বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত মুক্তির সংগ্রাম



মিনার মনসুর
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের কী দিয়েছে—আমি তাদের কিছুই বলি না। তাদের করুণা করা যেত কিংবা বাংলার বরেণ্য কবি আবদুল হাকিমের ভাষায় বলা যেত, ‘সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। কিন্তু আমি তার কোনোটাই করি না। কারণ আমি তাদেরকে কখনোই করুণা বা ক্রোধ কোনোটারই যোগ্য বলে বিবেচনা করিনি। তবে যারা বলেন যে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই দেননি, আমি তাদেরকে আয়নায় নিজের অবয়বটি দেখতে বলি। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের আগে তিনি কী ছিলেন, আর এখন কী হয়েছেন সেটা দেখলেই তো এ জাতীয় সব কু-তর্কের মীমাংসা হয়ে যায়! কথাটি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। স্বাধীনতার আগের সেই বাংলাদেশ আর এই বাংলাদেশ যে এক নয় সেটা বোঝার জন্য গবেষক-পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, শুধু চারপাশে তাকানোর মতো দুটি নির্দোষ চোখ থাকলেই চলে। স্বাধীনতা-পরবর্তী গত সাড়ে চার দশকে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে-অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, আমাদের নিকট অতীতের বাস্তবতার নিরিখে তা অভাবনীয়ই বলা যায়। আর তার বীজ বপিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জাদুকরী হাতেই। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। এখানে যে-কথাটি না বললেই নয় তা হলো, যারা স্বাধীনতা ও পরাধীনতার প্রভেদ বোঝেন না তাদের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা।

দাঁত থাকতে মানুষ দাঁতের মর্যাদা বোঝেন না। এটা কোনো নতুন কথা নয়। প্রকৃতিদত্ত সহজলভ্য অক্সিজেনের অবারিত সমুদ্রে যার বসবাস, অক্সিজেন-শূন্যতায় প্রাণ ওষ্ঠাগত না হলে সে অক্সিজেনের মূল্য বুঝবেই-বা কিভাবে? অথচ আমাদের আদিকবিরাও তা বুঝতেন। স্বাধীনতার ধারণা যখন এতটা স্পষ্টভাবে দানা বাঁধেনি, তখনই আমাদের আরেক বাঙালি কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে গেছেন, ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়!’ স্বাধীনতাহীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। কারণ স্বাধীনতার চেয়ে দামি যে আর কিছুই হতে পারে না তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। স্বাধীনতার জন্যে বিশ্বের দেশে দেশে এখনো যারা হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন তারাই জানেন স্বাধীনতার আসল মূল্য। যুগ যুগ ধরে রক্ত ঝরিয়েও অনেকে আজও স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। সেদিক থেকে আমরা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে যা কখনো ঘটেনি, ঘটবে এমনটা কল্পনাও করা যায়নি, সেই অভাবনীয় ঐতিহাসিক কাণ্ডটিই ঘটে গেছে আমাদের জীবনে। আর এই অসম্ভবকে যিনি সম্ভব করে দিয়ে গেছেন তাঁর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র ৫৫ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি যদি আর কিছু নাও করতেন, শুধু এই একটি কাজের জন্যেই তিনি অমর হয়ে থাকতেন। তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদিত হয়ে থাকত বিশ্ববরেণ্য নেতাদের তালিকায়।

বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর অবদান শুধু স্বাধীনতার মধ্যে সীমিত নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন এ দেশটিকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর কঠিনতম কাজটিও সম্পন্ন করতে হয়েছিল তাঁকেই। এককথায়, সেটা ছিল এক দানবীয় কর্ম। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে গোটা দেশ ক্ষতবিক্ষত। সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। দেশের প্রধান দুটি সমুদ্র বন্দরই ব্যবহারের অনুপযোগী। অর্থনীতির প্রধান খাত হিসেবে বিবেচিত কৃষি মুখ থুবড়ে পড়েছে। নামমাত্র যে শিল্প ও ব্যাংকবীমা ছিল—তাও দেউলিয়া হয়ে গেছে। খাদ্য নেই। কোষাগারও শূন্য। পুলিশ-প্রশাসন কিছুই নেই। নেই স্বাধীন একটি দেশ চালানোর মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ জনবলও। এদিকে মানুষের প্রত্যাশা তখন আকাশচুম্বী। বেকার তরুণ-যুবকরা অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা দেশে। প্রায় এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে গিয়েছিল। তারাও ফিরতে শুরু করেছে শূন্য হাতে। অন্যদিকে, আমেরিকা, চীন ও তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অবস্থান স্বাধীনতার বিপক্ষে। দেশের ভেতরেও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো তখনও তৎপর। এরকম একটি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে হাল ধরতে হয়েছিল সদ্যস্বাধীন এ দেশটির। আরো লক্ষণীয় যে তিনি সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিনবছর—১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এটুকু সময়ের মধ্যে তিনি যা করেছিলেন তা দেশ-বিদেশের ঝানু ঝানু বিশেষজ্ঞদেরও চমকে দিয়েছিল। পর্বতপ্রমাণ প্রতিকূলতার মধ্যেও গোটা দেশের চেহারাই বদলে দিয়েছিলেন তিনি। তার দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি।

এখানে শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, স্বাধীনতাপরবর্তী গত সাড়ে চার দশকে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। তার পরও আমরা খাদ্যে স্বনির্ভরতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নসহ সামগ্রিক জীবনমানের ক্ষেত্রেও। মানুষের আয় ও আয়ু দুটোই বেড়েছে। সর্বোপরি, মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যে-বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই বাজেটের আকার ইতোমধ্যে পাঁচ লাখ কোটি অতিক্রম করে গেছে। বাংলাদেশের সামনে এই যে অপরিমেয় সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বার খুলে গেছে, আলাদীনের সেই আশ্চর্য চেরাগটির নাম হলো স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু কেবল সেই স্বাধীনতাই এনে দেননি, একই সঙ্গে নির্মাণ করে গিয়েছিলেন অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মহাসড়কও। সেই মহাসড়ক ধরেই আমরা এখন তরতর করে এগিয়ে চলেছি। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, স্বাধীনতার পরপরই যে-সংবিধানটি তিনি জাতিকে উপহার দিয়ে গেছেন, তা এখনো বিশ্বের অন্যতম সেরা সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গণতন্ত্র শুধু নয়, সর্বপ্রকার মৌলিক অধিকারেরই নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে সেই সংবিধানে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক হলো জনগণ।

২.
প্রাথমিক বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে দেশ যখন সামনের দিকে চলতে শুরু করেছিল—ঠিক তখনই হানা হয় চূড়ান্ত আঘাত। সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাঁকে। কারা কেন মানবেতিহাসের এ ঘৃণ্যতম হত্যাযজ্ঞটি সংঘটিত করেছিল তা ইতোমধ্যে সকলেরই জানা হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হলো, ষড়যন্ত্রকারীরা যে-বাকশালকে তাদের যাবতীয় আক্রমণের মূল ঢাল বা বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছিল, সেটি ছিল পরীক্ষামূলক একটি কর্মসূচি। কিছুটা যুগান্তকারীও বলা যায়। এর গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক ছিল। প্রথমত, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা সংক্ষেপে ‘বাকশাল’ গঠন। দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিটিই ছিল আসল। বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রথম বিপ্লবটি ছিল দেশের স্বাধীনতা অর্জন। তার নেতৃত্বেই সেটি সফল হয়েছে। বাকশাল ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, এ বিপ্লবের লক্ষ্য হলো—‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’।

নানা প্রসঙ্গে নানাভাবে সে-কথা বারবার বলেছেনও তিনি। এও বলেছেন যে, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ দুটি কথা বলেছিলেন একই নিঃশ্বাসে। সেটি হলো, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল হয়েছে কিন্তু প্রকৃত ‘মুক্তি’ অর্জিত হয়নি। শত শত বছরের শোষণ-বঞ্চনার নিগড় থেকে দেশের কোটি কোটি মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত করার কাজটি যে কতটা কঠিন তা তিনি অন্য যে-কারো চেয়ে ভালো জানতেন। তিনি বলেছেন, তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য হলো—অর্থনৈতিক মুক্তি। তাঁর ঘোষিত বাকশাল তথা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ দেশের ভুখানাঙ্গা মানুষকে শোষণ-বঞ্চনা ও দারিদ্র্যের বংশানুক্রমিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা সম্ভব বলে তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করতেন।

গত শতাব্দীতে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের খুবই প্রিয় একটি স্লোগান ছিল—‘এ সমাজ ঘুণে ধরা/ এ সমাজ ভাঙতে হবে’। দশকের পর দশক ধরে স্লোগানটি এ-দেশের মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রাণিতও করেছে। গতানুগতিক অর্থে বঙ্গবন্ধু বিপ্লবী ছিলেন না। সব ধরনের হঠকারিতা বা চরমপন্থা থেকে তিনি নিজেকে সযত্নে দূরে রেখেছেন আমৃত্যু। তবে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু নিজেও সম্ভবত উপলব্ধি করেছিলেন দুঃখী মানুষের ভাগ্য বদলাতে হলে ঘুণে ধরা সমাজ ভাঙা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাঁর ভাষায়, ‘আমি কেন ডাক দিয়েছি? এই ঘুণে ধরা ইংরেজ আমলের, পাকিস্তানি আমলের যে শাসনব্যবস্থা তা চলতে পারে না। একে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। তা হলে দেশের মঙ্গল আসতে পারে। না হলে আসতে পারে না। আমি তিন বছর দেখেছি। দেখেশুনে আমি আমার স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছি।...’ (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণ: ২৬ মার্চ, ১৯৭৫)।

আমার বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মধ্যে বিদ্যমান ঘুণে ধরা সমাজ ভাঙার বলিষ্ঠ কিছু উপাদানও ছিল। তিনি তাঁর মতো করে সমাজ-ভাঙার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। বিশেষ করে কৃষি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের চিন্তা ছিল বঙ্গবন্ধুর মনে। পঁচাত্তরের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় প্রদত্ত দীর্ঘ ভাষণে সেটা তিনি বলেছেনও খোলাখুলিভাবে। তাঁর ভাষায়—“এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না। ...পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। ...কর্মক্ষম প্রতিটি মানুষকে কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল টাউটদেরকে বিদায় দেয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এই জন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি যে পাঁচ বছরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচশো থেকে হাজার ফ্যামিলি নিয়ে কম্পালসারি কো-অপারেটিভ হবে।”

[পুরো ভাষণ শুনতে ইউটিউব লিংকে ক্লিক করুন]

মূলত দ্বিতীয় বিপ্লবের এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যই তিনি গঠন করেছিলেন বাকশাল নামক নতুন রাজনৈতিক দল। এটাকে তিনি বলেছিলেন জাতীয় দল বা প্লাটফরম। দল-মত নির্বিশেষে সকলেরই যোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল এ দলে। সামরিক-বেসামরিক বহু সরকারি কর্মকর্তা সেই সুযোগ গ্রহণও করেছিলেন। গুটিকয় ব্যতিক্রম ছাড়া বাকশালে যোগ দেওয়ার জন্য হিড়িক পড়ে গিয়েছিল তখন। নানাভাবে দেনদরবারও চলছিল। শোনা যায়, যাকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বলে বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর হাস্যকর চেষ্টা চালানো হচ্ছে দীর্ঘদিন যাবৎ সেই সেনা কর্মকর্তাও ছিলেন এই দলে। ছিলেন আরো অনেকেই। বাকশালের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় এখনো থামেনি। বলা হয় যে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসন কায়েম করেছিলেন! বিসর্জন দিয়েছিলেন গণতন্ত্রকে! সে জন্যই নাকি সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল! বহু ‘নিরপেক্ষ’ বুদ্ধিজীবী-পণ্ডিতের মুখেও আমি এমন কথা বহুবার শুনেছি। এ প্রচারণা যে সুপরিকল্পিত, বিদ্বেষপ্রসূত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অনেকটা হরিণের পানি ঘোলা করার সেই গল্পের মতো। বস্তুত বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। দেশি-বিদেশি অনেকেই জড়িত ছিলেন এ-ষড়যন্ত্রের সঙ্গে। একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়াই ছিল তাদের প্রথম লক্ষ্য। ঘাতকরা তাদের লক্ষ্যে এতটাই অবিচল ছিল যে, বঙ্গবন্ধু বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণা না করলেও পরিস্থিতির কোনো হেরফের হতো বলে আমার মনে হয় না।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/03/1564835607561.jpg
◤ বাকশাল ছিল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ◢

 

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাই যদি বঙ্গবন্ধুর মূল উদ্দেশ্য হতো তার জন্য বাকশাল গঠনের প্রয়োজন ছিল না। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তিনি আরো বহুদিন ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। আমার জানা মতে, বঙ্গবন্ধুর ঘোর বিরোধীরাও নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার অসম্ভব দাবি কখনোই করেননি। সব দল মিলেও যে সেটা সম্ভব হতো না তা তারা ভালো করেই জানতেন। এমনকি চুয়াত্তর-পঁচাত্তরের সেই কঠিন দিনগুলোতেও সকল বিচারেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সেটা তিনি নিজেও জানতেন। যেখানেই তিনি যেতেন, সেখানেই মানুষের ঢল নামত। আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর কষ্ট ছিল অন্য জায়গায়। তিনি নিজের সঙ্গেই এক কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। নিজেকে, নিজের চারপাশের সব সীমাবদ্ধতাকে, ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু তাঁর সারা জীবনের স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিশেষ করে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ তাঁকে খুব বিচলিত করে তুলেছিল।

নানা সূত্রে এখন জানা যাচ্ছে যে, দ্রুত কিছু একটা করার জন্য ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। নানা জন নানা পরামর্শ দিয়েছেন তাঁকে। বলেছেন, ভেবেচিন্তে ধীরেসুস্থে পা ফেলতে। পরিণতি সম্পর্কে সতর্কও করে দিয়েছেন। ফিডেল ক্যাস্ট্রোর মতো নেতারাও ছিলেন পরামর্শদাতাদের দলে। কিন্তু একাত্তরের রুদ্ধশ্বাস দিনগুলোর মতো এবারও বঙ্গবন্ধু স্বীয় সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন। কারো কথাই শোনেননি তিনি। এমন নয় যে, পরিণতির ব্যাপারে তিনি খুব উদাসীন ছিলেন। ঘাতকের বুলেট যে-কোনো সময়ে তাঁর বুক ঝাঁঝরা করে দিতে পারে তাও তাঁর অজানা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত ছিলেন তিনি। সত্য যে কঠিন—নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনেই তা তিনি উপলব্ধি করেছেন পদে পদে। স্বধর্মে অবিচল থাকা যে আরো কঠিন তাও তিনি জানতেন। তবু যুধিষ্ঠিরের মতো তিনিও স্বধর্ম পালনে কখনোই কুণ্ঠিত হননি। যুধিষ্ঠির চলতেন নিজের বিবেচনা ও বিশ্বাস অনুযায়ী। বিবেকের নির্দেশকে শিরোধার্য জ্ঞান করতেন। এটাই হলো স্বধর্ম। শত ঝড়ঝঞ্ঝা সত্ত্বেও এ-পথ থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি যুধিষ্ঠির। এ জন্য বুদ্ধদেব বসু মহাভারতের নায়কের শিরোপাটি তুলে দিয়েছিলেন তাঁর মাথায়। বলেছিলেন—মহাবীর অর্জুন নন, যুক্তিবাদী যুধিষ্ঠিরই হলেন যথার্থ নায়ক। বঙ্গবন্ধুও তাই। বলা যায়, সম্পূর্ণ সজ্ঞানেই ঘাতকের উদ্যত সঙ্গীনকে অগ্রাহ্য করে একাত্তরের মতো আবারও বিবেকের ডাকেই সাড়া দিয়েছিলেন তিনি। এটাই তার স্বধর্ম। তবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমি রাজা ইডিপাসেরও মিল খুঁজে পাই—কোনো কিছুই যাকে নিজ জনগণের মঙ্গলসাধনের ব্রত থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। খুঁজে পাই আমাদের কালের ট্রাজিডির অনন্য এক মহানায়ককে।

বলা বাহুল্য, সপরিবারে আত্মাহুতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু এ-দেশের হতদরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে যে-সংগ্রামের সূচনা করে গেছেন, তাকে সফলভাবে সমাপ্ত করার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের ওপর। এখানে ব্যর্থতার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের সৌভাগ্য যে, তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত মুক্তির সংগ্রাম সমাপ্ত করার পথে ইতোমধ্যে আমরা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছি। দেশে-বিদেশে সর্বত্রই বাংলাদেশ আজ এক যথার্থই বিস্ময়ের নাম। জাতির পিতার সোনার বাংলা এখন আর কেবল স্বপ্নমাত্র নয়, পদ্মা সেতুর মতোই তার অবয়ব ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে দিনদিন।

মিনার মনসুর
পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;