অন বেয়িং অ্যা রাইটার



ভি এস নাইপল

  • Font increase
  • Font Decrease

অনুবাদ আফসানা বেগম

সত্যিই জানি না কী করে আমি লেখক হয়ে উঠলাম। এই পেশায় অগ্রগতির পথে নির্দিষ্ট কিছু দিন-তারিখ আমি উল্লেখ করতে পারি বটে। কিন্তু তারপরেও পুরো বিষয়টি ধোঁয়া ধোঁয়াই রয়ে যাবে। কারণ প্রক্রিয়াটি রহস্যময়, যেমন ধরা যাক, লেখক হতে গেলে—সবচেয়ে প্রথমে থাকতে হবে লেখক হওয়ার বাসনা, নিজেকে অন্যদের থেকে পৃথক ভাবার কিংবা লেখক হিসেবে পরিচিত হওয়ার পরিকল্পনা। কী নিয়ে লিখব সেটা ভাবার অনেক অনেক আগেই ওই দৃঢ় ইচ্ছেটুকু থাকা জরুরি।

১৯৫০ সালে অক্সফোর্ডে প্রথম বর্ষে পড়ার সময়টা আমার মনে পড়ে, অনেক দূর হেঁটে যেতাম আমি, মনে পড়ে ওই রাস্তাগুলো, হেমন্তের ঝরা পাতা বিছানো, শুকনো পাতায় আলোড়ন তুলে গাড়ি আর ট্রাকগুলো দ্রুত ছুটে যেত—সেদিকে তাকিয়ে আমি ভাবতে থাকতাম কী নিয়ে লেখা যায়। লেখক হব বলে অক্সফোর্ডে ঢোকার চেষ্টায় স্কলারশিপ বাগানোর জন্য কতই না কষ্ট করেছি। কিন্তু তখন আমি খোদ অক্সফোর্ডে, অথচ জানি না কী নিয়ে লেখা শুরু করব। তখন যেন আমাকে কিছু তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, নিশ্চিত জানি, লিখবার জন্য ওরকম হন্যে হয়ে না ঘুরলে আমার হয়তো কখনো লেখাই হতো না। মনের মধ্যে সেই ইচ্ছেটা লালন করে চলা ছিল যেমন আনন্দদায়ক তেমনই লোভনীয়—মস্কো থেকে ফিরে যাবার সময়ে নেপোলিয়নের সৈন্যদের জন্য যেমন লোভনীয় ছিল ঘুম।

একখানে বসে একটা বই লিখে ফেলার ব্যাপারটা আমার কাছে হঠাৎ খুব মেকি মনে হতো। আজ এত বছর পরেও সেই অনুভূতিটা আমাকে কখনো আচ্ছন্ন করে রাখে, আমি যখন একটা লেখা শুরু করি—তার মানেই হলো আমি কিছু সাজানো আর বানানো কাজের ব্যাপারে ভাবছি। মাথায় সব সময় কোনো নির্দিষ্ট কাহিনী বা ঘটনা থাকে না। আবার বলতে গেলে মাথায় অনেক কিছুই হয়তো থাকে; তেমন কিছু না ভেবেই আমি সম্পূর্ণ কল্পনা থেকে কোনো কাহিনীর শুরুটা লিখে ফেলি; লিখতে থাকি যতক্ষণ কোনো গন্তব্য না পাই—সেই সাজানো ঘটনার ভেতর দিয়ে এগোতে থাকি—একসময় সেটা আমাকে ঘায়েল করে ফেলে, আর তারপর আমার সারা জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতায় আমি অজানার উদ্দেশে রওনা দেই। আর এখনো এটাই সবচেয়ে রহস্যময়—সাজানো, বানানো, কৃত্রিম কতকগুলো বিষয়কে আশ্রয় করে একজনকে তার আত্মার, হৃদয়ের আর স্মৃতি ভাণ্ডারের গভীরতম অনুভূতি খুঁজে বের করতে হবে এবং তাকে স্পর্শও করতে হবে।

