বাংলাদেশ জিতল ‘লড়াই’, অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ!

ক্রিকেট, খেলা

এম.এম. কায়সার, স্পোর্টস এডিটর, বার্তা২৪.কম, নটিংহ্যামশায়ার, ইংল্যান্ড থেকে | 2023-08-30 12:41:34

৪৮ রানে হারা ম্যাচে প্রতিযোগিতা হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। জিততে পারতো বাংলাদেশও-এমন কিছু বললে অনেকেই হয়তো অবিশ্বাসের চোখে তাকাবেন! কিন্তু স্কোরকার্ড দেখে নয়, যারা এই ম্যাচ দেখেছে তারা নিশ্চিত জানেন ৩৮১ রানের পিছু ধাওয়া করতে নেমে এই ম্যাচে বাংলাদেশেরও সম্ভাবনা ছিল।

আসলে অস্ট্রেলিয়া শুধু এই ম্যাচ জিতল অংকের খাতায়। বাংলাদেশ যা জিতল তার নাম-লড়াই। তার নাম-সাহস! অস্ট্রেলিয়ার ৩৮১ রানের জবাবে বাংলাদেশ তুলল ৮ উইকেটে ৩৩৩।

বিশ্বকাপে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি আনন্দ উদযাপন হয়তো মুশফিক করতে পারলেন না। তবে তার এই সেঞ্চুরি এবং গোটা ম্যাচে বাংলাদেশের সম্মিলিত ব্যাটিং আরেকবার জানিয়ে দিলো-এই বাংলাদেশ ক্রমশই বিস্মিত করছে ক্রিকেট বিশ্বকে!

অস্ট্রেলিয়ার হৃদকম্প এতদূর থেকেও ঠিক শোনা যাচ্ছিলো! ৩৮১ রান তুলেও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের টেনশন এবং সাদা চেহারা আরও ‘সাদা’ হয়ে যাওয়া ঠিকই টের পাওয়া গেলো! মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ব্যাটিং নড়িয়ে দিলো অস্ট্রেলিয়ার ভিত। এবং সত্যিকার অর্থে বললে ম্যাচের একসময় অজিরা ঠিকই ‘ভীত’ হয়ে পড়েছিলো হারের ভয়ে!

হ্যাঁ স্কোরবোর্ডে ৩৮১ রান জমা করেও!

যে ক্ল্যাসিক কায়দায় মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ রান তাড়া করছিলেন পঞ্চম উইকেটে বাংলাদেশের সেই জুটিই অস্ট্রেলিয়ার শিরদাঁড়ায় ভয়ের একটা স্রোত বইয়ে দেয়; হারের!

এই ম্যাচের শেষভাগ পুরোপুরি টি-টুয়েন্টি মেজাজের হয়ে দাঁড়ায়। ম্যাচ জিততে বাংলাদেশের শেষ ৩৬ বলে চাই ৯৩ রান। তখনো অনেক বড় টার্গেট। কিন্তু ম্যাচের আগের দিন বলা মাশরাফির সেই কথাটা যে এই বাংলাদেশ দলের সব ক্রিকেটারদের অন্তরের বিশ্বাস-‘কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়; লড়বে বাংলাদেশ।’

সত্যিকার অর্থেই লড়ল বাংলাদেশ।

অস্ট্রেলিয়ার ৩৮১ রানের পিছু তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশের শুরুটা ভালো হয়নি। ২৩ রানে ভাঙে ওপেনিং জুটি। রান আউট হয়ে ফিরেন সৌম্য সরকার। তামিম ও সাকিব দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠছিলেন। দুজনে বেশ চমৎকার কায়দায় দলের ইনিংসকে সামনে বাড়াচ্ছিলেন। সাকিব টুর্নামেন্টে আরেকটি হাফসেঞ্চুরির কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্টয়নিসের একটি স্লোয়ার বুঝতে না পেরে ব্যাটের কানায় বল লাগিয়ে ক্যাচ তুলে দেন। ৪১ বলে ৪১ রান করে ফেরেন সাকিব। চলতি বিশ্বকাপের পাঁচ ম্যাচে এই প্রথম সাকিব অন্তত হাফসেঞ্চুরি নিচে আউট হলেন।

তামিম ইকবাল অবশ্য চলতি টুর্নামেন্টে নিজের হাফসেঞ্চুরি পেলেন। কিন্তু ইনিংসটা ৬২ রানের চেয়ে বেশি বড়ো করতে পারলেন না। পাঁচে ব্যাট করতে নামা লিটন দাসকে বাউন্সার দিয়েই স্বাগত জানালো অস্ট্রেলিয়া!

মিচেল স্টার্ক প্রথম বলটাই শর্ট দিলেন। বাউন্সার! লিটন মাথা নিচু করে সেই বাউন্সার এড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু সফল হলেন না। বল সোজা গিয়ে লাগলো তার হেলমেটে। বলের ধাক্কায় লিটন তাল সামাল দিতে পারলেও হেলমেট খুলে ফেলেন। বলের ধাক্কাটা লাগে তার হেলমেটের একপাশে। মাথা ঝাঁকুনি দিতে থাকেন লিটন। কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা- সেটা জানার জন্য সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক মাঠে ছুটেন। বারকয়েক লিটনকে পরীক্ষা করে চিকিৎসক যখন দেখলেন কোনো সমস্যা হয়নি। তখন আবার খেলা শুরু করেন আম্পায়াররা। তবে স্টার্কের বাউন্সারে ক্ষতিগ্রস্ত হেলমেটটা বদলে ফেলেন লিটন।

আগের ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুর্দান্ত ব্যাটিং করা লিটন দাসকে এই ম্যাচে ভালোই হোমওয়ার্ক করে নেমেছিল অস্ট্রেলিয়া। লিটন ব্যাট হাতে পাল্টা হামলা চালাতে পছন্দ করেন সেটা জেনে গেছে অস্ট্রেলিয়া। তাই শুরুতেই লিটনের আত্মবিশ্বাস যাতে নড়িয়ে দেয়া যায় সেজন্যই স্টার্ক তাকে প্রথম বলেই বাউন্সার দেন।

পরের ওভারেই অন্যপ্রান্ত থেকে প্যাট কামিন্সকেও আক্রমণে আনেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ। দু’প্রান্ত থেকে নিজের দলের সেরা ফাস্ট বোলারকে বাংলাদেশের ইনিংসের মাঝপথে আক্রমণে আনার উদ্দেশ্যই হলো গতির চোটে বাংলাদেশকে সঙ্কটে ফেলা।

লিটন দাস তিন বাউন্ডারিতে এই ম্যাচেও শুরুটা ভালোই করেছিলেন। কিন্তু স্পিনার অ্যাডাম জাম্পার বলে এলবি হলেন ২০ রান তুলে। মুশফিকের সঙ্গে এসে জুটি বাঁধলেন মাহমুদউল্লাহ। এই দুজনের ব্যাটে যা মিললো তার নাম-সাহস! তার নাম- জেতার জেদ! অসম্ভব সুন্দর ব্যাটিং করেন দুজনে বাংলাদেশকে রানকে যেভাবে সামনে বাড়ালেন তাতে অস্ট্রেলিয়ার ৩৮১ রানের স্কোরকে খুব দুরের পথ মনে হচ্ছিলো না!

দুজনেই দলের ব্যাটিংকে ম্যাচের একদম গভীর পর্যন্ত নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করলেন। দারুণভাবে তাতে সফলও হলেন। রক্ষণের সঙ্গে আক্রমণের মিশেল-ক্লাসিক ভঙ্গির এই ব্যাটিংয়ে জুটিতে যোগ হলো ১২৭ রান। তাও আবার মাত্র ১৬.১ ওভারে! মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ৫০ বলে ৬৯ রান করে।

শেষের টি-টুয়েন্টির আদলে সাব্বির রহমানের জন্য মঞ্চ তৈরি তখন। চাই ২৭ বলে ৮০ রান। কিন্তু সাব্বির রহমান যে এই মহাগুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রথম বলেই আউট! দুই বলে দুই উইকেট তুলে নিয়ে কোল্টার-নাইল মূলত ওখানেই অস্ট্রেলিয়ার জয়টা নিশ্চিত করে দিলেন।

আগের দিন লড়াইয়ের কথা বলা মোসাফির আরেকটি কথা মনে পড়লো এদিন ম্যাচ শেষে-‘৩৩০/৩৪০ রান তাড়া করা যায়, কিন্তু প্রতিপক্ষের স্কোর ৩৭০/৩৮০ হয়ে গেলে সেটা তখন...।’

অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে তো সেটাই হলো!

এ সম্পর্কিত আরও খবর