কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৮)



জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

পুনর্মিলন ও পূর্বাভাস

[পূর্ব প্রকাশের পর] “হ্যাঁ, এটাই উপযুক্ত সময় তোমাদের দুজনের এখানে ফিরে আসার। গত মাসগুলোতে আমি কতবার এসে দেখেছি তোমরা বাড়িতে নেই।”

রিড আমাদের বাড়ির চাবিহাতে মালুমঘাট থেকে ফিরে এসেছেন।

আমরা আমাদের বন্ধুদের ও গির্জার লোকজনের খোঁজখবরের জন্য তাঁকে চেপে ধরি। তিনি আমাদের অগুনতি প্রশ্নের জবাব দেন এবং নিজেও কিছু অভিজ্ঞতার গল্প করেন।

কোনো একবার অষুধপত্র ও খাবারদাবার নিয়ে হাসপাতালে যাবার পথে রিড একটি সেনাদলকে অনুসরণ করেছিলেন। তিনি যখন পটিয়া শহরে ঢোকেন, তখন দেখেন সৈন্যরা রাস্তার দুধারের দোকানগুলোতে গুলি ছুড়ছে। একজন মেজর তাকে একটি ভীতিপ্রদ অগ্নিকুণ্ডের ঠিক উল্টোদিকে থামতে ইঙ্গিত করেন। আগুনের তীব্রতা দেখে এবং তার প্রচণ্ড উত্তাপ অনুভব করে, তিনি তাঁর গাড়ির পেট্রোল ট্যাংক কিংবা আগুনলাগা দোকানের ভেতর থেকে বিস্ফোরণের ভয় পাচ্ছিলেন, তাই একটু সামনে এগিয়ে আগুনের হলকা থেকে গা বাঁচিয়ে দূরে দাঁড়ান।

অফিসার চিৎকার করতে করতে তাঁর দিকে ছুটে আসেন, “আমি যখন তোমাকে থামতে বলি, তখন সঙ্গে সঙ্গে তুমি থামবে। আমি যেখানে আছি, সেটা অবশ্যই নিরাপদ।”

তারপর অনেক মাস পরে রিড নিচের ঘটনাটির বর্ণনা দেন।

“চট্টগ্রামে অত্যাচারের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছিল। সেই সন্ধ্যাটার কথা মনে আছে, যখন মার্শাল ল’র ঘোষণাটি আমার কানে আসে যে, কার্ফ্যু শুরুর সময় রাত আটটা থেকে নয়টা করা হয়েছে। সাড়ে সাতটায় আমাদের এক কিশোর-সদস্য এসে বলে, “তারা আমার বাবাকে এইমাত্র ধরে নিয়ে গেছে।”

“আমি যদি কার্ফ্যুর সময় বদলানোর ঘোষণাটা না শুনতাম,” রিড ব্যাখ্যা করে বলেন, “তাহলে কিছুই করতে পারতাম না সে-রাতে।”

আমি মিউনিসিপ্যাল অফিসে গিয়েছিলাম। দারোয়ান খুব একটা সহযোগিতা করছিল না। ছেলেটির বাবা একটা ভিন্ন নাম দিয়েছিল, যেন তাকে হিন্দু বলে (সকল অপরাধের সেরা অপরাধ) সন্দেহ করা না হয়। পাঁচজন সৈন্য হেঁটে আসে। তারা স্বীকার করতে চাইছিল না যে, মানুষটি তাদের জিম্মায় আছে, এবং তারা আমাকে খুঁজে দেখতেও দিচ্ছিল না। ‘এঁর ওপর যেন কোনোভাবেই অত্যাচার করা না হয়। তিনি একজন খ্রিস্টান।’ এই কথা বলে আবার সকালে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়ে আমি বিদায় নিই।”

(অনেক ক্ষেত্রেই ‘খ্রিস্টান’ অর্থ ছিল দায়মুক্তি। এর কারণ সম্ভবত, পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা খ্রিস্টানের সঙ্গে আমেরিকাকে মিলিয়ে ফেলত, অথবা ঈশ্বর সত্যি পৃথিবীকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে, তিনি তাঁর সন্তানদের দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখেন, তাই খ্রিস্টানদেরকে তেমন অপমান বা অত্যাচারের শিকার হতে হয়নি।)

সকাল বেলায় আমি জন সরকারকে (আমাদের ভাষাবিভাগের দারুণ দেশি কর্মীটি) নিয়ে গ্রেফতারকৃত লোকটার বাড়িতে যাই। আমার জানা দরকার, তার বাবার গায়ে আওয়ামি লিগের রাজনীতির কলঙ্ক লেগে আছে কিনা, তিনি যদি রাজনৈতিকভাবে তার সঙ্গে যুক্ত না হয়ে থাকেন, তাহলে মিলিটারির তাকে আটকে রাখার কোনো কারণ থাকতে পারে না। তার পরিবার ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আমি এই মর্মে স্বাক্ষরিত প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করি। (আমি এটা স্থানীয় ক্যাথলিক পাদ্রির কাছ থেকে শিখেছিলাম, যিনি নিজে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন।) লোকটাকে অসংগতভাবে আটকে রাখা হচ্ছে, এই নিশ্চয়তা পেয়ে আমি তার পক্ষে একটা বিবৃতি তৈরি করি এবং মিউনিসিপ্যাল অফিসে ফেরত যাই। প্রথমে তারা আমাকে ঢুকতে দেয়নি। এরপর আমি একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করি, যিনি নিশ্চিত করেন যে, লোকটা সেখানে আছে। আমি ওপরতলায় উঠে তাকে মেঝেতে উবু হয়ে বসে থাকতে দেখি। তার হাতজোড়া পেছনে বাঁধা, তাকে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। তার শার্টে রক্তের দাগ। আমি তখন কিছু না করে অলসভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি।

