জাতীয় পার্টির মুখে এক, অন্তরে আরেক!

জাতীয় পার্টি, রাজনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-12-11 20:52:04

জাতীয় পার্টির মুখে এক আর অন্তরে আরেক। চেয়ারম্যান জিএম কাদের এক রকম ভাবলেও সিনিয়র অনেকেই সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতার জন্য তৎপর বলে জানা গেছে।

সমঝোতার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন দলটির নেতারা। পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য কো-চেয়ারম্যানরাও কখনও কখনও অংশ নিচ্ছেন।

দফায় দফায় বৈঠকের কথা স্বীকার করলেও বিষয়বস্তু নিয়ে রহস্য করে আসছে জাতীয় পার্টি। দলটির মহাসচিব বলেছেন, আমরা আসলে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করছি। আরও বৈঠক হতে পারে। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি প্রায় সব আসনেই নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে। বড় দুই দল হওয়ায় ভোট সুষ্ঠু করা এবং কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে। নির্বাচনের আগে পর্যন্ত এই যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে। জাতীয় পার্টি মনে করে আঁতাত করার চেয়ে ভোট সুষ্ঠু হলে বেশি আসন পাবে।

নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে আলোচনা হলে বৈঠকের স্থান ও সময় নিয়ে লুকোচুরি করা হচ্ছে কেন এমন প্রশ্নের জবাবে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, কৌশলগত কারণে বিষয়টি গোপন রাখা হচ্ছে। আসন সমঝোতার কোন সম্ভাবনা আছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনীতিতে কোন কথাই শেষ কথা নয়। সময় ও পরিস্থিতির কারণে অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়ে থাকে। এখানেও হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।

পার্টির মহাসচিবের এসব কথায় অনেকে সমঝোতার গন্ধ পাচ্ছেন। তারা বলছেন, আঁতাতের চেয়ে সুষ্ঠু ভোট হলে বেশি আসন পাওয়ার বিষয়টিও ইঙ্গিতপূর্ণ। অর্থাৎ সরকারের পক্ষ থেকে কিছু আসনের বিষয়ে সিগন্যাল দেওয়া হয়েছে। সে কারণে জাপা মনে করছে সুষ্ঠু হলে বেশি আসন পাবে?

পার্টির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তারা ৭০ আসনের একটি তালিকা আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে দিয়েছেন। দর-কষাকষির পর প্রত্যাশার পারদ ৪০ এ নামিয়ে এনেছে দলটি। এর কমে হলে নির্বাচনে না যাওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ৩২ থেকে ৩৫টি আসনের বিষয়ে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হয়েছে।

এসব আসনের মধ্যে রয়েছে বৃহত্তর রংপুরের ১৫টি। ঠাকুরগাঁও- ৩ আসনের বর্তমান এমপি হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, নীলফামারী-৩ আসনের রানা মোহাম্মদ সোহেল এমপি, নীলফামারী-৪ আসনের আহসান আদেলুর রহমান এমপি। লালমনিরহাট-৩ আসনে জাহিদ হাসান।

দলটি রংপুর জেলার ৬ আসনের মধ্যে ৪টি চাইলেও ৩টি আসনের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ। এগুলো হচ্ছে রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) আসিফ শাহরিয়ার, রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আনিসুল ইসলাম মন্ডল, রংপুর-৩ (সদর) জিএম কাদের। রংপুর-৪ (পীরগাছা-কাউনিয়া) নিয়ে রশি-টানাটানি চলছে। আসনটিতে বিগত ৩টি সংসদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী টিপু মুন্সী (বাণিজ্যমন্ত্রী) এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।

কুড়িগ্রাম-২ আসনে পনির উদ্দিন আহমেদ নিশ্চিত হলেও কুড়িগ্রাম-১ একেএম মোস্তাফিজুর রহমান এখনও চূড়ান্ত নন। গাইবান্ধা-১ আসনে বর্তমান এমপি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী নিশ্চিত হলেও অন্যটি ঝুলে রয়েছে। দিনাজপুর-৪ আসনে মোনাজাত চৌধুরীর আসন নিয়েও রয়েছে মতপার্থক্য। রাজশাহী বিভাগে ২টি আসন নিশ্চিত করা হয়েছে। বিগত দু’টি সংসদে যারা বগুড়ার আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবারও তাদের কপাল খুলতে পারে। তারা হলে বগুড়া-২ শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ ও বগুড়া-৩ নুরুল ইসলাম তালুকদার।

রাজধানী ঢাকায় ৪টি আসন নিশ্চিত করতে চায় জাপা। এগুলো হচ্ছে ঢাকা-৪, ৬, ১৭ ও ১৮। বিগত দু’টি সংসদে জাপাকে ঢাকা-৪ ও ৬ আসন ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আর ঢাকা-১৭ আসনে ২০০৮ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচিত হয়েছিল। এবার ওই আসনের সঙ্গে পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সহধর্মিণী শেরিফা কাদের’র জন্য ঢাকা-১৮ আসন চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

পার্টি সূত্র জানিয়েছে, বরিশাল বিভাগে ৩টি আসনের বিষয়ে ইতিবাচক আওয়ামী লীগ। বরিশাল-৩ গোলাম কিবরিয়া টিপু, পিরোজপুর-৩ মাশরেকুল আলম রবি। সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের পটুয়াখালী-১ নিশ্চিত করা হলেও তার স্ত্রী রত্না আমিনের আসন ঝুলে রয়েছে। সাতক্ষীরা-১ আসনে সৈয়দ দিদার বখত ও খুলনায়-৬ আসনে শফিকুল ইসলাম মধু।

নারায়ণগঞ্জ-৫ একেএম সেলিম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে লিয়াকত হোসেন খোকার নাম শোনা যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগ কাউকেই মনোনয়ন দেননি।

পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বর্তমান আসন কিশোরগঞ্জ-৩ থেকে, ময়মনসিংহ-৮ ফখরুল ইমাম ও ময়মনসিংহ-৫ সালাউদ্দিন আহমেদ মুক্তি, সুনামগঞ্জ-৪ আসনের বর্তমান এমপি পীর ফজলুর রহমান, জামালপুর-২ মোস্তফা আল মাহমুদ ও শেরপুর-১ মাহমুদুল হক মনির নাম আলোচনায় রয়েছে।

চট্টগ্রাম-৫ আসনে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চট্টগ্রাম-৮ সোলায়মান আলম শেঠ, ফেনী-৩ মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ অথবা ৩ আসনে অ্যাড রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া সমঝোতায় এগিয়ে বলে জানা গেছে।

জাতীয় সংসদের বিরোধীদলের আসনে থাকা জাতীয় পার্টি সরকারকে খুব একটা আস্থায় নিতে পারছে না। যে কারণে আগে-ভাগেই নিশ্চিত হতে চায়। জাপা শর্ত দিয়েছে এসব আসন থেকে নৌকার প্রার্থী ও তাদের বিদ্রোহীদের সরিয়ে নিতে হবে। সরকার নৌকার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও স্বতন্ত্রের বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা বিদ্যমান। যে কারণে ১৭ ডিসেম্বরের আগে কোন কিছুই চূড়ান্ত নয় বলে মনে করছেন জাপার শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর