পর্যটন মানচিত্র পাল্টে দেবে পদ্মা সেতু

  ‘স্বপ্ন ছুঁয়েছে’ পদ্মার এপার-ওপার



সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত | ছবি: ‍সুমন শেখ

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত | ছবি: ‍সুমন শেখ

  • Font increase
  • Font Decrease

কুয়াকাটা থেকে ফিরে: দেশের পর্যটন মানচিত্র পাল্টে দেবে পদ্মা সেতু। খুলনাকে হটিয়ে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার হবে সাগরকন্যা কুয়াকাটা। পর্যটক আগমনের দিক থেকে কক্সবাজারকেও চ্যালেঞ্জে ফেলে দিতে পারে কুয়াকাটা। কিন্তু এসবের জন্য সত্যিই কি প্রস্তুত কুয়াকাটা?

ট্যুর অপরেটর ও কুয়াকাটার পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানান, পদ্মা সেতুর আগেই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে লেবুখালী সেতু। এ দুই পয়েন্টে এখন ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুর্ভোগ পোহাতে হয় কুয়াকাটাগামী যাত্রীদের। সেতু দুটি চালু হলে ঢাকা থেকে সড়ক পথে কুয়াকাটা যেতে ৬ ঘণ্টার কম সময় লাগবে।

কুয়াকাটা একদিকে যেমন সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ করে দেবে অন্যদিকে খুব কম সময়ে সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট—কচিখালী, কটকা সৈকত, জামতলা সি বিচ, সুন্দরবন সংলগ্ন সাগরে জেগে ওঠা দ্বীপ পক্ষীর চর, ডিমের চর ঘুরে দেখার অপার সুযোগ সৃষ্টি করবে। কটকাতে হরিণপালের বিচরণ দেখতে অনেকেই ছুটে যান সেখানে। খুলনা শহর থেকে নদী পথে কটকা যেতে হলে সময় লাগে ১৫ ঘণ্টার মতো, আর মংলা থেকে সময় লাগে ১২ ঘণ্টা।

তবে কুয়াকাটা থেকে কটকায় পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো। খুলনা থেকে ওই স্পটে যেতে হলে রাত্রিযাপন ছাড়া ফিরে আসা সম্ভব না। কিন্তু কুয়াকাটা থেকে সকালে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা হরিণের সান্নিধ্যে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসা সম্ভব।

কুয়াকাটার পশ্চিম দিকে সুন্দরবন যেমন পর্যটকদের হাতছানি দেয় তেমনি পূর্ব দিকেও রয়েছে পর্যটনের বিশাল ভাণ্ডার। যার কথা মাথায় এলেই পর্যটকদের মন আনচান করে ওঠে। কিন্তু সময়ের অভাবে যেতে পারেন না অনেকে। সেই পর্যটন ভাণ্ডার চর কুকরি মুকরি, ঢাল চর, চর নিজামও কুয়াকাটার হাতের নাগালেই।


ঢাকা থেকে রাতে গিয়ে দিনের বেলা ঘুরে পরের রাতেই ঢাকায় ফেরা সম্ভব হবে। ছুটির দিনটি দারুণভাবে উপভোগ করা যাবে সেখানে। আর যাদের সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র-শনি, পদ্মা সেতু হলে তারা তো সোনায় সোহাগা। খরচও থাকবে সাধ্যের নাগালে।

শুধু কি সুন্দরবন, সাগরকন্যা কুয়াকাটার নিজেরও রয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য। এখানে একদিকে যেমন রয়েছে সূর্যাস্ত উপভোগ করার সুযোগ, তেমনি রয়েছে অপরূপ সূর্যোদয়। রয়েছে সৈকতকেন্দ্রিক পর্যটকপ্রিয় কার্যক্রম। সৈকতের কিটকটে হেলান দিয়ে মুখে পুরতে পারবেন সাশ্রয়ী মূল্যে সামুদ্রিক মাছের ফ্রাই ও বারবিকিউ। বর্ষা মৌসুমে রাতের নির্জনতাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় সাগরের গর্জন। প্রথমবার গেলে রীতিমতো বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিতে সক্ষম সমুদ্রের গগনবিদারি ডাক।

কুয়াকাটার গা ঘেঁষে অবস্থিত ফাতরার চর, লাল কাকড়ার চর, শুঁটকি পল্লি, লালদিয়ার চর, চর বিজয়, ফকিরহাট, সোনার চর, ক্র্যাব আইল্যান্ড বা কম কিসে? একটি স্পট থেকে আরেকটির প্রকৃতি ভিন্ন, রয়েছে ভিন্ন রকম জীব-বৈচিত্র্য। এক কথায় বলতে গেলে একটির চেয়ে আরেকটি বেশি আকর্ষণীয়। দারুণ সময় কাটাতে চাইলে এসব স্থানের জুড়ি মেলা ভার।

আরও অনেক স্পট রয়েছে যেগুলো পর্যটকদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়। নানান দিক বিবেচনায় পর্যটনের নতুন গন্তব্য মনে করা হচ্ছে কুয়াকাটাকে। শুধু কি সড়কপথ কুয়াকাটাকে কাছে এনে দিচ্ছে তা কিন্তু নয়। এর খুব কাছেই পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে রয়েছে বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনা।

পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, চাকামইয়া ইউনিয়নে এয়ারপোর্টের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। শিগগিরই ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হতে যাচ্ছে। কুয়াকাটা সৈকত থেকে যার দুরত্ব হবে ৮ কিলোমিটারের মতো।


বিমানবন্দরের দিক থেকেও খুলনাকে টেক্কা দিতে যাচ্ছে কুয়াকাটা। খুলনায় বিমানবন্দর নেই, আকাশ পথে যেতে চাইলে যশোর ঘুরে যেতে হয়। বলা যায় কুয়াকাটাকে কেন্দ্র করে চলছে উন্নয়ন যজ্ঞ। যারা ২০১০ সালের আগে সেখানে গেছেন তারা এখন গেলে এলাকাটিকে চিনতে পারবেন না। বিশাল বিশাল সড়ক চলে গেছে গ্রামের আনাচেকানাচে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত করে ফোর লেনের কাজ চলমান রয়েছে।

চমক থাকছে রেললাইনেও। ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা যাচ্ছে রেলপথ। প্রথম ধাপে বরিশাল পর্য়ন্ত লাইনের কাজ শেষ হবে। এরপর ২০২৫ সালের মধ্যে পৌঁছে যাবে কুয়াকাটা। চার ঘণ্টায় বরিশাল আর সাড়ে ৫ ঘণ্টায় কুয়াকাটা পৌঁছে দেবে পর্যটকদের। আর চাইলে নদী পথে যাওয়ার সুযোগ তো রয়েছেই। আধুনিক ও বিলাসবহুল অনেক লঞ্চ চলাচল করছে বরিশাল রুটে।

যাত্রী বেড়ে গেলে আরও অনেক বড় বড় কোম্পানি লঞ্চ নামানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পূর্ব-পশ্চিমমুখী কোনো মহাসড়ক নেই। চট্টগ্রাম কিংবা নোয়াখালী থেকে বরিশাল যেতে হলে ঢাকা ঘুরে যেতে হয়। বর্তমান সরকার পূর্ব-পশ্চিমে হাইওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে।

উপকূলীয় জেলা ছুঁয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে পায়রা-মংলা হয়ে বেনাপোলকে সংযুক্ত করা হবে অদূর ভবিষ্যতে। অর্থনৈতিক এই মহাসড়ক পর্যটনকেও দারুণভাবে নাড়িয়ে দেবে। বিভিন্ন অংশে মহাসড়কের কাজ এগিয়ে চলছে, শুধু ভোলায় তেঁতুলিয়া নদীতে ব্রিজ করা হলে চট্টগ্রাম থেকে পায়রা কিংবা বেনাপোল যেতে হলে ঢাকা ঘুরে যেতে হবে না। সোজা চলে যেতে পারবেন পর্যটকরা।

কুয়াকাটার প্রথম বেসরকারি উদ্যোক্তা কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কুয়াকাটা গেস্ট হাউসের প্রতিষ্ঠাতা এম এ মোত্তালেব শরীফ বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতকে সামনে তুলে আনে। বিচ কার্নিভালসহ নানা উদ্যোগের কারণে অল্পদিনেই কুয়াকাটা মানুষের আগ্রহের জায়গায় পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, এক সময় কুয়াকাটা যেতে হলে বরিশাল পার হওয়ার পর সাত-আটটি ফেরি পার হতে হতো। এখন সেসব নদীতে ব্রিজ নির্মিত হওয়ায় যাতায়াত অনেক সহজ হয়েছে। ছুটির দিনগুলোতে কুয়াকাটায় থাকে উপচেপড়া ভিড়। অনেক সময় হোটেলে রুম না পাওয়ায় মানুষের বাসা-বাড়িতে থাকতে দেখেছি ‍ট্যুরিস্টদের।

কুয়াকাটার সব হোটেল-মোটেল মিলে এখন আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে ছয় থেকে সাত হাজারের মতো। একদিনে ২০ হাজার ট্যুরিস্টের রেকর্ড রয়েছে বলে জানান কুয়াকাটা গেস্ট হাউসের প্রতিষ্ঠাতা।


এম এ মোত্তালেব শরীফ বলেন, পটুয়াখালীর লেবুখালীতে ব্রিজ হয়ে গেলেই দেখবেন ট্যুরিস্ট হু হু করে বেড়ে যাবে। ব্রিজটির শুধু মাঝের দুটি স্প্যান বসানোর কাজ বাকি। আর পদ্মা সেতু হয়ে গেলে তো কথাই নেই। আমরা মনে করছি কক্সবাজারকেও টেক্কা দিয়ে দেবে কুয়াকাটা সি বিচ।

তিনি আরও বলেন, এখন বরিশাল থেকে কুয়াকাটা যেতে লোকাল বাসে চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা লেগে যায়। অথচ প্রাইভেটকার নিয়ে গেলে মাত্র দেড় ঘণ্টার পথ। লোকাল বাসগুলো থেমে থেমে চলে, যে কারণে ট্যুরিস্টরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এখানে যদি ভালো বাস নামানো যায় অথবা ট্যুরিস্টদের জন্য পৃথক বাস সার্ভিস হয় তবে পাল্টে যাবে চিত্র। আমরা পর্যটন মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনকে বলেছি, তারা না পারলে আমরা ট্যুরিস্ট বাস নামাতে চাই।

অভিজাত হোটেল খান প্যালেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরুণ উদ্যোক্তা রাসেল খান বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে অনেক বাধা দূর হয়ে যাবে। এখন বিলাসবহুল কোম্পানিগুলোর বাস কুয়াকাটা পর্যন্ত আসে না। বরিশাল তাদের শেষ গন্তব্য। সেতু চালু হলে দেখবেন অনেক বিলাসবহুল বাস এ রুটে চলাচল করবে।

রাসেল খান বলেন, এক সময় মৌসুমেই ট্যুরিস্ট পাওয়া যেত না। এখন অফ সিজনেও ছুটির দিনে ট্যুরিস্টদের জায়গা দিতে পারি না। পদ্মা সেতু হয়ে গেলে কয়েকগুণ ট্যুরিস্ট বেড়ে যাবে। তখন মানুষ আর খুলনা হয়ে সুন্দরবন যাবে না। তারা সোজা কুয়াকাটা হয়ে সুন্দরবনে যেতে আগ্রহী হবে। এতে একদিকে যেমন সময় বাঁচবে, তেমনি ভ্রমণ খরচ কমবে।

কিন্তু কুয়াকাটা কি বাড়তি ট্যুরিস্টের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে? এমন প্রশ্নে রাসেল খান বলেন, আমি যেটুকু জানি অনেক বড় বড় কোম্পানি জমি নিয়ে বসে আছে। কেউ কেউ কাজও শুরু করেছে। অল্পদিনের মধ্যে কমপক্ষে ২০টি পাঁচ তারকা মানের হোটেল দেখতে পাবেন। শিকদার গ্রুপ ১৭ তলা ভবন নির্মাণ করছে। এ রকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।

তিনি বলেন, আমাদের হোটেলে এখন ১৪০ জন থাকতে পারে। সম্প্রসারণ কাজ চলছে ২০২২ সালের মধ্যে আরও ৩শ’ লোকের থাকার জায়গা হবে।

কুয়াকাটা গেস্ট হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মোত্তালেব শরীফ বলেন, আমাদেরও সম্প্রসারণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। কাজ শেষ হলে বাড়তি ৮শ’ লোকের থাকার জায়গা হবে। এখন কুয়াকাটায় ৭ হাজার লোকের আবাসন রয়েছে, শিগগিরই এই সক্ষমতা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।

তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, শুধু কি আবাসন হলেই সব হয়ে যাবে? এমনটা ভাবতে পারছেন না স্থানীয়রা। তারা মনে করছেন কুয়াকাটাকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন। না হলে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে এখানকার পর্যটন। কুয়াকাটায় নেই বাস টার্মিনাল। নৈশকোচ ও লোকাল বাস পার্কিং করতে হয় রাস্তার উপর। নৈশকোচ দিনের বেলা রাস্তার উপর জট তৈরি করে। নির্দিষ্ট বাস টার্মিনাল না হলে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হবে। আবার ট্যুরিস্টদের রিজার্ভ বাস পার্কিং নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে দেখা গেছে।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে ভোগান্তির আরেক নাম বিচ বাইক ও ফটোগ্রাফার। শত শত ফটোগ্রাফার আর মোটরবাইক চালকের উৎপাতে অতিষ্ট ট্যুরিস্টরা। একবার না বললেও অনেকটা নাছোড়বান্দার মতো পিছে লেগে থাকেন তারা। পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করতে থাকেন।

কুয়াকাটা থেকে সুন্দরবন ভ্রমণে রয়েছে আরেক জটিলতা। কটকা যেতে হলে বনবিভাগের ট্যাক্স দিতে যেতে হয় সুপতি রেঞ্জে। কুয়াকাটা থেকে কটকা সৈকত হয়ে সুপতি যেতে হয়। সেখানে গিয়ে ট্যাক্স জমা দিয়ে ফিরে এসে কটকা নামতে হয়। এই জটিলতা দূর করতে মহিপুর রেঞ্জে টোল আদায় করা যেতে পারে।

কুয়াকাটা থেকে এক সময় এই রুটে গ্রিন লাইন ট্যুরিস্ট শিপ চালু করেছিল। ট্যাক্স জটিলতার কারণে তারা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। তবে একটি কোম্পানি নতুন শিপ তৈরি করছে বলে জানিয়েছেন হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব মনিবুর রহমান বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, মাস্টার প্ল্যানে বাস টার্মিনালের পরিকল্পনা রয়েছে। পৌরসভা এটা নিয়ে কাজ করছে। শিগগিরই ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।

সৈকতে বাইক ও ফটোগ্রাফারদের উৎপাত প্রসঙ্গে মনিবুর রহমান বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। বেড়িবাঁধের অবস্থা খারাপ তাই বাইকগুলো বিচ দিয়ে চলাচল করে। বেড়িবাঁধ পাকা হয়ে গেলে তখন তাদের বিচে নামতে দেওয়া হবে না। তাদের নামারও প্রয়োজন পড়বে না। আর ফটোগ্রাফারদের উৎপাত বন্ধেও কার্যকর ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তারা একটি নির্দিষ্ট পয়েন্টে থাকবে সেখান থেকে কেউ চাইলে ডেকে নিতে পারবেন।

পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক ও বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি মতিউল ইসলাম চৌধুরী বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, বাড়তি পর্যটকের জন্য আমরাও প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত রাস্তা ফোর লেন করা হচ্ছে।

  ‘স্বপ্ন ছুঁয়েছে’ পদ্মার এপার-ওপার

লেক কিভু থেকে লেক টাঙ্গানিকার বিচে: কঙ্গো-বুরুন্ডি (পর্ব ২)



হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
কামিম্বি শহরতলী- রুয়ান্ডা

কামিম্বি শহরতলী- রুয়ান্ডা

  • Font increase
  • Font Decrease

রুসিজি, কঙ্গো-রুয়ান্ডা বর্ডার: পরদিন সকাল বেলা নাস্তা সেরে কঙ্গো রুয়ান্ডা বর্ডারে চলে এলাম। জায়গাটার নাম রুসিজি-১ দুই দেশের সীমান্ত চেক পোস্ট এখানে। ইমিগ্রেশন শেষ করে রুসিজি নদীর উপরের ব্রিজ পার হয়ে রুয়ান্ডার চেকপোস্টে গেলাম। রুয়ান্ডার দিকে রাস্তা বেশ ভাল। এই দিকে পাহাড় একটু বেশি। ছোট রুসিজি নদী দুই দেশকে আলাদা করে রেখেছে।

ইমিগ্রেশন অফিস রুসিজি

রুসিজি একটা ছোট পাহাড়ি নদী, নদী না বলে এটাকে একটা খাল কিংবা নালা ও বলা যেতে পারে। এই নদী লেক কিভুর পানি নিয়ে লেক টাঙ্গানিকার দিকে বয়ে চলছে। লেক কিভু সাগর সমতল থেকে প্রায় পনের’শ মিটার উঁচুতে আর লেক টাঙ্গানিকা সাগর সমতল থেকে প্রায় সাতশত পঞ্চাশ মিটার উপরে। গোমা এলাকার আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে এত উঁচুতে এই মিষ্টি পানির লেকগুলো সৃষ্টি হয়েছে। এই অঞ্চলে এখনও জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে।

রুসিজি সীমান্ত- রুয়ান্ডার ভেতরে

বুকাভু থেকে রুয়ান্ডা কঙ্গো সীমান্ত রুসিজি-১ ও রুসিজি-২ চেক পয়েন্টে পনের বিশ মিনিটে যাওয়া যায়। তাই বুকাভুর বেশির ভাগ মানুষ রুয়ান্ডার কামিম্বি বিমানবন্দর দিয়ে দেশের বাহিরে যাতায়াত করে। ব্যবসায়ীক দৃষ্টিকোণ থেকে রুয়ান্ডা সীমান্তের কাছে এই বিমানবন্দর বানিয়েছে। এখান থেকে রুয়ান্ডা এয়ার যাত্রীদেরকে কিগালি নিয়ে যায়, সেখান থেকে সারা পৃথিবীর যে কোন গন্তব্যে যাওয়া যায়।

রুসিজি বর্ডার-রুয়ান্ডার রাস্তা

রুয়ান্ডার এই অংশের কাছেই কামিম্বি শহর। এটা একটা ছোট সীমান্ত জনপদ। বিমানবন্দর থাকার কারণে এখানে অনেক বিদেশীর আনাগোনা আছে। কঙ্গোর ভেতরে বুকাভু শহর ও তার আশেপাশে অনেক বিদেশী এন জি ও কাজ করে। তারা নিজদেশে যাতায়াতের জন্য কামিম্বি বিমানবন্দর ব্যবহার করে। বুরুন্ডির রাজধানী বুজুম্বুরার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য আমরা একটা ট্যাক্সি ঠিক করলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভারের বাড়ি কামিম্বি শহরে। আমরা ট্যাক্সিতে করে বুজুম্বুরা যাব একরাত সেখানে থেকে পরদিন আবার রুসিজি -১ চেকপোস্টে ফিরে আসব। যাওয়ার পথে একটু ঘুরে রুয়ান্ডার কামিম্বি শহরেটা দেখে যাব।

ইমিগ্রেশন ফর্মালিটিজ শেষ করে ট্যাক্সিতে করে রওয়ানা হলাম। পাহাড়ি পথে আমরা চলছি। পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা পথ পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠে গেছে। পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙ্গিয়ে এই রাস্তা বুরুন্ডির দিকে চলে গেছে । দশ মিনিট চলার পর আমরা কামিম্বি শহরে পৌঁছালাম। যে কোন সাধারণ মফস্বল শহরের মত শহর। ব্যাংক, দোকানপাট সবই আছে এখানে। বিদেশী জিনিসপত্র পাওয়া যায় এখানে। রুয়ান্ডা এখন ফ্রেঞ্চ ভাষা বাদ দিয়ে ইংরেজির দিকে জোর দিয়েছে। আমাদের ড্রাইভার কিন্তু ইংরেজি বোঝে না। অল্প অল্প ফ্রেঞ্চ ভাষা জানা থাকাতে তার সাথে মাঝে মাঝে কিছু কথা বলা যায়।

রুয়ান্ডার এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটা মসজিদ দেখলাম, আমাদের ড্রাইভার ও মুসলিম, সে এখানকার অনেক মানুষকে চেনে। কামিম্বি শহরে দেখার কিছু নেই। শহরে প্রাণকেন্দ্রে রাস্তার মোড়ের আইল্যান্ডে একটা বড় ঘড়ি সময় জানিয়ে দিচ্ছে। এখানে ট্রাক, বাস ট্যাক্সি সবই পাওয়া যায়। বিমান বন্দরের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই শহরটাতে বেশ প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা যায়। এখানে কিছুক্ষণ থেকে আবার আমরা বুজুম্বুরার পথে রওয়ানা হলাম। রুসিজি ১ থেকে বুজম্বুরা প্রায় ১২৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪০ কিলোমিটার রুয়ান্ডাতে আর বাকী পথ বুরুন্ডির ভেতরে। রুয়ান্ডার ভেতর রাস্তা পাহাড়ি হলেও বেশ সুন্দর এবং উন্নত।

রুয়ান্ডা থেকে বুরুন্ডির পথে যেতে

রাস্তা থেকে নীচে পাহাড়ের উপত্যকাতে মাঝে মাঝে ঘরবাড়ী দেখা যায়। পাহাড়ের মাঝের পথ দিয়ে রুসিজি নদী একে বেঁকে লেক তাঙ্গানিকার দিকে চলছে। এদিকে গ্রাম অঞ্চল, মানুষজন মাঠে কাজ করছে কেউবা ঘরে ফিরছে। হাঁটা কিংবা সাইকেলেই তাদের যাতায়াত। আনায়াসে পাহাড়ি পথে তারা তাদের গন্তব্যে চলছে। মাঝে মাঝে কয়েকজন হাত দিয়ে ট্যাক্সিতে লিফট নিতে চাইছে এরা ট্যাক্সি কিংবা মাইক্রোতে করে আশেপাশের জনপদে যাবে। বুরুন্ডি সীমান্তের কিছু আগে ড্রাই ভার একটা ছোট শহরের মানি এক্সচেঞ্জে গাড়ি থামাল। আমরা নেমে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম। মানুষজন বেশ বন্ধুভাবাপন্ন, ভালই লাগল। এক ঘণ্টা চলার পর আমরা রুয়ান্ডা বুরুন্ডির সীমান্ত জনপদ রুয়া বর্ডারে পৌঁছে গেলাম।

রুয়া এলাকায় রুয়ান্ডা সরকার নিজ খরচে সুন্দর বর্ডার চেকপয়েন্ট বানিয়েছে। এখানে রুয়ান্ডা আর বুরুন্ডির পতাকা বাতাসে খেলা করছে। দুদেশের কাস্টম ও ইমিগ্রেসান অফিসারদের জন্য পাশাপাশি ডেস্ক, কাঁচের পার্টি শান দিয়ে আলাদা। ব্যাঙ্কের জন্য ও জায়গা করা আছে। ফর্ম ফিলাপ করার জন্য চেয়ার টেবিল আছে। হাত মুখ ভিজিয়ে নেয়ার জন্য পরিস্কার টয়লেট আছে দুইদিকেই। একটু দূরে কাস্টম ও ইমিগ্রেসান অফিসারদের জন্য বাংলো বানানো হয়েছে। এই কমপ্লেক্সে সব ধরনের সুবিধা আছে। এলাকাটা চারিদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দুই দিকে সীমান্তের প্রহরাতে পুলিস আছে।

ইমিগ্রেশন অফিস রুয়া-রুয়ান্ডা বুরুন্ডি বর্ডার

আমাদের পাসপোর্ট চেক করে দেখল রুয়ান্ডার পুলিশ। তারপর পারকিং লটে গাড়ি পার্ক কাস্টম ও ইমিগ্রেসান অফিসের ভেতরে গেলাম। মানুষজন তেমন নেই। দু একটা গাড়ি আছে, সেগুলোর মানুষজন ফর্ম ফিলাপ করে কাউনটারে জমা দিচ্ছে। আমাদের পাসপোর্টে রুয়ান্ডার এক্সিট সিল দিয়ে পাশের বুরুন্ডির অফিসারকে এগিয়ে দিল। অফিসার পাসপোর্ট দেখে আবার বুরুন্ডির এন্ট্রি সিল দিয়ে দিল। কাজ শেষে আবার আমরা পথে নামলাম। এখান থেকে বুরুন্ডি ৮০ কিলোমিটার।বুরুন্ডির রাস্তা উপত্যকার মধ্যে, দূরে অনেক উঁচু পাহাড়ের সারি যেন মেঘের সাথে মিশে আছে।দুপাশে ফাঁকা তৃণভূমি, মাঝে মাঝে ঝোপ গাছ। কিছু কিছু চাষ হয় এই মাঠে।

বুজুম্বুরার পথে – বুরুন্ডি

পথের এক জায়গাতে তুলার ক্ষেত, অনেক এলাকা নিয়ে সাদা হয়ে আছে সারা মাথ।মানুষজন মাঠে কাজ করছে, সাইকেল এখানকার অন্যতম বাহন, মাঝে মাঝে মোটর সাইকেল ও গাড়ি দেখা যায়। রাস্তার অবস্থা বেশী ভাল না তবে চলাচল করা যায়।পথের পাশে হঠাৎ এক জায়গাতে অনেক এলাকা জুড়ে বিশাল ক্যাকটাসের বন। রুয়ান্ডার পথে এধরনের দৃশ্য দেখা যায়নি। রাস্তা মাঝে মাঝে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে চলছে। নীচে রুসিজি নদী মাঝে মাঝে এঁকে বেঁকে চলছে দেখলাম। কিছু জায়গাতে বেশ স্রোত ও আছে এই ছোট নদীতে।

এরপর রাস্তার দুপাশে অনেক অর্ধসমাপ্ত ঘরবাড়ী দেখলাম ।বাড়ীগুলো বানানো প্রায় শেষ কিন্তু জানালা দরজা লাগানো হয়নি, কেউ সেখানে থাকে না। এর থেকে একটু দূরে ছোট গ্রামের কুঁড়ে ঘর দেখা যায়, হয়ত ভবিষ্যতে গ্রামের মানুষ এসব ঘরে থাকবে। রাস্তার পাশে ছোট ছোট জনপদ আছে। খুব সাধারণ মানের ঘরবাড়ী, মানুষ জন সরল জীবন যাপনেই অভ্যস্ত। মসজিদ দেখলাম কয়েকটা, সীমান্তের এই দিকে মুসলিম জনবসতি আছে বেশ কিছু।

বুজুম্বুরার কাছে রাস্তার মান একটু ভাল, প্রায় ঘন্টা খানেক আমরা খারাপ রাস্তায় চলেছি। শহরের বাহিরে বুজুম্বুরা বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দর দিয়ে ও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মী এবং এন জি ও কর্মীরা আশেপাশের দেশে যাতায়াত করে। আমরা শহরের ভেতরে ঢুকে গেলাম। রাস্তা বেশ খোলামেলা, ট্রাফিক জ্যাম তেমন নেই শহরের এই অংশে। শহরের ভেতরের রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে আমরা ডাউন টাউনে চলে এলাম। এর পাশেই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। আমাদের ড্রাইভার ও রুয়ান্ডিজ মুসলিম। শহরে মোটামুটি ট্রাফিক জ্যাম আছে। দুপুর হয়ে গেছে, আমরা একটা হোটেলে এলাম। মোটামুটি থাকা যায়। হোটেলে ব্যাগ রেখে আবার পথে বের হলাম।

ডাউন টাউন বুজুম্বুরা

বুজুম্বুরা শহরে অনেক মানি এক্সচেইঞ্জ আছে, হোটেল থেকে বের হয়ে বেশ জ্যামে পড়লাম। তারপর বড় একটা বাজার এলাকাতে এলাম। এখানে প্রচুর ফল ও তাজা সবজি পাওয়া যায়। গাড়ি পার্ক করে আমরা টাকা বদলে নিলাম। ডলারের বিনিময়ে প্রায় ১৬৫০ ফ্রা পাওয়া গেল। মোটামুটি জমজমাট শহর। মানুষজন তাদের নিত্য দিনের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। আমরাও দেরি না করে টাঙ্গানিকা লেকের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম।

চলবে......

 

  ‘স্বপ্ন ছুঁয়েছে’ পদ্মার এপার-ওপার

;

লেক কিভু থেকে লেক টাঙ্গানিকার বিচে: কঙ্গো-বুরুন্ডি (পর্ব ১)



হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
লেক কিভু থেকে লেক টাঙ্গানিকার বীচে: কঙ্গো থেকে বুরুন্ডি

লেক কিভু থেকে লেক টাঙ্গানিকার বীচে: কঙ্গো থেকে বুরুন্ডি

  • Font increase
  • Font Decrease

উগান্ডার এন্টেবি বিমানবন্দর থেকে দুইটার সময় সাব-৩৪০ বিমানে করে কঙ্গোর কাভুমু বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। ফ্লাইট টাইম এক ঘণ্টা বিশ মিনিট। আকাশ মেঘে ঢাকা থাকায় বিমান মেঘের উপর দিয়ে চলছিল, নিচে তাই সাদা মেঘের সাগর ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়নি। মেঘের উপর ঝকঝকে সোনালি আলোতে ডানা মেলে উড়ছিল আমাদের বাহন। কাভুমু বিমানবন্দর সাউথ কিভু প্রদেশে এবং বুকাভু এই বিমানবন্দরের কাছের বড় শহর।ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো সেন্ট্রাল আফ্রিকার গ্রেট লেক রিজিওনের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র। এটা আফ্রিকা মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ এবং সারা পৃথিবীতে আয়তনে ১১ তম। প্রায় ৭৫ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশ আফ্রিকার মধ্যে চতুর্থ জনবহুল দেশ।

কঙ্গোর সাথে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি,জাম্বিয়া, এঙ্গোলা, কঙ্গো ব্রাজাভিলের সীমান্ত আছে। লেক টাংগানিকা কঙ্গোকে তাঞ্জানিয়ার থেকে আলাদা করে রেখেছে। পশ্চিমে ৪০ কিলোমিটার করিডোর দিয়ে কঙ্গো আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত। নানা ঘাত প্রতিঘাত, যুদ্ধ বিগ্রহ করে কঙ্গো বেলজিয়াম থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও দেশটাতে এখনও গৃহযুদ্ধ চলছে। এই দেশের মাটির নিচের সম্পদের লোভে হানাহানি আর রক্তপাত লেগেই আছে। এই বিশাল দেশটাতে কবে শান্তি আসবে তা কেউ জানে না। এক অনিশ্চিত জীবন নিয়েই এদেশের মানুষ তাদের দিন কাটাচ্ছে। এই ক্রান্তিকালেই আমার এদেশে আসা হল।

স্থানীয় সময় দুইটা ত্রিশ মিনিটে আমাদের বিমান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর সাউথ কিভু প্রদেশের কাভুমু বিমানবন্দরে ল্যান্ড করল। আকাশ একটু মেঘলা থাকলেও বেশ আলো ছিল চারিদিকে। বিমানবন্দর একটা পাহাড়ের উপর এবং আসেপাশে সব পাহাড়ি এলাকা। ইমিগ্রেশানে একজন অফিসার বসে আছে, পাসপোর্ট নিয়ে এন্ট্রি সিল দিয়ে দিলেন।সব ফরমালিটিজ শেষ করে কাভুমু থেকে বুকাভুর দিকে রওয়ানা হলাম।

