকারী মহান শাসক। ভারতীয় উপমহাদেশের ঔপনিবেশিকতা বিরোধী স্বাধীনতার ইতিহাসে অগ্রণী ও শ্রেষ্ঠতম নাম টিপু সুলতান।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;