“আমি অ্যাংলিকান ক্রাইস্ট চার্চের মিনিস্টার রেভারেন্ড ডেভিড ড্যাভিকে তুলে নিয়ে, দুজনে একসঙ্গে সার্কিট হাউসে অবস্থিত মিলিটারি সদর দফতরের মেজর বুখারির সঙ্গে দেখা করতে যাই। দরজার প্রহরীরা আমাদের বাধা দেয় না, ফলে আমরা সোজা মেজরের টেবিলের কাছে হেঁটে যাই।”

মেজর চেঁচিয়ে উঠলেন এই বলে যে, ‘আপনারা পিয়ন ভেতরে ঢোকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতেন।’ এরপর তিনি ডেভিডের ওপর হম্বিতম্বি করতে লাগলেন, তখন আমি আর চুপ করে থাকতে পারিনি। ‘আমাদের একজন খ্রিষ্টান সদস্যকে ধরে আনা হয়েছে।’ আমি এই কথা বলে, প্রস্তুত করে আনা বিবৃতিটা তাঁকে দেখাই। তখন তিনি রাগে একেবারে ফেটে পড়লেন। তাঁর মুখ ক্রোধে গনগন করে, তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘আপনারা যা করেছেন তা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে! একমাত্র আমাদের সৈন্যরাই কোনো ঘটনা নিয়ে তদন্ত করতে পারে। আপনাদেরকে বন্দি করা হলো!’

“‘আমি কি আমাদের কনস্যুলেটকে ফোন করতে পারি?’ আমি জানতে চাই।”

‘অবশ্যই নয়। বসুন আপনারা!’

“এটা পরিষ্কার ছিল, আমি ও ডেভিড, দুজনকেই প্রেপ্তার করা হয়েছে। মেজর তাঁর বকাঝকা চালিয়ে যেতে থাকেন: ‘আপনারা উর্দুভাষীদের সাহায্য করেন না কেন? তারপর তিনি আমাদেরকে কিছু মায়াকান্নার গল্প শোনালেন, এক বিধবার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ইত্যাদি।”

“ততক্ষণে আমি ভাবতে থাকি, আমার কাছে গুর্‌গানসের ভক্সওয়াগন গাড়ি ও সব আসবাবপত্র রয়েছে; মেয়েদুটোর বাড়ি এবং অফিসের জিনিসপত্রেরও দায়িত্বও আমার ওপর। আমাকে যদি দেশ ছেড়ে যাবার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার নোটিশ দেওয়া হয় তাহলে কী হবে? আর আমি যদি না যাই তাহলেই বা কী হতে পারে? আমি তখন বুঝতে পারি পরিত্রাণের জন্য প্রার্থনার অর্থ কী। একমাত্র ঈশ্বরই এই অবস্থার সামাল দিতে পারেন।”

“আমাদেরকে প্রহরী দিয়ে বাইরে নিয়ে গিয়ে একটি গাছতলায় বসিয়ে রাখা হয়। কিছুক্ষণ পর সেই বদমেজাজি মেজরের আগমন ঘটে। তিনি ব্রিগেডিয়ারের কাছে গিয়েছিলেন।”

‘আপনারা যেতে পারেন’, মেজর বুখারি আমাদের শাস্তি বাতিলের ঘোষণা দেন, ‘কিন্তু আমরা আপনাদেরকে আর এখানে দেখতে চাই না। আমরা আপনাদের যেতে দিচ্ছি কারণ আমরা কোনো আন্তর্জাতিক খবর হোক তা চাই না।’

“আমি ঈশ্বরের এই আশীর্বাদকে আারো বেশি মূল্য দিচ্ছিলাম এইজন্য যে, অজস্র ক্ষেত্রে বহু লোকের অহেতুক মৃত্যু ঘটেছিল স্রেফে কোনো উত্তেজিত সৈন্যের হাতে। আমি উপলব্ধি করি, এই মেজর এরকম একটা হুকুম দিতে কী ভালোই না বাসতেন, ‘একে গুলি করো।’ ঈশ্বরের কৃপা এবং আমার আমেরিকান সনদ আমাকে রক্ষা করে।”

“আমি বন্দি লোকটার বাড়ি যাই এই কথাটা বলতে যে, আমি আর তার জন্য বেশি কিছু করতে পারব না। তারপর, হঠাৎ করে, কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এবং আমার প্রথমবার যাওয়ার পর তাকে নাকি আর মারধরও করা হয়নি।”

“‘তুমি ভাগ্যবান,’ তারা তাকে বলে। ‘একজন বিদেশি তোমার খোঁজে এসেছিল’।”

