ব্রাসেলসের মরোক্কান পল্লী



মঈনুস সুলতান

  • Font increase
  • Font Decrease

ব্রাসেলসের টাউন হলের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে গ্র্যান্ড প্লেসের ফ্লোরাল কার্পেট ঘিরে ঘুরপাক করনেওয়ালা পর্যটকদের উল্লাস দেখতে বেশ ভালোই লাগে। টাউন হলে আমি এসেছি আমার জানপহচান সুহৃদ লুকাস ও তার গার্লফ্রেন্ড এঞ্জেলিকের সাথে। আজ ভোরবিহানে ব্রাসেলসে আমি বেড়াতে এসেছি ইবোলা উপদ্রুত সিয়েরা লেওন থেকে। মাস সাতেক আগে লুকাস ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসাবে সিয়েরা লেওনে আসে জনমানুষের জিন্দেগিতে ইবোলার কারণে সৃষ্ট দুঃখকষ্টের খতিয়ান সংগ্রহ করতে। তখন আমার সাথে তার দোস্তির সূত্রপাত। তার মারফতে এঞ্জেলিকের সাথে আমার বার কয়েক স্কাইপে কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু মেয়েটির সাথে সাক্ষাত দেখা হলো কেবলমাত্র আজ। আমি প্যারিস যাওয়ার পথে একরাত্রির জন্য ব্রাসেলসে থেমেছি। এঞ্জেলিক আমাকে তার এপার্টমেন্টে সোফাবেডে শুয়ে রাত কাটানোর আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

একটু আগে আমরা টাউন হলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছি দিন শেষ হয়ে আসলেও গ্র্যান্ড প্লেসের সর্বত্র মোলায়েম আলো খেলছে। এখানকার চত্তর জুড়ে হাজারবিজার তরতাঁজা ফুল দিয়ে একটু আগে তৈরি হয়েছে একটি ফ্লোরাল কার্পেট। তাতে ভলানটিয়ার হিসাবে কাজ করেছে এঞ্জেলিক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে লুকাসের সাথে তার সম্পর্কে ধরেছে বেহদ চিড়। সিয়েরা লেওন থেকে ফিরে এসে লুকাস হিন্দুস্থানী এক গুরুদেবের কাছে সেলিবাসি বা সেক্স পরিহারের দীক্ষা নিয়েছে। সে হামেশা সকাল-সন্ধ্যা হরেক কিসিমের মেডিটেশন করে বেড়াচ্ছে। বিষয়টা এঞ্জেলিক একসেপ্ট করছে না। তাতে আমাদের সমবেথ মিথস্ক্রিয়ায় ছড়াচ্ছে টেনশন। লুকাসের আচরণে আমিও তাজ্জব হচ্ছি। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতার উপার্জনে তার চলছে না। সুতরাং সে নাইটগার্ডের পার্টটাইম চাকরি নিয়েছে। এবং তাতে হাজিরা দেওয়ার আগে সে শহরের সেমিটারি বা গোরস্থানে বসে শবাসন করে সময় কাটাচ্ছে। সঙ্গত কারণে তার তাবৎ বিষয়াদি আমার কাছে আজব ঠেকছে।

/uploads/files/6tDrJKzPIvCCvvdwz0MhrWk5P48RWfCYlZ0b7iRT.jpegমলেনবেকের সড়কে হেজাব পরা নারী 

টানা চারঘণ্টা খুব কনসেনট্রেটেড্‌ভাবে ফ্লোরাল কার্পেট তৈরিতে মেহনত করে এঞ্জেলিক ক্লান্ত। তার খিদে পেয়েছে। সে ডিনার না করে এপার্টমেন্টে ফিরতে চায় না। যেহেতু তার ডেরাতে রাত কাটাতে যাচ্ছি তাই সৌজন্যবশত আমি লুকাস ও তাকে ডিনারে নিয়ে যেতে চাই। মরোক্কান রেস্টুরেন্টের প্রস্তাব করলে এঞ্জেলিক প্রাচ্যদেশীয় খাবারের মশলাদার খোশবুর কথা ভেবে এক্সাইটেড হয়। গ্র্যান্ড প্লেসের মিনিট তিরিশেকের হাঁটা দূরত্বে আছে ব্রাসেলসের মরোক্কান পল্লী মলেনবেক। ওদিকে যাওয়ার ডিরেকশন মৌখিকভাবে দিয়ে লুকাস কেটে পড়তে চাইলে—এঞ্জেলিক অনুনাসিক স্বরে আবদার করে, ‘কাম-অন ম্যান, বেচারা সুলতান কতদূর সিয়েরা লেওন থেকে এসেছে, লেটস্ হ্যাভ অ্যা মিল টুগেদার।’ লুকাস মিনিমিনিয়ে কী যেন একটা অজুহাত দিতে গেলে আমিও তাকে অনুরোধ করি, ‘ইউ রোউট এন ইনফরমেটিভ আর্টিকেল এবাউট মরোক্কানস্ লিভিং ইন মলেনবেক। মূলত তোমার প্রবন্ধ পড়ে আমি ব্রাসেলসে মরোক্কান পল্লীটি দেখতে আগ্রহী হয়েছি লুকাস। সো প্লিজ টেইক আস টু মলেনবেক।’ অনিচ্ছায় পথ দেখিয়ে আমাদের সামনে খুব নিরাসক্তভাবে হাঁটে লুকাস। এঞ্জেলিক আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘সিয়ারা লেওন থেকে ফিরে আসার পর থেকে সে এ রকমের মুডি আচরণ করতে শুরু করেছে।’ আমি কোনো জবাব না দিয়ে চোখের ইশারায় এঞ্জেলিককে বলতে চাই—লুকাসের উপস্থিতিতে আমি তার সাথে এ ধরনের সেনসেটিভ কথাবার্তায় এনগেইজড্ হতে চাই না। সে ঠোঁট বেঁকিয়ে অবজ্ঞা করার ফেমিনিন ভঙ্গি করে।

গ্র্যান্ড প্লেস ছাড়িয়ে একটি ব্লক অতিক্রম করতেই দেখি মধ্যবৃত্তদের এক সাদামাটা আবাসিক এলাকার পার্কিং লট জুড়ে বাজছে মস্ত মস্ত সাউন্ড বক্সে স্টিরিও। মন চনমন করা সুরেতালে নাগরিকরা মেতেছে নৃত্যে। অবস্থা দেখে মনে হয়, সারা ব্রাসেলস্ আজ মেতেছে ফ্লোরাল কার্পেট নির্মাণের আনন্দে। জোড়ায় জোড়ায় যুগলরা স্টেপ ফেলে ছন্দিত দেহে নিমজ্জিত হয়েছে সোয়িং ড্যান্সের রিদমিক আবহে। এঞ্জেলিক দাঁড়িয়ে পড়ে কোমরের ঊর্মি ছড়িয়ে নীরবে জানতে চায়—যুগল ডান্সে কারো আগ্রহ আছে কি না? ‘আই ডোন্ট রিয়েলি হ্যাভ মাচ্ টাইম, ডিনার সেরেই... আই রিয়েলি হ্যাভ টু রান,’ বলে এঞ্জেলিকের দেহমনে জ্বলে ওঠা নৃত্যপ্রবণ শিখাতে পানি ঢেলে দেয় লুকাস। তার নিরাসক্ত আচরণে স্যাফয়ার পাথরে আলো পড়ার মতো এঞ্জেলিকের নীল চোখ থেকে ঠিকরে বেরোয় ক্রোধ ও হতাশা মেশানো দ্যুতি।

/uploads/files/oexbK1qO9ynm1RSrq7xiDXVwOlwMejaLyf4kbGR1.jpegনাগরিকরা মেতেছে নৃত্যে

লুকাস আগ বাড়তে বাড়তে বলে, ‘আমরা এবার মরোক্কান পল্লী মলেনবেকে ঢুকতে যাচ্ছি। ব্রাসেলসে লক্ষাধিক মরোক্কানদের বাস। টু বি স্পেসিফিক, ২০০৭ সালে নেওয়া আদমশুমারীতে নাম ওঠে দুই লাখ চৌষট্টি হাজার মরোক্কান বংশোদ্ভূত মানুষের। এদের অনেকেই জন্ম হয়েছে বেলজিয়ামে।’ আমরা চলে আসি মলেনবেকের একটি সড়কে। রাস্তায় প্রচুর হেজাব পরা নারী দেখে এঞ্জেলিক মন্তব্য করে, ‘সিমস্ লাইক উই আর ওয়াকিং থ্রু অ্যা স্ট্রিট অব মিডিলইস্ট।’ আমারও মনে হতে থাকে আমরা যেন চলে এসেছি মুসলিম প্রধান কোনো দেশে। হাঁটতে হাঁটতে শুনি পথচারীদের আইফোনে বাজছে মাগরিবের আজানের ধ্বনি। আমাদের ঠিক সামনে সড়ক অতিক্রম করছে একটি মরোক্কান পরিবার। দাড়িওয়ালা পুরুষ ঠেলছে খালি স্ট্রলার। পিছনে শিশুর হাত ধরে হাঁটছে খয়েরি রঙের বোর্কা পরা নারী।

স্ট্রিটের দুপাশে পর পর কয়েকটি মরোক্কান রেস্তোরাঁ। আমাদের কেউ একজন যেন দাঁতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি, আর লুকাস অনুগ্রহ করে অনিচ্ছায় আমাদের নিয়ে এসেছে ডেন্টিস্টের চেম্বারে, এ রকম ভঙ্গিতে সে আমাদের নিয়ে ঢুকে পড়ে একটি রেস্তোরাঁয়। ক্যানোপির চঁদোয়া তলে সাজিয়ে রাখা অনেকগুলো বেতের সোফা। কাবাবের সুরভি নাকে লাগতেই বাতাসে এরোমা শুঁকে এঞ্জেলিক বলে, ‘লেটস্ হ্যাভ গুড টাইম উইথ ওরিয়েন্টাল ফুড।’ দেখি বেতের সোফায় খুব রিলাক্সড্ কায়দায় বসে এক মরোক্কান প্রৌঢ় কাপোল শিশা হুঁকায় ধূমপান করছেন। স্যুট পরা আরব বংশোদ্ভূত সুদর্শন পুরুষের চুল পেকে সম্পূর্ণ রুপালি। তার সঙ্গী সম্ভবত কঙ্গোলীজ কোনো গোত্রের এক কৃষ্ণাঙ্গী মহিলা। আমাদের দেখতে পেয়ে তারা দুজনে মাথা মৃদু ঝুঁকিয়ে বাও করেন। রেস্তোরাঁর ভেতর সম্পূর্ণ নির্জন। এঞ্জেলিক খুব উৎসাহ নিয়ে ম্যানুতে খাবারের ছবি দেখে। স্টার্টার হিসাবে চট জলদি পরিবেশন করা হয় সাত ধরনের সিদ্ধ করা সব্জিতে তৈরি স্যালাদের সাথে গরম গরম রুটি। বেশ তারিয়ে তারিয়ে আমরা স্টার্টার চাখি। মেইন কোর্স হিসাবে এঞ্জেলিক ফিস চারমৌলা বলে গ্রিল করা মাছের সাথে কুসকুসের অর্ডার করে। আমি সবুজ অলিভের সাথে চাকতি করে কাটা লেবু মেশানো তাজিন পদ্ধতিতে রান্না করা চিকেনের কথা ভাবি। এঞ্জেলিক ফিসফিসিয়ে বলে—মেইন কোর্সের পর আমি কিন্তু হেভি একটা ডেজার্ট নিচ্ছি। আমার চাই সিনেমন মেশানো তিন তিনটি বাকলোবা। তার চোখেমুখে খেলছে এক ধরনের চটুল অভিব্যক্তি। আন্দাজ করি—ফ্লোরাল কার্পেট বুনটের জটিল কাজ সুন্দর মতো সমাপ্ত হওয়ায় সে সেলিব্রেশনের মুডে আছে। আমি বিষয়টা টুঁইয়ে দেয়ার জন্য, ‘হাউ এবাউট অ্যা এরোমেটিক শিশা আফটার দ্যা মিল?’ বললে সে উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার কব্জি চেপে ধরে বলে, ‘লেটস্ গো ফর আ ওয়ার্ম স্মোক।’ আমাদের হাল্কা মুডের মিথস্ক্রিয়া বোধ করি লুকাসের পছন্দ হয় না। সে হুমাস ও রুটির ভেজিটারিয়ান কোর্স টেক-আউট হিসাবে প্যাকেট করে দিতে বলে। স্টাইরোফোমের প্যাকেট হাতে আসতেই সে—‘হ্যাভ অ্যা ফেবুলাস ইভিনিং.. .. ইউ টু,’ বলে কবরখানায় শবাসনের ক্রিয়াকলাপে যাতে দেরি না হয় এ অজুহাত দিয়ে উঠে পড়ে। লুকাস চৌকাঠ অতিক্রম করে রেস্তোরাঁর বাইরে যেতেই এঞ্জেলিক বিষণ্ণ চোখে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘লেট হিম স্ক্রু হিমসেল্ফ ইন দ্যা গ্রেভইয়ার্ড, আমি চাই না তার মুডের জন্য আমাদের সন্ধ্যাটা রুয়িন্ড হোক।’ আমি তার চোখের ভাষা পড়ে নিয়ে বাড়িয়ে দেওয়া হাত মুঠো করে ধরে একটু পর তা আলতো করে ঠোঁটে ছোঁয়াই। সাথে সাথে এঞ্জেলিকের গণ্ডদেশ ভরে ওঠে গোধূলির রক্তিমাভায়।

