যে দ্বন্দ্বে ঝুলে আছে রওশন-কাদের সমঝোতা!

জাতীয় পার্টি, রাজনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-11-25 21:17:13

রওশন অনুসারীদের মনোনয়ন না দিতে অনড় জিএম কাদের, আর অনুসারীদের ছেড়ে একা নির্বাচনে যেতে নারাজ রওশন এরশাদ। সেই সঙ্গে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদের রংপুর-৩ আসন নিয়েও দেবর-ভাবির (জিএম কাদের-রওশন এরশাদ) দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে।

প্রয়োজনে নির্বাচনের বাইরে থাকবেন, তবুও অনুসারীদের ছেড়ে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা জানিয়েছেন রওশন এরশাদ। এমনকি জিএম কাদেরের স্বাক্ষরে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার কথা চিন্তা করছেন বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন।

শনিবার (২৫ নভেম্বর) দুপুরে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে রওশন এরশাদ।

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না শর্তে বার্তা২৪.কমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ওই বৈঠকে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, কাজী মামুনুর রশীদসহ অনেকেই যোগ দেন।

বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, দেবর জিএম কাদের’র আচরণে ভীষণ ক্ষুব্ধ রওশন এরশাদ। আগে থেকেই ছিল টানাপোড়েন, ছেলের আসন নিয়ে টান দেওয়ায় দূরত্ব আরও বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত রওশন এরশাদ নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করছেন তারপর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে চান। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে রংপুর-৩ (সদর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন পুত্র সাদ এরশাদ। ২০ নভেম্বর জিএম কাদেরের পক্ষে রংপুর-৩ আসনের মনোনয়নপত্র তোলা হয়েছে। আর এতেই বেজায় চটেছেন রওশন এরশাদ। জিএম কাদের বিগত কয়েকটি সংসদে লালমনিরহাট সদর থেকে নির্বাচন করে আসছেন।

তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, কয়েক দিন আগেও রওশনের অবস্থান ছিল ভিন্ন। তার অনুসারীরা ভিন্নভাবে মনোনয়নপত্র বিক্রির পরামর্শ দিলেও তাতে সায় দেন নি। তখন বলেছিলেন, সবাইকে নিয়ে পার্টি করতে হবে। পার্টিকে ভাগ করা উচিত হবে না।

গত ২০ থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নিকট দলীয় ফরম বিতরণ করে জাতীয় পার্টি। মনোনয়নপত্র বিতরণ শেষ হলেও রওশন এরশাদ কিংবা তার সন্তান সাদ এরশাদসহ অনুসারীরা কেউই পার্টির মনোনয়নপত্র তোলেন নি। অবশ্য আগেই রওশন অনুসারীদের মনোনয়নপত্র না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে রাখেন জিএম কাদের। এমনকি রওশন পন্থী বলে পরিচিত বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গার মেয়ে সাক্ষাৎ করতে আসলে জিএম কাদের নাকি সৌজন্যতাও দেখান নি।

শনিবার (২৫ নভেম্বর) জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের জানান, আমাদের সম্মানিত প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ গতকালও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ফোন করেছিলেন। তিনি তার ও পুত্র সাদ এরশাদ এবং ডা. কে আর ইসলামের জন্য তিনটি মনোনয়নপত্র চেয়েছেন। আজ তার (বেগম রওশন এরশাদ) লোক এলে আমরা মনোনয়নপত্র দিয়ে দেবো। বেগম রওশন এরশাদ বললে, আমরা তার মনোনয়নপত্র পাঠিয়ে দেবো। প্রয়োজন হলে আমি নিজে গিয়ে পৌঁছে দেবো। আমার মনে হচ্ছে, হয়তো মনোনয়নের জন্য লোক পাঠাবেন। তার জন্য সময় কোন বিষয় না। যখন চাইবেন তখনই দেওয়া হবে।

পার্টির মহাসচিব কয়েকদিন ধরেই এমন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় রওশন এরশাদের বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। তারপরও দৃশ্যপটে কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।

দেবর-ভাবির ঠান্ডা যুদ্ধ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই দৃশ্যমান। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদ মারা গেলে পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় দেবর-ভাবির মধ্যে। এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতার পদ নিয়ে শুরু হয় টানাটানি। জিএম কাদের এবং রওশন এরশাদ পাল্টাপাল্টি চিঠি দেন স্পিকারকে। শেষ পর্যন্ত রওশনের চিঠিকে মূল্যায়ন করেন স্পিকার। 

ঠান্ডা লড়াইয়ের মধ্যে ২০২২ সালে ৩১ আগস্ট হঠাৎ করেই একতরফা জাতীয় পার্টির কাউন্সিল আহ্বান করেন রওশন এরশাদ। ২৬ নভেম্বর পার্টির কাউন্সিলের তারিখ দিয়ে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে দেন। প্রতিক্রিয়ায় মাঠে নেমে পড়ে জিএম কাদের পন্থীরাও। একদিনের ব্যবধানে রওশন এরশাদকে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে দিতে স্পিকারকে চিঠি দেন। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই চিঠির কোন কার্যকারিতা দেখা যায় নি। রওশন পন্থী বলে পরিচিত মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ কয়েকজন নেতাকেও বহিষ্কার করেন জিএম কাদের। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ পদ থেকে মসিউর রহমান রাঙ্গাকেও সরাতে চিঠি দেন জিএম কাদের। এবারও বাঁধ সাধেন রওশন এরশাদ।

রওশন ঘোষিত সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব করা হয় সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহকে। গোলাম মসিহ্ কমিটি বেশ তোড়জোড় নিয়েই কাউন্সিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ৪৫টি জেলায় প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে। এতে জায়গা পান নানা কারণে নিষ্ক্রিয় জাতীয় পার্টির সিনিয়র ও পদবঞ্চিত নেতারা। গুলশানের ৪৭ নম্বর রোডে আলাদা অফিস নিয়ে চলে পার্টির কর্মকাণ্ড। যে অফিস এখনও বিদ্যমান।

দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানের এক সময়ে সংসদ বর্জনের আল্টিমেটাম দেন জিএম কাদের। হঠাৎ করেই দুই পক্ষই রণে ভঙ্গ দেন। জিএম কাদের সংসদ বর্জনের হুমকি থেকে সরে আসেন। ২ মাসের মাথায় ৩০ অক্টোবর হঠাৎ করেই কাউন্সিল সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন রওশন।

দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে রওশন এরশাদ দেশে ফিরলে প্রধানমন্ত্রীর ডাকে হাজির হন দেবর-ভাবি। সেই বৈঠকের পরে বরফ গলতে শুরু করে। গত ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন রওশন এরশাদ। এরপর কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে রওশন পন্থীরা।

কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য বাড়তে থাকে। জিএম কাদের ছিলেন অনেকটাই নির্বাচনের বিপক্ষে, আর রওশন এরশাদ আগাগোড়া নির্বাচনমুখী। রওশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা আগেভাগেই দিয়ে রেখেছিলেন। আর ২২ নভেম্বর অনেকটা বাধ্য হয়েই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন জিএম কাদের। কথিত রয়েছে দুই পক্ষই পৃথকভাবে নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর তালিকা তৈরি করেছেন।

গত ১৮ নভেম্বর জিএম কাদের ও রওশন এরশাদ পৃথক চিঠি জমা দেন ইলেকশন কমিশনে। রওশন তার চিঠিতে মহাজোট গঠন ও নৌকা অথবা লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচনের কথা জানান। অন্যদিকে জিএম কাদের নিজে লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ করার জন্য স্বাক্ষরের নমুনা কপি প্রেরণ করেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর