সানফ্রানসিসকো এয়ারপোর্টের সুশি বার



মঈনুস সুলতান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইস্পাতের চকচকে ট্রলিতে ক্যারিঅন লাগেজের ভারী ব্যাকপ্যাক ও ব্রিফকেস চাপিয়ে উঠে আসি সানফ্রানসিসকো শহরের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ডিপারচার লাউঞ্জে। একটু আগে ওয়াশিংটন ডিসি’র ড্যালাস থেকে এখানে উড়ে এসেছি। লাউঞ্জে সিংগাপুর এয়ার লাইন্সের কাউন্টার বন্ধ, খুলবে তা রাত ন’টার পর। আমার ফ্লাইট বারোটা পাঁচ মিনিটে। সানফ্রানসিসকো এয়ারপোর্টের ট্রানজিটে ঘণ্টা পাঁচেক কাটানোর কথা ভেবে হাই তুলতে তুলতে প্রসারিত ছাদের দিকে তাকাই। কাচের স্বচ্ছ কাঠামো ভেদ করে রুপালি ইস্পাতে তৈরি বিশাল এক মাছের প্রতীক সূর্যের অস্তরাগে ঝলসাচ্ছে রঙধনুর আভায়। অনেকক্ষণ একাকী বসে থাকা—তারপর এক নাগাড়ে ঘণ্টা ষোলো সিংগাপুর অব্দি উড়ে যাওয়ার কথা ভেবে আমার ভেতরে উৎসাহের আলো মরে যেতে থাকে সূর্যাস্তের ম্রিয়মাণ আভায়।

আজ খুব ভোরে মেক্সিকো সিটি থেকে বিমানে চেপেছি। ড্যালাসের ট্রানজিটেও খামোকা বসেছিলাম ঘণ্টাকয়েক। আমেরিকান এয়ার লাইন্সগুলো হালফিল আর যাত্রীদের খাবার দাবার কিছু সরবরাহ করে না। ড্যালাসেও মাইক্রোওয়েভ অভেনে গরম করা পিৎসা ভিন্ন বিশেষ কিছু জোটেনি। খানিক স্ন্যাক্সের সাথে একটু কফি পেলে ভালো হয়। একটি রেস্তোরাঁর তল্লাশে ট্রলি চালাতে গিয়ে দেখি, কাচের বিশাল সব কাসকেটে ডিসপ্লে করা হচ্ছে তালেভেরা নামক মেক্সিকোর সিরামিকে তৈরি তৈজসপত্র। এসব বাসন কোসন, ফুলদানী আর সোপ-ডিশ প্রভৃতি তৈরি হয় মেক্সিকোর পুয়েব্লা শহরে। ওখানে আমি বার দুয়েক গিয়েছিও। স্থানীয় আর্টিসানরা এসব পণ্য ফুটপাতে সাজিয়ে বসে থাকে পর্যটকদের অপেক্ষায়। একটু অবাক লাগে পুয়েব্লাতে যা ফুটপাতের পণ্য—সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে তা পরিণত হয়েছে প্রদর্শনযোগ্য শিল্প সামগ্রীতে। আমি মেক্সিকো একেবারে ছেড়ে এসেছি, আর হয়তো কখনো পুয়েব্লাতে যাওয়া হবে না ভেবে শূন্য লাগে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/10/1533890364000.jpg
তালেভেরা সিরামিকের ডিসপ্লে

তালেভেরার বাসন কোসনের প্রদর্শনী পেরিয়ে আসতেই ফুডকোর্ট। স্টেইক্ হাউস, চীনা খাবার, হ্যামবার্গার ও ফ্রেঞ্চ-ফ্রাইয়ের ছবি সাঁটা পানশালা পেরিয়ে আসতেই চোখে পড়ে, জাপানি কেতার একটি সুশি বার। কালচে ধূসর পাথরে তৈরি তার নির্জন কাউন্টার। ছাদ থেকে ঝুলছে রুপালিতে কমলালেবু রঙের ছোপ দেওয়া দুটি তাজা মাছ। এদিকে কেউ নেই, তবে অন্যদিকের আরেকটি কাউন্টারে রাখা সতেজ ফুলের ইকেবানায় সাজানো উজ্জ্বল পরিবেশ। এদিকে খদ্দেরদের বেশ ভিড়। সবগুলো টেবিলেই খাবার নিয়ে বসে আছে কেউ না কেউ। ইকেবানার ওপাশে কিমানো পরা একটি মেয়ে সিরামিকের ছোট্ট ছোট্ট ডিশে সয়ি সচ্ ঢেলে তাদের পাশে পাশে রাখছে বাঁশপাতার ছবি আঁকা চপস্টিক। আমি দাঁড়াতেই সে যেন দেবতাকে পূজার নৈবেদ্য দিচ্ছে, এরকম নিবেদিত ভঙ্গিতে আমার হাতে তুলে দেয় খাবারের মেনু। আমি কিছুক্ষণ তা খুঁটিয়ে দেখে, তাজা টুনা মাছ কিংবা কাঁচা স্যামন মাছের বিষয়টি এভয়েড করে অর্ডার দিই নিগিরি জুশি বলে এক ধরনের ভাঁপে রান্না করা সুশি।

বসার জন্য টেবিল খুঁজে পেতে একটু সমস্যা হয়। চোখ মিরমির করা মলিন চেহারার এক আধবুড়ো আমেরিকান সাহেব বসে আছেন বড়সড় এক গোলটেবিল ঘিরে—ঘোড়ার নালের মতো দেখতে চামড়ায় মোড়া বেঞ্চে। তার পাশে বসে বছর তিন চারেকের একটি জাপানি শিশু স্যুপ-বউল থেকে চপস্টিকে খুঁটে খাচ্ছে স্প্রাউট বা শিম-বিচির তাজা আংকুর। সাহেব হাতের ইশারায় আমাকে তাদের টেবিলে বসতে বলেন। ছোট মেয়েটি নড়েচড়ে ফিক করে হেসে আমার দিকে ড্রাগনের পাপেট ঠেলে দিলে ন্যাপকিনে ছলকে পড়ে কিছু স্যুপ। মেয়েটিকে জাপানি স্যুপ কিনে দিয়ে পাশে বসে সাহেব কেন জানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে হ্যামবার্গারে কামড় দেন। চেহারা সুরত দেখে মনে হয় ভদ্রলোক আর্থিকভাবে দরিদ্র। হয়তো কোনো রোগশোকেও ভুগছেন। তার ফ্যাকাশে চোখেমুখে ছাইবর্ণের অস্বাস্থ্যকর আভা। আর মিরমিরে চোখের পাতার উপর বেশ কটি হলুদাভ ছোট ছোট গোটা। তিনি স্ফোটকগুলো কাঁপিয়ে আমার দিকে চেয়ে বেজায় ম্লান হয়ে হাসেন। জাপানি বাচ্চাটিকে তবে কি তিনি দত্তক নিয়েছেন—এ কথা ভাবতে ভাবতে আমি ড্রাগনের পাপেটে হাত দিতেই, মেয়েটি তা ঝপ করে সরিয়ে নিয়ে তাকে কানে কানে, ‘লিসেন ড্যাডি, আই অ্যাম ফুল। ইউ ইট দ্যা স্যুপ’, বলে খাবলা দিয়ে তুলে নেয় তার পাত থেকে কয়েকটি ফ্রেঞ্চ-ফ্রাই।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/10/1533890653954.jpg
সুশি বারের নির্জন কাউন্টার

সুশি বারটি তাজা মাছের টুকরা, সামুদ্রিক গুল্ম ও ফুলপাতা, পাথর ছড়ানো ইকেবানা এবং সিরামিকের তৈজসপত্রে এমনভাবে সাজানো যে, তাকে দেবতাকে উপাচার দেওয়া পূজাপাঠের বেদির মতো তকতকে পবিত্র মনে হয়। একদিকে সিরামিকের বিশাল খুঞ্চাতে সিফুডের উপাচার সাজাতে সাজাতে কিমানো পরা তরুণীটি আড়চোখে আমাকে দেখে। জাপানি বাচ্চা মেয়েটি কী কারণে খিলখিল করে হেসে টেবিল নাড়িয়ে আবার কিছু স্যুপ ছলকে দিয়ে ছুটে যায় সুশি বারের দিকে। চোখ মিরমিরিয়ে সাহেব উঠে তার পেছন পেছন ছোটেন। কাউন্টারের কাছে পিলার ঘিরে খানিক লুকোচুরি খেলতে খেলতে বাচ্চাটি ট্রে হাতে কিমানো পরা ওয়েট্রস মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে ছুটে যায় লাউঞ্জের অন্যদিকে।

টেবিলের উপর আমার জন্য আনা নিগিরি জুশি নামের ওসাবি সচের সাথে আঁটালো ভাতের ভেতর শশার টুকরা ও খোসা ছড়ানো চিংড়ি মাছ দেওয়া সুশির চিত্রিত ট্রে রাখতে রাখতে মেয়েটি যেন স্বপ্নের ঘোরে আমার দিকে তাকায়। আমি ধন্যবাদ দিতে গেলে সে আমার হাতে ধরিয়ে দেয় ‘সুশি এটিকেট’ লেখা একখানা কাগজ। কাগজখানা পড়ে কিভাবে সুশি খেতে হয় সে বিষয়ে বেশ খানিকটা অবগত হই। চপস্টিক দিয়ে এক খণ্ড সুশি তুলে নিয়ে সয়ি সচে ডিপ্ দিয়ে তা চিবিয়ে মুখে পুরি জিনজারের পাতলা পরত।

কাঁপতে কাঁপতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ফিরে আসেন মলিন চেহারার সাহেব। না, তিনি বাচ্চা মেয়েটিকে ক্যাচ্ করতে পারেন নি। তা, সে গেল কোথায়? তার সন্ধানে আমিও এদিক ওদিক তাকাই। ক্লান্ত সাহেব স্ট্রো দিয়ে একটু কোক্ খেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘বাচ্চা-কাচ্চা লালন পালন করতে হয় কম বয়সে। আই অ্যাম এপ্রোচিং সিক্সটি সেভেন। এই বয়সে আর ছোটাছুটি ভালো লাগে না।’ আমি তাকে ‘ডোন্ট ওয়ারি’, বলে আশ্বস্ত করে বাচ্চাটির খোঁজে এবার উঠে পড়ি। তাকে পাওয়া যায় তালেবেরা সিরামিকের বাসন কোসনের ডিসপ্লে কাউন্টারের পেছনে। কিন্তু সে আমার সাথে আসবে না। আমি ফিরে এসে সাহেবকে তার সুলুক সন্ধান দিলে—তিনি উঠতে উঠতে যেন জনান্তিকে বলেন, ‘হোয়েন আই ওয়াজ ইয়াং, আমার যা চেহারা-সুরত তাতে বাচ্চা দূরে থাক ফিমেল পার্টনারই জুটাতে পারলাম না.. ..আর এ বয়সে এডাপ্ট করেও হয়েছে মুশকিল, আই ডোন্ট নো হাউ টু রেইজ দিস হাইপার এক্টিভ গার্ল।’

জাপানি বাচ্চাটির সন্ধানে গিয়ে সাহেব আর ফিরে আসেন না। ওয়েট্রেস তরুণীটি এসে টেবিল পরিস্কার করে। তার কব্জিতে জড়ানো জপমালা। আমি মনে মনে অপেক্ষা করি, কিন্তু সে এবার ফিরেও তাকায় না। তার গলায় ঝুলছে সামুদ্রিক কোনো মাছের দাঁতে তৈরি লকেট। ন্যাপকিন দিয়ে টেবিল মুছতে গেলে আমি তাতে এনগ্রেইব করে আঁকা পদ্মাসনরত বুদ্ধের মুখ দেখতে পাই। তার ঠোঁট নড়ে—মনে হয় সে বুঝি জপছে ত্রিপিটকের কোনো সূত্র।

আমাকে আরো অনেক সময় কাটাতে হবে। কিন্তু সুশি বার ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা হয় না। সে বছর খানেক আগে—প্রথম যে বার মেক্সিকোর পুয়েব্লা শহরে যাই, সে কথা মনে পড়ে। ফুটপাতে আর্টিসানরা তালেভেরার বর্ণাঢ্য সব সিরামিকের বাসন কোসন নিয়ে বসেছেন। এক আর্টিসানের কাছ থেকে শুনি যে—তাদের পূর্বপুরুষ ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেনের তালেভেরা বলে এক স্থান থেকে এসে এ শহরে বসতি শুরু করেন। সে থেকে তারা মাটি পুড়িয়ে সিরামিকের শিল্পদ্রব্য তৈরি করছেন। কথা বলতে বলতে পিঞ্জিরা থেকে বেরিয়ে একটি পাখি উড়ে এসে আমার বাহুতে বসেছিল। তাতে ফুটপাতের আর্টিসানরা সকলে হেসে উঠেছিল জোরেসোরে। তখনও স্প্যানিশ ভাষা আমার সড়গড় হয়ে আসেনি। ঠিক বুঝতে পারিনি—খেচরের এ আচরণের কোনো প্রতীকী তাৎপর্য আছে কি না। তালেভেরার একটি চিত্রিত ওয়াল প্লেট কিনেছিলাম। কাকে দেবো, কার কথা ভেবে কিনেছিলাম, এখন আর ঠিক মনেও পড়ে না।

সুশি এটিকেট লেখা কাগজটি এবার মনোযোগ দিয়ে পড়ি। জাপানি কিছু প্রতিশব্দের ধ্বনি আমার ভালো লাগে। জাপানে যাওয়ার আমার কোনো পরিকল্পনা নেই। দেশটি অত্যন্ত এক্সপেনসিভ, ওখানে পর্যটন আমার সাধ্যেও কুলাবে বলে মনে হয় না। তারপরও কিছু শব্দ যেমন জাপানি ভাষায় জিনজারকে বলা হয় ‘গারি’, চিংড়ি মাছকে ‘এবি’, আর ভাতকে বলা হয় ‘গহান’ ইত্যাদি নোটবুকে টুকে রাখি। কিমানো পরা ওয়েট্রেস কী কারণে যেন কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে ছাদের দিকে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে জপমালা টিপে। আমি তার কাছে গিয়ে ‘আগারি’ বা এক পেয়ালা গ্রিনটি চাইলে—আমি যে সবুজ চায়ের জাপানি প্রতিশব্দ ব্যবহার করছি, তাতে সে অবাক হয় না এক বিন্দু। আমার দিকে—যেন মন্দিরে পূরাকালের কষ্টিপাথরে তৈনি কোনো মূর্তি দেখছে—এমন এক নির্মোহ দৃষ্টিতে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে চলে যায় চা করতে।

পোড়ামাটির টি-পট থেকে আমি নিসর্গ আঁকা বাটিতে সবুজ চা ঢালি। প্রজাপতির মতো শেইপ দেওয়া মস্ত একটি উড্ডীন বেলুনের পেছন পেছন জোরেশোরে কথাবার্তায় হাসিঠাট্টায় হই হই করে স্টেইক্ হাউসের দিক থেকে সুশি বারে এসে উপস্থিত হয় আস্ত একটি পারিবার। তাদের সামনে গাব্দাগোব্দা গোছের একটি কিশোরী সুতোয় টেনে টেনে প্রজাপতিকে নিয়ে যাচ্ছে এদিক ওদিক। আর হুইলচেয়ারে বসা—বোধ করি তার বোন, বয়সে এক বছরের ছোট কিংবা বড় হবে; খুব মায়া মাখানো মুখের এ মেয়েটি হুইলচেয়ার চালিয়ে এঁকেবেঁকে স্পর্শ করতে চাচ্ছে বাটারফ্লাই শেপের বেলুনটি। হুইলচেয়ার মৃদু ধাক্কায় গার্বেজের ট্র্যাশবিন একদিকে হেলিয়ে দিলে সারা পরিবার হেসে ওঠে রইরই করে। তার পিতা—থুতনিতে সজারুর কাঁটার মতো কিছু দড়ো দাড়ি, কুংফু পালোয়ানের বিক্রমে ট্র্যাশবিনের ঘেঁটি ধরে তা বসিয়ে দেন ঠিক জায়গায়। গাব্দাগোব্দা কিশোরীটি খুবই দুষ্টু, সে বড়শি লাগা মাছকে খেলানোর মতো করে প্রজাপতিকে টেনে খেলাচ্ছে। হুইলচেয়ারে বসা মেয়েটিও ছাড়বে না। যান্ত্রিক চেয়ারটি এঁকেবেঁকে গেলে, তার পরনের উজ্জ্বল বর্ণের স্কার্টে তার শরীরের রেখা ব্লার হয়ে আমার চোখে যেন ভিজ্যুয়েল ইল্যুশন সৃষ্টি করে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/10/1533890792320.JPG
সিরামিকের ডিশে সি-ফুড

নরোম সরোম চেহারার মা এ পরিবারের আরো দুটি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে পাশের টেবিলে বসে তাদের চুল আঁচড়িয়ে ক্লিপ ও রিবন পরিয়ে দিচ্ছেন। তুলনামূলকভাবে শান্ত স্বভাবের মেয়ে দুটিকে চেহারাসুরতে যমজ মনে হয়। বাবা সুশি বার থেকে গ্রিলড্ ফিস্, সুশি, মিসো স্যুপ, সিউইড ও সেসমি সিড দেওয়া ভাত ইত্যাদি মিলিয়ে প্রচুর পরিমাণে খাবার নিয়ে টেবিলে আসেন। এদের চেহারা স্পষ্টত মঙ্গোলিয়ান। কিন্তু পিতামাতার কালো গাত্রবর্ণের জন্য ঠিক জাপানি বলেও মনে হয় না। তারা খেতে খেতে যে ভাষায় কথা বলছে, তার এক বর্ণও আমি বুঝতে পারি না; তাই ভাবি—তবে কি এ পরিবার কোরিয়ান? খেতে খেতে থেকে থেকে তারা কী কারণে যেন হেসে হইচই করে ওঠে।

আমি সবুজ চায়ে চুমুক দিতে দিতে তাদের অবজার্ভ করি। বাবা-মা ও বড় মেয়েটির গাত্র বর্ণ কালো হলেও যমজ দুটি ও হুইলচেয়ারে বসা মেয়েটির শরীর থেকে যেন গোলাপি বর্ণের দ্যুতি ছড়ায়। তবে কি এদের এ পরিবারে দত্তক নেওয়া হয়েছে?  হুইলচেয়ারটি খুবই দামী ও ভারী। সুতরাং আন্দাজ করি—বালিকাটির শরীরিক অক্ষমতা পার্মানেন্ট। সে এখন টেবিলে ম্যাগনেটিক দাবার সেট পেতে তার কিশোরী বোনের সাথে খেলতে খেলতে চপস্টিকে তুলে সুশি খাচ্ছে। যমজ দুটি খাবার দাবারে মোটেই নজর দিচ্ছে না। তারা পরস্পরের হাতে হাতে তালি বাজিয়ে বোধ করি ছড়া কাটছে। আর বাতাসে আওয়ারা ভেসে ভেসে বেলুনের প্রজাপতিটি দেখছে গোলাপি-কালো বর্ণের পরিবারের আনন্দ উচ্ছল পারস্পরিক ইন্টারেকশন।

দাবার গুটি চালতে গিয়ে হুইলচেয়ারে বসা মেয়েটি বোধ করি তার বোনকে মাত করে দিয়ে খিলখিল করে আমার দিকে মুখ ফেরালে, আমি দেখি তার মুখখানা বেজায় বাঁকানো। তবে কি তার স্ট্রোক হয়ে লুপ্ত হয়েছে শরীরের চলৎশক্তি? তার বোন তার দিকে কপট ক্রোধে তেড়ে আসলে, সে তড়িৎ গতিতে হুইল চেয়ার চালিয়ে পিছিয়ে যায়। তখন আমি বুঝতে পারি, তার সমস্ত শরীর আধখানা হয়ে বেঁকে আছে। হাসতে হাসতে হুইলচেয়ারের আরেকটি ধাক্কায় সে ফিরে যায় দাবার বোর্ডে। তাতে তার শরীরের রেখা আবারও আমার চোখে ব্লার হয়ে আসে। চকিতে পিকাসোর আঁকা কিউবিস্ট ছাদের একটি পোর্ট্রেটের কথা মনে পড়ে—যেখানে মুখচ্ছবি বাঁকা হয়ে ভেঙে যেন হয়ে গেছে দুটি মুখচ্ছবি।

আমি আরো কয়েকটি জাপানি প্রতিশব্দ নোটবুকে টুকি। কিমানো পরা ওয়েট্রেসটি গেল কোথায়? কিছুক্ষণের জন্য সুশি বারের কাউন্টারে কাউকে দেখা যায় না। একটু পর হামানদিস্তায় কিছু কুটতে কুটতে কাউন্টারে এসে দাঁড়ায় আরেকটি মেয়ে। তার কানে গাঁথা আইপডের মাইক্রোফোন জাতীয় সাদা বোতাম। সে কিছু শুনতে শুনতে একা একা হাসে। তার টপের বৃত্তাকার স্ফীতিতে আঁকা নিসর্গের খণ্ড চিত্রটি অবিকল সবুজ চায়ের বাটির ছবির মতো। সে মৃদু হাসতে হাসতে রাইসক্রেকার চিবায়। ঘটাৎকচের মতো স্থূলকায় মাথা মুড়ানো এপ্রোন পরা শেফ এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে দু’হাত নাড়িয়ে খুব এনিমেটেড্ হয়ে কিছু বলে। আমি দূর থেকে তার বচন কিছু শুনি না। কিন্তু তার হাতের নড়াচড়ায় মনে হয় সে সমুদ্রে হারপুন দিয়ে তিমি মাছ শিকারের দৃশ্য আঁকছে। মেয়েটি কান থেকে আইপডের মাইক্রোফোন খুলে নিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলে, শেফ এপ্রোনে হাত মুছে তার খোঁপা থেকে খুলে নেয় একটি চপস্টিক। তাতে ঘাড় অব্দি নেমে আসে কালোচুলের রাশ।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/10/1533890875108.JPG
ডিশে সাজানো সুশি

ডার্কস্যুটে আস্তিনে রুপালি কাফলিং পরা ধুপদুরূস্থ এক জাপানি জেন্টোলম্যান এসে কাউন্টারের কাছে দাঁড়ান। তার পেছনে ওয়াকারে ভর দিয়ে থুরথুরিয়ে কাঁপছেন খুব বৃদ্ধ এক মহিলা। তারা একটু পর সুশি ও স্যুপের ট্রে নিয়ে বসার জন্য চারদিকে তাকিয়ে টেবিল খোঁজেন। আমার টেবিলে বিস্তর খালি জায়গা। তাই আমি তাদের এখানে এসে বসতে আহ্বান জানাই।

বৃদ্ধার দাঁত বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। স্যুপের দিকে তাকিয়ে তার হাত ও মুখের পেশী কেবলই কাঁপে। সঙ্গী তার ছেলে মহিলার গলায় বিভ জাতীয় বড়সড় রুমাল বেঁধে দিয়ে মাকে চামচ দিয়ে স্যুপ খাওয়ান। তাদের সাথে টুকটাক কথাবার্তাও হয়। জাপানি কোনো কর্পোরেটের কর্তা ছেলে মাকে নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে এসেছিলেন চেরী ফুলের শোভা দেখাতে। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের পর জাপানের সম্রাট যুক্তরাষ্ট্রে উপহার হিসাবে পাঠান অনেকগুলো চেরী ফুলের চারা। চারাগুলো লাগানো হয় ওয়াশিংটন ডিসির একটি সরোবরের চারপাশে। বৃদ্ধার বাবা জাপ সম্রাটের নার্সারিতে চারাগুলোর যত্ন নিতেন। তিনি স্বয়ং ওয়াশিংটনে এসেছিলেন গাছগুলো লাগিয়ে দেয়ার জন্য। সে ছোটবেলা থেকে মহিলার ইচ্ছা একবার ওয়াশিংটন আসেন, তার বাবার লাগানো চেরী ফুলের গোলাপি সজ্জা দেখতে। কিন্তু জীবন যাপনের নানা ধান্দায় সে অবকাশ আর হয়ে ওঠেনি এতদিন। এখন তো বৃদ্ধা জীবনের প্রান্তিকে এসে পৌঁছেছেন, তাই ছেলে মাকে নিয়ে এসেছিলেন ওয়াশিংটন ডিসিতে চেরী ফুলে ঘেরা সরোবর দেখাতে।

মাইক্রোফোনে একটি ঘোষণা শুনে আমি চমকে উঠি। ভালো করে দ্বিতীয়বার আমার নাম শুনে আমি জাপ মা-পুত্রের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে পড়ি। মাইক্রোফোনে এবার স্প্যানিশ ভাষায় বলা হচ্ছে—আমার জন্য একটি জরুরি ম্যাসেজ অপেক্ষা করছে সিংগাপুর এয়ালাইন্সের কাউন্টারে। একটু নার্ভসনেসের সাথে আমি ওই দিকে দ্রুত হাঁটি।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;