কাভুমু বিমানবন্দর বুকাভু থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, প্রায় এক ঘণ্টার পাহাড়ি পথ, এই পথ বুকাভু থেকে লেক কিভুর পাড় ঘেঁসে অনেকদুর গিয়ে পাহাড়ের ভেতরে চলে গেছে। পাহাড়ের উপর এই বিমানবন্দর। এর পাশেই কঙ্গোর সামরিক বাহিনীর বিশাল ঘাঁটি। অনেক উঁচুতে বলে এখানকার আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা, চারিদিকে পাহাড় হলেও মাঝে বেশ ফাঁকা থাকার কারনে খোলামেলা পরিবেশ ও বাতাস চলাচল স্বাভাবিক।

কাভুমু থেকে বুকাভুর পথে

যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ হিসেবে রাস্তাগুলো বেশ ভাল। পাহাড়ি পথে আমরা বিমানবন্দর থেকে কাভুমু শহরের দিকে চলছি। ছোট জনপদ, শহরের মাঝে একটা মোড় আছে, সেখানে কিছু দোকানপাট, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস এসব দোকানে পাওয়া যায়। মোটর সাইকেল, সাইকেল ও মাইক্রবাসে সাধারণ মানুষ চলাচল করে। ঘরবাড়ি বেশিরভাগ ইটের দালান, টিনের চালা। মানুষজন আছে, মোটামুটি প্রাণচঞ্চল জনপদ। পাহাড়ের উঁচুনিচু পথে চলেছি, পাহাড়ি রোলিং কান্ট্রি সাইড বলা চলে এই এলাকাকে।

পথের ছোট জনপদ, বনপথ

পাহাড়ের মাঝ দিয়ে এঁকে বেঁকে রাস্তা চলে গেছে। এখানে মাঝে মাঝে ঘন বন আছে। রাস্তা দিয়ে লোক চলাচল আছে, পাহাড় থেকে নিচে এবং দূরে মাঝে মাঝে জনপদ দেখা যায়। অনেক কলার বাগান আছে পাহাড়ের ঢালে। ছোট ছোট জনপদে পাকা ঘরবাড়ীও আছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র এখানে পাওয়া যায়। সাউথ কিভু প্রদেশের সিকিউরিটি সিচুয়েসান তুলনামুলক ভাবে ভাল। মানুষের যানমালের কিছুটা নিরাপত্তা এখানে আছে। আলোকিত দিন, চমৎকার আবহাওয়া, আমরা গল্প করতে করতে চলছি। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে সাইকেল আরোহী দেখা যায়। এই পাহাড়ি পথে তারা বেশ কষ্ট করে সাইকেল দিয়ে যাত্রী ও মালপত্র পারাপার করে।

চলার পথের জনপদ

পাহাড়গুলো বেশ উঁচু এবং পাথুরে, চলার পথে অনেক পাহাড় থেকে পাথর সংগ্রহ করে ট্রাকে তোলা হচ্ছে দেখতে পেলাম। আমাদের যাত্রাপথ এক ঘণ্টা, বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমরা পাহাড়ের নিচে লেক কিভুর অস্তিত্ব টের পেলাম। লেকের পাশ দিয়েই চলছে এই পাহাড়ি রাস্তা। লেক কিভুর শান্ত নীল পানি দেখে বেশ ভাল লাগল। আমরা এই লেক দেখব বলেই এত দূর থেকে এদেশে এসেছি। লেকের একপাশে রুয়ান্ডার জনপদ। দূর থেকে তা দেখা যায়। পথে একটা বেশ বড় চার্চ দেখলাম। অনেক এলাকা নিয়ে এর সীমানা।

পাহাড়ের নিচে কৃত্রিম লেক তার পাশে বাঁশবন, লেকের পানিতে পাহাড়ের উপর থেকে আসা সূর্যের আলো আর বাতাসে বাঁশপাতার মিলিয়ে বেশ সুন্দর আবহ এখানে। আশেপাশের পরিবেশ থেকে এই এলাকার আলাদা পরিবেশ নজরে পড়ে।

পাহাড়ি রাস্তা থেকে নীচে বামে লেক কিভু, দূরে বুকাভু শহর

লেকের পাশ দিয়ে চলতে চলতে আমরা বুকাভু শহরের কাছাকাছি চলে এসেছি। দূর থেকে পাহাড়ের উপর গড়ে উঠা এই শহর দেখা যাচ্ছে। বিকেলের সূর্যের আলো এখন শহরের উপর পড়ছে। বুকাভু শহরটা ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর সাউথ কিভু প্রদেশের রাজধানী, সাউথ কিভু প্রদেশের আয়তন বাংলাদেশের দ্বিগুণ। পাশের প্রদেশ নর্থ কিভুর রাজধানী গোমা, লেক কিভু বুকাভু থেকে গোমা পর্যন্ত বিস্তৃত। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো একটা বিশাল দেশ, দেশটা আয়তনে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ষোল গুণ বড়। ফরাসি এদেশের সরকারি ভাষা এর পাশাপাশি লোকজন স্থানীয় ভাষার ভাবের আদান প্রদান করে। সোহেলি ভাষা এবং রুয়ান্ডার ভাষা এরা বুঝে।

দূরে রুয়ান্ডার জনপদ

বুকাভু শহরের ভেতর জলপথে লেকে চলাচলের জন্য বন্দর আছে। এই বন্দর থেকে মালপত্র ও যাত্রী নিয়ে লঞ্চ ও ছোট জাহাজ গোমা ও রুয়ান্ডার কিছু গন্তব্যে চলাচল করে। পুরো লেকটাই পাহাড়ের উপত্যকায়। এই লেকের গভীরতা কোন কোন জায়গাতে চারশত পঞ্চাশ মিটার। বেশ খাড়া পাড় বলে এখানে কোন প্রাকৃতিক বিচ বা বিনোদনের জায়গা নেই।


ব্যস্ত বুকাভুশহরের রাস্তা

শহরের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছি ততই বাড়ছে ভিড় ও ট্রাফিক জ্যাম। রাস্তা একটু খারাপ শহরের মধ্যে। মোটর সাইকেল কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে চলে, তাই বেশ সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়। আমাদের জেলা কিংবা মফস্বল শহরের মত এই বুকাভু শহর। সাধারনের চলাচলের জন্য মোটরসাইকেল, সাইকেল আর মাইক্রবাস আছে। ভিড় এবং যাত্রী তোলার ধরন আমাদের দেশের লোকাল বাসের মতই। মানুষ গাদাগাদি করেই চলছে। অনেক নতুন মডেলের গাড়িও আছে এখানে। এই দেশে দুটো শ্রেণীর মানুষ আছে, উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্ত। মধ্যবিত্ত প্রায় নেই বললেই চলে।

শহরের শেষ প্রান্তে আমাদের থাকার জায়গা, পুরো শহরটা তাই দেখতে দেখতে চলেছি। কিভু লেকের কোন না কোন অংশ শহরের প্রায় সব জায়গা থেকেই দেখা যায়। পাহাড়ি চড়াই উতরাই ভেঙ্গে উঁচু নিচু পথ নানা দিকে চলে গেছে। শহরের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হল স্বাধীনতা চত্তর। এখানে একটা বিশাল বৃত্তাকার আইল্যান্ড আছে। সেখানে স্বাধীনতার স্মারক ভাস্কর্য মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আর কঙ্গোর পতাকা বাতাসে পতপত করে উড়ছে। এই জায়গাতেই সব ধরনের মিটিং মিছিল আর গণ্ডগোল শুরু হয় তারপর তা অন্যান্য জায়গাতে ছড়িয়ে যায়। চত্বরটা বেশি বড় হওয়াতে রাস্তা সরু হয়ে গেছে বলে এখানে ট্রাফিক জ্যাম লেগেই আছে, একটা বাসস্ট্যান্ডও এখানকার ভিড় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

