একদা এক ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তি



লিডিয়া ডেভিস
ছবি নিউইয়র্কার থেকে। গ্রাফিক বার্তা২৪

ছবি নিউইয়র্কার থেকে। গ্রাফিক বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

অনুবাদ মেহেদী হাসান

লিডিয়া ডেভিস ১৯৪৭ সালের ১৫ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের নরদাম্পটনে জন্মগ্রহণ করেন। অনুগল্প (Flash fiction) কথিত অত্যন্ত স্বল্প পরিসরের সাহিত্য আঙ্গিকের জন্য তিনি অধিক পরিচিত। পাশাপাশি তিনি একজন ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক। তিনি মার্সেল প্রুস্তের সোয়ান’স ওয়ে এবং গুস্তাব ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারিসহ ফরাসি ও অন্যান্য ভাষার বেশ কিছু চিরায়ত সাহিত্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

লিডিয়া ডেভিসের বাবা রবার্ট গরহ্যাম ডেভিস (Robert Gorham Davis) ছিলেন একজন সাহিত্য সমালোচক ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক এবং মা হোপ হেল ভেভিস (Hope Hale Davis) ছিলেন একজন ছোটগল্পকার, স্কুল শিক্ষিকা এবং স্মৃতিকথা লেখক। গোড়ার দিকে তিনি সঙ্গীতের ওপর শিক্ষা গ্রহণ করেন—প্রথমে পিয়ানো, তারপর ভায়োলিন। সঙ্গীত ছিল তার প্রথম প্রেম। লেখক হওয়ার বিষয়ে লিডিয়া ডেভিস জানান, “আমি সম্ভবত সবসময় লেখক হওয়ার পথেই এগিয়ে গিয়েছি, এমনকি যদিও এটা আমার প্রথম প্রেম নয়।” 

লিডিয়া ডেভিস দ্য থারটিন উম্যান এন্ড আদার স্টোরিজ (১৯৭৬) এবং ব্রেক ইট ডাউন (১৯৮৬) সহ মোট ছয়টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেন। ব্রেক ইট ডাউন গল্প গ্রন্থটি পেন/ হেমিংওয়ে অ্যাওয়ার্ড-এর (PEN/Hemingway Award) চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এবং তার সাম্প্রতিক প্রকাশিত ভ্যারাইটিজ অব ডিস্টারবেন্স (২০০৭) গল্পগ্রন্থটি স্থান লাভ করে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড (National Book Award) চূড়ান্ত তালিকায়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত লেখা তার সকল গল্পের সমন্বয়ে প্রকাশিত হয়েছে দ্য কালেক্টডে স্টরিজ অব লিডিয়া ডেভিস (২০০৯)।

অনেকে তাকে অনেকাংশে তার নির্মিত সাহিত্য আঙ্গিকের গুরু হিসেবে অভিহিত করেন। তার অনেক অনুগল্প (Flash fiction) মাত্র একটি বা দুটি বাক্যেই সম্পূর্ণ। ডেভিস এইসব গল্পকে আকাশচুম্বী ভবনের সাথে তুলনা করেন এই অর্থে যে তারা আরোপিত শূন্যতা দ্বারা পরিব্যাপ্ত।

লিডিয়া ডেভিস ৬৫ বছর বয়সে ২০১৩ ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। ডেভিসকে পুরস্কার দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় ম্যান বুকার প্রাইজ ওয়েবসাইটে তার সাহিত্য কর্মকে কাব্যের পরিমিতিবোধ এবং যথাযথতা সম্বলিত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/01/1561953332191.jpg
তরুণ বয়সে লিডিয়া ডেভিস / প্যারিস ১৯৭৩

 

একদা এক ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তি 

মেয়েটি ক্লান্ত ও হালকা অসুস্থ এবং খুব পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারছে না। পোশাক পরার সময় মেয়েটি লোকটিকে জিজ্ঞেস করতে থাকে তার কাপড়-চোপড় সব কোথায় এবং লোকটি খুব ধৈর্য সহকারে মেয়েটির কাপড়-চোপড়ের অবস্থান জানায়—প্রথমে তার প্যান্ট, তারপর তার শার্ট, তারপর তার মোজা, তারপর তার চশমা। লোকটি মেয়েটিকে চশমা পরতে বলে এবং মেয়েটি চশমা পরে, তবে এতে তেমন কোনো লাভ হয় বলে মনে হয় না। রুমে খুব একটা আলো ঢুকছে না। এই খোঁজাখুঁজি এবং পোশাক পরার চেষ্টার সময় মেয়েটি প্রায় সকল পোশাক পরা অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থাকে। বিড়ালটাকে খাওয়াতে খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার এবং খাবারের টিন খোলার পর লোকটি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে। খাবারের টিন খোলার সময় এমন শব্দ হয় যা মেয়েটিকে হতবিহ্বল করে তোলে কারণ শব্দটি গাভীর বান থেকে স্টিলের বালতিতে দুধ পড়ার মতো শোনায়। প্রায় সকল পোশাক পরা অবস্থায় মেয়েটি লোকটির পাশে শুয়ে থাকার সময় লোকটি বিভিন্ন বিষয়ে একনাগাড়ে মেয়েটিকে বলে যায়। মেয়েটি লোকটির কথা শোনার সময় বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে, প্রথমে বিরক্তি, তারপর ব্যাপক উৎসাহ, এরপর আহ্লাদ, তারপর চিত্ত বিক্ষেপ, তারপর আবার বিরক্তি, এরপর আবার আহ্লাদ। লোকটি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে তার বাচালতায় সে কিছু মনে করছে কিনা এবং সে কথা বলা বন্ধ করবে নাকি চালিয়ে যাবে। এখন তার প্রস্তুত হওয়ার সময়—এই বলে মেয়েটি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে।

মেয়েটি আবার তার পোশাক খুঁজতে শুরু করে এবং লোকটি এবারও তাকে পোশাক খুঁজতে সাহায্য করে। মেয়েটি জানতে চায় তার আংটি কোথায়, জুতা কোথায়, জ্যাকেট কোথায় এবং পার্স কোথায়। লোকটি মেয়েটির জিনিসপত্রের অবস্থান জানিয়ে দেয়। এরপর লোকটি বিছানা ছাড়ে এবং মেয়েটি জানতে চাওয়ার আগেই কিছু জিনিস এগিয়ে দেয়। মেয়েটি যখন সকল পোশাক পরে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, তখন মেয়েটি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে যে তার পরিস্থিতি অনেকটা সেই হাসিডিক গল্পের মতো যা সে আগের দিন সাবওয়েতে পড়েছে। বইটি এখনো তার পার্সের মধ্যে আছে। মেয়েটি লোকটিকে জিজ্ঞেস করে মেয়েটি তাকে একটি গল্প পড়ে শোনাতে পারে কিনা, লোকটি ইতস্তত করে। মেয়েটি ভাবে লোকটি সম্ভবত চায় না সে তাকে গল্প পড়ে শোনাক, এমনকি যদিও লোকটি মেয়েটিকে পড়ে শোনাতে পছন্দ করে। মেয়েটি বলে একটি মাত্র অনুচ্ছেদ তাকে পড়ে শোনাবে, লোকটি রাজি হয় এবং তারা রান্নাঘরের টেবিলের সামনে বসে। ইতোমধ্যে লোকটিও পোশাক পরে নিয়েছে—একটি সাদা টি-শার্ট এবং একটি প্যান্ট যাতে তাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। পাতলা বাদামী রঙের বইটি থেকে মেয়েটি তাকে নিম্নোক্ত গল্পটি পড়ে শোনায়।

“একদা এক লোক ছিল—লোকটি ছিল ভীষণ নির্বোধ। সকাল বেলায় বিছানা ছাড়ার সময় পোশাক খুঁজে পাওয়া তার জন্য এতই দুষ্কর হয়ে উঠত যে, এই ঝামেলার কথা ভেবে সে রাতে বিছানায় যেতে ইতস্তত বোধ করত। একরাতে সে হাতে কাগজ ও পেন্সিল তুলে নেয় এবং তার পরনের পোশাক খুলে কোথায় রাখছে তা যথাযথভাবে লিখে রাখে। পরের দিন সকালে সে তার কাগজটি হাতে নিয়ে খুশি মনে পড়তে শুরু করে: টুপি—এখানে ছিল, তখন সে এটা মাথায় পরে; প্যান্ট—এখানে পড়ে আছে, সে প্যান্ট পরে নেয়; এবং সকল পোশাক পরা পর্যন্ত এভাবে চলে। এখন তার আতঙ্ক দূর হয় এবং সে নিজেকে বলে: ‘আমি আমার পোশাক খুঁজে পেয়েছি এবং গায়ে চাপিয়েছি, তবে আমি নিজে এখন কোথায় আছি? এই পৃথিবীর কোথায় আমি? সে চারদিকে খুঁজতে থাকে, তবে এতে কোনো লাভ হয় না; সে নিজেকে খুঁজে পায় না। ইহুদি যাজকটি বলে, আমাদের ব্যাপার-স্যাপারই এরকম।”

মেয়েটি পড়া থামায়। লোকটি গল্পটি পছন্দ করে, তবে শুরুর দিকটা, লোকটির সমস্যা এবং সমাধান, যেমন পছন্দ করে শেষের অংশটুকু—‘আমি কোথায়?’—তেমনটা পছন্দ করে বলে মনে হয় না।

মেয়েটি ভাবে সে ওই ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তিটির মতো, শুধু এই কারণে নয় যে, সে তার পোশাক খুঁজে পায় না, একারণেও নয় যে মাঝে মাঝে পোশাক পরা বাদেও অন্যান্য সাধারণ জিনিসপত্র তার নাগালের বাইরে চলে যায়। তবে বেশিরভাগ এই কারণে যে, সে প্রায়ই বুঝতে পারে না সে কোথায় এবং বিশেষ করে এই লোকটির প্রেক্ষিত থেকে মেয়েটি জানে না মেয়েটি কোথায়। মেয়েটি ভাবে এই লোকটির জীবনে সম্ভবত তার কোনো জায়গা নেই, লোকটি অবশ্য শুধু তার নিজের বাড়িতেই নেই, ঠিক তেমনিভাবে মেয়েটিও তার নিজের বাড়িতে নেই যখন সে লোকটির সাথে দেখা করতে যায় এবং সে আসলে জানে না কোথায় তার বাড়ি তবে ঠিকই সে রাস্তায় হোঁচট খেতে খেতে এবং পড়ে যেতে যেতে সেখানে পৌঁছায় যেন বাস্তবে নয় স্বপ্নে, তবে লোকটি মোটেই লোকটির নিজের জীবনে আর নেই এবং নিজেকে জিজ্ঞেস করে,‘আমি কোথায়?’

মেয়েটি আসলে নিজেকে একজন ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তি মনে করতে চায়। মেয়েটি কি বলতে পারে না, এই মেয়েটি একজন ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তি, ঠিক যেমনভাবে কয়েক সপ্তাহ আগে সে ভেবেছিল সে নিজেকে একজন দাঁড়িওয়ালা লোক মনে করেছে? কারণ এই গল্পের ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তি যে আচরণ করে মেয়েটি ঠিক তেমন আচরণই করত অথবা ঠিক এই মুহূর্তে তেমন আচরণ করছে, সে কি নিজেকে ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে পারে না, ঠিক যেমনভাবে কয়েক সপ্তাহ আগে সে ভেবেছিল একটি ক্যাফেতে পাশের টেবিলে বসে লিখতে থাকা কেউ দাড়িওয়ালা লোক হিসেবে পরিগণিত হবে? মেয়েটি একটি ক্যাফেতে বসেছিল এবং একজন দাড়িওয়ালা লোক তার থেকে দুই টেবিল পরে বসে লিখছিল এবং উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকা দুইজন মহিলা লাঞ্চ করতে আসে এবং দাড়িওয়ালা লোকটিকে বিরক্ত করে এবং মেয়েটি তার নোটবুকে লিখে রাখে যে তারা পাশের টেবিলে বসে লিখতে থাকা দাড়িওয়ালা লোকটিকে বিরক্ত করেছে এবং এরপর দেখে যদিও সে নিজে, যখন সে এটা লিখছিল, পাশের টেবিলে বসে লিখছে, সে সম্ভবত নিজেকে একজন দাড়িওয়ালা লোক মনে করে। ব্যাপারটা এরকম নয় যে সে কোনোভাবে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে, তবে দাড়িওয়ালা লোক এই শব্দটি এখন তার ওপর প্রয়োগ করা যায়। অথবা সম্ভবত সে পরিবর্তিত হয়ে গেছে।

মেয়েটি উচ্চস্বরে লোকটিকে গল্পটি পড়ে শোনায় কারণ এটা ঠিক তেমনই যেমনটা তার ক্ষেত্রে ঘটেছে, তবে এরপর সে ভাবে বিপরীতটাও তো হতে পারে এবং গল্পটি আগের দিন তার মনের ভেতরে কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারে এবং তার সকল পোশাক কোথায় আছে তা ভুলে যাওয়া এবং পোশাক পরার সময়কার এসব ঝামেলা সম্ভব করে তুলতে পারে। সেইদিন সকালে, অথবা সম্ভবত অন্য এক সকালে, লোকটিকে ছেড়ে আসার সময় একই ধরনের নির্বুদ্ধিতা অনুভব করা, যে তার নিজের জীবনে আর নেই, যখন মেয়েটি আবার নিজেকে লোকটির জীবনে খোঁজ করে এবং নিজেকে কোথাও খুঁজে পায় না, তখন আরো বিভ্রান্তি তৈরি হয়। মেয়েটি কাঁদে এবং সম্ভবত কাঁদে শুধুমাত্র এই কারণে যে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে এবং সে জানালার শার্শিতে পড়তে থাকা বৃষ্টির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে এবং এরপর সে ভাবে সে বেশি বেশি কাঁদে কারণ বৃষ্টি হচ্ছে অথবা এই বৃষ্টি প্রথমেই তার জন্য কান্না সম্ভব করে তোলে, যেহেতু সে ঘন ঘন কাঁদে না, এবং অবশেষে ভাবে এই দুইটি, বৃষ্টি এবং অশ্রু, আসলে একই। এরপর রাস্তায় একটা বিশাল হঠাৎ হট্টগোল বিভিন্ন জায়গা থেকে একই সময় আসতে থাকে—কিছু গাড়ি হর্ন বাজাচ্ছে, একটি ট্রাকের ইঞ্জিন ঘরঘর শব্দ করছে, অন্য একটি লক্করঝক্কর ট্রাক একটি ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে ঝনঝন করে চলছে, একটি রোড মেন্ডার রাস্তা পিটাচ্ছে—এবং হট্টগোলটি মনে হচ্ছে যেন তার ঠিক ভেতরে ঘটছে যেন তার ক্রোধ এবং দ্বিধা তাকে শূন্য করে দিয়ে গেছে এবং তার বুকের ঠিক মাঝখানে একটি জায়গা তৈরি করেছে এই উচ্চ ধাতব সংঘর্ষ তৈরি হওয়ার জন্য, অথবা যেন সে নিজে এই শরীর ত্যাগ করেছে এবং এই হট্টগোলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে গেছে, এবং এরপর সে ভাবে, আসলেই কি শব্দটি আমার ভেতরে ঢুকছে, অথবা আমার ভেতরের কিছু রাস্তায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে এরকম একটা বিশাল হট্টগোল তৈরি করার জন্য।

 

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;