মেসার্স গঘ ব্রাদার্স



শফিকুল কবীর চনদন
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

‘তুমি ছাড়া সত্যিই আমার কোনো বন্ধু নেই, এবং অসুস্থ হলেও তুমি সর্বদাই আমার ভাবনা জুড়ে থাকো।’১

কী ছিল ভ্যান গঘের অনুপ্রেরণা? কিভাবে তিনি আধুনিক চিত্রশিল্পী হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন? কারা তাঁর এই যাত্রার সহযোগী ছিলেন? তিনি তাঁর বহুবিধ সীমাবদ্ধতাকে কিভাবে অতিক্রম করেছিলেন? তিনি কি ভাগ্যবান প্রেমিক বা চিত্রশিল্পী ছিলেন? এমনই নানাবিধ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে ভিনসেন্টের এই নাতিদীর্ঘ জীবনজুড়ে খানাতল্লাশী দেওয়া যায়।

বিশ্ব-শিল্পের ইতিহাসে সবচে দৃঢ় ভ্রাতৃত্ব ‘ভ্যান গঘ ভাই’। একদিকে এক ছাদের নিচে ভ্ৰাতৃদ্বয়ের বসবাস যখন বিরক্তির চরমে তখনও বড়ভাই ভিনসেন্টের অনুপস্থিতি থিও’র কাছে অকার্যকর ও অসম্পূর্ণ যাপন হয়ে উঠেছিল। অবিচল পত্রালাপ আমাদের দেখিয়ে দেয়, তাঁরা শারীরিক সংস্থানে পৃথক হলেও সর্বদাই তাঁদের জীবনের জমা খরচের হিসাব নম্বর যেন যৌথই ছিল।

‘পরস্পরের কাছে আমাদের একনাগাড়ে চিঠি লিখে যেতে হবে।’২

থিও ছিলেন ভিনসেন্টের সর্বশ্রেষ্ঠ সমর্থক। উভয় ভাইয়েরই ছিল অস্থির জীবনযাপন। তাঁদের সম্পর্কের পরতে পরতে দৃষ্টি দিলে যে কারো চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠতে বাধ্য। তা আনন্দ বেদনার এক সমূহ তাৎপর্যে। সর্বকালের অন্যতম সেরা চিত্রকর হয়েও তিনি ছিলেন উদ্বেগাকুল ও বিষণ্ণ। তার সময়ে অনালোচিত। প্রথাগত প্রজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করেই তারা যে লড়েছিলেন সেসব নির্যাস নিয়েই একটি অভিসন্দর্ভ হয়ে ওঠে। থিও ভাইদ্বয়ের গল্প ছাড়া যা অসম্পূর্ণ।

এক ‘গঘ’ ঋণদাতা আরেক ‘গঘ’ ঋণ গ্রহীতা। একজন চিত্রকলা ব্যবসায়ী আরেকজন চিত্রকর্ম নির্মাতা। কেনা বেচার হিসাব মাথায় রেখেই যত আগাম দেনা পাওনা ‘গঘ ব্রাদার্সের’। যদি এই ব্যবসায় লক্ষ্মী হতো তাহলে গোপীল এন্ড কোং গঘ ব্রাদার্সে রূপ নিতে পারত! তবে এই ‘মেসার্স গঘ ব্রাদার্স’ তাদের অব্যবসায়িকতার শিল্পঋণ দিয়ে অনাগত ভবিষ্যত্বের জন্য দুনিয়াকে যে ঋণে আবদ্ধ করেছেন তা বলাই বাহুল্য।

সম্প্রতি এক গবেষণার হিসাবে দেখা যায় অনুজ ভ্রাতঃ থিও তাঁর জীবদ্দশায় আনুমানিক ১৮০০০ ডলার ভিনসেন্টের জন্য অকাতরে খরচ করেছেন। যার পুরোটাই সহায়তার মোড়কে। অসাধারণ তাই না? আমরা যদি আজকের মুদ্রাস্ফীতির হিসেবে কষে দেখি তাহলে সে অঙ্ক দাঁড়ায় চার লক্ষ ডলারের কাছাকাছি। আমরা এখানে সেই সত্যিকার ভ্রাতৃত্বের ভালোবাসার বন্ধনের কথাই আলাপে নিচ্ছি। অবশ্যই থিও সব সময় আলাপে এই অর্থকে দাতব্য হিসাবে নয়—বিনিয়োগ হিসাবেই দেখেছে। কিন্তু সংবেদনটা হলো, এমন ভাইয়ের সন্ধান সহজলভ্য নয় নিশ্চয়ই যে কিনা শিল্পলগ্নি থেকে অর্থ সমাগমের সম্ভাবনা নেই জেনেও ‘বিনিয়োগে’ ব্রতী হয়।

‘আমার কাজের অর্থমূল্য আছে কিনা সে বিষয়ে বলতে চাই যে, আমাকে তা খুবই বিস্মিত করবে যদি অন্যদের কাজের মতো আমার আঁকা ছবিগুলিও সময়মত  বিক্রয়যোগ্য হয়ে না ওঠে, ব্যাস এর বেশি আমার আর কোনো ভড়ং নেই।’৩

একসময় গঘ ভাইদের যৌথ প্রকল্প হিসাবেই ভিনসেন্টের চিত্রশিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠাকল্পে থিও মানসিক, আর্থিক, শিল্প পরামর্শক হিসাবে স্বনিয়োজিত হন। অস্বীকার করার জো নেই যে আজকের বিশ্ববরেণ্য শিল্পীর প্রতিষ্ঠার পেছনে থিও’র নিরন্তর প্রণোদনাই মুখ্য হয়ে আছে। ভিনসেন্টের কাজের উদ্ভাবনী বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেও শিল্প-ব্যবসায়ী থিও কোনো সংগ্রাহককেই উৎসাহী করে তুলতে না পারার ব্যর্থতা সত্ত্বেও, ছবি বিক্রি করতে না পারার অযোগ্যতা সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে থিওই ভিনসেন্টের এক নম্বর সমর্থক হয়ে হাজির থেকেছেন সারাজীবন।

দুই দশকের চ্যালেঞ্জ-মুখর সময়ের মধ্যে দুই ভাইয়ের লেখা অসংখ্য চিঠি। ভিনসেন্টের হৃদয়ের কোরক থেকে উৎসারিত পত্রপুঞ্জের অধিকাংশ এমনকি আসন্ন মৃত্যুর অব্যাবহিত পূর্বে লেখা পত্রটিরও প্রাপক ছোটভাই থিও। থিও তাঁর ভাইয়ের হৃদয় নিঙড়ানো এসব শিকড় সমাচারের প্রাপক। ভিনসেন্ট নিজেরই গরজে তার অন্তর্জীবন ব্যক্ত করেছিলেন ভাই থিওর কাছে।

‘তোমার কাছে সেসব সুযোগ পেয়েছি তার সমতুল্য তত ভালো ছবি আমি এখনো এঁকে উঠতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বাস করো, একদিন যদি সেটা করে উঠতে পারি তাহলে যেন তুমিও তাদের রচনা করেছো, কেননা আমরা দুজনেই সেসব ছবি এঁকে তুলেছি।’৪

‘থিও এই প্রশংসার উপযুক্ত পাত্র; নিজেকে করে তুলেছিলেন নিমিত্ত মাত্র আধার। সেজন্যেই ভাইয়ের শতপ্লাবী সৃষ্টির শরিক হিসেবে নিজেকে কখনোই দাবি করেননি। একমাত্র অহংকার ছিল তার; ভিনসেন্টের কাছ থেকে তিনি যত চিঠি পেয়েছেন এমন সৌভাগ্য আর কারো হয়নি।’৫

ভাই ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের জীবন ও রচনার ভাণ্ডারী হবার অধিকার তারই। ১৮৭৩ সাল থেকে পত্র বিনিময় ভাইয়ের সাথে। আত্মবিশ্বাসের বুনিয়াদ গড়ে ওঠে সেই থেকে ধীরে ধীরে। আর কখনো যে বনিবনার কোনো পরোয়াও করেনি তার লক্ষণও আছে পত্র চালাচালিতে। থিও মনে করেছিলেন তার ভাইয়ের মধ্যে দুটি পরস্পর বিরোধী সত্তা বিরাজিত—‘একজন বিস্ময়কর প্রতিভাদীপ্ত, পরিমার্জিত, দয়ালু এবং অন্যজন স্বার্থপর ও অনুভূতিহীন।’

কিন্তু ভিনসেন্ট তার জীবনের সমুদয় কর্জ করেছেন ভাই থিও’রই কাছ থেকে। তিনি প্রশান্তির জন্য মাথাও গুঁজেছেন ভাইয়েরই মমত্বের কাছে তার মুরোদকে ফিরিয়ে আনতে।

গরিমা, লালসা, ছলনা ছিল না, দুর্ভাগার পরনির্ভরশীলতার আশ্রয় যেমন হয়, তেমনি খ্যাতি, অর্থলিপ্সার জন্য নয়, এক অনন্যোপায় ভাবি-চিত্রীর মর্ম প্রকাশের একমাত্র উপায় হয়ে ওঠেন থিও। সেও নিষ্কলুষ ভ্রাতৃপ্রেম চিত্ত বিজড়িত পরিপূর্ণ অনুভব সাদা-নীল-হলুদের তারা ভরা রাতের মাহাত্ম্যকে রঙ চুবিয়ে টাঙিয়ে দেন ভবিষ্যতের প্রদর্শন দেয়ালে।

‘জীবনে কোনো মহৎ ঘটনায় আকস্মিকভাবে ঘটতে পারে না, তাকে ইচ্ছাশক্তিতেই ঘটাতে হয়।’৬

গঘ ভাইদ্বয় তাঁদের জবানে চিত্রশিল্পের সাথে ভ্রাতৃত্বের সহযোগিতার এমন এক প্রবল শক্তি ও আকর্ষণ দান করেছেন যা অনাগত ভবিষ্যৎ জুড়ে অসংখ্য শিল্পপ্রেমীদের হৃদয়কে আলোড়িত করবে।

ভিনসেন্টের জীবন-গগন জুড়ে নিনাদিত রং রেখার অবয়বচিত্রের থিও—বাস্তবের মনোজগতের মোহনচিত্র আঁকানোরও কারিগর। ভিনসেন্টের জীবনানুসন্ধান যে মগ্ন চৈতন্যের গভীরে তার কিনার ঘেঁষে অবস্থান থিও’র। রক্তক্ষরণের দাগে প্রকৃতি এঁকেছেন ভিনসেন্ট, তার ভাইকে এঁকেছেন শত শত পত্রের অসংখ্য বর্ণ  শব্দ ও বাক্যের মোহনীয় বিস্তারে।

‘আমার আশা তোমার সাহায্য ও সহানুভূতি কোনোভাবেই প্রত্যাহৃত হবে না এবং আমরা ভ্রাতৃত্ববোধে একে অপরের হাত ধরে থাকব বরাবরের মতো, যতই থাকুক না কেন সেসব জিনিস “জগৎ” যাদের বিরোধিতা করে।’৭

থিও ভিনসেন্টের আশ্রয়ের প্রতীক। প্রশ্রয়ের নীড়। প্রেমের জানালা। ক্ষরণের দাগ মেখে জীবনকে চেতনার সামর্থ্যে বাগে রাখার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে, নিজেদের বোধ ও উপলব্ধির জাগরণে।

আর্থিক শূন্যতায় হাত রেখে প্রকরণে চোখ রেখে এঁকেছেন ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ। সহনস্বরের প্রত্যয়ে লেখা পত্র থিওকে, অথচ প্রতিকৃতি? নিজের পঁয়ত্রিশটি আত্মপ্রতিকৃতির সন্ধান পাওয়া গেলেও থিওকে এঁকেছেন মাত্রই একবার। যা আবার আবিষ্কৃত হয়েছে ২০১১ সালে। এতদিন যা আত্মপ্রতিকৃতি হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছিল। কেন প্রতিকৃতি রচনায় থিও বিষয় হয়ে উঠে আসেনি? নাকি নিজেকে আরো পরিশীলিত করে থিওকে আঁকার কোশেশের বাসনা ছিল?

‘তোমার আন্তরিক সাহায্য যতটুকুই পাই না কেন, তা আমি যতটা ভালো করে পারি কাজে লাগাব, কাজে উন্নতি ঘটাবার জন্য আমি সর্বাধিক প্রচেষ্টা চালাব।’৮

গঘ ভাতৃদ্বয়ের সজীব ধারাভাষ্য তাঁদেরই মর্জির নিরীক্ষণের অনপনেয় স্বাক্ষর। তাতে সম্পর্ক জড়িয়ে রাখার মেহন্নত আছে। যা একজনকে টপকে গিয়ে আরেকজনকে প্রত্যক্ষ করার জো নেই। আছে বিবেকের যথোচিত প্রশ্রয়ের দাগ। যা মুদ্রিত হয়ে থাকে ভ্রাতৃপ্রেমের উজ্জ্বলতার আখরে। তাঁর শিল্পেরই মতো ভাই সম্পর্কের সমস্ত পূর্বধার্য্য সীমানাকে মানবিক উচ্চতায় সম্পর্কের অপাপবরণে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে স্থাপন করেন।

নিজেকে তিনি কোনোদিন সস্তা শ্রমে বিক্রয় করেননি। যদিও তাঁর সাধ ছিল চিত্রিত আলেখ্য যেভাবেই হোক বিক্রিবাট্টা করে আহার সংস্থান। এমনই ছিল তাঁর মর্জি। সৃষ্টিরাও তো চূড়ান্ত মর্জি মাফিক। তাঁর গোটা জীবন জুড়ে মেহন্নতের অনপনেয় স্বাক্ষর। শিল্পের নতুন ধারার পূর্বগামী হতে গিয়ে পত্রলেখক, ভ্রাতৃপ্রেম, সহোদরের সাথে চুক্তি, এসবই আসলে আপাত অস্থিরচিত্তের মানুষটার সৃষ্টিকাজের বৈভব মেনে নেওয়ার পথে অন্তরায় নয়।

‘....আঁকাচর্চা আরো আন্তরিকভাবে যদি করতে পারি সেটাই হবে বেশি কাজের, অন্তত তাঁর ওইসব বিক্রিযোগ্য অবিক্রিযোগ্য ইত্যাদি কথাবার্তার চাইতে কাজের কাজ। ওইসব বিক্রিটিক্রি ব্যাপার নিয়ে তাঁর যা মনে হচ্ছে সেসব জ্ঞান ট্যান আমার না শুনলেও চলবে।’৯

চিত্রকলা সমঝদার ব্যবসায়ী হয়েও থিও’র—ভাইয়ের প্রতি পক্ষপাত তো ছিলই, উপরন্তু যৌথ জীবন কারবারের এক প্রতিনিধির প্রতি ভালোবাসার শক্তির এক অন্তর্গত প্রবর্তনাও কি থিও’র দান নয়? ফলে এসব বাণিজ্য কায়কারবার ছাপিয়ে সহানুভূতি সেখানে কালান্তরে প্রসারিত হয়ে গিয়েছে। ফলত ‘মেসার্স গঘ ব্রাদার্স’-এর শিল্প পূর্বধার্য্য সীমানা চুরমার করে দিয়ে আত্মিক শিল্পায়নের দিকে তাঁদের যাত্রাপথের নিশানা সাব্যস্ত করেন।

‘প্রিয় ভাই, এটা তোমার কাছে পরিষ্কার করে দেওয়া ভালো যে, তোমার বিশ্বস্ত সাহায্যের জন্য কত দৃঢ় ও তীব্রভাবে অনুভব করি যে তোমার কাছে আমি বিশালভাবে ঋণী।’১০

ফলে আলাদা নজর দেওয়ার কথা ওঠানোই পরিমিত জ্ঞান কেননা ঘনিষ্ঠ পরিসরে এক চিত্রকলা ব্যবসায়ী আরেক চিত্রকর্মী শরিককে কী-রকম প্রসন্ন উদ্বেগে প্রত্যক্ষ করেছেন সেদিকে আমাদের দরদ-মন যেমন আদ্র হয়, উষ্ণতায়ও ছাপিয়ে সেদিকে মন পড়ে থাকে। আর ‘গঘ ব্রাদার্স’-এর সর্বব্যাপী অস্তিত্বের সংগ্রাম ভাবসঙ্গে জেগে থাকে।

‘থিও না থাকলে আমার কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করা কখনোই সম্ভব হতো না।’১১

ভিনসেন্টের মৃত্যুর পর থিও ভাই হারানোর বেদনায় তাঁর মৃত্যুর দায় অনুভব করেছিলেন? নিজেকে দোষী ভেবেছিলেন? একজনের গৃহী ব্যবসায়ী জীবন অন্যজনের শিল্পী জীবনের আপাত ভিন্ন জীবন হলেও গঘ ভাইদের জীবন এক সমাবৃত্তে এসে মীমাংসিত হয়ে যায়! থিও’র সমর্থন জারি থাকে। আওভারসের অদূরে বিস্তীর্ণ তৃণভূমির সবুজ কোমলে ঘেরা সমাধিক্ষেত্রে পাশাপাশি অন্তিম শয়নের মধ্য দিয়ে যৌথ যাপন, যৌথ হিসাব, যৌথ শিল্প প্রকল্প ‘মেসার্স গঘ ব্রাদার্স’-এর শহিদত্বের এজমালি স্মারক হয়ে।

কর্জ স্বীকার
০১. থিও ভ্যানগঘ, ২২ জুলাই, ১৮৮৩ হেগ
০২. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, ১৩ ডিসেম্বর ১৮৭২
০৩. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, জুলাই ৩১, ১৮৮২ হেগ  
০৪. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, পত্র সংখ্যা ৫৩৮
০৫. ট্রুডবার্টা দাশগুপ্ত, আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
০৬. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ
০৭. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, মে ১৮৮২, হেগ
০৮. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, মার্চ ১৮৮৩, হেগ
০৯. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, মার্চ ১৮৮২, হেগ
১০. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, মার্চ ১৮৮৩, হেগ
১১. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, অক্টবর ১৮৮৭, প্যারিস

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;