সাহিত্যের সবরকম ক্ষেত্রই আসলে কৃত্রিম, আর সেগুলো ক্রমাগত বদলে যেতে থাকে, বদলায় সংস্কৃতির নতুন ধারা আর আমেজের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে। ধরা যাক, সাহিত্য বোদ্ধা একজন মানুষ একটি মঞ্চনাটক লিখবে বলে ভাবল; তাকে তখন কিছু কল্পনা সাজাতে হবে যেটা বলতে গেলে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না—কাহিনীটা বিভিন্ন দৃশ্যে আর ছোট ছোট পালায় ভাগ করে নিতে হবে; হয়তো সাদা কাগজে একের পর এক লাইন লিখে যেতে হবে না, কিন্তু অভিনেতার কাছে স্পষ্ট করে তুলতে পালার একেকটা অংশ বর্ণনা করতে হবে ঠিকই। মঞ্চনাটক লিখেছেন, এমন একজনের কাছে জেনেছি, নাটকের দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজাতে গিয়ে তিনি নিজেকে সেই নাটকের সামনের সারিতে বসা একজন দর্শক হিসেবে কল্পনা করেন।

আগেকার দিনে যখন রেডিও বা রেকর্ড ছিল না, ছাপানো কাগজ যে যুগে রাজত্ব করত, তখন কেউ চাইলে একটা কাহিনীকে এমনভাবে সাজাতে পারত যেন সেটি অনেকগুলো ভাগে ভাগ হয়ে যায় আর মাসের পর মাস ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে, এভাবে ভল্যিউমের পর ভল্যিউম হয়ে যেত। তারও আগে, লেখা হয়েছিল গীতিকবিতা অথবা গীতিনাট্য, কখনো ছন্দ মেলানো, কখনো আবার ছন্দবিহীন; এমনকি গীতিমহাকাব্যও।

এর সবকিছুই এখন আমাদের চোখে কৃত্রিম, কিন্তু আজকের আধুনিক উপন্যাসকে যেমন পাঠকের কাছে বাস্তব বলে মনে হয়, সে সময়ে গীতিনাট্যকেও দর্শকের কাছে তেমনই বাস্তব মনে হতো। প্রকৃতপক্ষে উপন্যাসমাত্রই কৃত্রিম, কৃত্রিম তার কাহিনীর সরলতা কিংবা জটিলতায়, বানানো দৃশ্যকল্পে, সাধারণ জীবনযাপনের ছন্দে কোনো সংকট এবং তার থেকে উত্থানের ধারাবাহিক বর্ণনায়। আমি আসলে খুব সরাসরি বলতে চাচ্ছি যে এই কৃত্রিমতার অনুভূতি লেখালেখির শুরু থেকেই আমার ভেতরে কাজ করত, যখন আমি লিখতে শুরু করতাম, ভাবতাম আমার জীবনের অভিজ্ঞতার কোন অংশকে সেই লেখার আওতায় কী করে ফেলা যায়—বলতে গেলে, নিজের স্মৃতির ভেতরে পাগলের মতো হাতড়ে বেড়াতাম, পইপই করে খুঁজতাম কী করে সাহিত্যের ওই ক্ষেত্রটিতে সাজানো ঘটনার আবহে আমার অর্জিত কোনো অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে দিতে পারি।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রূপে বিন্যাস বা নির্মাণের প্রয়োজন: অভিজ্ঞতাকে সেখানে মিশিয়ে দিতে হবে সাবলীলভাবে, যেন অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু কিছু কিছু নির্মানের ক্ষেত্রে, যেমন কাপড়চোপড়ের ফ্যাশনের ক্ষেত্রে এই কৃত্রিমতার ব্যাপারটা মাঝে মধ্যে চরমে পৌঁছায়। আর তখন সেখানে নিজস্ব অভিজ্ঞতার প্রতিফলনে তাকে আরও তীক্ষ্ণ করার পরিবর্তে অনেক বেশি কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়, গাঁজাখুরি কল্পনার ভারে বিষয়টি তখন হয়ে দাঁড়ায় একটা বোঝার মতো। ট্রলোপ (ইংরেজ ঔপন্যাসিক অ্যান্থনি ট্রলোপ - অনুবাদক) যেমন কাল্পনিক একটা পরিস্থিতির অবতারণা করতেন—তিনি ছিলেন রীতিমতো একজন সমাজ গবেষক, সমাজ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল প্রখর, বলা যেতে পারে সেই জ্ঞানের গভীরতা ছিল ডিকেন্সের (ইংরেজ লেখক চার্লস ডিকেন্স। - অনুবাদক) চেয়েও বেশি, যেন এক মোহিনী শক্তি। অথচ ট্রলোপ, যিনি কিনা অকল্পনীয় পরিস্থিতি তৈরি করতেন, তাকে নিয়ে আমার এক ধরনের সমস্যা আছে, তার লেখার প্রারম্ভিক কয়েকটি পাতায় যে সামাজিক চিন্তা এবং দার্শনিক মতামতের পরিচয় পাওয়া যায়, তার সাথে মিলিয়ে পরে উদ্ভুত সেই জটিল পরিস্থিতির জট ধীরে ধীরে খোলা সহজ নয়। ঠাকরের (ভারতীয় বংশদ্ভূত ইংরেজি ভাষার সাহিত্যিক উইলিয়াম ঠাকরে। - অনুবাদক) লেখার বিষয়েও আমার একই কথা বলার আছে: পড়তে পড়তে এগুতে থাকলে মনে হয় বাচনভঙ্গিটি টিকিয়ে রাখার জোর চেষ্টা আর প্লটের জটিলতা যেন তার ঘাড়ে আলগা বোঝার মতো চেপে বসেছে।

বর্ণনামূলক সাহিত্য থেকে আনন্দ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিগত প্রায় একশো বছরে আমাদের রুচির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গত শতাব্দীর সমস্ত সাহিত্য, সিনেমা আর টেলিভিশনে প্রচারিত সব অনুষ্ঠান আমাদের রুচির পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছে। আজ একথা অনায়াসে বলতে পারি যে, ঊনিশ শতকের ইংরেজি ভাষার যেসব ঔপন্যাসিকেরা আমাকে উপন্যাস পড়ার প্রকৃত আনন্দ দেয়—যখন তাদের লেখার জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে মানুষের জীবন দেখা যায়, মানুষের সেই প্রতিকৃতি আমাকে উৎসাহিত করে—তবে দুঃখের বিষয় হলো, তাদের নিজেদের সময়ে সেই লেখকদের আদৌ ঔপন্যাসিক হিসেবে ভাবা হয়নি।

রিচার্ড জেফারিসের (ইংরেজ লেখক, ১৮৪৮-১৮৮৭। - অনুবাদক) মতো লেখকদের কথা আমি প্রায়ই ভাবি, যার লেখায় খামারে কাজ করা মানুষদের জীবনযাত্রা এমন সূক্ষ্মভাবে উঠে আসে, তাদের সম্পর্কে তার জ্ঞান এত বিস্তৃত আর বর্ণনা এত প্রাঞ্জল যে মনে হয় সেই শ্রেণির সব মানুষের পুরো জীবনটাই উঠে এসেছে তার লেখায়। অথবা যদি উইলিয়াম হ্যাজলিটের (ইংরেজ লেখক, ১৭৭৮-১৮৩০। - অনুবাদক) কথা বলি, বা চার্লস ল্যাম্ব (ইংরেজ লেখক, ১৭৭৫-১৮৩৪। - অনুবাদক), তাদের টানটান বর্ণনা, আঁটোসাটো অথচ আবেগী বাক্য, খুব সাধারণ ব্যাপার কিন্তু নয়, হেলাফেলা করে লিখে তারা বিখ্যাত হননি। তারপর যদি বলি উইলিয়াম কবেটের কথা, তিনি সেই সাংবাদিক আর প্যামফলেট লেখক, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যাপারে যার লেখাগুলো তীক্ষ্ণ, বিস্ময়কর গদ্যভঙ্গিমা, মাঝে মাঝে ভয়ানক সংস্কারের প্রতিজ্ঞা, গ্রাম্য মানুষদের জীবন, তাদের খাবারের অভ্যাস, সেখানকার রাস্তা, মাঠঘাট, এমনকি গ্রাম্য হোটেলের বর্ণনাও নিখুঁত তার। এই লেখকদের মধ্যে সবাই তাদের লেখার ধারায় সেই সময়ের উপন্যাসের ধারাটি বজায় রেখেছেন। নিজেদের প্রতিভার সাথে যুক্ত হয়েছে সময়ের প্রচলিত কাঠামো। তবে সেই কাঠামো ভেঙেচুরে প্রত্যেকে, পাঠককে যে যতটুকু আনন্দ দিতে পারেন সেভাবেই নির্মান করেছেন তাদের নিজস্ব ধারা।

কঠোর পরিশ্রমী প্রতি লেখককেই নিজস্ব ধারা তৈরি করতে হবে; আগে যা কিছু লেখা হয়েছে তাকেই আরেকটু বাড়িয়ে চড়িয়ে লেখার দায়িত্ব নিয়ে সে আসেনি। আর সেভাবেই সচেতন একজন লেখক তার নিজস্ব ধারাটির ব্যাপারে ভাববে, সিদ্ধান্ত নেবে; কারণ সে জানে তাকে কী করতে হবে। তবে সে অতীতে যা কিছু পড়েছে বা চর্চা করেছে তার প্রভাব তার লেখার উপরে চলে আসতেই পারে, ধারা সৃষ্টির সময়ে আগের সেই লেখকদের অভিজ্ঞতার ছায়া তার লেখায় পড়তে পারে, সুনির্দিষ্টভাবে নিজস্ব ধারা নির্মিত না-ও হতে পারে।

মৃত্যুর পরেও ফিলিপ লারকিন (ইংরেজ কবি, ১৯২২-১৯৮৫)—এখনো তার নিজস্ব এবং খুবই চমৎকার ধারা নিয়ে বেঁচে আছেন, বিশেষ করে তার শেষের দিকের লেখাগুলোর কথা যদি ধরা যায়। তিনি মনে করতেন সাহিত্যের ধারা এবং উপজীব্য বিষয় বস্তুত অদৃশ্য। ফিলিপ বেশ ধীরে কাজ করতেন, বলেছিলেন, “তুমি যখন কিনা আবিষ্কার করছো কী বলতে চাও, কিভাবে বলতে চাও, তাহলে সেজন্যে সময় তো লাগবেই।” কথাটি শুনতে যতটা সরল, তার অন্তর্নিহিত অর্থটি ততটাই গভীর। সাহিত্য সংগীতের মতো বিষয় নয়, এতে শুধু তরুণেরা আগ্রহী হবে তাও নয়; সাহিত্যকে কোনো নির্দিষ্ট বেড়াজালে ফেলাই যায় না। একজন লেখক যে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা খুঁজে বেড়ান, ছড়িয়ে দিতে চান, সেটা সম্পূর্ণ সামাজিক এবং আবেগতাড়িত; এটা গুছিয়ে নিতে সময় লাগে, কিসের ভেতর দিয়ে তিনি যাচ্ছেন সেটা বুঝতে এবং পুরো প্রক্রিয়াটি সাজাতে তার জীবনের সিংহভাগ পেরিয়ে যেতে পারে। এই বিষয়টি কৌশলগত এবং নিবিড় তত্ত্বাবধান দাবি করে, কারণ এতকিছুর পরে পুরো অভিজ্ঞতাটি হারিয়ে গেলে চলবে না, ফলাফল যে আকৃতিতে আসার কথা ছিল, তা থেকে বেরিয়ে অন্য আকৃতি নিলে চলবে না। প্রতি লেখকের নিজস্ব রীতি বা ধারার পেছনে রয়েছে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার ছায়া।