চট্টগ্রামে আমাদের সেই প্রথম দিনে রিড আমাদেরকে পরামর্শ দেন, একটু আড়ালে আবডালে থাকতে যাতে করে এটা বোঝা না যায় যে, আমরা ফেরত এসেছি। লোকেরা তাঁকে এদিক সেদিক দেখে অভ্যস্ত, এটা অনেক লোককে সাহসও দিয়েছিল যে, এখনো শহরে কিছু বিদেশি রয়েছে। সত্যি বলতে কি, রিড যখনই বাইরে গেছেন একটি শার্ট—তাঁর সেই বিখ্যাত সোনালিরঙা শার্টখানি পরেই গেছেন, যেন সবাই তাঁকে দেখা মাত্র চিনে ফেলতে পারে। আমরা এটিকে তাঁর ‘সাহসী’ শার্ট বলে ডাকতে শুরু করি।

আমাদের ফেরার প্রথম কয়েকদিন আমরা কোথাও-ই যেতে পারিনি। মার্চ মাসে আমরা যে-রক্তের দাগ, ধুলোবালি ও আবর্জনা ফেলে গিয়েছিলাম সেগুলো পরিষ্কার করতেই এতটা দিন লেগে গিয়েছিল আমাদের।

আমরা যখন বন্ধুদের কাছে যাওয়া শুরু করেছিলাম তখন একটা বেবিট্যাক্সি ঠিক আমাদের বাসার দরজা পর্যন্ত আসত। আমরা ঝটপট উঠে পড়তাম, যেখানে যাওয়ার যেতাম, সেখানে কিছুক্ষণ থেকেই, আবার বাড়ি ফিরে আসতাম। আমরা কখনো রাস্তায় দাঁড়াতাম না এবং খুব কমই কেনাকাটা করতাম।

আমরা আমাদের সাবধানী ও গুটিকয় বাড়ি-বেড়ানোর মধ্যেই বুঝতে পারতাম চারপাশের পরিবেশের পরিবর্তনটুকু। আপনি যেখানেই যান সেখানেই সৈন্যেরা বন্দুকহাতে টহল দিচ্ছে, নয় ট্রাকের পেছন থেকে আপনার দিকে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে রয়েছে, দুমদাম দোকানে ঢুকে তাদের যা যা দরকার নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এটা একটি দেশের দুই অংশ ছিল না মোটেও, যারা তাদের পাথর্ক্য ও বিরোধগুলো মিটিয়ে ফেলতে চাইছে। এটি শক্তিধর রাষ্ট্রক্ষমতা কর্তৃক প্রতিরোধহীন একটি অঞ্চলের দখলদারিত্ব ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রতিটি মুখে ভয়ের চিহ্ন। বাচ্চারা গান গেয়ে উঠলেই মায়েরা তাদের মুখ চাপা দিত, পাছে তারা সেই জনপ্রিয় ‘জয়বাংলা’ বলে ওঠে। রাস্তার ধারে যারা মধ্যরাত পর্যন্ত আড্ডা দিত সেইসব জটলা অদৃশ্য হয়ে গেছে। রাত নামলে কদাচিৎ কোনো গলার শব্দ কিংবা চলাফেরার আওয়াজ পাওয়া যেত বাইরে। একবার এক বন্ধুর বাড়ি থেকে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরার সময়, রাত সাড়ে নয়টায় একপাল বুনো শেয়ালকে সদর রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করতে দেখেছিলেন রিড।

এমনকি দিনের বেলাতেও সবকিছু বেশ শান্ত ছিল। একসময় আমি অভিযোগ করে বলেছিলাম যে, “আমি একটি বাজারের মধ্যে বাস করি,” কেননা আমি আমার বারান্দা থেকে না নেমেই জুতা, বিছানার চাদর, জ্যান্ত মাছ, হাঁড়িপাতিল, তাজা ফল ও সব্জি, বাসনপত্র, ডিম, কাপড়চোপড়, দরজার পাপোষ, ঝাড়ু, আইসক্রিম, চকলেট, গরম চিকেন প্যাটিস, অষুধপত্র কিনতে পারতাম। আমি আমার কাঁচি ধার দেওয়াতে এবং জুতা সেলাইও করাতে পারতাম। আমি পুরনো পত্রিকা ও শিশিবোতল বিক্রি করতে পারতাম। এখন এমনকি এই হকারেরাও সব রাস্তাঘাট ছেড়ে চলে গেছে।

দরজার গায়ে বাতাসের একটু জোর আঘাত, গাড়ির টায়ার ফাটা কিংবা ইঞ্জিনের অস্বাভাবিক শব্দে নিরীহ পথচারীরা ধারেকাছের দেয়াল টপকে আড়ালে গিয়ে লুকাত। তবে প্রায়শই এর কোনো কোনোটা হতো সত্যিকারের বুলেট কিংবা বোমার শব্দ।

আমাদেরকে মাঝেমধ্যে বাজারে যেতেই হত। চট্টগ্রামের কেন্দ্রে একটি চারতলা বাজার রয়েছে, নিউ মার্কেট নামে। একদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় আমরা একটা দোকানে কাপড় কিনছিলাম। হঠাৎ করে আমাদের চারপাশের লোকজন ছোটাছুটি শুরু করে দিল।

“মিলিটারি আসছে! মিলিটারি আসছে!” বিপণীবিতানের সিমেন্টের দেয়ালে ও ছাদে এই চিৎকারের প্রতিধ্বনি হচ্ছিল। বুড়ো মালিক দ্রুত আমাদেরকে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজার শাটার নামিয়ে দিলেন।

“ভয় পাবেন না! ভয় পাবেন না,” তিনি বারবার বলতে থাকেন, যদিও সেটা তিনি নিজেকে নাকি আমাদেরকে বলছিলেন, আমরা বুঝতে পারিনি। গুলির শব্দ শোনা যায়, তবে বিল্ডিংয়ের ভেতরে নয়। এটা একটা নকল বিপদসংকেত ছিল। আসলে আমাদের অবস্থান থেকে পৌনে এক মাইল দূরে অবস্থিত রেলওয়ে স্টেশনে আক্রমণ চালানো হয়েছিল।


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৭)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৬)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৫)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৪)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৩)

   

দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন



রামকৃষ্ণ জানা
দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন

দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন

  • Font increase
  • Font Decrease

রামকৃষ্ণ জানা

[বিশ্ব নদী দিবস প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রোববার। বিশ্ব নদী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘রাইটস অব রিভার'। বিশ্বেরা অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিবসটি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। ইতিহাসবিদ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপক ড.  রূপকুমার বর্মণ নদী ও ইতিহাসের চর্চায় উন্মোচন করেছেন মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বাহুমাত্রিক বিন্যাস।]

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্য দিয়ে অসংখ্য নদী প্রবাহিত হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত নদী-অববাহিকাগুলোতে ঘটে চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন যা বিশ্বব্যাপী অভিবাসনচর্চার অন্যতম বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে নদীকে বহুমুখী ব্যবহারের মাত্রাবৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত নদীজনিত সমস্যার কারণে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের াা অঞ্চলের মানুষেরা নিজেদের জীবনকে রক্ষা করতে জোরপূর্বক অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছে। এইরকম একটি প্রেক্ষাপটকে ড. রূপকুমার বর্মণ তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ইতিহাসচর্চায় এক বিশেষ স্থান দিয়েছেন।   

মোট তিনটি অধ্যায় এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক সারণীসহ এই বইটিতে একই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে। গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে নদীমাতৃক বাংলার জেলেসম্প্রদায়ের মানুষের জীবনজীবিকার ওপরে নদীর অপরিসীম প্রভাব। ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে লিখিত বিভিন্ন সাহিত্যগুলি যে তৎকালীন সমাজের দর্পণ-লেখক তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সাহিত্যের নিরিখে  বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামক উপন্যাসকে লেখক উক্ত অঞ্চলের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে শুধু নদীর সম্পর্কের আলোচনায় সীমাবদ্ধ না রেখে একে কেন্দ্র করে নদী-উপকূলবর্তী মানুষের জীবনসংকট ও তারই প্রভাবে যে তাদের অভিবাসন ঘটেছিল সেই প্রেক্ষিতকে নদীর ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে নতুনভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে তিতাস-অববাহিকায় মালোসম্প্রদায়-অধ্যুষিত চরটি একে একে জনশূন্য হয়ে উঠেছিল-তাও এতে পরিস্ফুটিত। বর্তমানে পরিবেশ-ইতিহাসচর্চায় আভ্যন্তরীণ অভিবাসনের একটি প্রামাণ্য দলিল রূপে বর্ণিত এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করে মানুষের আভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি ও অভিবাসন সংকটের কথাকে স্মরণ করিয়ে ডঃ বর্মণ এই সাহিত্যকে ইতিহাসের এক অন্যতম আধারে পরিণত করেছেন। 

ই. এইচ. কার(E. H. Carr)-এর ইতিহাসচর্চার মূল নির্যাস-‘ইতিহাসকে জানার আগে ঐতিহাসিক কে. জানো’-এ সম্পর্কে গ্রন্থকার পূর্ণমাত্রায় সচেতন। তিনি মালোজাতির ইতিহাসকে তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে বুকানন হ্যামিল্টন(Francis Buchanan-Hamilton), নৃতত্ত্ববিদ জেমস(Dr.James Wise) ও রিসলে(H.H. Risley) প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জেলেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ করেছেন। পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক সরকারের হীনবিভাজন নীতি থেকে মুক্তি পেতে তারা যে ১৯১৩ সালে ‘ঝালো-মালো ক্ষত্রিয় সমিতি’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতায়ন ঘটিয়েছিল লেখক তা বর্ণনা করেছেন।   

অধ্যাপক বর্মণ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে আসাম ও বাংলার নদী-উপত্যকাগুলিতে বসবাসকারী মানুষদের সার্বিক জীবনের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে ঐ অঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক সাহিত্যগুলোকে তাঁর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে ব্যবহার করেছেন। দেবেশ রায় রচিত ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’-কে লেখক একজন ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিয়েছেন যে একটি নদী  কীভাবে আঞ্চলিক স্তরের সংগ্রাম থেকে মানুষকে আন্তর্জাতিক স্তরের সংগ্রামে উত্তীর্ণ করতে পারে। তিস্তা নদী রাজবংশী সম্প্রদায়ের কাছে ছিল এক দেবীস্বরূপা আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ থেকে আগত প্রভূত মানুষের কাছে এই নদী-উপকূল হয়ে উঠেছিল আশ্রয়দাত্রী জননীস্বরূপা। এই প্রসঙ্গে লেখক অত্যন্ত সুচারুভাবে এই অঞ্চলের আদিবাসিন্দা রাজবংশী সম্প্রদায় ও আগন্তুক উদ্বাস্তু বাঙ্গালীর দ্বন্দ্বকে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তুলে  ধরেছেন। যুক্তফ্রন্ট সরকার ও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গৃহীত বিভিন্ন ভূমিসংস্কারমূলক পদক্ষেপ (যেমন-‘অপারেশন বর্গা’) এই রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায় এবং ইউ. কে. ডি. (UKD) ও ইউ. টি. জে. এ. এস. (UTJAS)-নামক আঞ্চলিক দলগুলি অচিরেই তাদের পূর্বতন দাবী তথা কামতাপুর রাজ্যগঠনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তিনি দেখিয়েছেন ভারত ও বাংলাদেশ জলবণ্টনচুক্তি অনুযায়ী তিস্তা নদীতে বাঁধ নির্মাণের দ্বারা সরকার মানুষের উন্নতি ঘটাতে সচেষ্ট হলেও সেই উন্নয়নযজ্ঞই কীভাবে নদী-উপকূলবর্তী মানুষগুলোকে বঞ্চনার শিকারে পরিণত করেছিল। অবশেষে ডঃ বর্মণ প্রশ্ন তুলেছেন-বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ কি তবে তিস্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে নাকি এখনও  মানুষ তিস্তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে?  

এরই সঙ্গে গ্রন্থকার সাহিত্যিক জিতেন্দ্র দাস লিখিত ‘কলহি নদীর একুল হিকুল’-গ্রন্থের ইতিহাসনির্ভর বিশ্লেষণের মাধ্যমে তৎকালীন আসামের বিশেষত দিপার বিলসংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন। কালক্রমে এই নদীর চরে অশান্তির বার্তা বহন করে আনে বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন এবং এরই  ফলশ্রুতিতে এখানে শুরু হয় বহিরাগত ও স্থানীয় মানুষদের সমাজের সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য স্থাপনের এক তীব্র অসম লড়াই। অসমের একটি নদীচরের মানুষের আভ্যন্তরীণ সংকট কীভাবে একটি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল তা লেখক বর্ণনা করেছেন। 

এই গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে ড.  রূপ কুমার বর্মণ তাঁর বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন যে, ভুটানের ওয়াং-চু (পশ্চিমবঙ্গে রায়ডাক ও বাংলাদেশে দুধকুমার নামে পরিচিত) নদী কীভাবে ভুটানের প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রমশ সমগ্র ভুটানবাসীর জীবনের অবলম্বন হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ভুটানের বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করে কীভাবে এই নদী ভুটানবাসীর মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল তার ইতিহাস লেখক তুলে ধরেছেন।  লেখকের বর্ণনায় প্রাধান্য পেয়েছে রায়ডাক-১ ও রায়ডাক-২ নদীর গতিপথে অসম ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় উদ্ভূত ঝাউকুঠি, বলাভুত ও রামরাই কুঠির মত অসংখ্য চরে বসবাসকারী মানুষের জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। তিনি দেখিয়েছেন যে এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে কোচ, মেচ, রাভা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর সাথে সাথে এখানকার অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে রাজবংশী মানুষের বসতি। ঔপনিবেশিক আমলে ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুন্ডাদের শ্রমিক হিসেবে আগমনের ফলে এই নদী-অববাহিকার বসতিগুলি এক মিশ্র সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব-পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকেও অনেক মানুষকে এই অঞ্চল সাদরে গ্রহণ  করে নিয়েছিল। ডঃ বর্মণের নৃ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এইভাবেই এই নদী-অববাহিকা হয়ে উঠেছিল এক টুকরো ভারতবর্ষ।  

লেখক এই অধ্যায়ে আরও দেখিয়েছেন যে একই নদীর জল বহুধর্ম ও বহুসংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে আবহমানকাল ধরে। কোচবিহারের রাজাদের অনুগ্রহে কামাক্ষ্যা মন্দিরের ভিত্তিস্থাপনের ইতিহাস লেখক তুলে ধরেছেন। পরবর্তীতে আবার এই রাজারা এই অঞ্চলেই একাধিক শিবমন্দির স্থাপন করে কোচবিহারের প্রধান দেবতা হিসেবে শিবকে স্থান দেন। অন্যদিকে এখানেই শঙ্করদেবের হাত ধরে একসময় যে বৈষ্ণবধর্মের উত্থান ঘটেছিল তা পরবর্তীতে কোচসাম্রাজ্যের রাজধর্মে পরিণত হয়। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে বৈষ্ণবসত্রগুলি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছিল। একদা কোচপ্রশাসনের ওপর বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তাঁরা নিজেদের নামের সাথে ‘নারায়ণ’ উপাধি সংযোগ করেছিলেন ও কোচমুদ্রার নাম ‘নারায়ণী মুদ্রা’ রেখেছিলেন। সেইসঙ্গে এই অঞ্চলে লৌকিক দেবদেবীরও পূজা-পাঠ প্রচলিত ছিল। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে ঔপনিবেশিককালে খ্রিষ্টান মিশনারীরা ‘ইভানজেলিকালিজম্’ ধারণার বশবর্তী হয়ে রাভা ও মেচ উপজাতিদের কীভাবে খ্রিষ্টানধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং এইসকল প্রান্তিক মানুষদের জীবনে পাশ্চাত্য ধর্ম ও শিক্ষা প্রবেশের সাথে সাথে তাদের নিজেদের চিরায়ত ঐতিহ্য, ধর্ম-সংস্কৃতির যে পরিবর্তনগুলি ঘটেছিল সে বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেছেন।

তবে আলোচ্য গ্রন্থে এই অঞ্চলের অন্যান্য অনেক নদীর কথা লেখকের আলোচনায় স্থান পায় নি। তিনি এই অঞ্চলের নিম্নবর্গের মানুষের ইতিহাসকে তুলে ধরলেও তাঁর লেখায় একটি বিশেষ জনজাতির কথা প্রাধান্য পেয়েছে। নদীর অভিশাপ তাহলে কি শুধুমাত্র জেলেসম্প্রদায়ের ওপর পড়েছিল কিংবা ঝালো-মালো সম্প্রদায়ের বর্তমান সামাজিক অবস্থান কেমন-এসকল প্রশ্নের উত্তরসন্ধানে লেখক নীরব থেকেছেন। তিনি অভিবাসনের ফলে সৃষ্ট এই অঞ্চলের আদি-অধিবাসীদের ক্ষোভের কথা উল্লেখ করলেও বাঙ্গালী উদবাস্তুর যন্ত্রণার কথা তাঁর লেখায় উহ্য থেকেছে। নদীকেন্দ্রিক উন্নয়নযজ্ঞ এই অঞ্চলের জনজাতিবিন্যাসকে কতখানি প্রভাবিত করেছিল তা আরও স্পষ্টভাবে পরিস্ফুটিত হলে তা পাঠকের মনে অধিক আগ্রহের সঞ্চার করত। কামতাপুর রাজ্যের দাবী উত্থানের পশ্চাতে অন্যান্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ভূমিকা এবং অসমের বঙ্গাল খেদাও আন্দোলনের ফলে দেশের অভ্যন্তরে বাঙ্গালীদের অভিবাসনের ঘটনা লেখক ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে ধরেছেন।

ডঃ বর্মণ তাঁর লেখা এই বইটিতে দেখিয়েছেন যে কোন অঞ্চলের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে সেই অঞ্চলকেন্দ্রিক রচিত সাহিত্যগুলি কীভাবে ইতিহাস রচনার প্রামান্য দলিল হয়ে উঠতে পারে। সাহিত্যে প্রতিভাত দলিত মানুষের জীবনসংগ্রামকে নদীকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় স্থান দিয়ে লেখক তাঁর অনন্য রচনাশৈলীর পরিচয় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। নদী কীভাবে জনমানসের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং সেইসঙ্গে মানুষের জীবনধারণের অর্থনৈতিক কাণ্ডারী হয়ে উঠতে পারে তা লেখক তাঁর সুদক্ষ লেখনীর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। তাঁর লেখায় নদী হয়ে উঠেছে নদী-অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর গোষ্ঠীগত এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রতীক। আবহমানকাল ধরে নদী মানুষের অভিবাসনের ফলে উদ্ভূত বিভিন্ন আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সাক্ষী থেকেছে এবং দ্বন্দ্বপ্রসূত অভিবাসনের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট আদি-অধিবাসী ও আগন্তুক সম্প্রদায়ের লোকেদের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্কের দলিল এই উপন্যাসকেন্দ্রিক ইতিহাস-বিশ্লেষণ। উত্তরবঙ্গের কামতাপুরি আন্দোলন(১৯৬৯) এবং অসমের বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন(১৯৭৯-১৯৮৫) উদ্ভবের ক্ষেত্রে নদী কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হয়ে ওঠে তা লেখকের ইতিহাসচর্চায় এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। সেইসঙ্গে নদী কীভাবে ধর্ম-সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে তার এক নির্ভরযোগ্য ইতিহাস-বিশ্লেষণ লেখকের লেখনীতে পরিস্ফুটিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গ ও অসমের পরিবেশ-ইতিহাসচর্চায় এই বই যে কতখানি মূল্যবান তা পাঠক  বইখানি পাঠের পর সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন।     

......

গ্রন্থ সমালোচনা

Rup Kumar Barman, River, Society and Culture: Environmental Perspectives on The Rivers of Assam and Bengal. Delhi: Primus Books, 2023, xix+95pp, ISBN: 978-93-5687-835-8(Paperback)

.........