স্বাধীনতা চত্তর- বুকাভু, কঙ্গো

শহরে আসতে আসতে প্রায় চারটা বেজে গেল, এই সময় সব অফিস আদালত ছুটি হয় বলে বেশ ভিড় থাকে শহরে। আমরা শহরটা একটু ঘুরে দেখতে দেখতে চললাম। অফিস পাড়ার দিকটা এখন প্রায় খালি হয়ে এসেছে। এখানে রাস্তাগুলো একটু চওড়া এবং তুলনামুলকভাবে ভাল। প্রাদেশিক দপ্তর, আইন মন্ত্রণালয় এবং কিছু প্রাশাসনিক ভবন দেখে আমরা গন্তব্যের পথে যাত্রা করলাম। এখানে উন্নয়নের কাজ চলছে, একটা চত্তরে ভাস্কর্য স্থাপনের কাজ হচ্ছে। এখানকার বাড়ি ঘরগুলোর শেষ তালার ছাদ টিনের চালা কিংবা টালি দিয়ে বানানো এবং উজ্জ্বল রঙ করা।

শহরে কিছু অংশ দেখে লেক কিভুর পেনিনসুলা এলাকায় এলাম। এখানেই আমাদের থাকার জায়গা। এখানে পাহাড়ের উঁচু থেকে লেকের দৃশ্য দেখা যায়, পড়ন্ত বিকেলের আলো শহর ছাড়িয়ে লেক ও তার আশ পাশ আলোকিত করছে। দূরের রুয়ান্ডার জনপদ ও এই আলোর ছটায় আলোকিত। এখানে সন্ধ্যার পর সাধারণত বাহিরে চলাচল কমে যায়। প্রায় বিদ্যুৎ থাকে না, যাদের সাধ্য আছে তারা জেনারেটর চালায়। মাঝে মাঝে পানির ও সমস্যা হয়। নিচে লেকে এত পানি তবুও বিদ্যুতের অভাবে পানি পেতে সমস্যা হয় এখানে।রাতে বিশ্ব কাপের খেলা দেখে ঘুমিয়ে গেলাম।

চলবে......

  ‘স্বপ্ন ছুঁয়েছে’ পদ্মার এপার-ওপার

;

ঢাকা থেকে নীলডুমুর: সুন্দরবনে কিছুক্ষণ



হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ঘোলাপেটুয়া নদী - সূর্যাস্ত

ঘোলাপেটুয়া নদী - সূর্যাস্ত

  • Font increase
  • Font Decrease

এপ্রিলের আবহাওয়া বেড়ানোর জন্য তেমন আদর্শ না হলেও সুযোগ যেহেতু পেয়ে গেলাম তাই ঢাকা থেকে খুলনা যাবার প্ল্যান করলাম, এবার বাসে না গিয়ে ট্রেনে যাব ঠিক করলাম। ঢাকা থেকে খুলনা এসি বাস আছে এবং টিকিটও সহজেই পাওয়া যায়। আমরা ট্রেনে যাব তাই ঢাকা-খুলনা সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে করে যাওয়া ঠিক হলো। এসি ফোরবার্থের টিকিট পেয়ে গেলাম। আমার দুটো পরিবার এবার ভ্রমণে বের হয়েছি। সুন্দরবন এক্সপ্রেস সকাল ছয়টা বিশ মিনিটে কমলাপুর থেকে ছাড়ে। বাচ্চাদের অত ভোরে উঠতে অসুবিধা হবে তাই আগের রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পাঠালাম। গাড়িতে খাবার জন্য নাস্তা ওদের মা বেশ সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নিল। সময় মত স্টেশনে গিয়ে জানলাম ট্রেন আরো ঘণ্টা দেড়েক পরে আসবে। এসি ওয়েটিং রুমে বসে রইলাম, এর রক্ষণাবেক্ষণ অতি সাধারণ মানের অথচ একটু দেশপ্রেম কিংবা আন্তরিকতা হলেই অনেক উন্নত মানের ভ্রমণ উপহার দিতে পারে দেশবাসীকে কিংবা বাংলাদেশ দেখতে আসা পর্যটকদেরকে ।

অবশেষে ট্রেন আসল। কুলি ঠিক করা ছিল। জিনিস পত্র আমাদের কমপার্টমেন্টে এনে দিল। এসি কমপার্টমেন্ট, একসময় এগুলো ঝকঝক করত এখন একটা সুইপার ফিনাইল দিয়ে টয়লেট পরিষ্কার করে কোনমতে রুমে একটু ভেজাপাটের ঝাড়ু দিয়ে গেল। সোফা গুলোতে ময়লা রয়ে গেছে, যাক নিজেরা পরিস্কার করে বসলাম। এই বগিতে যাত্রীদের জন্য এটেনডেন্ট আছে, এই ট্রেনের একটা দিক ভাল যে রুমের সাথে এটাচড বাথরুম, সেখানে টয়লেট পেপারও আছে। তবে গোটা বগিতে তিনটার মতো কামরাতে যাত্রী, বাকীগুলো খালি, অথচ টিকিট নেওয়ার সময় জানতাম সবটিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। ইঞ্জিন লাগার পর এসি চালো হলো। ঠান্ডা বাতাসের আমেজে দু ঘণ্টা লেইট ও অন্যান্য কষ্ট গুলো আস্তে আস্তে কমে গেল।

সাড়ে আটটার দিকে ট্রেন ছাড়লো। গরমের দিন হলেও সূর্যের আলোতে তখনও গরমভাব আসেনি, এসির মধ্যে এ আলোটাই ভাল লাগলো। কমলাপুর রেল স্টেশনে ট্রেনের দুপাশের সেই পরিচিত দৃশ্য, আরো নান্দনিক এলাকা বানানো যেত এই জায়গাগুলোকে। কে খেয়াল রাখে। লাইনের দুপাশে ধুলি উড়িয়ে সুন্দরবন এক্সপ্রেস সুন্দরবনের নগর খুলনার উদ্দেশ্যে ছুটে চলল। এয়ারপোট ও জয়দেবপুর স্টেশন পর্যন্তসেই পুরানো সব দৃশ্য, জয়দেবপুর থেকে নতুন লাইন টাঙ্গাইল হয়ে বঙ্গবন্ধু যমুনা ব্রীজ পর্যন্ত চলে গেছে। এই লাইন দিয়ে ব্রডগেজ ও মিটার গেজ উভয় ট্রেন চলতে পারে। নতুন বড় স্টেশন হয়েছে টাঙ্গাইলে তাছাড়া মৌচাক ও অন্যান্য কয়েকটা স্টেশন ও আছে। এখানে মাঝে মাঝে ট্রেন থেমে একটা দুটো আপ বা ডাউন ট্রেনকে পাস দিল।

বঙ্গবন্ধু যমুনা ব্রিজ

বিজেএমবিতে উঠে ট্রেনের গতি কমে গেল। কোথায় সেই প্রমত্তা যমুনা, ব্রিজের নীচে চিকন খালের মত যমুনার অংশ তার পাশেই চর। চরের বালি ঢেউ খেলানো যেন নদীর ঢেউ বালিতে তার ছাপ রেখে গেছে। চরে শনের ক্ষেত, অসমতল ভূমি দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেন লাইনের পাশে ট্রেন। পাশ দিয়ে উত্তর বঙ্গগামী বাস ট্রাক চলছে। আবার একচিলতে যমুনা তারপর ব্রিজটা উত্তর বঙ্গে গিয়ে শেষ । দুপাশের প্রকৃতি এখন একটু অন্য রকম। ট্রেনের দুধারে যেন ফাঁকা ধানের মাঠ, সবুজ ধান ফসল আসবে আসবে। দুরের গ্রামগুলো গাছ পালায় ছায়াঢাকা। কৃষক ধানক্ষেতের পাশে বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউ কাজ করছে। পানি এখন উঠে পাম্প মেশিনে, পানি দেয়া হয়েছে ক্ষেত গুলোতে। সিরাজগঞ্জ, পাবনার পাকশি তারপর ট্রেন চলবে দক্ষিন বাংলার দিকে, পথে উত্তর বাংলার অনেক ট্রেন স্টেশন।

 হার্ডিঞ্জ ব্রিজ

পাকশি স্টেশন পার হয়ে ট্রেন বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর, নীচে একসময় ছিল প্রমতা পদ্মা। এখন তার কিছুই নেই। যেন চকচক করে বালু কোথাও নাই কাঁদা। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের প্রায় সমান্তরালে চলে গেছে লালন শাহ ব্রিজ। ব্রিজ দিয়ে বাস ট্রাক চলছে নিজ নিজ গন্তব্যে। ব্রিজ পার হয়ে ভেড়ামারা স্টেশন, আমরা দক্ষিণ বাংলায় ঢুকে গেছি। দর্শনা, চুয়াডাংগা, কোট চাঁদপুর হয়ে যশোর স্টেশন। ট্রেন থামলেই বাচ্চারা জানতে চায় কোন স্টেশন, কি আছে এখানে। নতুন অভিজ্ঞতা বাচ্চাদের জন্য। খুলনা আর ঘণ্টা দেড়েকের পথ । যশোর স্টেশনে ট্রেন কিছুক্ষণ থামল, তারপর আবার পথচলা । খুলনার কাছাকাছি আসতেই বেলা শেষ। মাগরিবের আজানের সময় খুলনা স্টেশনে ট্রেন থামল, স্টেশন থেকে বাহিরে এসে মসজিদে নামাজ পড়লাম। একটু ঝড়ো বাতাস ছিল তখন। এই দুদিনে যদি আবহাওয়া ভাল না থাকে তাহলে এই ভ্রমণটা মাটি হবে। অনেক আশা নিয়ে এসেছি এবং ইনশাআল্লাহ আবহাওয়া ভাল থাকবে।

রাতে খুলনা শহর দেখতে বের হলাম, খোলামেলা শহর জানজট মুক্ত নির্মল, ভাল লেগে গেল প্রথমবারেই। ঢাকার দুঃসহ জট এখানে স্বপ্নের মত। খুলনায় থাকার জন্য অনেক হোটেল আছে। স্টেশনের পাশে সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য কতগুলো বেসরকারি পর্যটন সংস্থার অফিস। এখানে হোটেলের খোজ পাওয়া যায়। ট্যাক্সি কিংবা রিক্সায় হোটেলে যাওয়া যায়। দামও সাধ্যের মধ্যে। পরদিন সকাল বেলা নাস্তা খেয়ে সাতক্ষিরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। সাতক্ষীরা পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে এবং সেখান থেকে নীলডুমুর আরো ঘণ্টা দেড়েকের পথ। বাসে আসলে অবশ্য সময় আরো বেশি লাগে। নীলডুমুরের স্থানীয় নাম বুড়ি গোয়ালিনী, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ পর্যন্ত অনেক বাস যায় যেখান থেকে স্থানীয় বাহনে বুড়ি গোয়ালিনী যাওয়া যায়। নীলডুমুরের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছি রাস্তার দু পাশে ফনিমনসার ঝোপ দেখা যাচ্ছে। বাড়িঘরের কাছেও এ ধরনের ঝোপ যা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় দেখা যায় না ।নীলডুমুর এলাকায় ঢোকার সাথে সাথেই প্রকৃতি একটু অন্যরকম। দূরে শাখা নদী, নদীর অন্যপাড় সুন্দরবনের অংশ। রাস্তার দুপার্শ্বে জলমগ্ন এলাকা, চিংড়ি চাষে লেগে গেছে । লবণাক্ততা চাষাবাদের জন্য অনুপযোগী হলেও এই লবনপানির জলাবদ্ধতা চিংড়ি চাষের উপযুক্ত জায়গা । এখানেও বাড়ীঘর ও রাস্তার পাশে ফনীমনসার ঝোপ দেখলাম ।

পর্যটনের জন্য স্থানীয় এনজিও বর্ষা মোটেল বানাচ্ছে। তাছাড়া শাখা নদীর পাড়ে ছোট ছোট গোলঘর বানানো আছে। যেখানে বসে থেকে এক দৃষ্টিতে সুন্দর বনের সোভা দেখা যায় দিন রাত। এছাড়াও তাদের আছে ছোট ছোট বোট/লঞ্চ। এসব লঞ্চে সুন্দর বনের ভিতরে ভ্রমনের ব্যবস্থা করে থাকে। মোটামুটি এসময় পর্যটকের ভিড় না থাকলেও সুন্দরবনের টানে অনেক পর্যটক এখানে বেড়াতে আসে।

ঘোলাপেটুয়া নদী

দুপুরে রোদের প্রচন্ড তাপে বাইরে যাওয়ার কথা চিন্তাও করিনি ।বিকেল বেলা সুন্দরবন দেখার পালা। ঘোলাপেটুয়া নদীর ঘাট থেকে রওয়ানা হলাম সুন্দরবন দেখতে। নদীর দুপাশ থেকে অসংখ্য শাখা শিরা উপশিরার মত ছড়িয়ে গেছে । ভাটার সময় বলে এগুলোতে পানি ছিল না তবে জোয়ারের সময়ে এগুলোতে পানি থাকে। ভেজা দুইকুল দেখেই তা বোঝা যায়, নদীপথে ৪৫ মিনিট চলার পর বন বিভাগের টহল ফাঁড়ির জোট দেখা গেল। যাত্রা পথে বুড়ি গোয়ালিনী বাজার দেখলাম। এই বাজারের ঘাট থেকে যন্ত্রচালিত নৌকায় সৌখিন পর্যটকরা সুন্দরবনে ঘুরতে যায়। ঘাটে এ রকম কতগুলো নৌকা বাঁধা আছে। কলাগাছিয়া টহলফাঁড়ি এবং ইকো টুরিজম কেন্দ্রে বোট ভিড়ালাম। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ব্রিজের মত পাটাতনের উপর দিয়ে হেঁটে ফরেস্ট অফিসে যেতে হয় ।

কলাগাছিয়া টহলফাঁড়ি এবং ইকো টুটিজম কেন্দ্র

বনবিভাগের লোকজন এখানে থাকে। নামমাত্র দাম দিয়ে টিকিট করে এখানে বেড়ানোর ব্যবস্থা আছে। ইনচার্জ আমাদেরকে জানালো বাঘ ও এখানে মাঝে মাঝে আছে এবং হরিনের অভয়ারণ্য এটা, মাটিতে অনেক হরিণের পায়ের ছাপ দেখলাম। বাচ্চারা গোলপাতা গাছ দেখার জন্য উৎসুক, নারকেল পাতার মত পাতার নাম কেন গোলপাতা এটাই তারা ভেবে পায়না। সুন্দরী, কেওড়া ইত্যাদি নানা ধরনের গাছ এখানে আছে। বনবিভাগ পর্যটনের জন্য সুন্দর ওয়াকওয়ে বানিয়ে দিয়েছে। ধন্যবাদ জানাই দুরদর্শী সেই বন কর্মকর্তাকে।

ওয়াকওয়ে কলাগাছিয়া টহলফাঁড়ি এবং ইকো টুরিজম কেন্দ্র

ওয়াকওয়ের একদিক দিয়ে যাত্রা শুরু করলে সুন্দরবনের গাছপালা, হরিণের পায়ের ছাপ, জোয়ার ভাটার চিহ্ন, কৃত্রিমভাবে বানানো মিষ্টি পানির আঁধার এগুলো সব দেখতে দেখতে আবার নিজ অবস্থানে ফিরে আসা যায়। ওয়াকওয়ের নীচে জোয়ারের পানি আসে, ভাটার সময় পানি নেমে যায়। মিষ্টি পানি খেতে বনের অন্যান্য প্রানী আসে। বাঘ মামারা পানির টানে চলে আসে এখানে। এই নির্জন এলাকায় বন বিভাগের লোকজন মুরগী পালে এবং কাছের বাজার থেকে তাদের প্রয়োজনীয় জীবন উপকরন সংগ্রহ করে আনে। চোরাকারবারি বা বনদস্যুদের হটাতে তাদের ইঞ্জিন চালিত বোট আছে। তবে এটা দিয়ে দ্রুতগামী দস্যুর বোট ধাওয়া করা বেশ কষ্টকর। সন্ধ্যা হয় হয় করছে, সূর্য পশ্চিমে ঢলে পরছে। সুন্দরবনের জালের মতো বিছানো ছোট ছোট খাল ও বনের গাছপালায় ফাঁক দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে বোটে চড়লাম। আলো থাকতে থাকতে বুড়ি গোয়ালিনী ঘাটের দিকে রওয়ানা দিলাম। বাচ্চারা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক লীলাভূমি সুন্দরবন দেখে মুগ্ধ হলো। এটা এক নতুন অভিজ্ঞতা।

বুড়ি গোয়ালিনী এলাকা, সাতক্ষীরা

সন্ধ্যায় ফেরত এসে আবার নদীর ঘাটে গেলাম জোয়ার দেখার জন্য, আকাশে হালকা চাঁদের আলো, নদীর ঘাটে সোঁ সোঁ শব্দে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। নদীতে জোয়ারের পানির ছলাত ছলাত শব্দ। জোয়ারের সময় কিভাবে পানি বাড়ে তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তারা ঘাটের সিঁড়ির দিকে খেয়াল করছে বেশ মনোযোগ দিয়ে। একটু একটু করে পানি বেড়ে সিঁড়িগুলো ডুবিয়ে দিচ্ছে আর তাদের আগ্রহ আরও বাড়ছে, একসময় অনেক কাছে জোয়ারের পানি এসে গেল, নদীর এই জোয়ার ভাটার অভিজ্ঞতাও তাদের কাছে নতুন, যদিও কক্সবাজারের সমুদ্রতীরে তারা দেখেছে। রাত বাড়ছে তাই রেস্ট হাউজে ফিরে এলাম। পরদিন সকালে খুলনার উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রা, সাতক্ষিরা হয়ে রওয়ানা দিলাম ।

বুড়ি গোয়ালিনী এলাকা, সাতক্ষীরা

খুলনা শহরের সাতক্ষীরার ঘোষের মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে নতুন নতুন নাম ও ডিজাইনের মিষ্টি কেনা হলো, একটা মিষ্টির নাম ইলিশ এটা বেশ হিট হলো, বাচ্চাদের এটা বেশ পছন্দ। সন্ধ্যায় রুপসা ব্রিজ দেখতে বের হলাম, প্রথমে লঞ্চ ঘাটে এলাম, লঞ্চঘাট খুলনা স্টেশনের পাশেই ।

রাত হওয়াতে যাত্রী নেই, সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য রুপসা নামের পর্যটক ভর্তি দুটো লঞ্চ ঘাটে অপেক্ষা করছে। এরা প্রাইভেট পর্যটন সংস্থার মাধ্যমে প্যাকেজ ট্যুরে সুন্দরবন যাচ্ছে। একটা লঞ্চে অনুমতি নিয়ে উঠলাম, ঢুকতেই খাবার ঘর, রাতে বিরিয়ানী খাচ্ছিল যাত্রীরা । দোতালায় উঠে কেবিনগুলো দেখলাম, পর্যটকরা তাদের রুমে আরাম করছে, সকাল নাগাদ লঞ্চ ছেড়ে যাবে । এটা কটকা ও হিরন পয়েন্ট হয়ে আবার এখানেই ফিরে আসবে ।

রাতের রুপসা ব্রিজ

লঞ্চ ঘাট থেকে রুপসা ব্রিজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম, রাস্তা প্রায় ফাঁকা, ব্রিজের উঠার রোড চমৎকার। সুন্দর ও নান্দনিক ব্রিজ এলাকা, আলো জ্বলজ্বল করছে। টোল প্লাজার ওপারে না গিয়ে এপারেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম, নিচে নদী বয়ে চলছে। নদীতে সেই চিরপরিচিত নৌকায় টিমটিম করে আলো জ্বলছে, যন্ত্রচালিত নৌকা শব্দ করে রাতের আঁধারে নদীর বুক চিরে গন্তব্যে যাচ্ছে। ব্রিজের উপর সুন্দর বাতাস কিছুক্ষণ থেকে ফিরে চললাম। ঢাকা থেকে খুলনা হয়ে সুন্দরবন দেখার চমৎকার অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসলাম। সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল বলে সুন্দরবন ভ্রমণ এখন তেমন কষ্টসাধ্য নয়। একটা ছোট গ্রুপে বেশ মজা করে প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় সুন্দরবন দেখা যায়। দেশকে দেখুন, আমাদের দেশ অনেক সুন্দর। আসুন আমরা তাকে আরও সুন্দর করি।

ব্রি জেনারেল (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
লেখক সদস্য বাংলাদেশ ট্র্যাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন

 

  ‘স্বপ্ন ছুঁয়েছে’ পদ্মার এপার-ওপার

;

ভ্রমণ উৎসাহে শেয়ারট্রিপ ‘নাদিরস ফ্যান মিট’



সাব্বিন হাসান, কনসালটেন্ট এডিটর
ভ্রমণ উৎসাহে শেয়ারট্রিপ ‘নাদিরস ফ্যান মিট’

ভ্রমণ উৎসাহে শেয়ারট্রিপ ‘নাদিরস ফ্যান মিট’

  • Font increase
  • Font Decrease

নাদির অন দ্য গো আয়োজন করল প্রথম মিটআপ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হাজারো নাদির ভক্ত। যারা সরাসরি নাদিরের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সরাসরি সুযোগ পেয়েছেন। অনুষ্ঠানটি সৌজন্য করে শেয়ারট্রিপ। আয়োজক ছিল দ্য মার্বেল বি ইউ।

‘নাদির অন দ্য গো’ সুপরিচিত পুরস্কার প্রাপ্ত কনটেন্ট নির্মাতা। দেশে-বিদেশে লাখের বেশি ফলোয়ার প্রতিদিন তার কনটেন্ট উপভোগ করছেন।

নাদির মার্বেল অব টুমরো, বাংলাদেশের অন্যতম ইনফ্লুয়েন্সার প্ল্যাটফর্মের ট্রাভেল ক্যাটাগরিতে পুরস্কার বিজয়ী। নাদির ও ভ্রমণ ভক্তরা তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, তার থেকে অনুপ্রেরণাও নিয়েছেন।

কনটেন্ট সহযোগী হিসেবে আয়োজনকে উজ্জীবিত করেছে ডিজিটাল ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর অরিজিনালস’। তা ছাড়া সার্ভিস সহযোগিতায় ছিল ‘ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স’। কমিউনিটি এনগেজমেন্টে কাজ করেছে ‘কলোনি অব আর্টস’।

নাদির জানালেন, দারুণ একটি দিন ছিল। ভক্তদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা আর দেখা করতে পারা সত্যিই আনন্দের। মার্বেল বি ইউ আর শেয়ারট্রিপ যৌথভাবে দারুণ আয়োজন করেছে।

শেয়ারট্রিপ মার্কেটিং অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সামিউর রহমান জানালেন, যখন ভ্রমণের বিষয় আসে, নাদির তখন লাখো ভক্তের অনুপ্রেরণা। শুধু নাদিরের জন্য নয়, ভ্রমণ উদ্যোগে উৎসাহ দিতে শেয়ারট্রিপ সবসময়ই কনটেন্ট নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করবে।

দেশি-বিদেশি ভ্রমণকে উৎসাহ ও তথ্যবহুল করতে ভবিষ্যতে আরও অভিনব সব উদ্যোগ নিয়ে কাজ করবে ‘দ্য মার্বেল বি ইউ’।

  ‘স্বপ্ন ছুঁয়েছে’ পদ্মার এপার-ওপার

;