নৃশংস খুনী এরশাদ শিকদারের শুরু ও শেষ



তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
এরশাদ শিকদার

এরশাদ শিকদার

  • Font increase
  • Font Decrease

কিছু মানুষ আছেন যাদের পরিচয় করিয়ে দিতে তাদের কাজের বিবরণ দিতে হয় না। নামই হয়ে ওঠে তাদের কাজের বিবরণ, শুনলেই লোকে বুঝে ফেলে তিনি কে এবং তার কাজ কী। এমনই একজন কুখ্যাত খুনী এরশাদ শিকদার—যার নাম শুনলে লোকে ভয়ে, ঘৃণায় আঁতকে ওঠে এখনো।

একজন মানুষের পক্ষে করা সম্ভব এমন কোনো অপরাধ নেই যা সে করেনি। খুন, গুম, হত্যা, ধর্ষণসহ নির্যাতনের সকল শাখায় ছিল তার অবাধ বিচরণ। মানুষহত্যার ক্ষেত্রে এরশাদ শিকদার মাঝেমাঝে এমন সব উপায় অবলম্বন করত যা শুনলে যে কোনো মানুষ ভয়ে কেঁপে উঠবে। কিন্তু এরশাদ শিকদার তা করত হাসিমুখে। কাউকে হত্যা করার জন্য নির্মমভাবে আঘাত করার পর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত বুকের পাঁজরের ওপর উঠে নাচতে থাকা ছিল যার প্রিয় শখ, রক্তের পিপাসা মিটিয়ে দুধ দিয়ে গোসল করে নেওয়া ছিল যার প্রিয় অভ্যাস, সেই এরশাদ শিকদারের কথাই বলছি। শুধু তাই নয়, এরপর নিজেকে বিনোদিত করার জন্য আয়োজন করত জলসার। নাচ গানে ভরপুর সেই জলসায় আবার শরিক হতো ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ, যাদের ছত্রছায়াতেই একজন ছিঁচকে চোর থেকে বিশ্বের সেরা দশজন ‘সিরিয়াল কিলারের’ একজন হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায় এরশাদ শিকদার। জলসায় সবচেয়ে বড় চমক হিসেবে থাকত এরশাদের নিজের কণ্ঠে গাওয়া গান—‘আমি তো মরে যাব চলে যাব রেখে যাব সবই…’

এরশাদ শিকদারের উত্থান যে কোনো সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। এজন্যেই হয়তো নিজে একবার হলেও একটি ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিল এরশাদ। শোনা যায় একজন পরিচালককে তিনি প্রায় আড়াই কোটি টাকা দিয়েছিলেন তাকে সিনেমায় ভিলেন হিসেবে নেওয়ার জন্য। কিন্তু বাস্তবে যে এত বড় ভিলেন তার আসলে সিনেমার সাহায্যের দরকার পড়ে না। প্রকৃতিও তাকে তাই সেই সুযোগ দেয়নি।

মুনীর-খুকু এবং রীমা হত্যা ট্র্যাজেডি

এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। তার পিতার নাম বন্দে আলী। জন্মের পর থেকেই দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে করে বেড়ে ওঠা তার। অল্প বয়সেই পিতৃবিয়োগ। এরপর সংসারের হাল ধরেন তার মা। অন্যের বাসায় কাজ করে কোনোমতে দিনাতিপাত করতেন তিনি। অন্যদিকে এরশাদ ছোটবেলা থেকেই ছিল ডানপিটে। ছোট ছোট চুরি, মারামারি এসবের বিচার প্রায়ই আসত তার মায়ের কাছে। তবুও সে থামত না। সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াত সারা গ্রামে। একদিন বাসায় এসে এরশাদ এমন একটি দৃশ্য দেখতে পায় যা কোনো ছেলের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এলাকার একজন প্রভাবশালী লোককে মায়ের সাথে খুবই অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলে এরশাদ। তখন সে কিছুই করতে পারেনি। কে জানে এই ঘটনার প্রভাবেই কিনা পরবর্তী জীবনে অসংখ্য নারীকে বানিয়েছে ভোগের পণ্য। এমনকি তার নিজের ঔরসজাত কন্যা সন্তানও তার লালসার শিকার হয়

দেখতে শুনতে এরশাদ ছিল সুদর্শন। এজন্যেই যখন সে নিজ গ্রাম ছেড়ে জীবিকার জন্য ছুটে যায় খুলনার ঘাট এলাকায় আর কুলির কাজের পাশাপাশি শুরু করে ছোটখাট চুরি বাটপারি, তখন সবাই তাকে ‘রাঙ্গা চোর’ নামে ডাককে শুরু করে। আঞ্জু সরদার নামে এক কুলির সর্দার তাকে সমকামিতায় বাধ্য করে। পরবর্তীতে এই আঞ্জু সরকারকে ব্যবহার করেই ট্রলার থেকে মাছ আর গম চুরি এবং জাহাজ থেকে তেল চুরির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে হাত পাকায় এরশাদ। আর এভাবেই এককালের ‘রাঙ্গা চোর’ একদিন ভয়ঙ্কর খুনী হয়ে ওঠে।

এরশাদ শিকদারের জীবন কাহিনী কোনোভাবেই সিনেমার চেয়ে কম নয়। বরং তার বর্বরতা এবং নৃশংসতা কখনো সিনেমার নির্মম কাহিনীকেও হার মানায়। তার রাঙ্গা চোর থেকে এরশাদ শিকদার হয়ে ওঠা গল্পটাও যেন কোনো সুদক্ষ স্ক্রিপ্ট রাইটারের হাতেই লেখা।

মাছ, গম কিংবা তেল চুরি করে তার পোষাচ্ছিল না। ১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে এরশাদের নতুন সঙ্গী হলো একটা রামদা। এটা নিয়ে সে শুরু করল ছিনতাই। বেশ কয়েকজন সঙ্গীও জুটে গেল। অপরাধের একটা সার্কেল তৈরি হলো। বার্জ-কার্গো থেকে পণ্য চুরি করে নদীতে লাফিয়ে পড়া, রেললাইনের স্লিপার চুরি, কাঠ চুরি, রেলের ওয়াগন ভাঙা, ট্রলারে চাঁদাবাজি ইত্যাদি শুরু হয়ে গেল পুরোদমে। যে-ই প্রতিবাদ করছিল তার কপালেই জুটছিল রামদার কোপ। ধীরে ধীরে পুরো ঘাটে ছড়িয়ে পড়ল একটি নাম—এরশাদ শিকদার।

এরশাদ শিকদারের গল্প বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে টেনে আনা বাতুলতা। তবুও রবীন্দ্রনাথ বাঙালির জীবনের সাথে যেভাবে মিশে আছেন তাতে তাকে ছাড়া চলাও মুশকিল। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “পেয়ে পাওয়া ফুরায় না, বরং চাওয়া বেড়েই ওঠে।” এরশাদের হয়েছিল এই অবস্থা। সময়টা ১৯৮২। এক এরশাদ ঘাটের রাজা, কাকতালীয়ভাবে আরেক এরশাদ তখন দেশের রাজা। বিচক্ষণ এরশাদ শিকদার নিজের ক্ষমতার পরিধি বৃদ্ধির জন্য রাজনীতিতে যোগ দেয়। ১৯৮৮ সালে এক ভোটারবিহীন নির্বাচনে সে হয়ে যায় তৎকালীন ২১ নাম্বার, বর্তমানে ৮ নাম্বার ওয়ার্ডের কমিশনার। ব্যাস, তাকে আর কে আটকায়। চলতে থাকে একে একে জায়গা দখল। রেলের জায়গা, ব্যাংকের জায়গা, বিমানের জায়গা দখল করে গড়ে তোলে প্রায় ৬০ হাজার লোকের জন্য একটি বস্তি। যে লোকগুলো হয়ে ওঠে এরশাদের নিত্যদিনের নানান অপরাধের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সঙ্গী

এভাবে এরশাদ হয়ে উঠতে লাগল ওই অঞ্চলের অপরাধ জগতের একচ্ছত্র অধিপতি। বাড়তে লাগল শত্রু, বাড়তে লাগল রক্ত পিপাসা। যে বা যারা বিরোধিতা করতে চাইল, তাকেই হত্যা করা হলো নির্মমভাবে। এই যেমন ইনসাফ, কামাল ও খালেক নামের তিন নৈশপ্রহরী একবার এরশাদের চোরাচালানের কিছু মালামাল ধরিয়ে দিয়েছিল পুলিশের হাতে। কী সাহস! ক্ষিপ্ত এরশাদ বাঘের মতো হামলে পড়ল তাদের ওপর। একেকজনকে মাটিতে ফেলে বুকের ওপর লাফাতে লাগল এরশাদ। অবিরাম আঘাতে পাঁজর ভেঙে দেওয়া হলো তাদের। তারপর গলায় নাইলনের দড়ি দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হলো। একজন এই ঘটনা দেখে ফেলেছিল বলে তাকেও বরণ করতে হলো একই পরিণতি! কী নৃশংস!

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/24/1563963002032.jpg
◤ এখানেই গুলি করে মারা হতো ◢

 

এরশাদের প্রিয় নদী কোনটা এ ব্যাপারে ইতিহাসে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে অনুমান করে হয়তো নেওয়া যায় সেটা ভৈরব নদীই হবে। কেননা এখানেই খুন করে ফেলে দিয়েছে কত মায়ের সন্তানকে তার কোনো সঠিক হিসেব এরশাদ শিকদারের কাছেও ছিল না।

অপরাধ চালিয়ে যেতে হলে রাজনীতির বিকল্প নেই, একথা বুঝতে এরশাদের দেরি হয়নি। তাই তো ৯০-এর পর রাষ্ট্রপতি এরশাদকে হটিয়ে যখন বিএনপি ক্ষমতায়, তখন এরশাদও বিএনপিতে নাম লেখায়। এরপরে ৯৬ সালে নতুন সরকার পরিবর্তন হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেও যোগ দিতে সক্ষম হয় এরশাদ। পাশাপাশি চলতে থাকে তার হত্যাযজ্ঞ। কী বন্ধু, কী শত্রু, কাউকেই রেহায় দেয়নি এরশাদ। শুধুমাত্র সন্দেহের জেরেও সে খুন করে ফেলে মাস্টার জাহাঙ্গীর কিংবা ফটিকের মতো পারিবারিক বন্ধুকে। যারা নিয়মিত বাসায় আসা যাওয়া করত বলে এরশাদের ধারণা হয়েছিল সম্ভবত তার স্ত্রীর সাথে এদের কোনো গোপন সম্পর্ক আছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে হতভাগা লোকটির নাম সম্ভবত আকিমুল। ঝিনাইদহের টেলিফোন অপারেটর ছিল আকিমুল। একরাতে টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাতে ঘোরাতে, দৈবক্রমে সে ফোন করে ফেলে এরশাদের বাসায়। আর কই যায়! এরশাদের স্ত্রী খাদিজার সাথে ফোনালাপ এবং ফোনে প্রেম করার অপরাধে আকিমুলেরও স্থান হলো ভৈরব নদীতে

মানুষ মারার জন্য এরশাদ আলাদা জায়গা বানিয়েছিল। আফ্রিকান মাগুরের একটি পুকুর ছিল তার। জ্যান্ত মানুষ সেখানে ছেড়ে দিলে মিনিট পাঁচেক সময় লাগত উধাও হয়ে যেতে। বরফকল ছিল মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে তার আরকটি কুখ্যাত জায়গা। এখানে যে একবার গেছে, তার আর সহজে ফিরে আসা হয়নি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/24/1563965056550.jpg
◤ এখানেই আফ্রিকান মাগুরের খাবার হতো লাশগুলো ◢

 

এরশাদ শিকদারের অপরাধ জীবনের সবচেয়ে আলোচিত খুনের ঘটনা ছিল যুবলীগ নেতা খালিদ হত্যা। এই হত্যার ঘটনায় করা মামলাতেই গ্রেফতার করা হয়েছিল এই নরপিশাচকে। ১৯৯৯ সালের একরাতে ফোন করে তার বরফকলে যাওয়ার জন্য কয়েকজনকে ডাকে এরশাদ। তার ডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। খুলনা জেলা ছাত্রলীগ নেতা অসিত বরণ বিশ্বাস, আবু হানিফ, আলী আকবর। সাথে ব্যবসায়ী সৈয়দ মনির মীর ও তার ছোট ভাই চয়ন মীর আর যুবলীগ নেতা খালিদ হোসেন তাই রওয়ানা হন মৃত্যুকূপ বরফকলের দিকে। তারা গিয়ে পৌঁছুনোর পর কথাবার্তার একপর্যায়ে এরশাদ অট্টহাসি শুরু করে। এ যেন ঝড়ের আগে প্রকৃতির কঠিন পূর্বাভাস। ভয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে যায় সবার। এরশাদ খালিদকে টেনে হিঁচড়ে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে। রক্ত পিপাসা তখন চরমে। বুকের ওপর লাফ দিয়ে উঠে যায় এরশাদ। লাফাতে লাফাতে বুকের পাঁজর ছিন্নভিন্ন করে ফেলে সে। খালেদ ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।

এ যাত্রা আর রক্ষা হয় না এরশাদের। মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। ভারত থেকে বিশেষ নকশা করিয়ে আনা এরশাদের আবাসস্থল স্বর্ণকমলে অবস্থান করছিল এরশাদ। এমন সময় খবর আসে পুলিশ তাকে ধরতে আসবে। এরশাদ পালাতে গিয়েও সিদ্ধান্ত বদলায়। সে সবাইকে তার ক্ষমতার জোর দেখিয়ে দিতে চাইল। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেই চড়ে বসল ভ্যানে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/24/1563965154859.jpg
◤ স্বর্ণকমল ◢

 

২০০০ সালের ৩০ এপ্রিল খুলনার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারক এম হাসান ইমাম এরশাদ শিকদারের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলেন। ২০০৪ সালের ১০ মে রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর হলো দেশের ইতিহাসে কুখ্যাত এই ঘাতকের। এরশাদ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মৃত্যুর দিকে। পেছনে পড়ে রইল তার সকল কুকর্ম, পুলিশ এলেই লুকিয়ে থাকার জন্য খেলনা কবর, পড়ে রইল তার শত্রদের ফাঁসি দেওয়ার সেই ঘর। পড়ে রইল তার নিজের গাওয়া গান, “আমি তো মরে যাবো...”

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/24/1563965215783.jpg
◤ এরশাদের খেলনা কবর ◢

 

সত্য মিথ্যার, ন্যায় অন্যায়ের লড়াইটা আজকের নতুন না। এই লড়াই চলে আসছে পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে। যতদিন মানুষ থাকবে, পৃথিবী থাকবে, এই লড়াইও থাকবে। মিথ্যা, অন্যায় হয়তো সাময়িকভাবে বিজয়ের মালা পরতে পারে, কিন্তু সবশেষে সত্য এবং ন্যায়েরই জয় হয়। এরশাদ শিকদারের উত্থান ও পতন এই কথারই প্রমাণ দিয়ে গেল আরেকবার।

 

Image Courtesy: ‘সবাক’, সুমন সওদাগরের ব্লগ (২০১০)

পাখি ও বন্যপ্রাণীদের দুঃসময়



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
সুন্দরবনের বিপন্ন প্যারাপাখি। ছবি: সংগৃহীত

সুন্দরবনের বিপন্ন প্যারাপাখি। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

জলবায়ু পরিবর্তনে পাখিদের সংখ্যা কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। কমেছে পাখির আবাসস্থল। ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী।

বৈশ্বিক পাখি বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৪২ হাজার প্রজাতি হুমকির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ২৮ ভাগ। বিগত দুশো বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। এভাবে চলতে থাকলে আগামী একশ বছরের মধ্যে এই বন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

সুন্দরবনের খয়রাপাখা মাছরাঙা পাখি। ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতি বিশেজ্ঞরা বলছে, বনের ওপর মানুষের অধিক নির্ভরশীলতার কারণে ক্রমান্বয়ে এর আয়তন অতি দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছে। বনের আয়তনের সাথে সাথে হ্রাস পাচ্ছে এর জীববৈচিত্র। সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ, ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তনপায়ী প্রাণী হুমকির মুখে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সুন্দরবনে একাধিক অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হলেও কাজে আসছে না তার সুফল।

পাখি বিশেজ্ঞরা বলছেন, এক দিকে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনে পাখি সংখ্যা কমলেও ভারত অংশে সুন্দরবনে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের পাখি-বৈচিত্র্যের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ‘জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’। ‘বার্ডস অফ দ্য সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার’ নামের সেই বইটিতে এই অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রতিটি পাখি প্রজাতির ছবি-সহ বিশদ বর্ণনা নথিভুক্ত হয়েছে।

‘বার্ডস অফ দ্য সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার’ নামক বই।

বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৪২০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে সুন্দরবনে পরিযায়ী ও স্থানীয় পাখি মিলিয়ে রয়েছে ৪২৮টি প্রজাতি। দেশে প্রাপ্ত ১২টি প্রজাতির মাছরাঙার ৯টিরই দেখা মেলে এই অঞ্চলে। সেইসঙ্গে গোলিয়াথ হেরোন, স্পুনবিল স্যান্টপিপার, হুইমবেল, লার্জ ইগ্রেট, টেরেক স্যান্ডপিপার, প্যাসিফিক গোল্ডেন প্রোভারের মতো বিরল প্রজাতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে এই অঞ্চলে।

যা ইতিবাচক দিক হিসেবেই মনে করছেন ভারতের প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। ভারতে বর্তমানে ১৩০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। যার প্রায় এক তৃতীয়াংশই বাসিন্দা সুন্দরবনের। বৈচিত্র্যের নিরিখে গোটা ভারতের মধ্যে যা রয়েছে শীর্ষস্থানে। আবাসস্থল ও অবাধে চলাচলের জন্যে বাংলাদেশ অংশের পাখিরা ভারত অংশের সুন্দরবনে নিজেদের নিরাপদ মনে করছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

অন্যদিকে, কমতে থাকায় বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর প্রজাতির সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ১০০। এর মধ্যে পাখি প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৭২১। বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর অবস্থা কী - তা দেখার জন্য ২০১৫ সালে প্রকাশিত আইইউসিএন এর ‘লাল তালিকা’ দেখা যেতে পারে। সেখানে রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রায় ১২৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী হুমকি বা বিলুপ্তির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ১৪ ভাগ। গত ১০০ বছরে প্রায় ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে, যা এ দেশের মোট বন্যপ্রাণীর প্রায় ২ ভাগ।

;

হাকালুকিতে কম এসেছে পরিযায়ী পাখি



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
হাকালুকিতে পাতি-সরালির ঝাঁকও কমে গেছে। ছবি: এবি সিদ্দিক

হাকালুকিতে পাতি-সরালির ঝাঁকও কমে গেছে। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

হাকালুকিতে পাখি শিকারিদের কারণে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা দিন দিন কমছে। যার কারণে হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য অনেকটাই হুমকির মুখে।

হাওরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, নদী দূষণ, জাল বিষ টোপ ও পটাশ দিয়ে পাখি শিকার। একসঙ্গে বেশ কয়েকটি বিলে মাছ আহরণ, বিল শুকিয়ে মাছ নিধন, বিলে ২৪ ঘণ্টা পাহারা ও জলজ বৃক্ষ নিধনসহ রয়েছে নানান সমস্যা।

চলতি বছরের শীত মৌসুমের পাখিশুমারিতে সে তথ্যই জানান দিয়েছে। জানুয়ারি মাসের ২৮ ও ২৯ তারিখ দু’দিন ব্যাপী হাকালুকি হাওরে করা হয় পাখি শুমারি করে বন বিভাগ, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) যৌথ উদ্যোগে এ শুমারি করে।

বাংলাদেশে ৭১৮ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৩৮৮ প্রজাতির পাখিই পরিযায়ী। এরা শীতকালে পরিযায়ী হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসে বাংলাদেশে। আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয় হাকালুকি হাওরের মতো জলাশয়। প্রায় ১৮১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ হাওরে রয়েছে ছোট-বড় ২৭৬টি বিল। পাখিশুমারিতে তাদের জরিপে হাকালুকিতে এ বছর এসেছে প্রায় ২৫ হাজার পাখি। যা বিগত বছর থেকে অনেক কম। যা ২০২০ সালে ছিলো প্রায় ৪০ হাজার ১২৬ পাখি। মাত্র কয়েক বছর আগে দেশে ৫-৬ লাখ পরিযায়ী পাখি আসতো। এসব পাখির বেশিরভাগ মৌলভীবাজার ও সিলেটের হাওরে অবস্থান করতো।

যুগল বেগুনি কালেমের সৌন্দর্য। ছবি: এবি সিদ্দিক

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) এর পর্যবেক্ষণ বলছে, গত ২০ বছরে সারা বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমেছে ৩৫ শতাংশ। হাকালুকিতে কমেছে ৪৫ শতাংশ। ২০০০ সালের আগে হাওরে বিচরণ করতো প্রায় ৭৫-৮০ হাজার পাখি। তার ৮০ শতাংশই হাকালুকি হাওরে ছিলো।

পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাকালুকি হাওরে যে নদীগুলো মিলিত হয়েছে এখন সেই নদীগুলো প্লাস্টিক, পলিথিন, দূষিত পানি ও ময়লার ভাগাড়। পাখি কমার বিশেষ কয়েকটি কারণের মধ্যে এটি একটি। অরক্ষিত থাকায় দিন দিন কমেছে পাখির সংখ্যা। হাওরের পরিযায়ী পাখি রক্ষায় স্থানীয়দের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, পাশাপাশি প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা থাকতে হবে। এতেই বাঁচবে পাখি।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, সিলেট এর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, প্রতি বছর হাওরে বিল ইজারা দেওয়া হয়। এ বছরও হয়েছে। এতে বেশ লোকসমাগম ঘটে। দিনরাত পাহারা দেওয়া হয়। এসব কারণে পরিযায়ী পাখিরা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে না। বিল শুকিয়ে মাছ আহরণের কারণে নষ্ট হচ্ছে হাওরের জীববৈচিত্র্য। ফলে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমছে।

;

লালসবুজ রঙের পাখি ‘সেকরা-বসন্ত’



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
আপন মনে গাছের ডালে বসে আছে সেকরা-বসন্ত। ছবি: এবি সিদ্দিক

আপন মনে গাছের ডালে বসে আছে সেকরা-বসন্ত। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

ছোট আকারের লাল-সবুজ রঙের বর্ণিল পাখি ‘সেকরা-বসন্ত’। এ পাখিটির ইংরেজি নাম Coppersmith Barbet এবং বৈজ্ঞানিক নাম Psilopogon haemacephala. এরা কাপিটোনিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মেগালাইমা গণের এক প্রজাতির সুলভ পাখি। এরা বাংলাদেশের স্থানীয় পাখি।

এদের দেশের সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। IUCN এই প্রজাতিটিকে Least Concern বা শঙ্কাহীন বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে এরা Least Concern বা শঙ্কাহীন বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, সেকরা-বসন্ত আকারে ছোট হয়। মাত্র ১৭ সেন্টিমিটার। দেহ মূলত সবুব। তবে এদের কপাল লাল রঙের। চোখের চারপাশে হলুদ দাগ দেখা যায়। গলার নিচে রঙিন দাগ দেখা যায়। দেহের উপরের অংশ সবুজ। ঠোঁট কালো এবং পা লাল বর্ণের হয়ে থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ই দেখতে একই। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির গায়ের রঙ মলিন এবং এদের দেহে কোন লাল দাগ দেখতে পাওয়া যায় না।

তিনি আরও বলেন, সেকরা বসন্ত সাধারণত একা, জোড়ায় বা ছোট দলে চলাফেরা করে। এদেরকে বাগানে, বনে বাদাড়ে দেখতে পাওয়া যায়। এরা বড় গাছের মগডালে রোদ পোহায়। গাছের গর্তে বাসা বানায় এবং সেখানে বিশ্রাম নেয়। শুষ্ক মরুভুমি ও জলাখভূমির বনে এদের সহজে দেখা যায় না।

পাখিটির খাবার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই প্রজাতির পাখিরা সাধারণত ফলাহারী। তবে এরা মাঝে মধ্যে পোকা বিশেষ করে উইপোকা খেয়ে থাকে। এদের খাদ্য তালিকায় থাকে বট গাছের ফল, জংলি গাছের ফল, জলপাই জাতীয় ফল এবং বেরি জাতীয় ফল। এরা ফুলে পাপড়িও খেয়ে থাকে।

সেকরা বসন্তের প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। এরা গাছের সরু ডালের নিচে গর্ত করে বাসা বানায়। স্ত্রী পাখি একসাথে ৩ থেকে ৪ টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলিতে তা বাবা পাখি ও মা পাখি উভয়ই দিয়ে থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে প্রায় ২ সপ্তাহ সময় লাগে বলে জানান এ পাখি বিশেষজ্ঞ।

;

বিপদ টের পেলে ঝোপের মাঝে লুকিয়ে পড়ে ‘বাংলা কুবো’



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,
বাংলা কুবোর উড়ন্ত সৌন্দর্য। ছবি: এবি সিদ্দিক

বাংলা কুবোর উড়ন্ত সৌন্দর্য। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

বিপদের টের পেলে পাখিটি ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। কখনো ছোট দূরত্বে উড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে বাঁশবনে। তখন আর কেউ তাকে দেখতে পায় না।

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে অন্যতম এক পাখি ‘বাংলা কুবো’। বিভিন্ন বন-জঙ্গল তথা শালবন এবং চা বাগানে এদের বসবাস। অঞ্চলভেদে এ পাখির নাম কুবো, কুক্কা নামেও পরিচিত।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কমরুল হাসান বলেন, এই পাখিটির নাম অন্যান্য বাংলা নামগুলো হলো কানকুয়া, কুক্কা, ছোট কোকা, কুক্কাল বা কানাকুক্কা। ইংরেজিতে একে Lesser Coucal বলে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Centropus bengalensis। কুবো মাঝারি গড়নের ভূচর পাখি। এদের লম্বা ও শক্তিশালী পা এবং লম্বা লেজ থাকে। এরা উড়তে পটু নয়। ছেলে ও মেয়েপাখি দেখতে একই রকম। বড় কুবো কালো ও তামাটে রঙের লম্বা লেজওয়ালা পাখি। দেহের দৈর্ঘ্য ৪০ সেমি, ওজন ২৫০ গ্রাম। পিঠ তামাটে ও দেহতল চকচকে কালো। এ রকম দুটো প্রজাতি আমাদের দেশে পাওয়া যায়, একটি হলো বাংলা কুবো অপরটি বড় কুবো।

পাতার আড়ালে বাংলা কুবো। ছবি: এবি সিদ্দিক

পাখিটির স্বভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, ভূচর এ পাখি ওড়ার চেয়ে দৌঁড়াতে বেশ পটু। বাঁশঝাড়ে বসে থাকে চুপ করে। নিজেকে সবার থেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করে। এরা একটু লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। প্রয়োজনে এরা মাটিতে নেমে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঘন ঝোপ, বাঁশবন ও খেজুরগাছের আগায় পেয়ালার মতো বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা, সংখ্যায় তিন-চারটি। বনপ্রান্তে ও গ্রামাঞ্চলে এদের ঢের দেখা যায়। উঁচু ঝোপের মধ্য অগোছালোভাবে বাসা তৈরি করতে পছন্দ করে।

শারীরিক গঠন সম্পর্কে তিনি বলেন, উজ্জ্বল তামাটে কাঁধ-ঢাকনি ও ডানা ছাড়া পুরো দেহই কালো। চোখ লাল, ঠোঁট, পা, পায়ের পাতা ও নখর কালো। সাধারণত একা বা জোড়ায় বিচরণ করে। মাটিতে ধীরে ধীরে হেঁটে শিকার খোঁজে। ঝোপের তলায় তলায় ঘুরে ওরা যখন খাবার খোঁজে, তখন দীর্ঘ পুচ্ছটি প্রায় মাটি ছুঁয়ে থাকে।

বেশ গভীর ও সুরেলা কণ্ঠে ধীরে ধীরে উক...উক... শব্দে ডাকে। অন্য রকম একটি ডাকও শোনা যায়। খুব দ্রুত সংগীতের ঝংকারের মতো কুপ..কুপ..কুপ করে ছয়-সাতবার ডাকে। গরমের দিনে বহুদূর থেকে ওদের ডাক শোনা যায় বলে জানান এ বন্যপ্রাণ গবেষক।

;