বিবর্ণ সায়র



ফাহ্‌মিদা বারী
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

এক

দিলারা হাসান পাতলা টাওয়েল দিয়ে শিশুটিকে প্যাঁচিয়ে বের হয়ে এলেন লেবার রুম থেকে। একটুও সময় নষ্ট করলেন না তিনি। ডাক্তার, দুজন জুনিয়র সহকারি ডাক্তার, নার্স...সবাই বিস্মিত হয়ে তাকে দেখছে। বাধা দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে সবাই। দিলারা হাসান নির্বিকার। এত কিছু লক্ষ্য করার সময় নেই এখন। ডাক্তারের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়েই লেবার রুমে ঢুকেছিলেন তিনি। প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না ডাক্তার রওশন জাহান। বেশ কড়া ভাবেই বলেছিলেন, ‘আরে, কী বলছেন এসব আপনি? আপনি কেন থাকবেন লেবার রুমে? আমাদের হসপিটালের একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। আমরা ডাক্তার কিংবা নার্স ছাড়া অন্য কাউকে লেবার রুমে এলাউ করি না।’
দিলারা হাসান কাতর মুখে বলেছিলেন, ‘দেখুন, দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন। আমার মেয়েটি সাঙ্ঘাতিক ভীতু প্রকৃতির। ভয়ে শেষমেশ ওর একটা ভীষণ কিছু হয়ে যাবে। আমি থাকলে মেয়েটা একটু সাহস পেত।’
‘দেখুন, আপনিও দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন। সব মেয়েদেরই এইরকম সময় পার করতে হয়। ডেলিভারি পেইন সহ্য করে মা হতে হয়। পৃথিবীর সব মেয়েই কি সাহসী হয়ে জন্মায়? মা হওয়ার এই প্রক্রিয়াও তাদের সাহসী হতে সাহায্য করে। তাছাড়া আপনার মেয়ের বয়স অল্প। ডেলিভারিতে কোনোরকম কমপ্লিকেসি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমি কেন আপনার এই অন্যায় আবদার মেনে নেব?’

দিলারা হাসান তবুও গোঁ ধরে বসে থাকেন। কিছুতেই নিজের আবদার থেকে তাকে সরানো যায় না। শেষ পর্যন্ত নিতান্ত ইচ্ছের বিরুদ্ধে রাজি হতে বাধ্য হলেন ডাক্তার রওশন জাহান। দিলারা হাসান ডেলিভারির সময় লেবার রুমে থাকার অনুমতি পেলেন। কিন্তু ডেলিভারির পরপরই তিনি কেমন যেন অস্থিরতা শুরু করে দিলেন। তাড়াতাড়ি বাচ্চাকে কোলে নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।

উপস্থিত ডাক্তার, নার্স প্রত্যেকে খুব বিরক্ত হয়ে উঠল এই আচরণে। ডেলিভারির পরে বাচ্চাকে তার মায়ের বুকে দেওয়ার কথা...কিন্তু দিলারা হাসান কেমন একরকম ছোঁ মেরেই বাচ্চাকে তুলে নিলেন। তারপরে হঠাৎ করে কাউকে কিছু বোঝার অবকাশ না দিয়েই বাচ্চাকে একটা টাওয়েল দিয়ে পেঁচিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে এলেন। যে মেয়ের জন্য তিনি লেবার রুমে ঢোকার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, সেই মেয়ের দিকে একবার ফিরেও দেখলেন না।

লেবার রুমে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল। কী ঘটে গেল তারা যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। এভাবে বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কী মানে হয়? আর তাছাড়া ডেলিভারির পরে বাচ্চাটাকে কিছুক্ষণ অবজারভেশনেও রাখার কথা। অথচ এই ভদ্রমহিলা কাউকে কোনো সময়ই দিলেন না!