সাহিত্যে কোন ধারাকে অনুসরণ করব, তাতে কী ধরণের শব্দের ব্যবহার করব, এসব নিয়ে আমি বরাবরই বেশ সতর্ক ছিলাম, কারণ কাজের শুরুতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যে সাহিত্য আমি এতদিন ধরে জেনেছি, পড়েছি আর যে সাহিত্য আমি সৃষ্টি করতে চাই, মনের ভেতরে লালন করি, এই দুইয়ের মধ্যে একটা তফাৎ আছে। আমার অতীতের ভালো লাগা আর যে বিন্দুতে আমি পৌঁছতে চাই তার মধ্যে আছে এক ধরনের অনৈক্য। এই সাধারণ ব্যাপারটা অনুধাবনের পরপরই আমার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেল যে প্রচলিত সাহিত্যের অন্ধ অনুকরণের কোনো মানে নেই। 

জেমস জয়েস (আইরিশ কবি এবং ঔপন্যাসিক, ১৮৮২-১৭৪১। - অনুবাদক) তার প্রথমদিককার একটি লেখায় নিজের অস্বস্তির কথা উল্লেখ করেছিলেন—অথবা বলতে চেয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্যে তার গুরুর কথা, “আজ আমি এবং আমরা যে ভাষায় কথা বলি, তিনিও সেই ভাষায়ই বলতেন। বাড়ি, ঈশ্বর, পানশালা, প্রভু, এই শব্দগুলো তার থেকে আমার ঠোঁটে কি খুবই অন্যভাবে উচ্চারিত হয়! আমি তার মতো করে কথা না বলে থাকতে পারি না, তার আত্মাকে না ছুঁয়ে আমি লিখতে পারি না...তার ভাষার কারুকাজের ওপরে আমার হৃদয় অস্থির ঘোরাফেরা করতে থাকে।”

জেমস জয়েস ছিলেন স্বকীয়ত্বের ব্যাপারে নিরিক্ষায় পটু—লেখার বস্তুগত বিষয় থেকে তার লেখনীর ধারা পৃথক দিশায় প্রবাহিত হতো। অবশ্য এখানে আমি জেমস জয়েসের ভাষা বা শব্দের ব্যবহার নিয়ে কথা বলছি না। ইংরেজি সাহিত্য পড়তে গিয়ে আমি ভাষাগত সমস্যা বোধ করিনি—ভাষা তো ভাষার মতোই। কিন্তু একটি বিষয়ে আমি বরাবর ভাবতাম, শব্দের ব্যবহারিক অর্থের ব্যাপারে, একই শব্দ স্থান ভেদে কতরকম অর্থ প্রকাশ করতে পারে। বাগান, বাড়ি, গাছপালা, মালি, জায়গা-জমি, এসব শব্দকে ইংল্যান্ডের একজন যেভাবে বোঝে, ত্রিনিদাদের একজনের কাছে সেগুলো কতই না আলাদাভাবে ধরা দেয়। ত্রিনিদাদের ব্যক্তির কাছে হয়তো এসবের মানে ক্ষেতখামার, কৃষিকাজের কারণে একসাথে বসবাসরত গুচ্ছ পরিবার। এখন প্রশ্ন হলো, আমার নিজের কাছে যে শব্দ যে অর্থ প্রকাশ করে তা দিয়ে তবে কী করে আমি সঠিকভাবে, সততার সাথে যা লিখতে চাই তার সবটা ব্যক্ত করতে পারব? সবখানের সব পাঠক কি আমার সেই লেখা তাদের অতীতের পঠিত সাহিত্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একইভাবে গ্রহণ করতে পারবে? আমার মনে হতো জীবনে আমি যা দেখেছি তাকেই উপস্থাপন করতে হবে, আর এভাবেই নিজেকে লেখক বা উপস্থাপক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব; আমাকে সবকিছু সবিস্তারে বর্ণনা করে যেতে হবে। আমার লেখক হওয়ার পথে এই কাজটিই আমি বিভিন্নভাবে করতে চেষ্টা করেছি। প্রাথমিকভাবে, বছরদুয়েক পরিশ্রমের পরে আমি একটি লেখা শেষ করেছিলাম, যা শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয়েছিল, যা বলতে চাই, যেভাবে বলতে চাই তা যেন বলে উঠতে পেরেছি।

আমার লক্ষ্য ছিল সত্যের অনুসন্ধান, নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার আলোকে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা, লেখকের প্রতিচ্ছবির ভেতর দিয়ে সত্যের উৎস খোঁজা। কিন্তু সেই লেখাটি যখন শেষ করেছিলাম, তারপরেও দেখলাম লেখা তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি বরাবরের মতোই আমার কাছে রহস্যময় রয়ে গেল।

ফরাসি সমালোচক সান্তে ব্যুভে ভাবতেন একজন লেখকের ব্যাক্তিগত জীবন আলোচনা করলে তার লেখার ধারার কারণ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। সান্তে ব্যুভের ধারণার আক্রমণাত্মক বিরোধিতা করে অদ্ভুত এক বই প্রকাশ করেছিলেন প্রুস্ত (ফরাসি ঔপন্যাসিক মার্সেল প্রুস্ত। - অনুবাদক)। বইটি ছিল একেবারে ব্যতিক্রমী এক সৃষ্টি, একেবারে নতুন ধরণের এবং চমকপ্রদ, কিছুটা আত্মজীবনী, কিছুটা সাহিত্য সমালোচনা আর কিছুটা আবার কল্পকাহিনী, বইটির নাম ছিল সান্তে ব্যুভের বিরুদ্ধে। সেই বইয়ে সমালোচনা করা হয়েছিল বস্তত একজন সমালোচকের, একই সাথে তুলে ধরা হয়েছিল লেখার প্রতি একজন লেখকের টান, বর্ণিত হয়েছিল লেখকের নিজস্বতা এবং তার সৃষ্টির কৃত্রিমতার স্বরূপ।

“এই ধ্যান ধারণা”—প্রুস্ত বলেন (সিলভিয়া টনসেন্ড ওয়ার্নারের অনুবাদে)—আর তিনি বলছিলেন সান্তে ব্যুভের ধ্যান ধারণা সম্পর্কে—“শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে আমরা জীবনে যা অর্জন করি সেসব যেন তার মধ্যে নেই, জানেনও না যে একটি লেখা একজন মানুষ লেখে তার নিজের চরিত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে, আপন চরিত্র হলো যেখানে আমরা আমাদের নিজস্ব অভ্যাস, নিজস্ব দোষগুণের চর্চা করি।” আর তার কয়েক পাতা পরে সেখানেই প্রুস্ত আরো যোগ করেছেন: “লেখকের লেখনীর উপলক্ষ যাচাই করলে বোঝা যায় যে তার সৃষ্টিতে রয়েছে ভাসা-ভাসা ব্যাপারস্যাপার বা শূন্যতার চেয়েও বেশি কিছু, অথচ তার ব্যক্তিগত জীবনে নিশ্চয়ই রয়ে গেছে আরো গভীর বা জটিলতর কোনো ঘটনা, একজনের একান্ত জীবনের যাবতীয় অর্জন থেকে নিংড়ানো নির্যাসটুকু সে তার লেখায় ঢালতে পারে, একাকিত্বে লেখক সেই লেখাটি সাজিয়ে নেয় কেবল নিজের জন্য, পরবর্তী কালে তা জনসমক্ষে প্রকাশ পায়। নিজের জীবনে মানুষ যা কিছু চর্চা করে—যেমন অন্যের সাথে কথোপকথনের সময়ে, যতই পরিশুদ্ধ করে বলুক না কেন.. —তা নিজের অবচেতন মনের অগভীর কথাবার্তাই মাত্র, সেসব কথা কিছুতেই ব্যক্তির ভেতরকার সেই লালিত অনুভূতি নয় যা কিনা পৃথিবীর আর সব কিছুকে একদিকে সরিয়ে রেখে লিখে ফেলা যায়, যা কিনা লেখা যায় আপন মনে পৃথিবীর এমাথা-ওমাথা পরিভ্রমণ করতে করতে।”

এটা অবশ্য কৌতুহল উদ্দীপক—তবে কিছুতেই বিস্ময়কর নয় যে, লেখকের লেখক সত্তা নিয়ে প্রায় একই ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন আরেক বিখ্যাত লেখক, সমরসেট মম। তার বিখ্যাত কল্পকাহিনী কেকস আর অ্যালি-তে অতুলনীয় টমাস হার্ডি চরিত্র সৃষ্টি করতে গিয়ে, একটার পর একটা আকস্মিক ঘটনার অবতারণা করে (যার জন্য অবশ্য তিনি বেশ সমালোচনার মুখেও পড়েছিলেন) দেখিয়েছেন যে ওয়েসেক্সের বিয়োগান্তক কাহিনী রচয়িতা একজন ঔপন্যাসিকের নিজস্ব জীবন কত অদ্ভুতভাবে সাধারণ হতে পারে, আর এজন্যেই লেখালেখির বিষয়টা রহস্যময়। “আমার এমনটাই মনে হয়”—মম পরিশেষে বলেন—“একজন লেখকের ভেতরের মানুষটা, যে তার মৃত্যু পর্যন্ত থাকে অচেনা এবং একাকি, কিন্তু সেই ভেতরের মানুষটা, যে সবার অজান্তে জীবন যাপন করেছিল, তার ছায়ামূর্তি অথবা আত্মা, স্বরচিত সমস্ত বইগুলো এবং তার নিজস্ব জীবনের মাঝখানে কোথাও অদৃশ্য হয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকে, আর দুটো পুতুল সত্তার বিয়োগান্তক পরিণতি দেখে শ্লেষের হাসি হাসে...”

(২৩ এপ্রিল, ১৯৮৭, নিউ ইয়র্ক বুক রিভিউ)

ভি এস নাইপল
১৯৩২ সালের ১৭ অগাস্ট বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপল জন্মেছিলেন ত্রিনিদাদে। নোবেল বিজয়ী এই লেখক একাধারে ত্রিনিদাদ এবং ইংল্যান্ডের নাগরিক। তিনি ইংরেজি ভাষায় উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর ব্যাপী লেখালেখি করেছেন এবং ফিকশন, নন-ফিকশন মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা তিরিশের বেশি। তার বিখ্যাত রচনার মধ্যে রয়েছে, এ হাউজ অফ মিস্টার বিশ্বাস, ইন এ ফ্রি স্টেট, এ বেন্ড ইন দ্য রিভার, দ্য এনিগমা অফ অ্যারাইভাল, এ ওয়ে ইন দ্য ওয়ার্ল্ড, আরলি ত্রিনিদাদ নভেলস।

তিনি ১৯৭১ সালে বুকার এবং ২০০১ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। নোবেল কমিটি পুরস্কারের আয়োজনে উল্লেখ করে, ‘তার লেখা ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে নতুন আঙ্গিকে আমাদের সামনের তুলে ধরার প্রয়াস পায়।’ সেখানে আরো বলা হয়, ‘আধুনিক মানসিতাই তার লেখায় ঐতিহ্যের মোড়কে ঢাকা।’    

উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং ভ্রমণ কাহিনী, প্রত্যেকটিই তার কলমে হয়ে উঠেছে অসামান্য। তবে ১৫৬৬ থেকে ১৫৬৮ সালের মধ্যে রচিত তার রম্য উপন্যাস আরলি ত্রিনিদাদ তাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়।

ইন্ডিয়া থেকে অভিবাসী হয়ে তাঁর পরিবার ত্রিনিদাদে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল। তাঁর বাবা ছিলেন ত্রিনিদাদ গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক। তারা ভারতীয় ব্রাহ্মণ পরিবার হলেও ধীরে ধীরে বাড়িতে ধর্মীয় নীতি আর কঠোর নিয়মকানুনের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। বাড়িতেও তারা ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতেন।

ভি এস নাইপল তার কল্পকাহিনী এবং ভ্রমণ কাহিনীতে তৃতীয় বিশ্বকে কর্কশ এবং আবেগবিহীনভাবে তুলে ধরেছেন বলে সমালোচিত হয়েছিলেন।

২০১৮ সালের ১২ অগাস্ট, লন্ডনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;