আপনি যা ভাবেন একটা গানের অর্থ সে রকম নাও হতে পারে - পিট সিগার



অনুবাদ | রহমান রাহিম
পিট সিগার (১৯১৯-২০১৪)

পিট সিগার (১৯১৯-২০১৪)

  • Font increase
  • Font Decrease

পিট সিগার ছিলেন একজন বিখ্যাত মার্কিন লোকসংগীত শিল্পী। শুধু আমেরিকান লোকসংগীত নয়, বিশ্ব লোকসংগীতের সাথেই তাঁর ছিল এক নিবিড় সংযোগ। গীতিকার এবং বাদক হিসেবেও তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ১৯৬৩ সালে লোকসংগীত নিয়ে রেডিও নিউইয়র্কে এ্যালান ওয়াসারকে দেওয়া তাঁর বিখ্যাত ইন্টারভিউটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন রায়হান রহমান রাহি

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jan/03/1546508180161.jpg

এ্যালান ওয়াসার : অবশ্যই যে প্রশ্নটা প্রথমে করব, সেটি হলো আপনার কাছে লোকসংগীতের সংজ্ঞা কী?

পিট সিগার : সংজ্ঞা বিষয়টাই এমন যে এটি ব্যক্তি বিশেষে আলাদা আলাদা রকম হয়। একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় দুজন মানুষ একমত হবে না সম্ভবত এই ব্যাপারটিই সবচেয়ে স্বাভাবিক।
একটা সময় ছিল, যখন ঔপনিবেশিক প্রাচুর্য চারদিকে গম গম করত। ইউরোপীয় মধ্যযুগের দিকেই তাকালে দেখবেন সংগীত ছিল সেই প্রাচুর্যের ঘেরাটোপে আবৃত এক শিল্প-বিশেষ। সম্রাট-সম্রাজ্ঞীরা নিজ খরচে রাজপ্রাসাদে একদল সংগীতজ্ঞকে ভরণপোষণ করছেন আর তাঁরা সিম্ফোনি অর্কেষ্ট্রা সহযোগে সংগীতকে দিচ্ছেন নতুন এক মাত্রা । ধ্রুপদী সংগীত বলতে আমরা যে বিষয়টি বুঝি, রাজ দরবারগুলোতে মূলত সেটির চর্চাই হতো।
এ তো গেল রাজা রাজরাদের আলাপ, কিন্তু সাধারণ দাস শ্রেণীর মানুষদের এমন প্রাচুর্য ছিল না যে তারা সংগীত সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য আর্থিকভাবে কাউকে কিছু দিতে পারবে। ফলে, নিজেদের মনের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেরাই নিজেদের জন্য গান বাঁধত। সেই সকল দাস শ্রেণীর মানুষদের নিজস্ব যে গান, আমার ধারণা সেটিই ‘লোকসংগীত’।
একটা কথা খুব চালু জানেন কিনা জানি না। কেউ কেউ বলেন আমেরিকায় কোনো লোকসংগীত নাকি পাবেন না, কারণ ওই সাধারণ দাস শ্রেণীর লোক আমেরিকায় ছিল না কোনোদিন।
কিন্তু, মজার বিষয় হলো হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ কিন্তু এখানে রয়েছেন যারা ওই পুরনো ঘরানার বেহালার সুর, ব্যালাড, ব্যাঞ্জোর সুর, গিটারে ব্লুজ বাজনা, আধ্যাত্মিক বন্দনাগীতিগুলো দারুন পছন্দ করেন এবং এখনো অবধি ওইগুলোকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন। তারা ওই গান, সুরগুলোকে না পারলেন কোনো শৈল্পিক সংগীত স্তরে স্থান দিতে, না এগুলো জ্যাজ বা অন্যান্য জনপ্রিয় ধারার মতো জনপ্রিয় কোনো ধারা। শেষমেষ তারা বললেন কী—‘চলো ভাই এর তো একটা নাম দেওয়া চাই। এর নাম আজ থেকে লোকসংগীত। ব্যস!

কিন্তু যা বললাম, সংজ্ঞায় দুজন মানুষ কখনো সব মিলিয়ে একমত হবেন না সেটিই স্বাভাবিক। সুতরাং আমি ব্যক্তিগতভাবে এ নিয়ে বিতর্কের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এটা আমার কাছে অনেকটা বিয়ারের সংজ্ঞায়ন করার মতোই। আমেরিকানদের কাছে ব্রিটিশ বিয়ার এবং ব্রিটিশদের কাছে আমেরিকান বিয়ার বিস্বাদ লাগবে এটাই চিরায়ত। এ নিয়ে ন্যূনতম কোনো বিতর্কিত পরিস্থিতি তৈরি হোক, অন্তত আমি তা কখনোই চাইনি।

এ্যালান ওয়াসার : একেবারে প্রথম কবে, কেমন করে লোকসংগীতের প্রতি আপনার উৎসাহ সৃষ্টি হয়?

পিট সিগার : ১৯৩৫ সালের দিকে আমার বয়স ছিল ১৬ বছর। বাবা ছিলেন সংগীতত্ত্বের একজন অধ্যাপক, তিনি আমাকে নর্থ ক্যারোলিনার একটা স্কয়ার ডান্স ফেস্টিভলে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তখনই আমি প্রথম আবিষ্কার করি আমার দেশেরই এমন এক সংগীত-ভাণ্ডার রয়েছে যা কখনো রেডিওতে কিংবা থিয়েটারে বাজানো হয় না। মনে আছে সেবারই আমি সেই সঙ্গীতের প্রেমে পড়ি। আর উঁচু ঘাড়ওয়ালা ব্যাঞ্জোর প্রতি ভালো লাগাও ঠিক তখন থেকেই। ব্যাঞ্জো মূলত আফ্রিকান একটি যন্ত্র। পরে দক্ষিণ ঔপনিবেশিক অঞ্চলের দাসেরা ব্যাঞ্জো বাজানোর নতুন কৌশল আবিষ্কার করে যেটা ছিল অনেকটা অর্ধেক ইউরোপীয়, অর্ধেক আফ্রিকান ধাঁচের।
১৮৩০ সালের দিকে সাদা মানুষেরা ব্যাঞ্জোর প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং আমেরিকায় ব্যাঞ্জো এমনভাবে সাড়া তৈরি করেছিল যেটা একশো বছর পর রক এন্ড রোল মিউজিক করেছে।
ব্যাঞ্জো ছিল না কোথায়? সবখানেই এর দারুণ জয়জয়কার! কেউ চাইলে নিজেই নিজের জন্য ব্যাঞ্জো বানাতে পারত। জনপ্রিয়তার এমনই অবস্থা, ততদিনে পশ্চিমের লোকজনের হাতেও ব্যাঞ্জো পৌঁছে গিয়েছিল।

এরপরই জনপ্রিয় সংগীত ধারার স্বাভাবিক পরিবর্তনের রীতি অনুসারে ব্যাঞ্জোর চল চলে যায়। ১৯৩০ সালে আমার তখন কৈশোর, মন চাইল আমি ব্যাঞ্জো বাজানো শিখব। কিন্তু শিখব কই? শেখা তো যায় একমাত্র পাহাড়ে। মনে আছে, স্কুলে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে আমি দু’বছর কেবল ইতিউতি ঘুরে ফিরেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম। সে সময়টায় ব্যাঞ্জো বাজাতে পারে এমন কৃষকের দেখা পেলেই হলো, আমি তার কাছে ব্যাঞ্জো বাজানোর একটা দুটো কৌশল শিখে নিতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছি। এমন করেই আস্তে ধীরে একদিন ব্যাঞ্জো বাজানো শিখে গিয়েছিলাম।

এ্যালান ওয়াসার : তারপর? সেখান থেকে?

পিট সিগার : মজার বিষয় হলো, এটা যে আমার জীবিকা নির্বাহের উপায় হবে আমি কখনোই তা ভেবে চিন্তে ঠিক করে রাখিনি। ছোটবেলায় আমি একজন সাংবাদিক হতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু এ ধরনের কোনো কাজই পেলাম না। এক সম্পাদকের কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু এ জাতীয় কাজ করবার কোনো সাধারণ অভিজ্ঞতাটুকুও আমার ছিল না।
তাই চিন্তাধারায় একটা পরিবর্তন আনলাম। তখুনি বিভিন্ন স্কুল, সামার ক্যাম্প ধরনের জায়গাগুলোতে আমি গান গাইতে শুরু করি। ধীরে ধীরে সেই স্কুলের বাচ্চাগুলি কলেজে যেতে শুরু করে। এরপর কলেজ থেকেও গান গাইবার জন্য ডাক আসতে শুরু হয়।
দেখছিলাম, কেমন করে চোখের সামনেই এই বিষয়টার একটা কমার্শিয়াল ফিল্ড ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। অদেত্তা, বেনেট-রিচার্ড ডায়ার, কিংস্টন ট্রায়োসহ শত শত পারফর্মার ছিলেন, যারা অনেক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আয়োজিত কনসার্টে ডাক পেয়ে সেখানে গান শুনিয়ে দর্শকের মন জিতে নিয়েছেন।

শেষম্যাশ কলেজের শিক্ষার্থীরাও বুঝতে পেরেছিলেন যে—আমাদেক কান্ট্রি পিপলরা লোকসংগীত বিষয়টি ভালোমতো মনে ধারণ করেন, গাইতে পারেন। আমার জন্য এটিই ছিল সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।

এ্যালান ওয়াসার : বিখ্যাত লোকসংগীত গায়ক লিড বেল্লি-র সাথেও তো আপনার পরিচয় ছিল।

পিট সিগার : হ্যাঁ। পেশাদার হিসেবে নিজেকে চিন্তা করবার সময়টায় আমি তাঁকে আমার শিক্ষক হিসেবেই ভেবেছি, যদিও তিনি এ বিষয়টি সম্পর্কে জানতেন না। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, আমি কত মনোযোগ দিয়ে তাঁর বাজানো দেখতাম!
একবার একজন আমাকে বললেন—‘পিট, তোমার তো গলার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত। একজন শিক্ষকের কাছে যাও , যিনি তোমাকে কণ্ঠ অনুশীলনে তালিম দিতে পারবেন।’ আমি তাকে বলেছিলাম—‘যদি কেউ লিড বেল্লির মতো গাইতে শেখাতে পারেন আমি তার জন্য জীবনের শেষ সঞ্চয় পর্যন্ত দিয়ে শিখতে রাজি আছি।’
বিষয়টা হলো কী জানেন তো, যখনি আপনি কণ্ঠের অনুশীলনের জন্যে কোনো শিক্ষকের কাছে যাবেন, তিনি আপনাকে গতানুগতিক রেওয়াজের তালিম দিতে শুরু করে দিবেন। যেন আপনাকে অপেরা শিল্পী হিসেবে প্রস্তুত করাই তার কাজ। মূলত সে কারণেই আমি আর ওমুখো হইনি।

লিড বেল্লি ১৯৪৯ সালে মারা গিয়েছিলেন। যেসব গান আমরা উনার থেকে শিখেছিলাম, আমার ধারণা সেগুলো আমাদের সারাজীবনই মনে থাকবে। গান করে বিরাট টাকা পয়সা কামাই করবেন এমন চিন্তা এই মানুষটার কখনোই ছিল না। আজকে যেসব তরুণ তাঁর—‘লাইক রক আইল্যান্ড লাইন’, ‘ওল্ড কটন ফিল্ডস এট হোম’, ‘মিডনাইট স্পেশাল’, ‘ব্রিং মি লিটল ওয়াটার সিলভি’—গাইছেন অন্তত তাঁদের হৃদয়ের মণিকোঠায় লিড বেল্লি চির অমর থাকবেন।
দ্য ওয়েভার্সের সাথে আমার প্রথম যে হিট রেকর্ডটি বের হয়েছিল সেটি ছিল তাঁরই গান—‘গুড নাইট আইরিন’। লোকে এখনো নিয়ম করে গানটি শুনতে চায়।

এ্যালান ওয়াসার : আপনার ওই বিখ্যাত রেকর্ডটি তবে দ্য ওয়েভার্সের সাথে?

পিট সিগার : এটা ১৯৫৫ সালের কার্নেগি হল কনসার্টের সময়কার। দ্য ওয়েভার্সের মেম্বারদের মাঝে দুজন ছিল নিউইয়র্কের একেবারে স্থানীয়। ভাইব্র্যান্ট এ্যাল্টো ভয়েস সেক্টরে ছিলেন রনি গিলবার্ট আর ফ্রেড হলারম্যান ছিলেন লো ব্যারিটোনে। আরকানসাসের যাজক লি হায়েস ছিল বেজ-এ। আমি ওদের সাথে স্প্লিট টেনর হিসেবে কাজ করতাম।

এ্যালান ওয়াসার : ‘স্প্লিট টেনর’— এই বিষয়টা কী?

পিট সিগার : আমি মাঝে মাঝে ফ্যালসেটো ধরনের সুরে, মাঝে মাঝে চড়া সুরে, সময়ে সময়ে গ্রাউলিংসহ তাঁদের সাথে গাইতাম। এখনকার যে কণ্ঠের কথা আপনারা সবাই বলেন, তখন কিন্তু আমার কণ্ঠ এমন ছিল না। গাইতে গাইতে আস্তে ধীরে কণ্ঠকে পরিণত করেছি।
দ্য ওয়েভার্সরাই প্রাথমিক অবস্থায় দেখিয়ে দিয়েছিলেন কেমন করে লোকসংগীতও শহুরে বিনোদনে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। মূলত তাঁদের দেখানো পথ ধরেই পরবর্তীতে কিংস্টন ট্রায়ো, দ্য গেটওয়ে সিংগারস-সহ বাকিরা হেঁটে গেছেন। বর্তমান সময়ে পিটার, পল-ম্যারী ওরা আছেন। তাঁরা সকলেই আমাদের বন্ধু বান্ধব। আমি যখন থেকে ওদের চিনতাম তখন ওদের বয়সই বা কত? কেবল হাইস্কুলে পড়ত সম্ভবত!

এ্যালান ওয়াসার : সত্যি! এ কারণেই সম্ভবত তাঁরা আপনাকে গুরুর মতন মান্য করেন।

পিট সিগার : গুরু! নাহ। এই সম্বোধনটা আসলে বেশ বিব্রতকর। গুরু হতে হলে সম্ভবত বেশ বুড়ো হতে হয়। আমার দাড়ি দেখুন, এখনো সব ঠিকঠাক, একটাও পাকেনি। তবে, এ কথা সত্য ইদানীং অনেকেই আমার কাছে পরামর্শ নিতে আসছেন।
আমি কোনো হোমড়া-চোমড়া ধরনের কেউ নই—চেষ্টা করি সে কথাই মানুষকে বোঝাতে। জানেন, আমি পারতপক্ষে, ছেলে মেয়েদেরও উপদেশ দিতে পছন্দ করি না যদি না তাদের সেটা দরকার লাগে। সে যাই হোক, তবুও আমার মাঝে মাঝে মোড়ল, গুরু ইত্যাদিসূচক সম্বোধন শুনতে হয়। এরচেয়ে বাজে আর কী বা হতে পারে বলুন?

এ্যালান ওয়াসার : পরিবারের কথা যেহেতু এলো, একটা কথা জিজ্ঞেস করি বরং। আপনাদের গোটা পরিবারটাই তো সম্ভবত লোকসংগীতের চর্চা করছে, তাই না?

পিট সিগার : আমার বাবা দুই বিয়ে করেছিলেন। আমি প্রথম পক্ষের সবচেয়ে ছোট সন্তান। মাইকেল সিগার এবং পিগি সিগার ছিলেন দ্বিতীয় পক্ষের বড় দুই সন্তান। তাঁরা দুজনই অসম্ভব গুণী সংগীতজ্ঞ। আমি আমার জীবনে যে কয়জন সেরা বাদক দেখেছি মাইক তাঁদের অন্যতম। পিগির কথা নতুন করে কী আর বলব? ব্যালাডে ওর মতন দক্ষ গায়িকা খুব কমই দেখেছি।
পিগি সদ্যই বিয়ে করেছে ইবান ম্যাককলকে। তিনিও একজন ব্রিটিশ লোকসংগীত গায়ক।
আমার তিনটি সন্তান আছে। আমি, আমার স্ত্রী এবং বাচ্চারা মিলে পরিকল্পনা করেছি এই গ্রীষ্মে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াব। হয়তো কোনো দেশে আমাদের গান শুনেছে এমন কাউকে পেলেও পেয়ে যেতে পারি।

এ্যালান ওয়াসার : কোন কোন দেশে ঘুরবার পরিকল্পনা আছে যদি একটু জানাতেন।

পিট সিগার : সেপ্টেম্বর মাসটা অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে কাটাব। অক্টোবর নভেম্বরের দিকে জাপানে থাকার কথা। এর মাঝে বিরতি কোথায় নেব তা এখনো ঠিক হয়নি। তবে ডিসেম্বরের দিকে ভারতের দিকে যাব এ সমন্ধে নিশ্চিত। জানুয়ারিতে আফ্রিকার বেশ ক’টা দেশে এবং ফেব্রুয়ারিতে ইতালির দিকে যাত্রা করব। এরপর মার্চ, এপ্রিল, মে-র দিকে ইউরোপের বাকি দেশগুলো ঘোরার ইচ্ছে আছে। দেখি কী হয়!

এ্যালান ওয়াসার : এই ভ্রমণ সমন্ধে একটা কৌতূহলসূচক প্রশ্ন ছিল। মূলত আপনাদের এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য কী? বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকগান সংগ্রহের একটা চেষ্টা কি সেখানে থাকে না এমনি বায়ু পরিবর্তনের জন্যই?

পিট সিগার : ‘আমাকে সবসময়ই কিছু না কিছু শেখার মধ্যেই থাকতে হবে’—এমন ধরনের লোভ থেকে আমি নিজেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করি। আপনি সবসময় এমন করে শেখার মধ্যে মগ্ন থেকে পারবেনও না আসলে। নিজেকে অবশ্যই মাঝে মাঝে একটু আধটু বিশ্রাম দিতে হবে। তা না হলে দেখা যায় শেখাটা একটা সময় পর তার মান হারাচ্ছে। ‘জ্ঞান অর্জন’—এই বিষয়টির মধ্যে হয়তো একটা ভারি বোধ রয়েছে। সেটি যদি আর ভারি না থাকে তবে শেখার কী মানে?
একটা দুটো জাপানি লোকগান গাইতে চেষ্টা করব। ব্যাঞ্জোটাকে ভারতীয় সেতারের মতো বাজানো যায় কিনা দেখি। ইসরায়েলি কিছু গান এবং পূর্ব ইউরোপের বিখ্যাত লোকনৃত্য করবে সে সমন্ধেও ছোটখাটো পরিকল্পনা রয়েছে।

দ্য ওয়েভার্সের প্রথম দিককার হিটগান ‘জেনা’, এটা কিন্তু একটা ইসরায়েলি লোকগান। আমার সবচেয়ে প্রিয় গান যেগুলো ওগুলোর মধ্যে একটা গান সাউথ আফ্রিকার। বার-তের বছর আগে একটা ফোনোগ্রাফ রেকর্ড শুনে শুনে আমি গানটা শিখেছিলাম। প্রচণ্ড সর্দিতে বিছানায় শুয়ে আছি, হঠাৎ গানটা সামনে এলো। তারপর এক নাগাড়ে শুনতে শুনতে একটা সময় আবিষ্কার করলাম গানটা এত কঠিন না। বেজ, টেনর একই রকমভাবে বারবার বাজছে আর তার সাথে চড়া সুরের কাজটা আমাকে বলতে গেলে মুগ্ধতায় ফেলে দিয়েছিল। তারপরই গানটা শিখতে শুরু করে দিই। চড়া সুরটাও এক পর্যায়ে আমার আয়ত্তে এসে যায়।
এই গানটা একটা নতুনত্বের কথা ভেবে তৈরি করতে বসেছিলাম, কিন্তু শেষ করার সময় একধরনের তুমুল ভালো লাগার ভেতর দিয়ে শেষ করেছি। শুধু আমার একার না, শ্রোতাদের হৃদয়েও এই গান দারুণ স্পর্শ করেছে বলে আমার ধারণা।
দ্য ওয়েভার্স গানটা বের করতে অনেক সাহায্য করেছে। গানটার নাম ‘উইমোওয়েহ’। সাউথ আফ্রিকার স্থানীয় ভাষায় এটিকে বলা হয় ‘বুবাহ’, যার অর্থ ‘সিংহ’।

এ্যালান ওয়াসার : পুরো গানটার মানে কী সেটি যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন।

পিট সিগার : মানুষজন প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে অমুক-তমুক গানের কী মানে। এটা সত্যিই একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রত্যেকটা ব্যালাড, শ্রমসংগীত কিংবা ছড়াগানেরই কোনো না কোনো সুনির্দিষ্ট মানে রয়েছে। কিছু গানের প্রেক্ষাপট বেশ চিত্তাকর্ষক, কোনো কোনোটা হয়তো স্বাধীনতা নিয়ে, আবার কিছু গান নিজস্ব পৃথিবীতে টিকে থাকবার সংগ্রাম গাঁথা হিসেবে রচিত হয়েছে।

আমি কখনো আফ্রিকায় যাইনি, কিন্তু এই গানটার অর্থ অনুসন্ধান করে দেখলাম, এ গানে বলছে—‘সিংহটা ঘুমিয়ে আছে’।
জুলুদের শেষ রাজা চাকা দ্য লায়ন ছিলেন দুর্দান্ত একজন সেনানায়ক। ইউরোপীয়রা তাঁকে হত্যা করে সাম্রাজ্যবাদের সূচনা করেছিল। কিন্তু কেউ কেউ ধারণা করতেন চাকা দ্য লায়ন আসলে মরেনি। তিনি হয়তো ঘুমিয়ে আছেন বা বিশ্রাম নিচ্ছেন কোথাও। সময় হলে ঠিকই জেগে উঠে হারানো স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করবেন। সম্ভবত, এই চিন্তা থেকেই গানটা রচিত। আমি জানি না, কারণ আমি আগেই বলেছি আফ্রিকায় আমি কখনোই যাইনি।
দক্ষিণ আফ্রিকার এখনকার দৃশ্যপট কল্পনা করে একবার ভাবুন তো ঠিক সেই সময়ে এই গানটা তাদের কাছে কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। আশা করি, ইতোমধ্যেই উত্তর পেয়ে গেছেন।

এ্যালান ওয়াসার : ঠিক একরকমই একটা কাহিনী নিয়ে আরেকটা গান আছে । নাম সম্ভবত—‘ফলো দ্য ড্রিংকিং গউর্ড’।

পিট সিগার : ১৮৫০ সালের দিকে স্বাধীনতাকামী দাসেরা যখন দক্ষিণ থেকে কানাডায় পালিয়ে গিয়েছিল, কিছু সাহসী আমেরিকান জীবন বাজি রেখে তাদের সাহায্য করেছিলেন। এ গানটা সে প্রেক্ষাপটেই তৈরি।
ওই সময়ে ধর্মীয় গানগুলো ‘ফলো দ্য রাইসেন লর্ড’ নামে পরিচিত ছিল। গানটা এই ধাঁচের হলেও এতে স্পষ্ট রকমভাবে কিছু নতুনত্বের আভাস লক্ষ্য করা যায়।
গান গাওয়ার সময় অনেকেই শব্দের এদিক সেদিক করেছেন। বিষয় সেটি নয়, বিষয় যেটি সেটি হলো একবার ভাবুন সমবেত স্বরে সকল দাসেরা শস্যক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে এই গানটা গাইছে।
ওভারসিয়ার মাঝে মাঝে তার চাবুক নিয়ে এসে দেখতেন সকল দাসেরা একসঙ্গে গান গাইছে। ওভারসিয়ার ভাবতেন দাসেরা আনন্দে গান করছে এবং তা দেখেই তিনি চলে যেতেন। কিন্তু এ তো শুধু গান নয়। এটি ছিল দাসেদের দক্ষিণে পালিয়ে যাবার গুপ্ত নির্দেশনা।

‘ড্রিংকিং গউর্ড’ দ্বারা ঋক্ষমণ্ডলকে ইশারা করা হতো, যা শুধুমাত্র দক্ষিণের আকাশেই উদিত হতো।
সবসময়ই আপনি যা ভাবেন একটা গানের অর্থ সেরকম নাও হতে পারে। তবুও অর্থকে খোঁজার চেষ্টাটা আমার কাছে দারুণ লাগে।
সুনির্দিষ্ট অর্থের বিষয়ে মতবিরোধের বিষয়টি যে স্বাভাবিক, তা আমি প্রথম টের পেয়েছিলাম যখন পুরনো ব্রিটিশ ব্যালাড ‘বারবারা অ্যালেন’-এর অর্থ খুঁজতে গিয়ে অনেক তাবড় তাবড় বিশারদরা দীর্ঘস্থায়ী মিটিং করছিলেন।

এই ব্যালাড শুনলে দেখা যায় একজন পুরুষ তার প্রেয়সীকে নিঠুর সাব্যস্ত করতে চেষ্টা করছেন। কারণ কী? কারণ হলো প্রেমিকের চাই একটি চুমু। প্রেয়সী তা দেবে না। ফলে প্রেমিক তার প্রেমের সে বিরহ বুকে নিয়ে মরনের কোলে ঢলে পড়ছে। আপনার কী মনে হয়? শুধুমাত্র এই কাহিনীর জন্য ব্যালাডটি বিখ্যাত? না। আপনি যে এর মেলডি বা কথার বিন্যাস দেখে একে বিচার করতে যাবেন এমনটিও সম্ভব নয়। কারণ সুরটি সাধারণই আর কথা যেহেতু লোকে ইচ্ছেমতো গাইতে পারে একটা সুনির্দিষ্ট ফর্ম তৈরি করে একে বিচারের জো নেই। তবে? ভালো লাগার কোনো কারণ থাকে না আসলে।
গানের শেষ স্তবকে দেখা যায় বারবারা অ্যালেন, সেই নিষ্ঠুর যুবতী যার কবরে কাঁটাঝোপ ছড়িয়ে যাচ্ছে, উইলিয়াম যে প্রেমের দায়ে মরেছিল তার কবরে ফুটেছে সুন্দর এক গোলাপ—তা আরেকবার সমালোচকদের গানের অর্থ ব্যাখ্যা করতে হিমশিম খাওয়ায়।

পৃথিবীতে সবাইকেই একধরনের নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমার ধারণা এই গানটিতে এমন একধরনের উচ্চাশার বিষয় আছে যেটি সেই নিষ্ঠুরতাকে দূরে সরিয়ে নিখাঁদ সৌন্দর্যেরই গল্প বলে। যেটা এই পৃথিবীতেই হোক কিংবা পৃথিবীর বাইরে কোথাও!

এ্যালান ওয়াসার : ধন্যবাদ পিট সিগার। আমাদের অনুষ্ঠানে আপনার পদধূলি পড়েছে এতে আমরা আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

পিট সিগার : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;