বৌদ্ধ আর হিন্দু দেবতাদের নিষিদ্ধ মিশ্রণ

, ট্রাভেল

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, নং খাই, থাইল্যান্ড থেকে | 2023-08-31 07:48:56

থাইল্যান্ডের উত্তরের ছোট প্রাদেশিক শহর নং খাই। প্রতিবেশী দেশ লাওসের সঙ্গে সীমান্ত এই শহরের। যাদের ভাগ করেছে মেকং নদী।

শনিবার সকালে ঘুম ভাঙলো দেরিতে। লাওস থেকে আমাদের বন্ধু পাতিতিন এসেছেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। নদীর ওপারেই লাওসের রাজধানী ভিয়েনতিয়েন। নিজের সাইকেল নিয়েই চলে এসেছে এখানে৷ নং খাই কানালায়ায়েউই ওয়াক্লেহংয়ের চেয়েও ভালো চেনেন পাতিতিন। ও হ্যা, পাতিতিনের ডাক নাম কং আর কানালায়ায়েউইয়ের ডাক নাম পে।

আগের সন্ধ্যায় মেকংয়ের তীরের সান্ধ্যকালীন বাজার দেখা হয়েছে আর নদী তীরে রাতভর আড্ডা। তাই শনিবারে ঠিক করলাম সাইক্লিং করব আর দেখতে যাবো সালা কাও খু।

এই শহর খুব ছিমছাম। মানুষের তুলনায় প্যাগোডার সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। আর ড্রাগনের যে প্রভাব রয়েছে, সেটা রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে শুরু করে যেকোন স্থাপনার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। প্রায় ৫ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে পৌছালাম সালা কাও খু'তে। সূর্য যেন আজ সকাল থেকেই আগুন ঢেলে যাচ্ছে। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল বুদ্ধের দাঁড়িয়ে থাকা এক দীর্ঘ মূর্তি৷ আর সাপের সাতটি ফনা৷

সালা কাও খু'তে ঢুকতে গুণতে হলো ১০০ টাকার টিকিট। এরপর যেন অভিভূত হওয়ার পালা৷ এখানকার ভাস্কর্যগুলো রহস্য ছড়ানো। কারণ এর নির্মাণেই যেন ছড়িয়ে আছে রহস্য। এই সালা কাও খু নির্মাণে সময় লেগেছে ২০ বছরের বেশি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রহস্যে ঘেরা এক সাধু লুয়াং পু বৌন লিউয়া সৌরিরাত এই ভাস্কর্যের বাগান নির্মাণ করেছিলেন গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে৷ ১৯৯৬ সালে পরলোকগমন করেন লুয়াং পু। কিন্তু তার সাধনায় নির্মিত বুদ্ধ, শিব, ভিষ্ণু এবং আরো দেব-দেবীর মূর্তিগুলো যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি চোখে পড়ার মতও।

শুধু হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম নয়, লু পাং অন্যান্য ধর্ম-সংস্কৃতি থেকেও নিয়েছেন উপাদান। যেমন তার শবদেহ চিতায় না দিয়ে তার ইচ্ছেনুযায়ী কবর দিয়ে মাজার বানানো হয়েছে। আর এই মাজারের গঠন একেবারেই প্যাগোডার সঙ্গে যায় না।

এই লুয়াং পু এবং কাও খু নিয়ে বেশ জ্ঞান রয়েছে কংয়ের। সে বললো, লুয়াং পু নিজের জীবনিতে বলেছেন, তিনি শৈশবে একটি গর্তে নিমজ্জিত হয়েছিলেন। যেখানে তার সঙ্গে কাও খু নামে একজন সন্নাসী ভূ-গর্ভের এক রহস্যময় জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তাকেও একজন পুরোহিতে রূপান্তরিত করেন। পরে ভিয়েতনামে এক যোগীর কাছে হিন্দু ধর্মের দীক্ষাও নেন তিনি। বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের মিশ্রণ করে নতুন এক মৌলিক ধর্মীয় ধারণার উদ্ভব ঘটান লুয়াং পু। মেকং নদীর তীরের আশপাশে তার অনুসারি বাড়তে থাকে হু হু করে। এমনকি এই কাও খু’র ভাস্কর্যের বাগান প্রকল্পও করার কথা ছিল লাওসে। তবে ১৯৭৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টি লাওস নিয়ন্ত্রণে নিলে সেখান থেকে সরে থাইল্যান্ডের নং খাইতে চলে আসেন তিনি।

