ইমরান খানের বিয়ের তিন ইনিংস ও দুটি ‘রাজনৈতিক ডিভোর্স’!

ক্রিকেট, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 08:13:07

সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝি। বিশ্বসুন্দরীরা কে কেমন বর পছন্দ করেন- সেই গল্পের মাঝে হঠাৎ করে মিস অস্ট্রেলিয়ার কাছে একটা প্রশ্ন গেল; ‘‘তা আপনি এবারের ক্রিসমাসে কি উপহার পেলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন।’’

জমাট সেই আড্ডায় বেশি সময় না নিয়ে মিস অস্ট্রেলিয়ার উত্তর -‘ইমরান খান’!

ব্যস সেই তখন থেকেই ক্রিকেট আড্ডায় হ্যান্ডসাম বিষয়ক গল্পে এটা খুবই জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত একটা উক্তি হয়ে গেল।

ইমরান খান-এই নামের মধ্যেই এটা জাদুকরী আকর্ষণ। খেলার মাঠে। মাঠের বাইরে। চলাফেরায়। কথাবার্তা। হাসিতে। ব্যাটে- বলে। ব্যক্তিত্বের ছটায়-তার সবকিছু জুড়ে নায়কোচিত এক আর্কষণ!

একটু অন্যভাবে বললে-এক সময় ক্রিকেট দুনিয়ায় হ্যামিলেনের বাঁশিওয়ালা হয়ে হেঁটেছেন ইমরান খান। আর তার পেছনে বিশ্বের তাবৎ সুন্দরীদের ম্যালা ভিড়। আহা যদি একবার তাকে ছোঁয়া যায়! সেইসময় এই দৌঁড়ে জানা শোনা প্রতিদ্বন্দ্বীদের নামগুলো একটু শুনি আজ আরেকবার; কলকাতায় মুনমুন সেন। মুম্বাইয়ে জিনাত আমান। আমেরিকায় সিটা হোয়াইট। ইংল্যান্ডে সুসানা কনস্টানটাইন, লেডি ক্যামম্পেল, বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এমা সার্জেট।

ভাবছেন ব্যাস এটুকুই! মুলত ইমরানের জীবনে প্রেমের সংখ্যা  অসংখ্য, তবে কোন প্রেমের ইনিংসই লম্বা হয়নি। এক ইনিংস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরের প্রেমের ইনিংস শুরু। কে প্রথম আর কে মাঝের জন সম্ভত সেই নামগুলোও ভুলে গেছেন ইমরান!

আমরা তাই সেই নামগুলো মনে রাখি কি করে?

এমনসব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয় ইমরান খানও সেই পথেই হাঁটা শুরু করলেন। বয়স ত্রিশ পেরিয়ে গেল, কিন্তু বিয়ের কথা মুখেই আনছেন না। পয়ত্রিশও হয়ে গেল। তারপরও বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই জবাব কেবল রহস্য ছড়ানো মুচকি হাসি!

কারো আশা না ভেঙ্গে সবাইকে আশায় রাখা-রাসপুটিনীয় এই প্রেমের সূত্র ঠিক রেখে চল্লিশের পরও নিজেকে মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলার’-এর তালিকায় রাখেন ইমরান। অবশেষে একসময় সেই ইনিংসও শেষ হয় তার।

বিশ্বের সব গোলার্ধের তরুণী হৃদয়ে ঝড় তোলা ইমরান বউ হিসেবে বেছে নেন বৃটিশ ধনকুবেরের মেয়ে জেমিমা গোল্ডস্মিথকে। প্রথম যৌবন ইংল্যান্ডে কাটানো। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা। কাউন্টিতে খেলা-সবকিছু মিলেই ইংল্যান্ড ছিল ইমরানের সেকেন্ড হোম। ‘প্রথম’ বিয়ের জন্যও সঙ্গী বেছে নিলেন সেখান থেকেই। ধারণা করা হচ্ছে, ইমরানের প্রেমে তার আকর্ষণেই একপ্রকার অন্ধ হয়েই জেমিমা সব ছেড়ে তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই বিয়ের সময় ইমরানের বয়স ছিল ৪২। কনে জেমিমা মোটে ২১!

বিয়ের আগে ইমরানের দেয়া সব শর্তই কবুল করেন জেমিমা। ইহুদি ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হোন। মুসলিম নাম হয় তার হাইকা। ১৯৯৫ সালে রিচমন্ডে পুরোদুস্তর ইমলামি কায়দায় ইমরান ও জেমিমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর জেমিমা পাকিস্তানে চলে আসেন। অপরিচিত পাকিস্তানি সংস্কৃতি ও বোলচালের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিজেকে পুরোপুরি পাল্টে ফেলেন জেমিমা। পাশ্চ্যাতের পোষাক ও চালচলনে অভ্যস্ত জেমিমা পাকিস্তানি স্টাইলের সালোয়ার-কামিজ পরা শুরু করেন। মাথায় উঠে ওড়না। ইসলামি অনুশাসন মেনে চলতে শুরু করেন, এমনকি উর্দূও শেখেন।

এরই মধ্যে ইমরান খান পাকিস্তানে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও শুরু করেন। ইমরানের রাজনৈতিক মিছিলে ওড়না মাথায় নিয়মিত জেমিমাকেও দেখা যেতে লাগল। দারুণ সুখে ভরা তাদের সংসারে দুই শিশুপুত্র জন্ম নিল-সুলায়মান ও কাশিম। বিয়ের পরও ইংল্যান্ডে যান জেমিমা। তবে বছরের বেশিরভাগ সময় তার কাটে পাকিস্তানে। ইমরান খান এই সময় রাজনীতিতে বেশি ব্যস্ত হয়ে যান। তেহরিকে ইনসাফ নামের একটি রাজনৈতিক দলও গড়ে তোলেন তিনি। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নির্বাচিতও হন। কিন্তু তার রাজনৈতিক দল শুরুতে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফের রোষানলে পড়ে ইমরানকে জেলেও যেতে হয়। সেসময় প্রায় বছর খানেক জেমিমা ও তার সন্তানদের নিরাপত্তায় ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ইমরান জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ফেরেন। কিন্তু সেই তখন থেকেই এই জুটির মধ্যে ভাঙ্গনের সুর শোনা যেতে লাগল।

পুর্ব-পশ্চিমের সাংস্কৃতিক বিরোধ। দ্বন্দ্ব-জীবনবোধ হঠাৎ করে তাদের দাম্পত্য জীবনে ছন্দপতন ঘটায়। সংসার জীবন নাকি রাজনীতি; এই দুইয়ের মধ্যে একটা পছন্দ বেছে নেয়ার সময় এসে দাড়ায় ইমরানের সামনে। যখন মাঠে ক্রিকেট খেলতেন তখনো এমন অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হয়েছে। শেষমেষ রাজনীতিকেই বেছে নিলেন ইমরান। বউ বাদ। বিয়ে করার জন্য জেমিমা যেভাবে পাগলপারা হয়েছিলেন এবার ডিভোর্সের জন্যও ঠিক তেমনই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ইমরান- জেমিমা জুটির নবম বিয়ে বার্ষিকীর সময়টা কাটল ডিভোর্সের ফাইল নিয়ে আদালতে দৌঁড়েদৌঁড়িতে।

অবশেষে ২০০৪ সালের ২২ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে এই জুটির ডিভোর্স সম্পন্ন। ইমরান ‘পরাজয়’ মেনে নিয়ে তখন জানান- জেমিমা পাকিস্তানে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার সব চেষ্টাই করেছে। কিন্তু আমার রাজনৈতিক জীবনের জন্য তার এখানে টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে দাড়ায়। তাই আমরা সবঝোতার মাধ্যমে এই ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেই। এটা আমাদের দুজনের জন্যই অত্যন্ত দুঃখজনক একটা অধ্যায়। ঘটনা। আমার ভবিষ্যৎ এবং চিন্তাভাবনা সবকিছুই জুড়েই শুধু পাকিস্তান এবং রাজনীতি।’

-তো জনগণ, কি বুঝলেন?

কেবল নিজের রাজনৈতিক জীবনকে সফল করতেই ইমরান সেই সময় নিজের প্রথম বউকে ছেড়ে দেয়ার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সন্দেহ নেই আলোচিত এই ডিভোর্সের সিদ্ধান্তের দায়ভার সেসময় পুরোটাই ইরমানের ঘাড়েই চেপেছিল। নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে সফেদ করতেই ইমরান এই ডির্ভোসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে পাকিস্তানের বিশ্লেষকদের বিশ্বাস।

রাজনীতির ময়দানে ইমরানের পাশে স্ত্রী হিসেবে জেমিমার উপস্থিতি জনগণের মনে আস্থা জাগাতে পারেনি। তার বিয়ে এবং হঠাৎ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া-এই দুইয়ের মধ্যে পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিমাদের একটা ষড়যন্ত্র আবিস্কার করে বসে সেসময়। পাকিস্তান জুড়ে একটা প্রচলিত ধারণা ছড়িয়ে পড়ে ইহুদি ধর্মের মেয়েকে ইমরানের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব পাকিস্তানে নতুন ফর্মূলায় নিজেদের কৃর্তত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর এই কাজে ইমরানকে স্রেফ ঘুঁটির মতো ব্যবহার করছে পশ্চিমা শাসকরা। মুলত এই ধারণা একসময় পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় বিশ্বাসে পরিণত হয়। আর এই কারণে শুরুতে ইমরানের রাজনৈতিক দল তেহরিকে ইনসাফ পাকিস্তানে মোটেও জনপ্রিয়তা পায়নি। এই দলটি পশ্চিমাদের দালাল-এই ব্র্র্যাকেটেই তাদের উত্তরণ আটকে যায়। ইমরানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও নিশ্চিত অপমৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

সেই রাজনৈতিক ধস ঠেকাতেই ইমরান-জেমিমার ডিভোর্স!

বহুল আলোচিত সেই ডিভোর্সের পরের এক দশকের পুরোটাই ইমরান খান ব্যয় করেন তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে শক্তপোক্ত করতে। হঠাৎ করেই ২০১৫ সালে পাকিস্তানের জিও টিভির সাংবাদিক, উপস্থাপিকা ও সিনেমা প্রযোজক রেহাম খানকে বিয়ে করেন। তবে সেই বিয়ের ইনিংস বছরখানেকও টিকলো না। রেহামের আগের বিয়ে, তার স্টাইলিস্ট বাহারি এবং উদারনৈতিক জীবনযাপন ইমরান খানের রাজনীতিক পুচ্ছদের ধাঁতের সঙ্গে যায়নি। ইমরান আরেকবার আপোষ করলেন রাজনীতির সঙ্গে। রেহামের সঙ্গে তার সংসার ধর্ম টিকে মাত্র ৯ মাস। পাকিস্তানের ক্রিকেটার কাম এই রাজনীতিবিদ প্রকাশ্যে স্বীকারও করেন-‘রেহামকে বিয়ে করাটা ছিল তার জীবনের  বড় একটা ভুল সিদ্ধান্ত।’

সেই ভুল থেকেই বেরিয়ে আসতেই ‘দ্বিতীয় ডিভোর্স!’

তিন নম্বর বিয়ে ইমরান খান করেছেন চলতি বছরেই। তৃতীয় বিবির নাম বুশরা মানেকা। ভীষন পর্দানশীন, ধার্মিক। ইমরানের রাজনৈতিক দল, দর্শন এবং পাকিস্তানি ভাবধারার সঙ্গে পুরোপুরি মিল তার। বিয়ের ‘তৃতীয় ইনিংস’ ইমরানের জন্য তাহলে সৌভাগ্যই বয়ে এনেছে।

পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে ইমরান খানের বসে পড়াটা এখন নেহাৎ একটা সময়ের অপেক্ষা!

এ সম্পর্কিত আরও খবর