বাইরে বেরিয়ে দিলারা হাসান নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করতে লাগলেন। বাচ্চাটা কাঁদছিল। তিনি মুখে একটা দুধের ফিডার ধরে দিলেন। কিছুক্ষণ টেনে তার কান্না বন্ধ হয়েছে। ড্রাইভার আর কাজের মেয়ে কমলাকে আগে থেকেই সবকিছু বলা ছিল।

নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। অল্প সময়েই রোগীকে ওয়ার্ডে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকেই একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে তাকে ওঠানো হয়েছে গাড়িতে। ওয়ার্ডের এসিস্টেন্ট নার্স অনেক বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সুবিধা করতে পারেনি। নার্স কিছু একটা সন্দেহ করে ডাক্তারকে ডেকে আনার জন্য পাও বাড়িয়েছিল। তখনই তার হাতে বেশ কিছু নোট গুঁজে দেয় ড্রাইভার লিয়াকত।

রোগীকে গাড়িতে উঠিয়ে তারা দুজন দিলারা হাসানকে চোখের ইশারা করে। সেটা দেখেই আর দেরি করেন না দিলারা হাসান। তাড়াতাড়ি চলে আসেন রিসেপশনে।

ক্লিনিকটা তেমন পুরনো নয়। মোটামুটি নতুনই বলা চলে। স্টাফ সংখ্যাও খুব একটা বেশি নয়। ওয়ার্ডগুলো বেশ ফাঁকা ফাঁকা। চিকন করিডোরটা পার হতে হতে এদিক সেদিক দেখছিলেন দিলারা হাসান। নাঃ! তেমন কেউ নেই আশেপাশে।

রিসেপশনে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দিলারা হাসান কিছুক্ষণের জন্য থতমত খেয়ে গেলেন। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই সুনিপুণ দক্ষতায় নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। করুণ মুখে বললেন, ‘আমার মেয়ের বাচ্চাটা মনে হয় বদল হয়েছে। আমি কাউকে পেলাম না কথাটা বলার জন্য। আপনি...তুমি কি একটু দেখবে দয়া করে মা?’ মেয়েটা ফোন করার জন্য রিসিভার কানে তুলতে যাচ্ছিল দেখেই তিনি তাড়াতাড়ি আবার বলে ওঠেন, ‘না না...তুমি একটু বাচ্চাটাকে সাথে করে নিয়ে যাও। আমি এখানেই আছি। একটু কিছুক্ষণের জন্য...নিজে গিয়ে একটু দেখো না মা!’

রিসেপশনিস্ট মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল দিলারা হাসানের দিকে। তার রিসেপশন থেকে উঠে যাওয়ার অনুমতি নেই। আবার ভদ্রমহিলার কথাগুলোও সে ঠেলতে পারছে না। বয়স্ক একজন মানুষ মা মা বলে তাকে অনুরোধ করছে। এটা ঠেলে ফেলার মতো মনের জোর এখনো হয়ে ওঠেনি মেয়েটার। সে কোলে তুলে নিলো বাচ্চাটিকে। বাচ্চাটি ঠিক সেই মুহূর্তেই কেমন যেন একটা শব্দ করে উঠল। দিলারা হাসান আবার তাড়া দিলেন তাকে। মেয়েটি কিছুটা অনিচ্ছা সহকারেই এগিয়ে গেল সামনের দিকে।

আর দাঁড়ালেন না দিলারা হাসান। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে সশব্দে বন্ধ করে দিলেন দরজা। মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন নিশ্চল চোখে। ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখে স্বগতোক্তি করে চলেছে তার মেয়ে ঈষিতা, ‘একটিবার দেখতেও দিলে না আমাকে? একটিবারের জন্য ওকে কোলে নিতে দিলে না! মাত্র একবার....’
দিলারা জামান ঠান্ডা গলায় ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন, ‘লিয়াকত, গাড়ি চালাও।’

দুই

আঠারো বছর পরের কথা...
লতিফা বেগম আঁচারের বয়াম রোদে শুকাতে দিয়ে মোড়ায় বসে উলকাঁটা বুনছেন। শীতের সকালের মিঠেকড়া রোদ। এমন আরামদায়ক রোদে পিঠে রোদের হাল্কা আঁচ এসে লাগলে শরীরটা চনমনে হয়ে ওঠে। বাতের ব্যথারও বড় উপশম হয়। তিনি শীতের সকালের এই রোদটা উপভোগ করার জন্য সব কাজকর্ম ফেলে রাখতে রাজি আছেন।

ছোট বউমা আঁচার বানিয়েছে। লতিফা বেগম বসে বসে সেই আঁচার পাহারা দিচ্ছেন। এই অজুহাতেই তিনি দীর্ঘসময় রোদে বসে থাকেন। কারণ বেশিক্ষণ আরাম করে রোদ পোহানোর জো নেই। বড় বৌ সোহানা তার এই বেশিক্ষণ রোদ পোহানোর ওপরেও কড়াকড়ি জারি করে দিয়েছে। শক্ত নির্দেশ দিয়ে বলেছে, ‘মা, আপনি কিন্তু অনেক বেশি সময় রোদে বসে থাকেন। বেলা বারোটার পরে সূর্যের আলো সরাসরি গায়ে না লাগানোই ভালো। সকাল আটটা থেকে নয়টা...বড়জোর দশটা, ব্যাস! তারবেশি দরকার নেই। এক ঝামেলা মেটাতে গিয়ে আরেক ঝামেলা বাঁধিয়ে বসবেন দেখছি!’

সোহানা ডাক্তার। কাজেই তার কথা না শুনে উপায় নেই। তবু রোদ থেকে উঠে আসতে মন চায় না লতিফা বেগমের। বসে বসে কত কী ভাবনায় জড়িয়ে যান তিনি! রোদের ওম গায়ে লাগিয়ে ব্যথা বেদনাকে সাময়িক ছুটি দিয়ে সংসারের হাজার বেদনায় ইচ্ছেমতন ডুব মারা যায়।  মনোকষ্টের কি আর শেষ আছে? আপাতত ছোট ছেলের বৌকে নিয়েই যত চিন্তা তার। বিয়ের প্রায় পনেরো বছর হতে চলল। এখন অব্দি মা হওয়ার নাম নেই! সারাদিন রান্নাবান্না, সেলাই ফোঁড়াই নিয়ে তুমুল ব্যস্ত সময় কাটায়। কী ই বা করবে বেচারী! একটা কিছু না করলে তার সময়টাই বা কিভাবে কাটবে?

লক্ষীগোছের চুপচাপ মেয়ে দেখে ঘরে এনেছিলেন। দেখতে শুনতে একেবারে এক নাম্বার। মাস্টার্স করছিল। বড় বৌ ডাক্তার। কাজেই ছোটজন লেখাপড়াতে বেশি পিছিয়ে থাকলে বিয়ের পরে দুই বৌয়ের মধ্যে ঝামেলা বাঁধতে পারে। ব্যক্তিত্বের ঝামেলা। সেজন্যই মাস্টার্স পাশ মেয়ে দেখে খুঁজে এনেছিলেন। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে সেটাই কাল হয়েছে। আরেকটু কম বয়সী মেয়ে নিয়ে এলে হয়তো বাচ্চা হতে এই সমস্যাটা পোহাতে হতো না। আজকাল মেয়েদের একটু বাড়তির দিকে বয়স চলে গেলেই বিপদ। বাচ্চা হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

ছোটছেলের যদি কোনো উত্তরাধিকার না থাকে, তাহলে কিভাবে সয়সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করবেন সেই চিন্তাতেই রাতে ঘুম আসে না তার। স্বামী তো তার ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ওপারে বসে আছে। বড় জনের দুই ছেলে। বিপুল অধিকার তার। অথচ আদরের ছোট ছেলের ঘর শূন্য। মা হয়ে এই ব্যবধান তিনি সহ্য করতে পারছেন না। সোহানার বাছাই করে দেওয়া গাইনোকলজিস্টকেই দেখিয়ে আসছে ছোট বৌমা। কিন্তু সুফল তো আজও এলো না! তিনি চোখ বুজলেই যদি সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া বাঁধে!

ঈশিতা ছাদে উঠে এসে দেখে, গালে হাত দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তার শাশুড়ি। হাতের উলকাঁটা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আঁচারের বোতলের কাছে দু’তিনটি কাক ঘুরঘুর করছে। একজন একটু বেশি সাহসী হয়ে মুখ প্রায় লাগিয়েই ফেলেছে আর কি! ঈশিতা দৌঁড়ে গিয়ে সেটাকে তাড়িয়ে দিয়ে শাশুড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘মা, কী করছেন? নিচে চলেন। ভাবী একবার ফোন করে খবর নিয়েছে আপনি ছাদ থেকে ফিরেছেন কি না!’
লতিফা বেগম ঈশিতার আওয়াজ পেয়ে নড়েচড়ে বসেন। ওঠার আয়োজন করতে করতে বলেন, ‘বড় বৌমার জ্বালায় একটু আরাম করে রোদ পোহাতে পারি না!’
ঈশিতা মুখ টিপে হাসে। আঁচারের বয়ামগুলোর মুখ আটকাতে আটকাতে ক্ষীণসুরে বলে, ‘মা, আজ বিকেলে একটু মোহাম্মদপুরে যাব।’

মোহাম্মদপুর ঈশিতার বাবার বাড়ি। সে মাসে বড়জোর এক দু’বার বাবার বাড়িতে যায়। ইচ্ছে করলে প্রতি সপ্তাহেই যেতে পারে। কারো কোনো আপত্তি নেই তাতে। কিন্তু ঈশিতা নিজে থেকেই তেমন একটা উৎসাহ দেখায় না। লতিফা বেগম জোরাজুরি করেন না। মেয়ে যদি নিজে থেকে বাবার বাড়িতে যেতে আগ্রহ না দেখায়, তাহলে তার কী করার আছে? অবশ্য ঈশিতার মাকে তিনি মনে মনে একটু ভয় পান। এমন কাঠখোট্টা স্বভাবের মহিলা! কেমন যেন চাঁছাছোলা ভাবভঙ্গি! মাধুর্য শব্দটা তার ভেতরে খুঁজেই পাওয়া যায় না। অথচ ঈশিতার আঁচার আচরণ ভারী নম্র। এমন মায়ের এরকম মেয়ে কিভাবে হয়, তা এক বিস্ময়েরই ব্যাপার বটে! বয়ামগুলোর মুখ আটকে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে ঈশিতা। শাশুড়ি নিচে নেমে গেছেন ইতিমধ্যে।

বিয়ের পরে এই বাড়িটাতেই শিকড় বিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে ঈশিতা। খুব ডাকাডাকি না করলে মায়ের কাছে যেতেও ইচ্ছে করে না ওর। কেন যেন মনে হয়, আঠারো বছর আগের সেই ঘটনাটি না ঘটলে ওর জীবনটা অন্যরকম হতে পারত।

যদিও মাকেও দোষ দেওয়া যায় না কিছুতেই। মেয়ের ভবিষ্যত সাচ্ছন্দ্যের দিকটা তো বাবা-মাকেই দেখতে হয়! অবশ্য ওর জীবনে বাবার ভূমিকা প্রায় নেই বললেই চলে। ছোটবেলা থেকেই ওদের পরিবারে মা’র কথাই শেষ কথা। বাবাকে নীরব দর্শকের ভূমিকায় দেখতে দেখতে সেই বাড়ির প্রতি কেমন যেন অভক্তি জন্মে গিয়েছিল ঈশিতার। তাইতো মোমেনের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল একদিন। পালিয়েই বাঁচতে চেয়েছিল।

মোমেনকে বিয়ে করে সন্তানের মাও হতে পেরেছিল সে। কিন্তু ওর নিজের মা ই তাকে সেই সংসার করতে দেয়নি। ছিনিয়ে নিয়েছে সবকিছু। মা’র পছন্দেই আবার নতুন সংসার পাততে হয়েছে তাকে। সব অতীতকে নিপুণ দক্ষতায় ধামাচাপা দিয়ে ঈশিতার মা তাকে আবার বিয়ে দিয়েছে। আজ্ঞাকারী ভক্তের মতো চুপচাপ সবকিছু মেনে নিয়েছিল ঈশিতা। এই নতুন সংসারেই সে ডালপালা ছড়িয়ে বাঁচতে চেয়েছিল আবার। কিন্তু ভাগ্যের ফের কার জানা আছে? সে তো শিকড় ছড়িয়েছে ঠিকই...কিন্তু ডালপালা আর ছাড়তে পারল কই?

তিন

ঈশিতা আগে একবার মা হয়েছিল। তার কেসটা প্রাইমারি ইনফার্টিলিটির নয়।
গাইনোকলোজিস্ট রেহানা খানম সোহানার টিচার ছিলেন। ঈশিতার ইনফার্টিলির বিষয়টা দেখার জন্য তার চেয়ে বেশি কাউকে পারদর্শী মনে করেনি সোহানা। সেই রেহানা খানমই একদিন ফোনে জানিয়েছিলেন বিষয়টা। সোহানা একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল শুনে। সহজ সরল বোকা ধরনের একটা মেয়ে ঈশিতা। কে জানত, ওর জীবনে এমন বিষয় লুকিয়ে আছে! অবশ্য সে জানে, আলাভোলা মেয়েরাই জীবনে বিপদে পড়ে বেশি। ঈশিতাও নিশ্চয়ই কোনো বোকামির খেসারত দিতে গিয়েই মা হয়ে গিয়েছিল। আর সেই মাতৃত্বকে লুকিয়ে ছাপিয়েই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কথাটা ঈশিতাকে জিজ্ঞেস করবে কি করবে না অনেকদিন ভেবেছে সোহানা। করলে যদি কোনো সমস্যা হয়? ঈশিতা যদি আর কখনোই ওর সাথে সহজ হতে না পারে! সাত পাঁচ বহু কিছু ভেবে একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিল কথাটা। ঈশিতার দু’চোখ ভরে উঠেছিল টলটলে অশ্রুতে। কাতর কণ্ঠে বলেছিল, ‘আমার সংসারটা ভেঙে দিও না ভাবী!’
সোহানা ব্যাকুল হয়ে বলেছিল, ‘না না এমন কথা বল না ঈশিতা। আমি তোমাকে আমার ছোটবোনের মতোই দেখি। এসব কথা কাউকে কি বলা যায়?’

সেদিন কাঁদতে কাঁদতে অনেক কথাই বলেছিল ঈশিতা। বাবার অফিসের ছোটখাট এক কর্মচারী প্রায়ই আসত ওদের বাসায়... এটা সেটা অফিসের কাজে। মা’র কড়া শাসনে বন্দি জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। অল্প বয়সী ভদ্র গোছের সেই কর্মচারীকে কেন যেন খুব আপন লাগত ঈশিতার। অল্প বয়সের ভুলে পালিয়ে গিয়েছিল তার সাথে। বিয়েও করেছিল ওরা। তারপরে লুকিয়ে সংসার...বাচ্চা। আর তখনই মায়ের হস্তক্ষেপ। বাচ্চাটাকে চোখের দেখাও দেখতে পারেনি সে। আর সেই কর্মচারীকে কোথায় যে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাও জানা হয়নি ঈশিতার।

সোহানা অবাক হয়েছিল এমন গল্প শুনে। নিখাঁদ বিস্ময়েই বলেছিল, ‘আবির জানে এসব কথা?’
‘নাহ ভাবী। ও কিছু জানে না!’
সোহানা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল সেই কথায়। মনে মনে ভেবেছিল, ‘ভাগ্যিস, আবিরটা চিরদিনের বোকা!’

ঈশিতার মা হতে চাওয়ার এই দুরন্ত সংগ্রামে তার মাকে সে কিছুতেই সামিল করতে চায়নি। নিজের মা একদিন ওর মাতৃত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল। তাকে সে কিছুতেই নিজের কষ্টের কথা বলবে না।

কিন্তু না বললেই বা কী আসে যায়! মায়ের দায় কি এত সহজে মেটে? আঠারো বছর আগে যা করেছিলেন, তার জন্য এখনো অনুতপ্ত হতে পারেননি দিলারা হাসান। একমাত্র মেয়েকে সারাজীবনের জন্য সামান্য এক অফিস কর্মচারীর কাছে সঁপে দিতে পারেননি তিনি। বাচ্চাটাকে যদি রেখে দিতেন, তাহলে ঈশিতা কোনোদিনই তার নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে পারত না। আর তাছাড়া বিয়েই বা দিতেন কিভাবে?

মোমেন ছেলেটা অবশ্য খুব ঝামেলা করেছিল। যতটা না ঈশিতার জন্য, তারচেয়ে বেশি বাচ্চাটার জন্য। মৃত বাচ্চা প্রসবের গল্প শুনিয়ে আর মোটা অঙ্কের খেসারত চুকিয়ে তাকে অন্য জায়গায় বদলির ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছেন। তার স্বামী তো বিপদ দেখলেই গর্তে গিয়ে লুকায়। তাকেই এসব অপ্রিয় কাজগুলো করতে হয় সবসময়। আর তার ফল হিসেবে সকলের কাছে তিনিই খারাপ হিসেবে চিহ্নিত হন। আর কেউ না জানুক, তিনি নিজে তো জানেন...যা কিছু করেছেন মেয়ের সুখের কথা ভেবেই করেছেন।

কিন্তু তার মেয়েটা নতুন যে কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, সেটা থেকেও মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারছেন না তিনি। কারণ তিনি তো মা! আর মা হওয়াই যে সবচেয়ে বড় বিপদ! গতকাল রাত থেকেই মেয়েকে ক্রমাগত ফোন দিয়ে চলেছেন দিলারা হাসান।

একটা ভালো সন্ধান পেয়েছেন। নবজাতক শিশুকে দত্তক হিসেবে নেওয়ার এক দারুণ সুযোগ। ড্রাইভার লিয়াকতই খবরই এনে দিয়েছে। লিয়াকত তার পুরনো বিশ্বস্ত লোক। এই পরিবারের সবকিছুই আগাগোড়া জানে সে। সরকারি হাসপাতালের এই বাচ্চা কেনা বেচার খবরটা সে কোথা থেকে যেন সংগ্রহ করেছে। দরিদ্র অনেক পিতামাতাই অর্থের অভাবে বাচ্চাকে বিক্রি করে দেয়। ঈশিতাকে এমন একটা বাচ্চা কিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলেই সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে। একটা বাচ্চা সবকিছু বদলে দিতে পারে।

ঈশিতাকে রাতে অনেক অনুনয় বিনয় করে আসতে বলেছেন দিলারা হাসান। মেয়েটা কেন যেন তাকে আর দেখতেই পারে না। মাকে শত্রু মনে করে সে। অনেক অনুরোধের কারণে শেষমেশ আসতে রাজি হয়েছে বটে,  কিন্তু বাসায় পা দিয়েই বলেছে, ‘মা, আমার বাচ্চার ব্যাপারে তুমি দয়া করে আর কিছু করতে যেও না। বাচ্চা যদি আমার ভাগ্যে না থাকে আমি সেটা মেনে নিতে রাজি আছি।’ দিলারা হাসান জানেন, এসব মেয়ের ক্ষোভের কথা। একটা বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারলেই এসব ক্ষোভ কই হাওয়া হয়ে যাবে! তিনি ধৈর্য হারান না। আস্তে ধীরে মেয়েকে বোঝান। ‘মারে, তুই না হয় মেনে নিবি। তোর শ্বশুরবাড়িও কি মেনে নিবে? তাদের বাচ্চা চাওয়ার আবদার মেটাবি কিভাবে?’
‘সেই আবদার মেটানোর জন্য আরেকজনের বাচ্চাকে কিনে আনতে বলছো! সেটা আমার শ্বশুরবাড়ি মেনে নিবে তাই বা কিভাবে ভাবছো মা?’
‘মেনে না নাওয়ার কিছু নেই। এমন হরহামেশাই হচ্ছে। তুই দয়া করে আর ঝামেলা করিস না। আবিরকে বোঝানোর ভার আমার।’

ঈশিতা বুঝতে পারে, তার মা আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছে। এবারও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নাই তার।

চার

আবির আর ঈশিতাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে যান দিলারা হাসান। লিয়াকত তাদেরকে একটা ওয়ার্ডের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে কাকে যেন ডেকে আনতে যায়। কিছুক্ষণ বাদেই মোটাসোটা গড়নের এক আয়াকে নিয়ে হাজির হয় সে। মহিলার নাম নুরজাহান। বয়স পঞ্চাশ আর পঞ্চান্নের আশেপাশে। প্রথম থেকেই বিভিন্ন ক্লিনিক আর হাসপাতালে আয়ার কাজ করে আসছে সে।

বিশাল শরীরে থপথপ করে হেঁটে এসে হাঁপাতে থাকে সেই নুরজাহান আয়া। নির্বিকার মুখে দেওয়ালের গায়ে পানের পিক ফেলে খসখসে গলায় বলে, ‘বাচ্চা কেডা নিব?’ দিলারা হাসান মেয়ে আর জামাইকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, ‘এরা নিবে বাচ্চা।’
‘বিয়া কদ্দিনের? বাচ্চা হয়নি?’ লিয়াকত অধৈর্য গলায় বলে, ‘সেই খবরে তুমার কী খালা? বাচ্চা কনে পাইবো? ক্যামনে পাইবো...খোঁজ দাও। নিয়া বিদায় হই। তুমিও কামে যাও।’

লিয়াকতের মুখের দিকে গনগনে চোখে তাকিয়ে আরেকবার পিচ করে পানের পিক ফেলে দশাসই নুরজাহান খালা। তারপরে টেনে টেনে বলে, ‘গরীব মাইনষের বাচ্চারে নিয়ে যাইবো বইলা ডিটেল হুনুম না কী কও মিয়া? গরীব বইলা কি হ্যারা বানের পানিত ভাইসা আইছে নাকি? হ্যারাও আল্লাহর বান্দা! বৈধ বাচ্চা। আল্লাহ্‌র ফেরেশতা। এমনি এমনি যার তার হাতে তুইলা দিমু?’ লিয়াকত শান্ত হয়। সে জানে, এই খালাকে চেতিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। ইনি অনেকটা মিডিয়ার কাজ করে থাকে। দরিদ্র পিতামাতা যারা সন্তান লালনপালনে অক্ষম, তারা এই খালার সাথে যোগাযোগ করে। আর খালা যোগাযোগ করে কোনো নিঃসন্তান দম্পত্তি এমন বাচ্চা কিনে নেবে কিনা। টাকা পয়সা যা পায়, সেই দরিদ্র পিতামাতাকেই দিয়ে দেয় সে। এই লেনদেনে সে নিজে তেমন একটা লাভবান হয় না।

অথবা অন্য কথায় বলা যায়, লাভবান হতে চায় না। এই কাজ পরস্পরের সম্মতির ভিত্তিতেই করে থাকে সে। তবু নিজের বাচ্চাকে যখন অসহায় দুটি মানুষ অন্য একজনের হাতে নিতান্ত বাধ্য হয়ে তুলে দেয়, তখন সেই দরিদ্র পিতামাতার চোখের পানিতে সে এখনো কাতর হয়ে ওঠে। সেই শিশুটিকে বুকে নিয়ে নিঃসন্তান দুজন মানুষ যখন আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে, সেই দৃশ্যও চোখের সামনে থেকে সরে না। এ যেন দুঃখ আর সুখের মিলিত ধারা!
লিয়াকত আবার জিজ্ঞেস করে। তবে এবার বেশ শান্ত গলায়, ‘তাইলে কই যামু খালা?’
‘৩ নাম্বার ওয়ার্ডের পাশে একডা ছোট ঘর আছে। হেইখানে আমার মাইয়া সুফিয়া আছে। হ্যায় বাচ্চা দেখাইবো। আইজ আমার ডিউটি নাই। বাড়িত যামু। হেইখানে গিয়া আমার নাম কইলেই হইবো। সুফিয়ারে কওন আছে!’

এতক্ষণ পাথরের মুখে দাঁড়িয়ে এই কথোপকথন শুনছিল আবির আর ঈশিতা। ঈশিতার দু’চোখের কোল বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। আবিরও চুপচাপ শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ঈশিতার বুকের ভেতরটা অজানা যন্ত্রণায় জ্বলেপুড়ে খাক হচ্ছে। আঠারো বছরের আগুন এত সহজে তো শান্ত হবার নয়! এই বুক যে শিশুকে স্তন্যপান করাতে পারেনি, তা আজও যেন দুধের ভারে টনটন করে ওঠে। তবু সেই বুকে আর কোনো শিশুকে সে ঠাঁই দিতে পারল না! আর কেউ এই দুধের ভার থেকে তাকে মুক্তি দিলো না!

খালার কথামত ৩ নাম্বার ওয়ার্ডের পাশের ছোটঘরটিতে হাজির হয়ে যায় তারা। ঘরটিতে ছোটছোট কয়েকটা বেড সাজিয়ে রাখা। দুইটি বেডে দুজন শিশুকে রাখা আছে। মলিন শাড়ি কাপড়ের দুটি নারী আকুল চোখে সেই শিশুদুটির দিকে ঝুঁকে বসে আছে। সালোয়ার কামিজ পরা একটি সুশ্রী মেয়ে তাদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।

ওদের ঢুকতে দেখেই নারী দুজনের চোখে মুখে কিসের যেন এক ছায়া সরে গেল। ঈশিতার চোখ এড়ালো না সেই অব্যক্ত ছায়ার আড়ালের কথা। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকিছু মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল সে। সুফিয়া মেয়েটিকে দেখে তার বুকের মধ্যে কেমন এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। মেয়েটার বয়স সতেরো আঠারোর বেশি হবে না। আয়াটি বলছিল, সুফিয়া তার মেয়ে। অথচ এই মেয়ের সমগ্র অবয়বের কোথাও সেই আয়াটির সাথে বিন্দুমাত্র মিল নেই। এ যেন অনেকটা...অনেকটা...তার মতোই দেখতে!

নিজেকে শাসন করল ঈশিতা। জীবন জীবনের মতোই। এই জীবনে কাকতালীয় কোনোকিছু এত সহজে ঘটে না। হয়তো এই মেয়েটি সত্যি সত্যিই সেই আয়াটিরই মেয়ে। অথবা এমনও হতে পারে, একেও সে কোথাও থেকে কিনেই নিয়েছে। যদিও সে নিজেও দরিদ্র...কিন্তু তারও তো অপূর্ণ মাতৃত্বের কষ্ট থাকতে পারে! অথবা এটাও সম্ভব... কারো ফেলে যাওয়া সন্তানকেই সে নিজের করে নিয়েছে!

বুকটা কেঁপে ওঠে ঈশিতার। তার অনেক চাপাচাপিতে কাজের মেয়ে কমলা বলেছিল, তার সন্তানকে সেই ক্লিনিকেই ফেলে এসেছিল তার মা। সেখানে তার ভাগ্যে কী ঘটেছিল সেই খবর কেউ জানে না। কাজেই... এমন কি হতে পারে না?

অবরুদ্ধ অশ্রুকে বহুকষ্টে সংবরণ করে বাইরে বেরিয়ে আসে ঈশিতা। এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হয়, দরিদ্র নারী দুটির চোখেমুখে কিসের এক চাপা আনন্দ যেন ছিটকে পড়ছে। ঈশিতা তাদের শিশুদের কাউকে নেবে না, আরো কিছুদিন তারা তাদের শিশুদের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতে পারবে... এই আনন্দ পৌঁছে গেছে তাদের কানে।

এদিকে ঘরে ফিরতে ফিরতে নুরজাহান আয়া তখন ভাবছিল, ঐ বয়স্কা মহিলাটিকে কোথায় যেন দেখেছে সে। অনেকদিন আগে ডাক্তার রওশন জাহানের ক্লিনিকে সে আয়ার কাজ করত। সুফিয়াকে সে যেখানে পেয়েছিল। সেখানেই কি দেখেছে এই মহিলাটিকে?

ভাবনাটা বেশিদূর এগোয় না নুরজাহানের। বয়স হয়ে গেছে। এখন কেন যেন কোনো কিছুই খুব বেশিক্ষণ ভাবতে ভালো লাগে না তার। জীবন সায়রে অনেক তো অবগাহন করা হলো! বিবর্ণ আঁচড়ে মলিন হয়ে গিয়েছে সেই সায়রের জল।
আর কী হবে ওতশত ভেবে?

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;