রামকৃষ্ণ জানা ,গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

;

গড়তে চান বই পড়ার অভ্যাস?



মোঃ শরীফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

  • Font increase
  • Font Decrease

লাইব্রেরিগুলো আজকাল ফাঁকা পড়ে থাকে। ক্যাম্পাসের আড্ডায় বই, সে বড়ই হাস্যকর! বই পড়ার মতো সময় হয়ে ওঠে না কারোরই! আমাদের বর্তমান সময়টা কেড়ে নিয়েছে মোবাইল আর ইন্টারনেট। অথচ বই পড়ার গুরুত্ব কমবেশ সকলেরই জানা।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য বই কতটা জরুরি সেটা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু একটি বই পড়ার জন্য যে সময় প্রয়োজন, প্রয়োজন উপযুক্ত স্থান। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সঠিক বই নির্বাচন।

বই পড়া শুরুর ক্ষেত্রে নতুন পাঠকরা নানান সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পেরে অনেকের আর বই পড়াই হয় না। আজকের আলোচনায় আমরা জানব কীভাবে একটি বই পাঠ করা যায়, গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস।

সময়: বই পড়ার কথা বললেই সবাই এক বাক্যে বলবে, ‘সময় নেই!’ সময় নিয়ে আমাদের অভিযোগের বড় কারণ হলো, নিজের কাজগুলো গুছিয়ে না করা। প্রতিদিন মাত্র ২০-৩০ মিনিট সময় দিয়েই কিন্তু গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস। সময় না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া। তাই, সকাল কিংবা সন্ধ্যা হাতের ফোনটা দূরে সরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসে যান বই নিয়ে।

পরিবেশ: উপযুক্ত পরিবেশ বই পড়ার মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়। জানালার পাশে, বেলকনিতে কিংবা বাসার ছাদে বই পড়ার স্থানটি যেন হয় নির্জন এবং শান্ত। আজকাল বিভিন্ন পার্কে ‘নীরব বই পাঠ কর্মসূচি’ দেখা যায়। চাইলে যোগ দিতে পারেন তাঁদের দলেও। বই পড়ার পাশাপাশি পরিচয় হবে বইপ্রেমী মানুষদের সাথে।

বই নির্বাচন: বই পড়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছে যেমন জরুরি তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক বই নির্বাচন। এক্ষেত্রে নিজের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিন। যেসব গল্প আপনাকে আকর্ষণ করে শুরুতে সেই বইগুলোকেই আপনার পাঠ্য তালিকায় রাখুন। 

পাঠাগার: পাঠাগারে গেলেই যে বই পড়তেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বইয়ের সাথে সময় কাটালে এক সময় সেটা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হবে। আর ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে কখন যে দু’য়েক পাতা পড়ে ফেলবেন, নিজেই টের পাবেন না! তাই বই পড়ার অভ্যাস গড়তে চলে যান পাঠাগারে। বই না পড়ুন, অন্তত সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা তো হবে!

সোশ্যাল মিডিয়া: আমরা সবকিছুতেই সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার সুষ্ঠু ব্যবহার আপনার অভ্যাস গড়ার বড় সহায়ক। ফেসবুকে সাহিত্য তথা বই বিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা হয়, হয় বই বিষয়ক আড্ডাও। এসব গ্রুপে যুক্ত হয়ে বাড়াতে পারেন বইয়ের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা।

ধারাবাহিকতা: বলা হয়ে থাকে টানা ২১ দিন কোনো কাজ করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। বই পড়ার ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। অভ্যাস গড়তে হলে ধরে রাখতে হবে ধারাবাহিকতা। সামান্য হলেও প্রতিদিন পড়ুন। এই ধারাবাহিকতায় আপনার বই পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করবে। 

বই পড়ার অভ্যাস রাতারাতি তৈরি হবে না। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়। নতুন পাঠকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছুদূর পড়ার পর বইটি আর ভালো লাগে না। এক্ষেত্রে ধৈর্য্যহারা হওয়া যাবে। জোর করে সে বই পড়ার প্রয়োজন নেই।

বই মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ায়। বই পড়ার অভ্যাস গড়তে পারলে জীবনে উন্নতি সাধন অবধারিত। একাডেমিক পড়ার বাইরেও বইয়ের বিশাল একটি জগত রয়েছে। সেই জগতে মানুষ জানার জন্য পড়ে, পড়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য। বই পড়লে মানসিক চাপ হ্রাস পায়, হয় মস্তিস্কের ব্যায়াম, বাড়ে শব্দ ভান্ডার ও স্মৃতি শক্তি। বই পাঠকের চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করে, বৃদ্ধি করে বিশ্লেষণ ক্ষমতা। বই পড়ার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশ হয়। তাই বই হোক প্রত্যেক মানুষের উত্তম বন্ধু এবং বইয়ের সঙ্গে হোক আমাদের মিতালি।

;

মায়ের সমাধির খোঁজে



মহীবুল আজিজ
মায়ের সমাধির খোঁজে

মায়ের সমাধির খোঁজে

  • Font increase
  • Font Decrease

কন্ডাক্টরকে বললাম, এখানে নামিয়ে দিন,
এখানে এই মিয়াপাড়ায় আমি নামবো—
মিয়াপাড়া কবরস্থানে শুয়ে আছে আমার মা।
মায়ের কবর দেখতে এলাম আটান্ন বছর পরে,
জ্যাঠা বলেছিলেন, গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটু গেলে
একটা গোলাপ গাছ ঘেঁষে কবরটা,
কবরের আগে আমাকে গোলাপ গাছ খুঁজতে হয়—
জ্যাঠা চলে গেছেন তা-ও বত্রিশ বছর।
ডানদিকে ঘুরতেই জড়িয়ে ধরে তাজা গোলাপের ঘ্রাণ,
পাশাপাশি চারটা কবর, চারটাতেই গোলাপের পাহারা;
এত কবর এত কবর, কবরে ভর্তি কবরস্থান—
কোথায় শেষ শয্যা নিয়েছিলেন আমার মা!
হাওয়ায় পাতা দোলে গোলাপের, চারটাই একসঙ্গে,
চারটা গাছ থেকেই মুখবাড়ানো গোলাপ ডাক দেয়—
এইখানে এইখানে এইখানে—কোন্খানে!
উবু হবো কবরের মাটি নিতে
কিন্তু চারটাই ডানদিকে, চারটাই গোলাপের পাশে,
প্রতিটি কবর থেকে একটি একটি মুঠো নিয়ে
পলিথিনের চারটে ব্যাগে রাখি।
একবার মনে হয় প্রথমটাতে,
তারপর মনে হয় দ্বিতীয়টাতে,
আবার মনে হয় তৃতীয়টাতে
এবং মনে হয় চতুর্থটাতে সন্ধান রয়েছে মায়ের।
মা সুপ্ত থেকে যান অনির্দিষ্ট মাটিতে ,
তবে কোন্ মানবের মাটি ধরে রাখি বুকের কাছে!
ঠিক তখন বিস্ময়ের মতন একটি ফুটন্ত গোলাপ
গাছ থেকে ঝরে পড়ে দ্বিতীয় কবরে,
সংশয়ী মন বলে, তবে কী গোলাপই বার্তাবহ মায়ের!
অদৃষ্টে অবিশ্বাসী মন দোলে সংশয়ে,
তখন আরেকটি গোলাপ ঝরে পড়ে চতুর্থ কবরে।
অর্থাৎ দুই যোগ দুইয়ে এসে আমার আর হিসেব মেলে না,
জ্যাঠা বলেছিলেন, কবরটা গেটের ডানদিকে ঘুরতেই
এবং গোলাপের পাশে।
বত্রিশ বছরে চতুর্গুণ হয়েছে গোলাপ
কিন্তু এক ও অবিভাজ্য আমার মা’কে
এই গোলাপের কারণেই খুঁজে পাই না আমি—
ফিরে আসি শুধু গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে।

১১-০৯-২০২৩

;

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল



শরীফুল আলম
অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

  • Font increase
  • Font Decrease

 

আমি সীজার হতে চাইনি
তবুও তুমি ক্লিওপেট্রাই থেকে গেলে
অহেতুক লড়াইয়ে তুমি জয়ী হতে চেয়েছিলে
সম্ভবত একেই পরিযায়ী প্রেম বলে
আলো আঁধারীর খেলা বলে
স্বপ্ন আর জেগে থাকা বলে ,
সমাপ্তি কিম্বা বিবিধ, তা সে যাই হউক
এই সহজ কথাটি
আমরা কেউ কাউকে সহজ ভাবে বলতে পারিনি
অথচ তুমি ফ্রিজিডেয়ারটি বন্ধ করে রাখলে
আর বললে, "নোটেড ",

নিউইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
হ্যাঁ, এটাই সত্যি
তুমি লৌহশৃংখলে অনুজ্জ্বল এক ডিমলাইট
সুচারু মোহের অভাবে তুমি প্রমত্তা নদী
বাবুই পাখীর বাসার ন্যায় তুমি ঝুলে থাক আমার স্বপ্নে
যা হতে পারতো নির্মল এক সবুজের প্রান্তর ।

তুমি ওঁত পেতে থাকা বাঁশপাতার ফাঁকে পূর্ণিমা
আমি তোলপাড় করে ছুটে চলা এক্সপ্রেস ট্রেন
দলছুট শালিক,
আজ কোন বৈভব নেই
ভালোবাসাবাসি নেই ,
কবিতাও ইদানিং প্রিয় লাগেনা
তবু স্নায়ুরা জেগে থাকে
মনে হয় হলুদ পাতায় যেন ক্লোরোফিল
আমিও প্রবণতায় ফিরে যাই সাইবেরিয়া ।

আনচান মনে কত আকুলতা
কালবৈশাখীর তান্ডব
যেন বাতাসে কাঁপন ধরে,
এসো সখা,
এই শ্রাবণে আবার রিডিজাইন করি,
স্যাটেলাইটে প্যারালাল বার্তা পাঠাই
ভুলে যাই অর্ধেক রিয়েল আর অর্ধেক ভুল
প্লাবনে অবাধ্য ঢেউয়ের উছ্বল ।

________________________________________

 ৯ সেপ্টেম্বর । ২০২৩।
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

 

;