/uploads/files/LdPV8CYH7Yg86Kkt4CLZcnK20vE6L7Y3ny9Cr734.jpegশিশা হুঁকায় ধূমপান

নিরিবিলিতে আমরা খাবারের স্বাদ চাখি। গ্রিল করা ফিস চারমৌলা খেতে খেতে মাঝে মাঝে চোখের ঘন পাপড়ি তুলে আমার দিকে তাকাচ্ছে এঞ্জেলিক। মনে হয় তার মনে জমছে কিছু কথা কিংবা কৌতূহল, কিন্তু কিভাবে বিষয়টা পাড়বে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। অলিভ মেশানো চিকেনের স্বাদ চমৎকার, তা তারিয়ে খেতে খেতে অনুভব করি শরীরে হঠাৎ করে জ্বর আসার মতো তার চমৎকার দেহবল্লরীর প্রতি আমার মধ্যে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের আকর্ষণ। লুকাস আমার খুব কাছের লোক, ইবোলাক্রান্ত সিয়েরা লেওনের কঠিন দিনগুলোতে তার সাথে আন্তরিকভাবে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়েছি, তার সাথে এঞ্জেলিকের সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যাওয়ার আগে তার গার্লফ্রেন্ডের শরীর নিয়ে ভাবা আপত্তিকর মনে হয়। তাই, মেয়েটির কাঁধের নিচে ভি শেইপের নিরাবরণ ত্বকে ছড়াচ্ছে লাবণ্যের যে জোছনা—তা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আমি বাকলভা ও মিন্ট টি’র অর্ডার করি। খানিক পর পরিবেশিত হয় শিশা হুঁকা। তার চিলিম থেকে ছড়াচ্ছে এপ্রিকটের ফ্লেভার মেশানো তামাকের সৌরভ। চায়ে চুমুক দিয়ে শিশায় দম দিতে গেলে দেখি—কেন জানি অবাক হয়ে এঞ্জেলিক আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আর ঠিক তখনই রোস্তোরাঁর জানালা জুড়ে বেজে ওঠে নানা ধরনের বাদ্য-বাজনা। খোলা শার্সি দিয়ে দেখি—ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে জরির জবরজং পোশাক ও লাল রঙের ট্যাসেল ঝোলানো টুপি মাথায় স্ট্রিট সিংগারদের ছোট্ট একটি দল। তার খুব জোশে বাজায়—‘ওয়া লাললা ফাতেমা/ জার রাব্বি গির কালিমা..।’ এঞ্জেলিক আমার হাত থেকে হুঁকার নল সরিয়ে নিয়ে জানতে চায়, ‘টেল মি দ্যা মিনিং অব দিস সঙ।’ জবাবে আমি বলি, ‘আই ডোন্ট রিয়েলি নো, রেস্তোরাঁর ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করো।’ সে এবার আমার চিবুক ছুঁয়ে আবদার করে, ‘আই নো ইউ আর অ্যা মুসলিম, ইউ মাস্ট নো দ্যা মিনিং, আমাকে গানের অর্থটা বলবে না।’ আমি তার হাত মুঠো করে ধরে উঠে দাঁড়ালে—সেও আমার শরীর সংলগ্ন হয়ে হেঁটে আসে জানালায়। স্ট্রিট সিংগারদের থালায় আমরা দুজনে দরাজ হাতে ইউরোর কিছু কয়েন ছুঁড়ে দেই। খুশি হয়ে কেবলমাত্র আমাদের দুজনের জন্য এক বাদক বাঁশরীতে বিশেষ টিউন বাজায়। তন্ময় হয়ে শুনতে গিয়ে খেয়াল করি—আমার হাত আলতো করে পেঁচিয়ে আছে এঞ্জেলিকের কোমর।

/uploads/files/WJDgSvOHmHrZKQ7TzMDWwPMxXKbY9DlaqoAj2Ovl.jpegস্ট্রিট সিংগারদের ছোট্ট দল 

সাবওয়ে ধরে আন্ডারগ্রাউন্ডের দুটি স্টেশন পাড়ি দিয়ে আমরা চলে আসি এঞ্জেলিকের এপার্টমেন্টের কাছাকাছি। স্টেশনের পাশেই ফুটপাত থেকে সামান্য দূরে পার্ক করে রাখা তার মিনিয়েচার মডেলের ইলেকট্রিক কার। কায়ক্লেশে কেবলমাত্র দুজনের বসার উপযোগী গাড়িটিকে কিউট দেখায়। আমি ব্যাকপ্যাক কোলে নিয়ে তার পাশে বসলে এঞ্জেলিক স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে বিমর্ষ ভঙ্গিতে জানতে চায়, ‘ক্যান আই আস্ক ইউ ওয়ান স্ট্রেইট কোয়েশ্চন?’ আমি মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে বলি, ‘প্লিজ গো এহেড।’ ব্লক হয়ে যাওয়া ওয়াটার টেপে হঠাৎ করে তোড়ে জল এসে যাওয়ার মতো আবেগ নিয়ে সে জানতে চায়, ‘হোয়াট হেপেনড্ টু লুকাস? সিয়েরা লেওনে সে কী করে সময় কাটিয়েছে? ডু ইউ নো হোয়াই হি লস্ট ইন্টারেস্ট ইন মি?’ আমি সরাসরি এ প্রশ্নের জবাব না দিলে সে মন্তব্য করে, ‘ইউ নো দ্যা হৌল থিং, বাট ইউ আর নট টেলিং মি দ্যা ট্রুথ। নিশ্চয়ই সে কারো সাথে জড়িয়েছে।’ কথা না বলে আমি নিশ্চুপ থাকলে সে আমার হাত মুঠো করে চেপে ধরে। তার করতল ছড়াচ্ছে শরীরে জ্বর আসার মতো উত্তাপ। সে আমার চোখে চোখ রেখে জানতে চায়, ‘বা’ গাল ও গলার এক পাশ পুড়ে যাওয়া ব্লন্ড চুলের নারীটি কে? টেল মি হু দ্যা হেল ইজ শি?’ বর্ণনা থেকে আমি চিনতে পারি এঞ্জেলিক লরা শেলক্রসের কথা বলছে। আমি জবাব দেই, ‘লরা সিয়েরা লেওনে ইবোলা রিকভারি প্রোগ্রামে কাজ করছে। এর আগে কয়েক বার সে ইরাকে ত্রাণ সরবরাহের কাজে যুক্ত ছিল। রোড-সাইড বোমার বিস্ফোরণে তার শরীরের বা’ দিকের বেশ খানিকটা ঝলসে গেছে।’ তারপর উল্টা জানতে চাই, ‘তুমি লরার কথা জানলে কিভাবে?’ এঞ্জেলিক জবাব দেয়, ‘লুকাসের আইফোনে আমি তার ছবি দেখেছি, নাউ টেল মি হোয়াট ইজ দ্যা স্টোরি উইথ লরা?’ আমি রেসপন্সে বলি, ‘অনেস্ট টু গড আই ডোন্ট নো, তবে লরা তার কটেজে নানা ধরনের মেডিটেশনের আয়োজন করে থাকে। শুনেছি লোকাস তার সাথে মেডিটেশন প্র্যকটিশ করত।’ এঞ্জেলিক এবার প্রশ্ন করে, ‘লরা কি হিপনোটিজমের চর্চা করে?’ আমি জবাব দিই, ‘ইয়েস, শুনেছি সম্মোহনের অনেক কলাকৌশল তার জানা আছে। ইবোলা দূরীকরণের কাজ করতে গিয়ে যারা স্ট্রেসড্ আউট হয়েছে, এদের কাউকে কাউকে লরা আত্মসম্মোহনের প্রসেস্ শিখিয়েছে যাতে তারা স্ট্রেস্ ম্যানেজ করতে পারে।’ এবার হিস্টিরিয়া রোগীর মতো ঝরঝরিয়ে কেঁদে এঞ্জেলিক বলে, ‘নাউ আই নো দ্যা ট্রুথ, দ্যাট বিচ্ লরা লুকাসকে হিপনোটাইজড্ করেছে, সে এখনো সম্মোহনের ঘোরের মাঝে আছে। দিস ইজ এবাউট সিক্স মান্থ, সে আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি... আই অ্যাম শিওর কবরখানায় শবাসনে বসে সে লরার ধ্যান করছে। আই রিয়েলি হেইট হিজ মেডিটেশন এন্ড স্টুপিড সেলিবাসি বিজনেস।’

/uploads/files/OKXwJV6PnnZ1JgeOh6ryDUe3oMHo12kncCgpxpvp.jpegএঞ্জেলিকের ছোট্টমোট্ট ইলেকট্রিক কার

ব্যাকরোড ধরে গলিগুঁজির ভেতর দিয়ে ভ্রমর গুঞ্জনের মতো ধ্বনি তুলে ছোট্টমোট্ট ইলেকট্রিক কারটি মিনিট বিশেকের মাঝে চলে আসে এঞ্জেলিকের এপার্টমেন্টের কাছে। পার্ক করে গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে সে আফসোস করে মন্তব্য করে, ‘লুকাস আবহাওয়া দূষণের কারণে পেট্রোল চালিত গাড়ি পছন্দ করে না। তাই খুব আগ্রহ নিয়ে বিদ্যুত-চালিত ছোট্ট এ গাড়িটি কিনেছিলাম। ভেবেছিলাম দেশে ফেরা লুকাসকে হোমকামিং হিসাবে সারপ্রাইজ দেবো। সে কিন্তু একদিন পাশে বসেও এ গাড়িটা ট্রাই করেনি। সিয়েরা লেওন থেকে ফিরে এয়ারপোর্টে আমার চুমো ফিরিয়ে না দিয়ে কোল্ড ভয়েসে জানাল যে, সে সেলিবাসির দীক্ষা নিয়েছে। আই গিভ অ্যা ড্যাম টু হিজ স্টুপিড সেলিবাসি।’ তারপর এপার্টমেন্টের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমার দিকে চেয়ে ফিক করে হেসে বলে, ‘আমি তো সেলিবাসির দীক্ষা নেইনি, কয়েক মাস তার জন্য অপেক্ষা করলাম, নাউ টেল মি হোয়াই শুড আই স্টার্ভ?’ আমিও হেসে হাল্কা মুডে জবাব দেই, ‘তোমার অনাহারে থাকার তেমন কোনো কারণ তো আমি দেখতে পাচ্ছি না।’

‘হিয়ার ইউ গো’, বলে এঞ্জেলিক এপার্টমেন্টের তালা খোলে।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;