এখানে ভাস্কর্যগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটলে ঐতিহাসিক বা ধর্মীয় আবেশ পাওয়া যাবে না। বরং কিছুটা অদ্ভুত আর রহস্যঘেরা যেন সব কিছু। এখানে প্রথমে ঢুকলেই একজন সর্পদেবী রয়েছেন। তার পেছনেই এক ঝাঁক কুকুরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হাতি। ভাস্কর্যগুলো নিখুঁত৷ গড়নে রয়েছে শিল্পের ছোঁয়া৷

এখানে আরেকটি বড় ভাস্কর্য আমাদের মতো অনেককেই ভাবাচ্ছে। একটি কুকুর মাঝখানে। তার পেছনে একটি সাপ ফনা তুলে রয়েছে। আর অপর পার্শ্বে ধনুক হাতে তরুণ। এই ভাস্কর্যে তিনটি চরিত্র কে কাকে রক্ষা করছে বা মারতে চাচ্ছে সেটি বোঝার উপায় নেই। থাই ভাষায় লেখা রয়েছে বর্ণনা। পে সেটি পড়ে আমাদের জানালো, এটাই হচ্ছে দৃস্টিভঙ্গি। আসলে তুমি যেটা বিশ্বাস করতে চাও সেটাই দেখতে পাবে৷

এখানে দুটি মাঝারি ধরনের পুকুর রয়েছে। পুকুরে মাগুর মাছের ঝাঁক। দেখে মনে হয় এক-একটি মাছের ওজন ৫ থেকে ১০ কেজির কম হবে না। দর্শনার্থীরা অনেকেই পাউরুটি ছুড়ে দিচ্ছেন আর এক গালেই পুরে নিচ্ছে মাছগুলো। এই মাছ এবং এখানকার কবুতরগুলোকেও পবিত্র আর রহস্যঘেরা বলে বিশ্বাস করেন অনুসারীরা।

সেখানে কিছুক্ষণ বসে থেকে আমরা হেঁটে হেঁটে ভাস্কর্যগুলোর রহস্য উন্মোচনের ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। এখানে সবচেয়ে উঁচু ভাস্করর্যটি ২৫ মিটার। যেটাতে একটি কালসাপের বুক বরাবর বসে আছেন বুদ্ধ আর সাপটির মাথা ৭টি।

এখানকার ভাস্কর্য আর মূর্তিগুলো দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, সাপ ভালোবাসতেন লুয়াং পু। কং বলেন, তিনি বিশ্বাস করতেন, ভবিষ্যত সময় সাপের। সাপের কোন হাত পা নেই পৃথিবী ধ্বংস করার মতো। তাই এটি এক পবিত্র প্রাণী। তিনি নিজেকেও অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক সাপ বলে ভাবতেন।

লুয়াং পু'র অনুসারীরা এই ভাস্কর্যের বাগানটি তৈরি করেছেন তার সন্ন্যাসী কাও খু'র স্মরণে। লুয়াং পু তার জীবনীতে বলেছেন, তার অনুসারীরা কেউ ভাস্কর নয়, তবে সবাই হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে এই ভাস্কর্যগুলো বানিয়েছেন৷

১৯৯৬ সালে লুয়াং পু'র মৃত্যু হলে তার অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু পরের বছরই লুয়াং পু'র এই সর্পকেন্দ্রিক দেবতা প্রার্থনা নিষিদ্ধ করে নং খাইয়ের স্থানীয় সরকার।

এখানে হাঁটার সময় হঠাৎ করেই যেন হিম হয়ে আসে শরীর। মনে হয় যেন কোন অশরীরি আত্মা ঘোরাফেরা করছে৷ লুয়াং পু'র সাপের ভাস্কর্যগুলো কেমন যেন রহস্যময় হাসি দিয়ে রেখেছে।

দুপুরের রোদে আমাদের যেন কাহিল দশা। মেকংয়ের তীর ধরে হোটেলে ফিরতে আবার ৫ কিলোমিটার সাইক্লিংয়ের কথা ভাবতেই লুয়াং পু'র রহস্য মাথা থেকে উবে গেল!

এ সম্পর্কিত আরও খবর