হাতুড়েসিংহের কাছে ফেরা আর ‘হাতুড়ে চিকিৎসা’ একই কথা!

ক্রিকেট, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পোর্টস এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-30 17:56:02

বাংলাদেশ কোচের পদের চাকরির জন্য কোনো দরখাস্ত করেননি চন্ডিকা হাতুড়েসিংহে। আবেদন পত্র জমা দেয়ার তারিখ অনেক আগেই শেষ। এমনকি হাতুড়েসিংহে ব্যাক ডেটেও কোনো দরখাস্ত জমা দেননি।

কিন্তু তারপরও বিসিবি’র উৎসাহী একটা অংশ তাকে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের কোচ হিসেবে পেতে আগ্রহী!

তাও যেনতেন ভাবে আগ্রহী নয়, একেবারে নিজস্ব উদ্যোগে ঢাকা থেকে কলম্বোতে হাতুড়েসিংহের সঙ্গে ফোনে কথা বলে। আলোচনা প্রথম ধাপ এর মধ্যেই শেষ!

অথচ বিসিবির টেবিলে এখনো কিন্তু হাতুড়েসিংহের চেয়েও হাইপ্রোফাইল কোচের দরখাস্ত জমা পড়েছে। এদের বায়োডাটা এবং কোচিং ক্যারিয়ারের সাফল্য জানাচ্ছে হাতুড়েসিংহে এদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে।

কিন্তু ‘টেন্ডারে’ অংশ না নেয়া হাতুড়েসিংহেকেই আবার বাংলাদেশ কোচের কাজটা দেয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে বিসিবির একটা অংশ।
 
প্রশ্ন হলো- কোচ হাতুড়েসিংহের কাছে বিসিবি কি এমন যাদুমন্ত্র দেখতে পেয়েছিলো যে তাকে আবার ফিরিয়ে আনার জন্য তার কাছেই উল্টো দরখাস্ত ঠুকতে হবে?

একটা বড় অভিযোগ কারণ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে, আর তা হলো কমিশন বাণিজ্য! মোটা বেতনে তাকে বাংলাদেশ কোচের চাকরিটা দিতে পারলে তার এজেন্টের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন মিলবে!

আর তাই উপযাজক হয়ে তাকে কোচের পদে ফেরানোর এমন নিয়ম ভেঙ্গে উঠে পড়ে লাগা! পরীক্ষার ফর্মই যিনি কিনেননি, তাকে পরীক্ষায় প্রথম করিয়ে দেয়ার দু’নম্বরি চিন্তা!
 
কোচ হিসেবে চন্ডিকা হাতুড়েসিংহে এমন আহামরি কিছুই ছিলেন না। মূলত বাংলাদেশে কোচ হিসেবে যোগদানের পর থেকেই তার নামটা কোচদের তালিকায় একটু আলাদা ভাবে উচ্চারিত হতে শুরু করে। এটা ঠিক যে তার কোচিং কালে বাংলাদেশের ক্রিকেট দল বেশ ভালো সাফল্য পায়। তবে তাতে কোচ হিসেবে তার যতখানি না ভূমিকা তারচেয়ে বেশি এই সাফল্যের পেছনে ছিলো বাংলাদেশের সিনিয়র পাঁচ ক্রিকেটারের পারফরম্যান্স। সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ এবং মাশরাফির সেরা সময় তিনি বাংলাদেশ কোচের দায়িত্ব পান।

কোচ মাঠের বাইরে দলের পরিকল্পনা ঠিক করে দেন। কিন্তু মাঠে তো ক্রিকেটারদেরই পারফরম্যান্স করতে হয়। ড্রেসিংরুম বা ল্যাপটপের পাশে বসা কোচ কোনো ক্রিকেট ম্যাচ জেতায় না। ম্যাচ জেতায় ২২ গজের ক্রিকেটাররা।

এই হিসেবটাই বুঝতে না পেরে হাতুড়েসিংহের জমানায় আসা সাফল্যকে বিসিবি পুরোটাই ‘কোচের কৃতিত্ব’ভাবতে শুরু করে দেয়। আর তাই তাকে এতো বেশি ক্ষমতায়ান করা হয় যা তাকে কোচ নয়, স্বৈরশাসকেই পরিণত করে।

এক সময় তিনি নির্বাচকদের পাত্তা না দেয়া শুরু করেন। দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের মধ্যে শুধুমাত্র তামিম ইকবাল ছাড়া বাকি চারজনের সঙ্গেই তিনি ঝগড়া বাঁধিয়ে বসেন।

বিস্তারিত উদাহরণ দিলে এই রিপোর্টের আকার প্রবন্ধ হয়ে যাবে!

মাশরাফিকে টি-টুয়েন্টিতে তিনি শুধু অধিনায়ক না, দলেই রাখতে চাননি। বোর্ডকেও সেই ফতোয়া গেলান হাতুড়েসিংহে। আর তাই হঠাৎ একরাতের সিদ্ধান্তে মাশরাফি টি-টুয়েন্টি থেকে সরে দাড়ান।

কোচিংয়ের শেষ অ্যাসাইনমেন্টে ২০১৭ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে টেস্ট অধিনায়ক মুশফিক রহিমের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলেন কোচ হাতুড়েসিংহে। মাঠের ফিল্ডিং পজিশন কি হবে সেটা ড্রেসিংরুম থেকে কোচ ঠিক করে দিতেন। অধিনায়ক যেন পুতুল শুধু! মুশফিককে তিনি ফিল্ডিং করতে পাঠান বাউন্ডারি লাইনে। অধিনায়ক হিসেবে সেটাই ছিলো মুশফিক রহিমের শেষ সিরিজ।

সাকিব আল হাসান তিন নম্বরে ব্যাট করুন এটা কখনোই চাননি তিনি, এই পজিশনে বারবার সাব্বিরকে প্রমোট করতে চেয়েছেন হাতুড়েসিংহে। তিনে ফিরার জন্য সাকিবকে তার চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। আর তিনে ফিরে যেন নিজেকেও ফিরে পেলেন সাকিব, বিশ্বকাপে যার ফল পেয়েছে বাংলাদেশ।
 
মুমিনুল হকের ব্যাটিংয়ের মধ্যে কোচ হাতুড়েসিংহে এত বেশি খুঁত খুঁজে পেয়েছিলেন যে তাকে তিনি টেস্ট দল থেকে একসময় বাদ দেন। একজন ব্যাটসম্যানের ব্যাটিংয়ে ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। কোচের কাজই সেটা শুধরে দেয়া। কিন্তু হাতুড়েসিংহে সেটা না করে মুমিনুলকে বাদ দেয়ার মধ্যে সমাধান খুঁজলেন। তার আত্মবিশ্বাস নষ্ট করার জন্য যা করার সবাই করলেন।

সেই মুমিনুল হক জবাবটা ঠিকই দিলেন ব্যাট দিয়ে। শ্রীলঙ্কার কোচ হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন হাতুড়েসিংহে। সেই সফরে প্রথম টেস্টেই মুমিনুল উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে জানিয়ে দিলেন তাকে নিয়ে অবিচার করেছিলেন হাতুড়েসিংহে।

ঘরোয়া ক্রিকেটের একটা ম্যাচও না দেখতেন না তিনি। অথচ তিনি নির্বাচক প্যানেলের সবচেয়ে প্রভাবশালী কর্তা! চরম স্বেচ্ছাচারিতার উদাহরণ তৈরি করেন কোচ হাতুড়েসিংহে। বিসিবি সভাপতি ছাড়া বোর্ডেরও কাউকে তেমন পাত্তা দিতেন না কোচ। অথচ তিনি ছিলেন বোর্ডের একজন চাকুরে! পুরো ড্রেসিংরুমে দমবদ্ধ করা একটা পরিবেশের উদ্ভব হয় তার সময়ে। চোখ গরম হেডমাষ্টারের পদবী জুটে হাতুড়েসিংহের নামের পাশে।

বিশ্বকাপের আগেভাগে হঠাৎ করেই চাকরি ছেড়ে শ্রীলঙ্কায় নিজ দেশের কোচের পদে ফিরে যান হাতুড়েসিংহে। আকস্মিকভাবে তার এই চলে যাওয়ায় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ পরিকল্পনা সঙ্কটে পড়ে। কিন্তু মেয়াদ পুরো না করে পেশাদারিত্বের গল্প ফেঁদে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলে হাতুড়েসিংহে চলে যান।

শ্রীলঙ্কায়ও সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে তার বিবাদ লেগেই ছিলো। তার সময়ে তিনজন অধিনায়ককে বদল করেন তিনি। চান্দিমাল-ম্যাথুস-মালিঙ্গা, কোনো সিনিয়রের সঙ্গে তার বনিবনা হয়নি। অবস্থা এমন দাঁড়ায় বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ে। চার বছর পর দলে ফিরিয়ে এনে দিমুথ করুনারত্নেকে অধিনায়ক করতে হয়। শ্রীলঙ্কায় কোচ হিসেবে ব্যর্থ হাতুড়েসিংহে এখন চাকরিহারা হয়ে বিপদে।

কোচ হিসেবে হাতুড়েসিংহে আসলে সমাধান নয়, উল্টো সমস্যার অন্য নাম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর