দ্বিতীয় জীবনগুলো



রাবেয়া রব্বানী
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

তৃষা
নিকুঞ্জ ১২
সকাল সাতটা
৮ জুলাই ২০১৯

ভেজা কাপড়ে বারান্দা মোড়ানো। ধোঁয়াগুলো চারপাশে কুয়াশার মতো জমে বসেছে। পাল্লা দিয়ে আমিও সিগারেটটাকে একটা ঠোঁটের মতো নিষ্পেষণ করছি। ফ্রয়েড যখন বলেছেন, “চুমু খাওয়ার মতো কোনো কিছু পাওয়া না গেলেই ধূমপান অপরিহার্য হয়ে উঠে”—তখন হলেও হতে পারে ঠোঁটের উত্তেজনাই এর প্রতি আমার আকর্ষণের কারণ। তবে সকল মন্দেরও কিছু ভালো থাকে, যেমন সকালের সিগারেটটা টানার সময় সারাদিনের একটা রুটিন এঁকে ফেলা যায় আবার অনেক সূক্ষ্ম কিছু নজরে পড়ে। এইতো এখন আমার চোখে পড়ল এক সপ্তাহর টানা বৃষ্টিতে সবকিছুই কেমন উর্বরতা পেয়েছে। গ্রিলের নিচের দেয়ালে মিহি মাদুরের মতো শ্যাওলা জমে আছে। গত রাতে টয়লেটে লাইট জ্বালাতেই দেখি তেলাপোকাগুলো বাচ্চাকাচ্চাগুলো ছুটোছুটি শুরু করেছে। মাসিক হওয়ার দিন পার হয়ে গেছে তিনদিন হয়, এর ওপর রুশোর খণ্ডকালীন কাছে আসা আবার আমাকে কাবু করে নিচ্ছে। এইসব নিয়ে ভাবনাটা অবশ্য কিছুটা পেছানো যেতে পারে, অন্তত সূর্য ওঠা পর্যন্ত।

সূর্য ওঠা পর্যন্ত একটা গড়িমসি ভাব আমি নিতেই পারি। অন্তত আজ রান্না না করে বাইরে থেকে খিচুড়ি কিনে আনতে পারি। দুপুরে সেটে গিয়ে রুশোর স্যাঁতস্যাঁতা সান্নিধ্যে গা পেতে দিতে পারি। এক্ষেত্রেও আমার অনেক যুক্তি আছে। মাত্র চার মাস হয়েছে বিপিন আর আমার বিয়ে হয়েছে। তাকে বোঝার আগেই আবার অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। পনের দিন হয় আমি কি আগের চেয়ে বেশি একা নই? তাছাড়া কাজের খাতিরে রুশোকে এড়ানোর কোনো কায়দা আমার নেই। রুশো ফার্স্ট এসিসটেন্ট ডাইরেক্টর আমি সেকেন্ড। আজ শুটিং না থাকলেও বেক স্টেজের কাজ তো চলছেই। সেট তৈরি হচ্ছে, ক্যারেকটার রিহার্সাল করছে। কিছু বোঝাপড়া আমারও থাকা জরুরি। কিংবা অলস দুপুরে ঘুমুলে মুখে মেদ বাড়ে রাতে ঘুম হয় না কিংবা স্টুডিওতে ঘন ঘন ঢু দিলে হয়তো নোমানুর নোমানের সুনজরে পড়ে আমি তার পরবর্তী বিগ প্রোডাকশনের কাজেও থাকতে পারব। বিপিন নিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত সে আসলেই আমাকে নিয়ে যেতে পারবে কিনা সে বিষয়ে কিছুই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না যেহেতু, সেহেতু এতদিনের গড়া ক্যারিয়ারে আমি পানি ঢেলে দিতে পারি না। কিংবা সূর্য ওঠা পর্যন্ত আমি ভিন্ন একটা চরিত্রে অভিনয় করতে পারি। ন্যাকা, কিংকর্তব্যবিমূঢ় নারী, কত পদই তো আছে।

আজ চাইলে শাড়িও পরা যায়। এমন কেউ হয়তো আজ সেটে আসবে যে আমার শাড়ি পরাটা পছন্দ করে তাকাবে। মেলো ড্রামার মেয়েদের মতো আমি যেনতেন আবেগ দেখিয়ে ফেলব না, আমার চলন হবে দ্রুত ও উচ্ছল ও বিক্ষিপ্ত। সিঁদুরটা এত চিকন করে আঁকব যে প্রায় বোঝাই যাবে না। শাঁখাটা না হয় আজ পরব না। মা আর বিপিন কল করলে বলে দিব ব্যস্ত আছি। রুশো যদি আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চায় বা হাতিরঝিল যেতে চায় আমি না না করতে করতে হ্যাঁ বলে ফেলব। এরপর আলো অন্ধকারে ছুটতে থাকা রিকশায় আমার গায়ের ওমে প্রভাবিত হয়ে রুশো যদি বলে ফেলে যে সে আসলেই আমাকে ভালোবাসে আমি অবিশ্বাসের সুর দিব না। বলব না তোমার প্রেম ঋতুকালীন সবজির মতো। ঘুরে ঘুরে আসে আবার চলে যায়। ভাব দেখাব রুশোর প্রেম স্থির ও অবিনশ্বর। তবে গদগদও হওয়া যাবে না। গদগদ ভাবে রুশোর ভয় আছে। এখনো কি সে বোঝেনি আমিও কম যাই না? এই যে নাকের উপর দিয়ে বিয়ে করে ফেললাম। চার মাস দরকার ছাড়া কথাই বললাম না প্রায়। সে নিজে টান দেখালে আমি তার প্রতি কিছুটা টান বোধ করি এই যা। বর্ষাকাল বলেই না রুশোর প্রেম চড়া তাও কি আর আমি বুঝি না? গত কয়েকদিন ধরে সে যেই তালে আমার নিস্পৃহতা ভাঙার পায়তারা করছে তার একটাই অর্থ, তার এখন রোমান্স দরকার। বিপিন? কামলা দিতে দিতে বিপিনের শরীরে তেজ নেই আর মন সেটা আগেই কেউ খেয়ে রেখে দিয়েছে। এই আধ খাওয়া মন আবার নতুন করে গজাতে গজাতে আমি বুড়ি হয়ে যাব নাকি? সূর্য ওঠা পর্যন্ত সেটেলড মেরেজের দোষগুলো নিয়ে বলতে থাকলে একটা মহাকাব্য তো হয়েই যাবে। এইটুকু সময়ের জন্য একজন নিষঙ্গ নারী হিসাবে আমি আমার নিজের জন্য নিজে কিছু ব্যবস্থা করলে পৃথিবীর গতিতে কোনো খুঁত আসবে না। পৃথিবী ঠিকঠাক তার নিজ অক্ষের ওপরই চলবে।

রুশো
বাংলাদেশে ফিল্ম ডেভলাপমেন্ট কর্পোরেশন, তেজগাঁ
সকাল সাড়ে সাতটা
৯ জুলাই ২০১৯

শুটিং ফ্লোরে নাশতার পর চা, চায়ের পর কফি। তারপর বেলা গড়াতেই আবার হালকা নাস্তা, এরপর দুপুরের খাবার আবার সন্ধ্যে হতেই ভারী নাশতা। অনেকেই দেখি বেশি কিছু খেতে পারে না। তবে আমি কিচ্ছু বাদ দিই না। এগুলো হচ্ছে ইনপুট বা নিবেশ। এক্ষেত্রে সকল সেন্স অর্গানকে আমি গুরুত্ব দিই। শব্দের ভোজ, ঘ্রাণের ভোজ, দৃশ্যের ভোজ, স্বাদের ভোজ এইসবের তিল তিল নিবেশ শরীর ও মনের ভেতর প্রক্রিয়া করেই তো কিছু উৎপাদিত হয়। আর আর্ট তো যেনতেন কিছু না। নাটকের দৃশ্যটা পর্দায় শৈল্পিকভাবে নামাতে নানান কিছুতে আমাকে ধ্যান দিতে হয়। সৌন্দর্য বোধ তো লাগেই সাথে লাগে পরিমিতি জ্ঞান, লাগে একটানা খেটে যাওয়ার শক্তি। তাই আমাকে সবকিছু ঠিকঠাক নিতে হয়। তারপর বাইরে দাঁড়িয়ে কসে একটা সিগারেট টান দিতেই সব স্মৃতি আর নতুন নিবেশ মিশিয়ে আগে নিজের মতো করে সারাদিনের শুট করা দৃশ্যগুলো কল্পনা করে নিতে হয়। তা মূল ডিরেক্টররা আসুক কি না-আসুক। প্রথম বিকল্প পরিচালক হিসাবে এই ব্যবস্থাপনায় আমাকে পরিপূর্ণ প্রস্তুত থাকতে হয়। নিবেশ ও প্রকাশের এই প্রক্রিয়ায় আমার তৃষাকে প্রয়োজন হয়। কারণ নিয়মিত ধারে কাছে থাকা আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত নারী উপাদান সে। তার ওপর মাথা ভালো। গায়ের রঙটা যা একটু ময়লা, এটা অবশ্য চোখের জন্য একটা অপূর্ণাঙ্গ নিবেশ। তবে চেহারা আর ফিগার ভালো বলে মাঝেসাজেই এই ব্যাপারটা কেমন করে যেন দাবিয়ে যায়। বিশেষ করে বর্ষার সময় এবং বিশেষ করে যখন শরীর কাউকে ছুঁয়ে থাকার নির্ভার অনুমতি চায় তখন তৃষা প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। বলা যায় তৃষা আমার ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো কিংবা গোপন বিশ্বস্ত বন্ধু। নারী পুরুষের এই ধরনের অনুভূতির সত্যতা মানুষ একগামিতা দিয়ে বিচার করে। ওকে একেবারে পেয়ে ফেলার কোনো ইচ্ছে আমার কখনোই হয়নি, অতএব একে প্রেম না বললাম। ওর বিয়ে হয়েছে ভালোই হয়েছে তা না হলে কখন কোন দাবি দাওয়া নিয়ে হাজির হতো বলা যায় না। এই যে বিয়ে করে ফেলল যে কোন দিন চলে যাবে অস্ট্রেলিয়া তাতে আমার আনন্দই হয়। হ্যাঁ, কাছাকাছি থাকে বলে এখনো একটা প্রক্সিমিটি এফেক্ট কাজ করে, যেমন হুটহাট ছুঁতে ইচ্ছে করে, ওর নির্লিপ্ততা আমাকে কষ্ট দেয় সেটাকে আমার অনুরক্তিতে আনা পর্যন্ত আমার সব উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পেতে থাকা জিনিস না পেতে থাকলে, আর পাওয়া যাবে না এই ভাবনা মাঝেমাঝে তৃষাকে একটা বিশাল স্থানে বসিয়ে দেয়। ওকে ছাড়া তখন আমার হা পিত্যেশ আসে। না না, একে ভালোবাসা বলা যায় না কোনো যুক্তিতেই। আমার প্রতি নির্ভরশীল হতে থাকা তৃষাকে যে আমার একদম সহ্য হয় না। লতার মতো একটা ঝুঁকে থাকা মেয়ে মানেই নিবেশ পথকে রুদ্ধ করতে থাকা একজন শত্রু তৈরি করা, যে চাইবে সকল ভোজ শুধু তার কাছ থেকেই হতে হবে। মনোগামী ভোজনকারীর অন্তত আর্ট হয় না।

আবার আসা যাক চোখের ভোজ প্রসঙ্গে। আজ রোদ বেশি বলে ভারী পর্দাটা টানিয়ে দিয়েছে। পর্দাটার দিকে তাকালেই মনে পড়ে রুপা আপার কথা। একটা জুনিয়র আর্টিস্টের বড় বোন, ওর সাথেই আসত রোজ। এই নাটকের আগের নাটকে এই ফ্লোরেই কাজ করতে হয়েছে আমাদের। তখন এই পর্দাটা সরানোর আগেই তার পায়ের শব্দে আমি এখান থেকে পেছনে ফিরে তাকাতাম। রুপা আপার অসাধারণ সৌন্দর্য যেন মহাকাশের কালো শূন্যতা ছাপিয়ে প্রথম সূর্যের আলোর মতো আমার চোখে এসে পড়ত। টানা চোখ, গোলাপি ঠোঁট কালো চুল আর অস্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা, মোনালিসার মতো মৃদুহাসি, উফ। রুপা আপার কাছে যেতেই আমার গলা শুকিয়ে আসত। এটাকে ঘোর বলা যেতে পারে। আমি যখন রুপা আপার রূপের চারপাশে পোকা মাকড়ের মতো ঘুরছি তখন আবার এলো ন্যান্সি। অন্য ফ্লোরে কাজ করে ও, তবে প্রায়ই আমার সাথে গল্প করতে চলে আসত। স্ট্রাগলারদের কৌশল বুঝি আমি, তবে আমার দরকার ছিল নিবেশ। ন্যান্সির হলুদ মসৃণ পা লম্বা করে মেলে রাখত আমার সামনে, সোজা চুলগুলো মুখের ওপর চলে আসত। তখন তৃষাকে কাজ ছাড়া আমার মনেই পড়ত না বিশেষ। স্বার্থপর বললে বলতে পারেন। আমার স্বার্থ হচ্ছে আর্ট। তৃষাকে কোনো একদিন একটা নির্দোষ চুমু খেতে খেতে বুঝিয়ে বলেছিলাম কথাটা। বুঝেছিল হয়তো।

নাটক শেষ হতেই একসাথেই রুপা আপা চোখের আড়াল হয়ে গেল আর ন্যান্সি পেয়ে গেল বিগ বাজেট অফার। একটা মোবাইলে যেচে মেয়েদের সাথে যোগাযোগ আমার আসে না। প্রকৃতি যে ভোজের ব্যবস্থা করবে একজন সত্যিকারের আর্টিস্ট তার ওপরই আস্থা রাখবে। তাই বারবার ঘুরে ফিরে আসে তৃষা।

এখন বর্ষাকাল। মাঝেমাঝেই ঝড়ো হাওয়া আসে। কারেন্ট চলে যায়। সবাই সেটের কালো পর্দা খুলে দরজায় এসে দাঁড়াই। বাতাসে নারকেল গাছ নুয়ে পড়তে চায়। এমন সময় তৃষা ছাড়া আর নারী কই যার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো যাবে?

বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন,তেজগাঁ
সকাল নয়টা
৯ জুলাই ২০১৯

ওই তৃষা এত দেরি করছোছ কেন? নিজেই যদি কল টাইমের পরে আসো তাইলে তুমি কি বালের সেকেন্ড এ ডি হইছো?
দেখতাছো না আমি পাঠাওয়ের বাইকে আসছি। এত জ্যাম! আমি রেগুলার দেরি করি? রুশো, ঝামেলা করবা না সকাল সকাল।
হইছে যা আগে ক্যারেকটার কলশিট কনফার্ম কর, কস্টিউম দেখ, সবাই আইসা বইসা আছি, খালি ম্যাডাম লেট।

চিৎকারে রুশোর গলার রগ ফুলে যাচ্ছে। শুধু তৃষা না আজ প্রোডাকশনের সবার ওপরই ঝড় গেছে। কাজের চাপ থাকলে রুশোর হুঁশ থাকে না। এর মধ্যে আজ সকালেই চলে এসেছেন নোমানুর নোমান। এ নেই সে নেই। কী একটা বাজে অবস্থা।

তৃষা মুখ কালো করে মেকআপ রুমে আর্টিস্টদের কস্টিউম চেক করছে। এই রুমে এসি আছে বলে সিনিয়র আর্টিস্টসহ অনেকে বসে থাকে। একজন বয়স্ক লোক বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছেন অথচ মেয়ে আর্টিস্টদের শাড়ি পরা বাকি। উনাকে কিভাবে ওঠাতে হবে না বুঝে তৃষা বাইরে যায়।
এই রুশো! রুশো।
কী? তর এখন আবার হইছে কী?
রুশো মুখে রুটির টুকরা নিয়ে কথাটা মনিটর টেবিল থেকেই বলল। কাছে গিয়ে তৃষা দেখল সেখানে নোমানুর নোমানও নাশতা করছেন। রুশোর মুখে খাবার দেখে তৃষার আরো রাগ লাগছে। নিজের খাওয়াটাই বোঝে, কী বিশ্রী স্বার্থপর একটা ছেলে রুশো! সে নোমানুর নোমানের সামনেই বলে ফেলল, কাজ করব কিভাবে দাদা? এই বয়স্ক লোকটা কে মেকআপ রুমে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। মেয়েরা তো চেঞ্জ করবে। ইজি ফিল করতেছে না।
নোমানুর নোমান খাওয়া থামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, উনি কে জানো না? এই নাটকের নাট্যকার। একসময়ের জনপ্রিয় লেখক আবু রায়হান হায়দার।
তৃষা হা করে বলল, দাদা উনি আবু রায়হান হায়দার? হঠাৎ চিনতে পারিনি। ফেসবুকে আরো একটু কম বয়সী দেখায় না?
রুশো ডিমটা মুখের সামনে ধরে বলল, ফেসবুক হচ্ছে তারার আলো। কোটি কোটি আলোকবর্ষ পরেরটা আমরা দেখতে পাই। হা হা।

হাসি চাপতে গিয়ে নোমানুর নোমানের শরীর কেঁপে উঠল। তিনি নিজেকে সংযত করে বললেন, আস্তে বলো। উনার মেয়ে আছেন সেটের কোথাও। আর উনি ঘুমাচ্ছেন না উনার ন্যাক্রোলেপসি আছে। হঠাৎ হাত পা কলাপস হয়ে যায়।
তৃষা ফিসফিস করে বলল, ফেসবুকে যা রগচটা দাদা। এই আনফ্রেন্ড করছেন, একে ওকে গালাগাল করছেন। আমি উনার ফ্রেন্ডলিস্টে ছিলাম। কেন জানি আমাকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছিল।
ইন টলারেন্স আছে উনার। বাদ দাও এখন। সবাই সাবধান আজ সকালে উঠেই নাকি তিনি গো ধরেছেন সেটে আসবেন। তার গল্পের কী বারোটা বাজানো হচ্ছে তা দেখবেন। যাই হোক নাশতা তাড়াতাড়ি সেরে ফেল। সিন ওঠাব এখন।

..................

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/06/1565094720140.jpg

সকাল দশটা বাজে। তৃষা তার কাজ তাড়াতাড়ি সেরে একটা রুটি জোর করে গিলে ঠিক সেটের সামনে রেডি হয়ে বসে আছে। কালো পর্দাটা ভালোভাবে টেনে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চাশ জনের বেশি মানুষ ফ্লোরটাতে কিন্তু পিনপতন নীরবতা। নোমানুর নোমানের হাতের সিগারেটের আগুন অন্ধকারে ওঠানামা করছে। আবু রায়হান হায়দার নোমানুর নোমান ও রুশোর সাথে মনিটরের সামনে বসে আছেন। একমাথা কাঁচা পাকা চুল, ভারী চশমা, হাতে একটা লাঠি। নাক বন্ধ হয়ে থাকা বাচ্চাদের মতো তার ঠোঁট দুটো খোলা। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না এমনভাবে তিনি কিছুক্ষণ সেটের দিকে দেখছেন, কিছুক্ষণ দেখছেন মনিটর স্ক্রিনের দিকে। পজিশন বুঝে নিয়ে মাইকে রুশো বলল, অল কোয়া-ইট। রোল ক্যামেরা। নোমানুর নোমান বললেন, একশন।

সেটে অদিতি ও আরিফ অভিনয় করছে। এসময়ের সেরা জুটি। অভিনয়েও সেরা। একটা দুটা সংলাপ বলার পরই আবু রায়হান হায়দার কী যেন বিড়বিড় করে উঠলেন। রুশো তার মুখের কাছে কান নিয়েও কিছু শুনতে পেল না। কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। রুশো বুঝতে পারল ভদ্রলোকের বাঁ-পাশে প্যারালাইসিস জাতীয় কিছু হয়েছে। তাই জিভ অসাড়। সেট থেকে আসা আলোতে রুশো তার মুখের দিকে ভালোভাবে তাকাল। আহা! স্যোশাল সাইটে বীরযোদ্ধার মতো শব্দের অস্ত্র নিয়ে তৈরিই থাকেন যিনি সরাসরি কতটা অথর্ব, অসহায়। আবু রায়হান হায়দার তার হাতের লাঠির ওপর সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়ালেন। রুশো তাকে ধরতে গেলেই জড়ানো গলায় বললেন, ছোঁ...বে না...। মেকআপ রুম থেকে তার মেয়ে চলে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে চেষ্টা করল। সমস্যা বুঝে নোমানুর নোমান উঠে বললেন, কাট।

রুশো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কালো পর্দাটা সরিয়ে ফ্লোরের বাইরে এসে দাঁড়াল। পেছনে তৃষাও এলো।
কী হইছে রুশো?
বুড়ার রাগ হইতাছে বুঝস না। কী ছাইপাশ বানাইতাছি আমরা। হা হা হা।
তৃষা বলল, রুশো এভাবে বুড়া বলবা না। আমি কিন্তু আসলেই উনার ফ্যান।
রুশো বলল, তুই তো আমারও ফ্যান।
কইসে?
কইসে কী? চল আজ দুইজনে রন্টির ফ্লাটে যাই।
কেন তুমি আমার লগে মাগনা চার্ম নিবা? ভাবছো বিয়া হইয়া গেছে এখন আর ঝুট ঝামেলা নাই। কইবা আর ফ্লাটে দৌড় দিব?
রাখ তোর বিয়া। এইসব বিয়া ফিয়া ফালতু। আমিও তো বিয়া করমু, তখন তুই যদি আমাকে কোনো ফ্লাটে নিয়ে যাইতে চাস। আমি যামু। হাহা।
রুশো হাসছে।
যদিও রুশোর সাথে আর কোথাও যাওয়ার প্রশ্ন আসে না তবুও স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তৃষা নিজেকে যুক্তি দেখাচ্ছে কেন সে রুশোর সাথে যাবে না। তার প্রথম যুক্তি, সে তো রুশোর কাছে কিছুই চায় না তবু সে যে তার প্রেমিকা না ব্যাপারটার গতকাল বিকেলেও একটা প্রকট চুমু খাওয়ার মাঝখানে রুশো বুঝিয়ে দিয়েছে, এই ব্যাপারটা বারবার বুঝিয়ে দেওয়ার মধ্যে একটা স্পষ্ট অপমান আছে। দুই, কখন তৃষা রুশোর সাথে রোমান্সে জড়াবে তা রুশোই নির্ধারণ করে। কোনো একজনের সিদ্ধান্তে যখন কোনো সম্পর্কের গতি নির্দিষ্ট হয় তবে তা দাস প্রথার মতো জঘন্য একটা সম্পর্ক।

রুশো তৃষার হাত ধরে ফ্লোরের পিছের চাপা গলিটাতে গিয়ে একটা সিগারেট জ্বালাল এবং তৃষাও ঝটপট নিজের প্যাকেট বের করে তা থেকে আগুন নিল। কয়েক টান দিয়ে তৃষা বলল, যাব না।
রুশো আবার তৃষার কোমরে হাত দিয়ে কাছে টেনে নিতে নিতে বলল, চল না রে রন্টির ফ্লাটে। তৃষা হেসে ফেলে বলল, একটু বেশি বোল্ড হইয়া গেছো মনে হয়। নাকি আর কাউরে পাইতাছো না?
অন্যদের দিয়া তোর কী কাজ? আমি কি তোর জামাইর কথা জিজ্ঞেস করছি?
তৃষা এক এক করে স্তনের দিকে এগিয়ে যাওয়া রুশোর আঙুলগুলো ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, আসলে যাব না এই জন্য যে, তোমার সাথে ফাউ রোমান্স মারানোর বিগার উঠে নাই আমার?
আরে হইছে কি?
তৃষা দ্রুত সিগারেটটা শেষ করে গলিটা থেকে বের হতেই দেখে ফ্লোরের দরজার নোমানুর নোমান দাঁড়িয়ে আছেন। রুশোও বের হয়ে আসে পিছে পিছে। রুশো তার সিগারেটসহ হাতটা পিছে ধরে রেখে জিজ্ঞেস করল, দাদা। শুটিং কি হবে না?
হবে। উনি চলে যাচ্ছেন। আমাকে কিছুটা পছন্দ করেন বলেই অভিনেতা অভিনেত্রীদের ওপর গেছে। হাহা।
তৃষার মনে হলো, লম্বা চউড়া ছাতির নোমানুর নোমানের হাতে বাদামি স্লিম সিগারেটটা ঠিক পর্যাপ্ত না আর তাই বুঝি উনি চেইন স্মোকার হয়ে উঠেছেন।
রুশো বলল, আচ্ছা দাদা এত এরোগ্যান্সি কেন বেডার? স্ট্রোকের রোগী তাই এত তেজ।
নোমানুর নোমান এক মুখ ধোঁয়া আকাশের দিকে উড়িয়ে দিয়ে তার দুই ভ্রুর মাঝখানটা স্পর্শ করে বললেন, প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্স নিয়ে কাজ করা লোক এরা। মূল কল্পনা কিন্তু এদেরই। আমরা কাজ করি পরের ধাপে। বেডা ফেডা বলো কিভাবে?
রুশো ‘সরি দাদা’ বলে মুখ নিচু করল।
তৃষা বাঁকা হাসি হেসে ফ্লোরের ভেতরে পা বাড়াল।

আবু রায়হান হায়দার
স্মৃতি মহল, বনানী
সকাল ১০টা
১০ জুলাই ২০১৯

এক প্রস্থ কাপড় দিয়ে এক কাঁধ আর নিম্নভাগ ঢাকা, মাথায় পপি ফুলের মালা, লালচে কোঁকড়ানো চুল। সোনালি রঙের পেয়ালা থেকে সবসময় কিছু পানরত সোমনাস। হ্যাঁ, সবসময় এভাবেই সোমনাস আসে আমার কাছে। মাঝেমাঝে সাথে থাকে ওর ন্যাতানো ছেলেটা, অই যে মরফিউস না কী ছাই নাম। ব্যাটা যতটুকু সময় থাকে বারান্দায় শরীর এলিয়েই পড়ে থাকে। জিভের অসাড়তা থাকা সত্ত্বেও সোমনাস আমার সব কথা বোঝে। আমি তাকে স্পষ্টভাবে বললাম, সোমনাস, এই সকালেই আমি তোমাকে দেখতে চাইনি। লোপা নাশতার টেবিল থেকে ডাকছে।
এই পৃথিবীতে আমাদের সকল ঋণ পরিশোধ করে যেতে হয় হায়দার, এমনকি ঘুমেরও। তোমার ঘুমের হিসেবটা আমার কাছে আছে। অনেক বাকি আছে, দেখাব?
সোমনাস তার কোমরে জড়ানো কাপড়ের গিট থেকে একটা কাগজ বের করল।
ধুর! এসব দেখতে চাই না এখন।
আমি উঠে দাড়াতেই সোমনাস দৌড়ে এসে আমাকে চেপে ধরেছে। শালার শক্তি কম না। আমাকে কোথায় যেন তলিয়ে নিয়ে যায়। কিছুই মনে থাকে না।

চোখ খুলতেই দেখি লোপা ঝুঁকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সোমনাসের অত্যাচারে শরীর মন হঠাৎ এমন অচেতন হয়ে যায় অনেকদিন ধরেই। তবু লোপা প্রতিবার দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়! বাবা তো! নিজের অংশটা আসলে কেউই হারাতে চায় না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোপাকে ধরে উঠে দাঁড়াই। নাশতা করতে হবে।

নাশতায় কীসব ওটস ডিমের সাদা অংশ একবাটি মশলা ছাড়া সবজি। গেলা শেষ হতেই লোপা এক এক করে রাজ্যের ঔষধ আমার মুখে পুরে দেয়। অসহায় গাছের মতো আমি আবার হা করে গিলে নিই।
বাবা চলো তোমার ঘরে যাই।
না...
এখানে বাতাস কম তোমার সাফোকেশন হবে।
খ...ব...র দে...খ...ব।

খবর বেশিক্ষণ দেখা যায় না। কাপুরুষ জনগণ, জঘন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা, শুধু হত্যা, অন্যায় আর তেলবাজী। অযোগ্য লোকে দুনিয়া সয়লাব। রাগে আমার গা জ্বলে যায়। রিমোটটা ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।
লো...পা...
কী হয়েছে বাবা! বলেছিলাম খবর দেখার দরকার নেই। না তুমি দেখবেই আর প্রেশার হাই করে ফেলবে। চলো।
লোপা জোর করে আমাকে আবার শোবার রুমে নিয়ে যায়। সোমনাস কাঁধ থেকে কাপড়টা একটু খুলে রেখেছে। ঠিক ফ্যান বরাবর সে এখন আরাম কেদারায় বসে আছে। বাতাস তার মাথার পপি ফুলের পাপড়ি চুইয়ে আমার নাক ছুঁয়ে যাচ্ছে। সকালেই আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছি আমি! আমাকে ঘুমের দিকে এগুতে দেখে সোমনাস তার হিসাবের কাগজে কিছু একটা টুকে রাখতে চাচ্ছে। সে কলম খুঁজে পাচ্ছে না। আমি কোনোরকম নিজেকে জাগ্রত রেখে বললাম, খুন করে ফেলব তোমাকে সোমনাস।
লোপা আবার শোবার রুমে ঢুকে বলল, গোঙাচ্ছো কেন বাবা?
সো...ম...না...স। আমা...কে... ঘু...ম পাড়া...য়।
আবার সোমনাসকে দেখছো? বাবা তোমাকে হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ দেয়া হয় তাই তুমি ঘুমাও। গ্রিক মিথোলজির দেবতাদের তো আর খেয়ে কাজ নেই তোমাকে ঘুম পাড়াতে আসবে? এইসব হ্যালুসিনেশন তুমি বোঝো না? সত্যি করে বলো তো বাবা আমি সরে গেলে কি ঔষধ মাঝেমাঝে মুখ থেকে ফেলে দাও?
যা… তু…ই…।
না যাব না। অনেক হয়েছে আজ তুমি সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যাবে আমার সাথে।

মায়ের মতো মুণ্ডহীন গর্দভ হয়েছে। বাকযন্ত্রের অসাড়তা দিয়ে আমাকে বিচার করছে। আমাকে হ্যালুসিনেশন শেখাচ্ছে। লোপা বালিশটা ঠিক করে দিতে দিতে আবার বলল, বাবা অনেক হয়েছে আর পারি না, শান্ত হয়ে ঘুমাও তো।

আহ সে আর পারছে না। এই আমড়া গাছটাকে এই জন্যই এর জামাই আর নিচ্ছে না। আমারটা খেয়ে পড়ে আমাকে নিয়েই আর পারছেন না মা ভগবতী। ইচ্ছে করছে ধাক্কা দিয়ে একে ঘর থেকে বের করে দিই। আমি বিছানার পাশে ফুলদানীটা নিচে ফেলে দিলাম। একটুর জন্য ওর পায়ে লাগেনি। লোপা নাটকিপনা করে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে গেছে। যাক। কোলাহল শুনে সোমনাসের রোগা ছেলেটা মরফিউস না কী ছাই নাম, সে বারান্দা থেকে এসে দাঁড়িয়েছে। সোমনাস একে একে পপি ফুলগুলোর পাপড়ি ছাড়াচ্ছে। ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে, বাইরে থেকেও কিছু বাতাস এসে তাল দিচ্ছে, তার সাথে উড়ছে পাপড়িগুলো। চোখ বুজে আসছে।

রুশো
মোহাম্মদপুর পি সি কালচার হাউজিং
রাত এগারোটা
১৫ জুলাই ২০১৯

আমি আমার সৎ বাবা ইয়াসের খানের জুতোয় কালি করে দিচ্ছি। আমার আসল মায়ের সাহস নেই কাজ শেষ হবার মাঝখানে আমাকে ভাত খেতে নিয়ে যায়। তিনি পুরনো পর্দা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। কালি করা কেমন হচ্ছে সৎ বাবা চশমা ফাঁক দিয়ে তা যাচাই করছেন।

চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করলেও আমি মিষ্টি হাসি দিই। এই বাসায় রাগ দেখানোর ক্ষমতা একমাত্র আমার সৎ বাবার। কেননা আমি এই সংসারে এক পাইও দিই না। আমার কামাই সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। টাকাগুলো আমি ব্যাংকে জমাচ্ছি নিজের ডিরেকশনে একটা ফিল্ম করব এই আশায়। একবেলা যাই খাই বা না খাই রাতে ফ্রিতে শুতে পাই বলে লোকটা সারাদিনের জমানো কাজ করায়। কল ঠিক করায়, মশারির পেরেক লাগায়, টিভির জ্যাক ঠিক করায়, আমার ছুটির দিনে তার ছেলেমেয়ে দুটোকে অংক করায়, বাজার করায়। মাঝে মাঝে কিছু না পেলে এভাবে জুতা পলিস করায়। আমি করে দিই। আমি তো দা মারসান সিনেমার নায়ক মার্ক ওয়াটনি, কত প্রতিকূল অবস্থায় আমি জীবনের গান আমি গেয়েই যাচ্ছি, অক্সিজেনহীন মঙ্গলের বুকে গাছ লাগিয়েছি, পানির ব্যবস্থা করেছি আরো কত প্রতিকূলতা সহ্য করেছি। আর তো কদিন, এই তো উদ্ধারকারী রকেট এলো বলে। আর তো কদিন, আমি এই জীবনের মাধ্যাকর্ষণ পার করে দ্বিতীয় জীবনে চলে যাব।

তৃষা
নিকুঞ্জ ১২
বিকেল চারটা
১৬ জুলাই,২০১৯

শুটিং সেটের কাজ শেষ হতে হতে বৃষ্টিও শেষ। সকল উর্বরতা এখন বেখাপ্পা। সূর্য উঠলে মূল জীবনে ফিরতেই হয়। কত জরুরি বিষয় থাকে মূল জীবনে। এখন বাচ্চা হলে আমার অস্ট্রেলিয়া যাওয়া নিয়ে ঝামেলা হবে তাই গত পরশু রুবিনার কথা অনুযায়ী এম এম কিট কিনে খেতে হয়েছে। আজ ভোরে হাই কমোডে বসতেই জমাট ভ্রুণটা কিছু বের হয়েছে, রক্তপাত শুরু হতেই হতেই খেয়াল করলাম তেলাপোকার ঔষধও কাজ করেছে। ফ্লোর জুড়ে পড়ে রয়েছে মৃত তেলাপোকার দল। ডেটল, ফিনাইল, মসকিউতো কিলারও সমান তালে ব্যবহার করছি। কোনো খুদে জীবন আর উসকে উঠতে দিব না। এসবের পাশাপাশি রোজই রুশোর প্রতি অনুভূতিটাও হাতড়ে দেখছি। সুসংবাদ এই যে, তাও মৃতপ্রায়।

দু একদিনের মধ্যে মা চলে আসবেন। বিপিনের বাসা থেকেও কয়েকজন আসার কথা। তাই আমি বসে নেই। এখন সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে রেলিংয়ের নিচের দেয়ালের শ্যাওলাগুলো তুলে ফেলছি। সিগারেটটা এই মুহূর্তে একটা ঠোঁটের মতো লাগছে না। ফ্রয়েড ঠিকই বলেছেন, কখনো কখনো সিগারেট কেবল একটি সিগারেটই হয়ে ওঠে।

আবু রায়হান হায়দার
স্মৃতি মহল, বনানী
বিকেল চারটা
১৬ জুলাই ২০১৯

আজ বিকেলে সোমনাস আসেনি বলে পিসিতে বসতে পারলাম। আহ ফেসবুক! এখানে আমি পুরোদমে একজন সক্রিয় মানুষ। এখানে কথা বলতে জিভ লাগে না, ঘুরে বেড়াতে লাঠির ওপর ভর দিতে হয় না। তবে সমস্যা, ছাতার মতো বেড়ে ওঠা পত্রিকা, সম্পাদক আর ক্লীব কবি-লেখক নামক পাতি সেলিব্রেটিদের নিয়ে। এদের একদম সহ্য করতে পারি না। এইতো একটা স্ক্রিনশট রেডি করেছি। পোস্ট করব বলে। একটা পা চাটা, নির্লজ্জ ভণ্ডের মুখোশ খুলব আজ।

আমি পুছি না। এইসব কু তার্কিক পাঠা, সেলিব্রেটি ছাগল, গ্রুপ করা গরু-গাধা, ধর্মান্ধ অশ্বডিম্বের দলকে আমি একদম পুছি না। খুব বেশি সময় তো নেই। সোমনাস আসতে আসতে আগাছাগুলোকে ছেঁটে নিতে হবে। আমার আঙিনা অযোগ্যদের জন্য নয়।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;