শুধুমাত্র আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি দেখছে সরকার

বিএনপি, রাজনীতি

রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-31 04:35:16

জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে আছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে কারাবন্দী করা হয়। তার কারাবাসের ১৬ মাস ইতোমধ্যেই পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘ এই সময়ে একাধিকবারই খালেদা জিয়ার মুক্তির গুঞ্জন ওঠে, কিন্তু প্রতিবারই সে গুঞ্জনের ধ্বনি সময়ের সঙ্গে বাতাসে মিলিয়ে গেছে।

গুঞ্জনের ধারাবাহিকতায় ফের আলোচনায় বেগম জিয়ার কারামুক্তি। সংসদ থেকে রাজনীতির ময়দান, হাইকোর্ট থেকে চায়ের টেবিলে, এছাড়াও খালেদার মুক্তি নিয়ে প্রতিদিনই গণমাধ্যমে কথা বলছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী। বিএনপির নেতারা যেখানে দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তি না হওয়ার জন্য সরকারের সদিচ্ছাকে দায়ী করে রাজপথের আন্দোলনকে উপায় হিসেবে দেখছেন, সেখানে একমাত্র আইনি প্রক্রিয়াতেই বেগম জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা দেখছে সরকার।

কারাবন্দী বেগম জিয়ার মুক্তির গুঞ্জন জোরালো হয় চলতি বছরের জানুয়ারিতে। তখন টানা তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। গুঞ্জন ওঠে, সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেওয়ায় খালেদার মুক্তির নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে। কারাগারে অসুস্থ খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে সেসময় সরকারকে নমনীয় অবস্থান নিতে দেখা যায়।

সূত্র জানায়, প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে তখন সরকারের সঙ্গে মধ্যস্থতা করেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের তিন নেতা। এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক উপদেষ্টা।

২৫ মার্চ অসুস্থ খালেদা জিয়াকে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও বলতে শোনা যায়, 'অসুস্থ বেগম জিয়া প্যারোলে মুক্তির জন্য আবেদন করলে সক্রিয় বিবেচনা করবে সরকার।' শেষ পর্যন্ত বিএনপির পক্ষ থেকে প্যারোলের আবেদন না করায় ভেস্তে যায় রাজনৈতিক সমঝোতা।

এরপর আসে এপ্রিল মাস। 'নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নিলে মুক্ত হতে পারেন বেগম জিয়া'-নতুন এই রাজনৈতিক সমীকরণের গুঞ্জন ওঠে রাজনৈতিক মহলে। কিন্তু ২৯ এপ্রিল, শপথগ্রহণের সর্বশেষ দিনে নানা নাটকীয়তা শেষে বিএনপির সংসদ সদস্যরা শপথ নিলেও বেগম জিয়ার মুক্তির গুঞ্জন আবারও চাপা পড়ে যায়।

সূত্র জানায়, বিএনপি যেখানে দলীয় চেয়ারপারসনের নিঃশর্ত মুক্তি চান সেখানে সরকারের বক্তব্য, আইনি প্রক্রিয়াতেই এগোতে হবে তাদের। অসুস্থ বেগম জিয়ার চিকিৎসার জন্য প্যারোলের আবেদন করলে সরকার ইতিবাচক বিবেচনা করবে। প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে গেলেও আপত্তি করবে না সরকার। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন তার 'আপসহীন' ইমেজ টিকিয়ে রাখতে প্যারোলে মুক্তি নিতে অস্বীকৃতি জানান।

তবে হ্যাঁ, আদালত যদি বিএনপি চেয়ারপারসনকে জামিন দেন সেক্ষেত্রে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। বিএনপির সঙ্গে প্যারোল সমঝোতা ভেস্তে যাওযায় সরকার কঠোর অবস্থানে থাকলেও আদালতের মাধ্যমে খালেদা মুক্তি পেলে সরকার তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, 'খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছেন। কোনো আন্দোলনের মাধ্যমে নয়, কেবলমাত্র আইনগত প্রক্রিয়াতে শুধু তার মুক্তি সম্ভব।’

আদালত সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে রয়েছে ৩৬টি মামলা। সেনা নিয়ন্ত্রিত জরুরি অবস্থার সরকারের আমলে চারটি এবং আওয়ামী লীগের গত দুই মেয়াদে ৩২টি মামলা দায়ের হয়েছে। এরমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা পাঁচটি, নাশকতার ১৬টি, মানহানির চারটি, হত্যা মামলা তিনটি, মানহানিকর বক্তব্য দেওয়ার দুটি, রাষ্ট্রদ্রোহের একটি, ভুয়া জন্মদিন পালনের একটি, সাবেক নৌ মন্ত্রীর ওপর বোমা হামলার একটি, জাতীয় পতাকার অবমাননার একটি, ড্যান্ডি ডাইংয়ের অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন একটি এবং বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ের মালিকানা নিয়ে একটি দেওয়ানি মামলা রয়েছে।

এসব মামলার ১৬টিতে অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে রয়েছে। উচ্চ আদালতে ১১টির বিচার স্থগিত আছে। আর বাকি ২০টি মামলার কোনটিতে অভিযোগপত্র জমা পড়েছে, বা কোনোটি তদন্তের পর্যায়ে আছে।

২০১৪ সালে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি মানহানির মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল নিম্ন আদালত। মানহানির এই দুই মামলায় খালেদা জিয়াকে মঙ্গলবার (১৮ জুন) ৬ মাসের জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। এখন তার কারামুক্তিতে বাধা মাত্র আর দুটি মামলা।

মুক্তির জন্য জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্ট বিভাগে জামিন পেতে হবে। ওই দুই মামলায় তিনি ১৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত।

এদিকে সম্প্রতি কেরানীগঞ্জের নতুন কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি ভিআইপি কক্ষ আধুনিক সুযোগ সুবিধা দিয়ে নতুন করে সাজানো হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের জামিন না হলে, আর চিকিৎসকরা ‘নিরাপদ’ মনে করলে খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু হাসপাতাল থেকে এই কারাগারে বন্দী রাখা হবে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'বেগম জিয়ার মু‌ক্তির বিষয়‌টি সম্পূর্ণ আদাল‌তের এখ‌তিয়ার। আদালত তাকে মু‌ক্তি দি‌লে তা‌তে সরকা‌রের কোনো হস্ত‌ক্ষেপ থাক‌বে না। এরই ম‌ধ্যে আদালত ৩০ থে‌কে ৩২টি মামলায় তাকে জা‌মিন দি‌য়ে‌ছে।'

আদলতে হস্তক্ষেপের বিষয়ে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আদালত বেগম জিয়াকে মুক্তি দিলে সরকার সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ অতীতেও করেনি, বর্তমানেও করছে না, ভবিষ্যতেও করবে না।'

এ সম্পর্কিত আরও খবর