প্যারাকজম



মাহরীন ফেরদৌস
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

সাঁকো
প্রায় অনেক বছর পর এমন কারো সাথে পরিচয়। পরিচয়টুকু পথে কিংবা গলির মাথায়। বাড়ির সামনের বিখ্যাত মিষ্টির দোকানে, ব্যাঙের ছাতার মতো সদ্য গজিয়ে যাওয়া রেস্তোরাঁয়। টঙের দোকানে কারো ভীষণ শব্দ করে চায়ে চুমুক দেওয়ায়। ছাদের অলকানন্দা ফুল কিংবা খুলনার ঝপঝপিয়া নদীর তীরে। এতবার পরিচয় কিভাবে হয় ভাবতে পারে সবাই। তবে তা ব্যাখ্যা করা দুর্বোধ্য ও জটিল। তার সাথে দেখা হবার পর থেকেই বারবার, নানা স্থানে হচ্ছে পরিচয়। আমরা দুজন অবশ্য ফেসবুকে বন্ধু নই। ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট কিংবা টুইটারেও আমরা একে অন্যকে দেখি না। কারণ, আমি খুঁজে দেখেছি সে এসব কিছুই ব্যবহার করে না। তারপরেও ক্যামোন অদ্ভুত জায়গায় আমাদের দেখা হয়ে যায়।

যেমন, মৌনতার ঘরের বারান্দা দিয়ে তার ঘর দেখা যায়। জনমানবশূন্য শহরের মতো সেই মস্ত ঘরে সে বই পড়ে সময় কাটায়। সম্ভবত মৃদু শব্দে শোনে গান। বই পড়ার সময় মাঝে মাঝে অল্প মাথা ঝাঁকায়, যেন গল্পকার ও পাঠক দুটো সে নিজেই। তারপর, ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটতে থাকে। তার দেখাদেখি আজকাল আমিও খুব হাঁটতে শুরু করেছি। বাড়ির ছাদে, ঘরের ভেতরে, রাস্তায় কিংবা গলিতে আমি রিকশা না ডেকে, গাড়িতে না চড়ে হাঁটতে থাকি। আমার কেবলই মনে হয় এভাবে হাঁটতে হাঁটতেই আমাদের একদিন সত্যিই পরিচয় হয়ে যাবে। এ যুগে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে জুড়ে না থাকলে একে অন্যকে কাছ থেকে দেখার আর উপায় আছে কি? নেই। তাই আমার মাঝেমাঝে মনে হয় আমি মৌনতার ঘরটা ভাড়া নিয়ে থাকি, কিন্তু তা সম্ভব না। সেজন্য ছুটির দিনগুলোতে খুব ভোরে আমি ওর বাসায় চলে যাই। ওদের বারান্দায় অনেক গাছ। বাড়ির নানা পরিত্যক্ত জিনিস সেখানে বস্তাবন্দী করে ফেলে রাখা। এছাড়াও বারান্দার উপরের গ্রিলের এপাশ থেকে ওপাশে টাঙিয়ে দেওয়া তিন, চারটা লম্বা নাইলনের দড়ি। দিন-রাত সেখানে শত শত রঙ বেরঙের কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়। একটা টুল নিয়েও বসার জায়গা নেই। ঠেস দিয়ে দাঁড়ানোর জন্য কোনো ফাঁকা দেয়ালও অনুপস্থিত। এমন একটা জায়গা থেকে আমি তাকে দেখি। বারান্দা দিয়ে তার ঘরের দেয়ালে ক্রিকেট ব্যাট দেখে মৌনতাকে জানিয়েছিলাম। শুনে ও বলেছিল, ‘হয়তো খেলার মাঠ নিয়ে তার অনেক স্মৃতি আছে। সে হয়তো ক্রিকেট খেলতে খুব পছন্দ করে।’

শুনে আমারও বলতে ইচ্ছা করল, আমার বাড়ির পাশে একটা মস্ত বড় খেলার মাঠ আছে। আর মাঠ পেরিয়েই একটা ঘন সবুজ পার্ক। সেই পার্কের নির্দিষ্ট বেঞ্চিতে বসলে নাকি অকারণেই সবার মন খারাপ হয়ে যায়। আমার খুব ইচ্ছা করে খেলার মাঠের পাশের এই পার্কের গল্প আমি তাকে শোনাই, কিংবা ঘর থেকে একটা বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে তাকে তুলে নিয়ে এসে বলি, ‘চলো দেখে আসি স্টেশনের শেষ ট্রেনটা কোন গ্রামে যায়। কী আছে সেখানে? অনেক অনেক গাছ, শান্ত নদী, লেবু বাগান, বৃষ্টির পর রংধনু আর সন্ধ্যা নেমে আসার আগেই ঝিঁঝিঁ পোকাদের ঘোরলাগা গান!’

এসব ছাড়াও, আমি মনে মনে অনেকবার ভাবি তার সাথে হঠাৎ করে কোথাও দেখা হয়ে যাবে নাকি? হয়তো ব্যস্ত নগরীতে ভিড়ের মধ্যে সে হুট করে সামনে এসে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে বলবে ‘কেমন আছো?’ জানি না তখন আমি কী উত্তর দেব। হয়তো পেছন ঘুরে হাঁটতে শুরু করব বিব্রত ভঙ্গিতে। মুগ্ধতা কিংবা প্রেম যে নামই হোক, আমাকে বিব্রত করে খুব। লুকাতে পারি না, আবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতেও ইচ্ছে করে না। আমি জানি আর অল্প কয়মাস পরেই মৌনতারা এই বাসা ছেড়ে দিবে। এরপর তার সাথে দেখা হবে কিভাবে? জানা নেই। যদি ওর প্লে লিস্টের গানগুলো পেতাম হয়তো গানে গানে একটা সাঁকো তৈরি করে ফেলতাম দুজন। সেখানে আমাদের দেখা হতে পারত। মৌনতা আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, ‘এই মানুষটাকে নিয়ে তোর পরিকল্পনা কী?’

আমি বিশেষভাবে কিছু বলতে পারি না। এই ভালোলাগা, ঘোরলাগা কিংবা ‘আমাদের মাঝে যেন কী মিল আছে’ ধরনের অনুভূতির পৃথক কোনো সংজ্ঞা আমার কাছে নেই। শুধু জানি তার কথা না ভাবলে মনে হয় এবেলায় আকাশের দিকে তাকানো পাপ। আর মনে হয় সবকিছু এভাবেই থাক। মানিক মিয়া এভিনিউয়ের পার্ক থেকে গলা বাড়িয়ে দেওয়া ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ ছুঁয়ে দিক তার চিবুক। টঙের দোকানের মস্ত বড় কেতলির বিকট হুইসেল আর বাষ্পগুলো ঝাপসা করে দিক ওর কালো ফ্রেমের চশমা।

আমি শুধু ভুলতে চেষ্টা করে কিছু স্বপ্ন দেখে ফেলি। এই যেমন কিছুদিন আগে একরাতে দেখলাম, এক বিষাদ জাগানো ল্যাম্পপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। পেছনে চেনাজানা বহু মানুষ। আমি পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, যাওয়ার সময় অকপটে ছুঁয়ে দিলাম তার হাত। কেউ দেখল না, কেউ জানল না। এরপর চলে গেলাম দূরে, বহুদূরে। শান্ত হয়ে এলো চারপাশ।

আবার স্বপ্নে দেখলাম কোনো এক বইয়ের দোকানে দেখা হয়ে গিয়েছে আমাদের। শেলফের শতশত বইয়ের পাতাগুলোর ভেতর থেকে অনবরত পানি ঝরে একটা নদী হয়েছে। সেই নদীতে অল্প অল্প ঢেউ। ভাসছে অজস্র বই। বইয়ের খোলা পাতার ভেতর থেকে ফুটে উঠেছে কচুরিপানা ফুল। আমরা দাঁড়িয়ে আছি দুজনেই। হঠাৎ কী যেন একটা খুঁজতে চলে গেল ও। আমি একলা দাঁড়িয়ে। আমার পায়ে বাড়ছে জড়তা। যেন ডুবে যাচ্ছি আর আটকে যাচ্ছি কোথাও। মনে হচ্ছে, মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই আলো ফুটে উঠবে, আর হারিয়ে যাবে সব। আমি প্রাণপণে চোখ বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করতে থাকি। তারপর ভুলে যাই আমি কেন সেখানে আছি। এমন সময় কোথা থেকে আসা এক অচেনা বাতাসে কচুরিপানা ফুলগুলো দুলতে থাকে। আর নিয়ম করে পুড়তে থাকে আমার স্বপ্নের তারাবাতিগুলো।


অফবিট
- ‘তারপর?’
- ‘তারপর আর কিছুই না।’
- ‘ আশ্চর্য! এই সোশিওপ্যাথ ধরনের রহস্যময় মানুষটার সাথে তোর কোনো কথা বা কিছুই হয়নি?’ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে আমার বন্ধু জাহিদ, যাকে আমরা মজা করে জ্যাক বলে ডাকি।
- ‘উঁহু।’ আমি মাথা নাড়ি। আর জ্যাক আমার দিকে একটু সন্দেহজনক দৃষ্টি ফেলে কফিকাপে শব্দ করে চুমুক দেয়।

আমি চুপ করে থাকি। জ্যাককে কিভাবে বলি, মাঝেমাঝে এমন সময় আসে যখন মনে হয় পৃথিবীটা একই সাথে ভয়ংকর সুন্দর এবং প্রচণ্ড বেদনায় ভরপুর। আর তাই, বারান্দায় দাঁড়ালে যখন আচমকা বিপুল বাতাসের ঢেউ এসে সমুদ্রের মতো আমার ওপর আছড়ে পড়ে, তখন আমি দু চোখ বন্ধ করে ফেলি। আজকাল এত দীর্ঘশ্বাস আসে থেকে থেকে, যে মনে হয় ঝড় উঠে যাবে আকাশে। গুমোট, গম্ভীর আর ভারী এই শ্বাসের ভার নিতে পারি না।

আমি কিভাবে ওকে বলি, মৌনতারা বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছে মাসখানেক হলো। আর আমি তবুও ঘুরেফিরে হেঁটে যাই তার বাড়ির সামনে। আর দাঁড়িয়ে থাকি। তবে এখন সম্ভবত আমি জানি যে, সেও জানে আমি হেঁটে যাচ্ছি। আর সম্ভবত তার সাথে আমার একটা গোপন প্রেম আছে। বাস্তবতায় নিয়ন্ত্রিত এবং ফ্যান্টাসিতে অনিয়ন্ত্রিত এক প্রেম। সেখানে জীবনানন্দ দাশের সোনালি ডানার গাংচিলের সাথে আবুল হাসানের সাদা চামেলি ফুলের দেখা হয়ে যায়। অবাস্তব লাগছে? হ্যাঁ, আমারও এমন লাগে।

- ‘সে তোর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কোনো?’ জ্যাক আরেক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে আমার পাশে বসতে বসতে বলে। আমি প্রমাদ গুনি। নিশ্চয়ই এটা মৌনতার কাজ। বাড়ি বদলের পর থেকে আমি এখনো ওদের আগের বাড়ির সামনে নিয়মিত যাই এটা বোঝার পর সে অতিরিক্ত চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেই কিছু একটা জ্যাককে বলেছে, আর তাই সবসময় নিজের প্যাঁচানো দুনিয়ায় ব্যস্ত থাকা বন্ধুটি হঠাৎ করেই বেশ সময় দিচ্ছে আমাকে। এমন গ্যাঁড়াকলে পড়ে নিজেকে নিজেরই লাথি মারতে ইচ্ছে হয়।

কপিশপের বাইরের স্বচ্ছ কাচে ঘনিয়ে আসে ছায়া। আকাশে বেশ মেঘ করছে। বখাটে বাতাস রাস্তায়। ধুলা আর ছেঁড়া কাগজ অহেতুক উড়ছে এলোমেলো। আমি আনমনা হই আর জ্যাকের চেহারা ঝাপসা হয়ে আসে ক্রমশ। আজকাল আমার তাকে নিয়ে ভাবতে আরো ভালোলাগে। চোখ বন্ধ করলে মনে হয় সে ভীষণ কাছে। এই তো পাশে। চোখ খুললে হারিয়ে যায় সব। এমন তো মনে হয়নি আগে কোনোদিন, বরং আমি অনেকটাই ঠেকে শেখা ও টুকে নেওয়া একলা মানুষ। একটা সময় ছিল যখন শামুকের মতো খুব গুটিয়ে থাকতাম, কিন্তু এই কর্পোরেট কালচার আর সিজিআইতে ভরপুর সেলুলয়েড পৃথিবী আমাকে বদলে দিয়েছে অনেকটুকু। এ কারণে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে নিহিলিস্ট হই। নিহিলিজম চর্চাই হবে আমার এগিয়ে যাওয়া। ‘নিহিল’ অর্থ যেমন ‘কিছুই না’ আমিও তেমন ‘কিছুতেই কিছু যায় আসে না’ ধরনের জগতে থাকব। তবে কোথাও যেন তবুও কী বাকি থেকে যায়, সে কারণেই আমি হয়তো নানা জায়গায়, নানা মানুষের মাঝে গল্প খুঁজে বেড়াই। তবে এই পৃথিবীর ৭,৭৮০ মিলিয়ন মানুষের মাঝে হুট করে উল্টা কেউ আমারই গল্পে চলে আসবে, আমার সাথে বসবাস করতে শুরু করবে তা ভাবতে পারি না। তাই যেখানে তার সাথে আমার তিন থেকে পাঁচ মিনিটের জন্যও কোনোদিন মুখোমুখি আলাপ হয়নি, তবুও কিভাবে তাকে নিয়েই এতকিছু ভাবছি, এই ভেবে নিজের মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। মনের মধ্যে প্রশ্ন ঘুরে, ‘আমাদের মাঝে ক্লিক করলটা কোথায়?’

জ্যাকের দ্বিতীয় কাপ কফি চলে আসে। এবার দেখতে পাই আমার জন্য বাটারস্কচ আইসক্রিম অর্ডার করেছিল ও। ওয়াফেলের ভেতর থেকে মোলায়েম আইসক্রিম উঁকি দিয়ে বলে, ‘হাউডি!’ কফি হাতে নিয়ে স্মোকিং জোনের দিকে যেতে ইশারা করে ও। আমি ওর পিছু নেই। কী কী যেন বলতে থাকে, আমার কানে আসে না। না শুনেই মাথা নাড়ি।
- ‘তুই কোনো কথাই শুনছিস না তাই না?’ প্রায় ধমকে বলে ওঠে আমার সুদর্শন বন্ধু। আমি শূন্য চোখে তাকাই।
- ‘আমি তোকে বললাম, অফিসে এবার প্রমোশন লিস্টে আমার নাম আসেনি। তুই মাথা নাড়লি যেন এটা খুব স্বাভাবিক। বললাম, বাড়ি বদলাব, নতুন ফ্ল্যাট খুঁজছি, তুই উত্তর দিলি না। এরপর স্মোকিং জোনে আসতে আসতে বললাম, আমার বসের বউয়ের সাথে আমার ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড হয়েছে। মিড লাইফ ক্রাইসিসে ভোগা মহিলা এখন আমার পিছু ছাড়ছে না। এত চরম কথা শুনে তুই শুধুই মাথা নাড়লি। হয়েছেটা কী তোর?’
আমি থতমত খেয়ে যাই। প্রাণপণে মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে মনে মনে নার্সারির একটা হাস্যকর ছড়া কাটি,
“অল দ্য লিটল ফিশেস আর সুইমিং ইন দ্য ওয়াটার
সুইমিং ইন দ্য ওয়াটার,
সুইমিং ইন দ্য ওয়াটার,
অল দ্য লিটল ফিশেস আর সুইমিং ইন দ্য ওয়াটার
স্প্লিশ, স্প্লিশ, স্প্লিশ, স্প্লিশ, স্প্ল্যাশ”

অল্পক্ষণে ধাতস্থ হই। তারপর জ্যাককে শান্ত করার জন্য বলি, ‘আইসক্রিমটা দারুণ। আর ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড শুনলে আমি আগে ভাবতাম ছেলে-মেয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কিস করেছে। এখন বুঝি এর মাহাত্ম্য। তোর প্রমোশন কি এ জন্যই আটকে গিয়েছে?’

নির্মমভাবে নিজের গালের ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি চুলকাতে চুলকাতে ও বলে, ‘আসলে রাতে থাকিনি। ডিনারে গিয়েছিলাম শুধু। ডিনার থেকে অন্যকিছু হয়ে যেতে পারে বুঝতে পেরে এড়িয়ে চলে আসছি, কিন্তু মহিলা পিছু ছাড়ছে না। তুই আমার কথাকে পাত্তা দিচ্ছিলি না বলে চাপাবাজি করলাম, কিন্তু লাভ কী? তুই তো দেখছি মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দা হয়ে আছিস। যাই হোক, আমি বের হব একটু পর। যাওয়ার আগে তোকে বাড়ির কাছে নামিয়ে যাব?’

আমি সবগুলো দাঁত বের করে মাথা ঝাঁকাই। খানিক পরেই অল্প বৃষ্টির মাঝে আমি ওর বাইকের পেছনে উঠে বসি।

- ‘সাবধানে বস। পড়িস না আবার।’ সিরিয়াস কণ্ঠে বলে জ্যাক। আর মিনিট দুয়েকের মাঝে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে শোঁ করে উড়ালপঙ্খীর মতো চলতে শুরু করে ওর বাইক। জ্যামের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাইকের এঁকেবেঁকে যাওয়া, সাথে প্রবল বাতাস, একটু আধটু বৃষ্টি আমার মনের গুমোট ভাব অনেকটুকুই দূর করে দেয়।

আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বুজি। সাথে সাথে এটাও খেয়াল রাখি যেন পড়ে না যাই। তবে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের কাছে পৌঁছাতেই আবার আনমনা হই। এখানের ছাতিম গাছটা কি আমার কথা রেখেছে? আমার কথা ভেবে বকুলের ঘ্রাণ সেই মানুষটার পিছু নিয়েছে তো? সে কি জানে, নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে আমি এখন এত কবিতা পড়ি, এত বই পড়ি যে মাথা বনবন করে ঘুরতে থাকে। সারাক্ষণ পেছনে বাজতে থাকে নানারকম ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিক। মনে হয়, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মোনালিসাকে ভুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে ঠা ঠা করে। আর এই স্টুপিড হৃদয় তার কথা ভাবতে ভাবতে আমার চোখে আনন্দের বাষ্প এনে দেয়। মনে হয় জাদুর শহর, প্রাণের শহর সব চাপাবাজি। ঢাকা নামের এই প্রাইভেসিহীন শহরে আমি এমন কোনো শূন্য রাজপথ খুঁজে পাব না যেখানে শুধু আমরা দুজন থাকব। তার একটা হাত তুলে এনে চেপে ধরতে পারব না আমার রাত জাগা শুষ্ক গালে। সবখানে শত শত মানুষ। আমরা পালাব কোথায়? তারপর আবার প্রশ্ন জাগে, একই রকম দেখতে দুই হাত, দুই পা, ২০৬টা হাড়, একটা হৃদয়, নাক, কান, গলা সমেত একধাঁচের মানুষদের মাঝে আমার কেন তার সাথেই একটা অলীক যোগসূত্র শুরু হলো? এই অতি পুরাতন কিন্তু আধুনিক, আধ্যাত্মিক ব্যাপার শুরু করল কে? আমি নাকি সে?

- ‘এখানে নামাই। বাকি পথটুকু হেঁটে যেতে পারবি নাকি রিকশা নিবি?’ আমার বাড়ির সামনের মূল সড়কে এসে জিজ্ঞেস করে জ্যাক। আমি বাস্তবে ফিরি। এক গাল হেসে বলি, ‘এটুকু পথ, হেঁটেই যাব।’
- ‘সাবধানে যা। আর আমি রাতে ফোন করে কথা বলছি আবার তোর বিষয়ে।’ চোখ পাকিয়ে বলে ও। আমি মনে মনে বলি, ‘নো ওয়ে।’ তবে মুখে বলি, ‘কল করিস। আমি রাতে জেগেই থাকি।’

মাথায় হেলমেট ঠিক করে একটা স্যালুট দেওয়ার ভঙ্গি করে বিদায় নেয় ও। আর খুব ধীর পায়ে আমি বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। মূল সড়ক থেকে বাড়ি ফেরার এই পথটুকু আমার খুব চেনা, খুব আপন। বাড়ি থেকে ক্রমশ ফ্ল্যাটবাড়ি হয়ে ওঠা কৃত্রিম দালান, ওষুধের দোকানের পাশের নর্দমা, মুদি দোকানের অলস আনিস চাচা, একটা জারুল, দুইটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আর পিচঢালা মসৃণ অথচ সরু পথ আমার খুব পরিচিত। কত কত বছর ধরে এখানে আমি পায়ের ছাপ ফেলে যাচ্ছি। বাড়ি ফিরছি, বাড়ি ছাড়ছি। ওদের মতো করে এই শহরের আর কোনো পথ কি আমাকে চেনে? অবশ্য মৌনতাদের বাড়ি সামনের পথটুকু আজকাল আমাকে একটু একটু করে চিনতে শুরু করেছে। সে পথকে কি আমি প্রশ্ন করতে পারি, কেন দিনের খুব ক্ষণস্থায়ী কিছু মুহূর্তে আমার দেজাভু হয়? কেন মনে হয় তার সাথে আমার হয়তো পরিচয়টা আগেই ছিল। কথা হয়েছিল, দেখা হয়েছিল, কিন্তু আসলে তো এসব কিছু হয়নি। আমার মস্তিষ্কের ‘টেম্পোরাল লোব’ কেন আমার সাথে এমন বেইমানি করছে? কেন পৃথিবীর সব ফুলের রঙ আমার কাছে হয়ে যাচ্ছে তীব্র সুন্দর? কেন বহু দূরে অচেনা কোনো পাখি ডেকে গেলেও আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় প্রচণ্ড সচেতন হয়ে ওঠে? মধ্যরাতে ঝিঁঝিঁ পোকারা একসাথে কোরাস গাইতে শুরু করলে কেন ইচ্ছে হয় আমি ওদের মাঝে গিয়ে মুখ ডুবিয়ে ঘুমিয়ে থাকি? ঘুম ভেঙে যায় মাঝরাতে, আর ভাবি, ‘এই অবেলায় সে করছে কী?’ তারপর আবার মনে হয়, ‘আমাদের ক্লিক করল কোথায়? কিউপিড কি সত্যি আছে পৃথিবীতে?’

বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে একটা গাড়ি চলে যায় আমার পাশ দিয়ে। আর ঠিক তখনই ব্যাগে থাকা মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। সম্বিৎ ফিরে আসে আমার। বাসা থেকে ফোন। কলটা ধরে মৃদু স্বরে বলি, ‘আর দুই মিনিট লাগবে।’

হাতঘড়ি দেখি। রাত প্রায় আটটা। এ সময় সেও কি বাইরে থেকে নিজের বাড়ি ফেরে? আবার এমন কি হতে পারে, আমার যা হচ্ছে তা হলো প্যারালাল ইউনিভার্সের সংঘাত। অর্থাৎ, আমরা এ জগতে অচেনা থাকার পোশাক পরে আছি আর অন্য জগতে একসাথে বইয়ের দোকানে খুব ঘুরছি। সে কারণেই তার প্রতি আমার এত টান। আমার ইচ্ছে করে সে যখন খাবার খাবে, আমি সেই খাবারের দারুণ কোনো স্বাদ হয়ে তার মাঝে থাকি। সে যখন প্রিয় গান শোনে, সেই গানের সুর হয়ে কানের ভেতর প্রবেশ করি। কিংবা, আমি তার কোনো বেদনার স্মৃতি হই। সে যখন কাঁদবে, সেখানে আমিই কারণ হব।

আবার মোবাইলটা বেজে ওঠে। আমি কলটা কেটে দিয়ে মাথা ফাঁকা করতে করতে দ্রুত পা চালাই।

নিজের ঘরে এসে ক্লান্ত লাগে খুব। কাঁধের ব্যাগ ছুড়ে ফেলি বিছানায়। তারপর সোজা চলে যাই শাওয়ার নিতে। অনবরত মাথার ওপর বৃষ্টির মতো ঝরে যাওয়া এই জলের সাথে আমার একান্ত সময়। এই সময়টা আমি সবচেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি সবকিছু থেকে। প্রতিটি জলের ফোঁটা আমার ক্লেদ, ক্লান্তি আর বিষণ্ণতা মুছতে থাকে। দীর্ঘ সময় তাই অকারণেই ঝর্নার নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রায় মিনিট চল্লিশেক পর বের হই। হালকা লাগে ভীষণ। ডাইনিং টেবিল থেকে প্লেটে অল্প কিছু খাবার নিয়ে নিজের ঘরে চলে এসে একটা সিরিয়াল ছেড়ে দিই। আসলে ওটায় মন নেই শুধুই সফট নয়েজের জন্য চালিয়ে রাখা। আশা করছি জ্যাক রাতে ফোন করবে না, প্রাক্তন প্রেমিকা, অফিসের ক্যাচাল নিয়ে এমনিতেই সে সবসময় খুব চাপে থাকা মানুষ। আজ বহুদিন পর দেখা হলো, আগে প্রতি সপ্তাহেই আড্ডা হতো। সেই দিনগুলো হারিয়ে গেলেও বন্ধুত্ব ঠিকই টিকে আছে। জানি না মৌনতা আমাকে নিয়ে ঠিক কতটুকু বলেছে ওকে। তবে, আমার নিজের কথা কাউকে বলতে ভালো লাগে না। একদমই না।

এরচেয়ে মনে মনে তার সাথে কথা বলা ভালো। আমি কি তার সাথে কথা বলতে যাব? একদিন সরাসরি সামনে গিয়ে বলে বসব, ‘আমাদের কথা বলা উচিৎ।’ সে নিশ্চয়ই চোখেমুখে বিশাল বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে ফেলবে। আর আমাকে পালানোর পথ খুঁজতে হবে। নাকি কোনো পাঞ্চ লাইন দিয়ে জিজ্ঞেস করব, ‘হ্যালো, তুমি কি কোনো বিখ্যাত ব্ল্যাক কফি? তোমাকে ভাবলে তাহলে আমার ঘুম আসে না কেন?’ ছিঃ! খুব বাজে ছিল। এসব কেন ভাবছি? বাদ, সব বাদ। বরং পরিকল্পনা করি, আজকে আগে আগে ঘুমিয়ে যেতে চেষ্টা করব। তবে তা সম্ভব হয় না, আমাকে ভুল প্রমাণ করে, ঠিক মধ্যরাতে জ্যাক ফোন করে। ওর কলটা ধরব না ভেবেও ধরে ফেলি।

- ‘তুই কী কিছু বলবি আমাকে আর ওই বিষয়ে?’ ফোন করেই গম্ভীর স্বরে বলে জ্যাক।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি।
- ‘কিছু তো বল। হালকা লাগবে। ওই বিখ্যাত সিনেমাটা দেখিসনি, যেখানে প্রশ্ন করা হয় মানুষ নিজের গোপন কথা কাউকে বলতে না পারলে কী করবে? উত্তর দেওয়া হয়, শহরের শেষ প্রান্তের কোনো গাছের ভেতর গর্ত করে, সেখানে ফিসফিস করে নিজের মনের কথা বলে গর্তটা মাটিচাপা দিয়ে বন্ধ করে দিবে। তোর তো এত খারাপ দিন আসেনি। আমাকেই একটা গাছ হিসেবে ধরে নিয়ে কিছু তো বলতে পারিস।’ বলতে বলতে জ্যাকের কণ্ঠ নরম হয়ে আসে কিছুটা।
আমিও ঢোঁক গিলি, সময় নিই। তারপর বিড়বিড় করে বলি, ‘আমার রোজকার কাজে সে নিয়ত আসা-যাওয়া করতে থাকে।’
- ‘আর?’ প্রশ্ন করে জ্যাক।

আমি চুপ করে যাই। আর মনে মনে ভাবি, এভাবেই তাকে নিয়ে প্রাণপণে অভ্যস্ত হতে চেষ্টা করছি। যেভাবে আমি প্রথম অভ্যস্ত হয়েছিলাম যখন আমাকে মাইনাস পাওয়ারের চশমা নিতে হয়েছিল। আগে আমি ভাবতাম চশমা একটা কদাকার বস্তু, মানুষের চোখ হবে বাহুল্য ছাড়া। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, চশমাটা আমার চেহারায় মানিয়ে গেল। গত পনের বছরে সেই বাহুল্যকে আমি আপন করে নিয়েছি। তবে আমার চশমা আমাকে পীড়া দেয় না। সে দেয়। আমার খালি মনে হয় সেও আমাকে দেখে, খালি দেখে। সে কি অন্যজগতে আটকা পড়া মানুষ? কথা বলতে পারে না? তবে সে কথা বলতে আসলে হয়তো আমি ইশারায় বলতাম, ‘সসসসস...’ তারপর তার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম কয়েক ঘণ্টা। আমাদের হয়তো তখন কথা হতো, কিন্তু হতো না কোনো শব্দ। এমন যোগাযোগ চলত যা শুধু আমরাই শুনতাম।

- ‘ হ্যালো, শুনতে পাচ্ছিস? কথা বলছিস না কেন?’ ফোনের অন্যপাশ থেকে ডাকতে থাকে আমার চিন্তিত বন্ধু। আমি তবুও চুপ করে থাকি।
- ‘আমার সাথে কথা বল। মৌনতা আমাকে সব বলেছে। এসব ফ্যান্টাসি থেকে বের হয়ে আয়।’ ঠান্ডা স্বরে বলে ও।
- ‘কী বলেছে?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করি আমি।
যা বলার বলেছে, ‘তুই হয় আমাকে সব বলে নিজেকে হালকা কর। নয়তো মাথা থেকে সব ঝেড়ে দে। এসব কিছুই নেই।’
- ‘নেই মানে?’ খেই হারিয়ে ফেলার মতো প্রশ্ন করি আমি।
- ‘নেই, এমন কোনো মানুষ নেই। ও বাসাটা খালি। বহুদিন থেকেই। মৌনতা আগেই বলেছে তোকে, তুই একাই নানাকিছু ভেবে যাচ্ছিস। এসব তোর নিজের প্যারাকজমের প্যারা। নিজের কল্পজগত। বাদ দে। আমি জানি চেষ্টা করলেই পারবি।’

আমার মাথায় উঠে যায় ঝড়। একটা তুমুল কালো মেঘময়, বিষণ্ণ ঝড়। সেই ঝড়ে জ্যাকের কথা আবছা হয়ে আসে। আমি শুধু ভাবি, আমার আজকাল খুব ঘুম পায়, কিন্তু শান্তিমতো ঘুমাতে পারি না। সেকি শিশুর মতো ঘুমায়? আমি কল্পনা করতে চেষ্টা করি এবং বুঝি, যে যাই বলুক, বোধ থেকে বোধের, সুর থেকে সুরের আর ঠিক-বেঠিকের সীমারেখা পেরিয়ে যে গাঢ় সবুজ মাঠ আছে, সেখানে তার সাথে আমার যোগসূত্র। সে আমাকে দেখেছে কিন্তু আসলে শুধু আমাকে দেখেনি, সে আমার ভেতরের বইটার হার্ড কভারে হাত বুলিয়ে পড়ার জন্য পাতা উলটে ফেলেছে। আর পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত লকারে রেখে দেওয়া সেই বই কেউ দেখে ফেলেছে বুঝতে পেরে আমি ভেতরে ভেতরে থতমত খেয়ে কেঁপে উঠেছি। আমি তার হাত ধরতে চাই চাহিদা থেকে না, তার সাথে যোগাযোগ করতে, অনুভব করতে। কপালের সাথে কপাল ঠেকাতে চাই চিন্তাগুলো ছড়িয়ে দিতে। একটা মন্থর, স্পন্দিত নদীর মতো।

- ‘হ্যালো... তুই ঠিক আছিস? কথা বল প্লিজ।’ জ্যাক আবার ডেকে যায়।

আমি কিছুই শুনি না। হ্যাঁ, হয়তো ওরা ঠিক। আসলে হয়তো তার সাথে আমার কিছুই নেই। আসলে এই পৃথিবীতে সে নেই। মৌনতার উল্টা দিকের বাসাটা বরাবর খালিই ছিল। সেখানে গেলে সবাই হয়তো দেখতে পাবে, ‘ভাড়াটিয়া চাই’ নামে ঝুলছে বিবর্ণ কোনো সাইনবোর্ড। এইসব আমার ঘুণে ধরা মস্তিষ্কের ‘প্যারাকজম’। আমার লিখতে না পারা ভালোবাসার ১০০ সনেট। আমার আশ্চর্য সাম্রাজ্য, সুখী ফানুস। তাতে কী? আমার জন্য তো এসব সত্যি। ভীষণ সত্যি। আর তাই এই প্রত্যাখ্যাত হবার খালি খালি ভাব নিয়ে যখন আমি হাওয়ায় ভেসে যাওয়া কোনো বিষণ্ণ শুকনো পাতার মতো উড়তে থাকি, তখনই জেনে যাই আমাদের মাঝে যোগসূত্রটা আসলে কোথায় এবং কিভাবে। জেনে যাই, বনভূমি লোকালয় থেকে কেন এত দূরে থাকে। হ্যাঁ, ঠিক সে কারণে, সেই একই কারণে সে আর আমি পাশাপাশি থাকি; কাছাকাছি থাকি…

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আমাকে আমার কাছের কেউ বারবার ডেকে যায়। আমি উত্তর দিই না। বরং, দূরের কারো জন্য আমি সবকিছু ছেড়ে তার সাথেই জলের মতো ঘুরতে থাকি।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;