নড়াইল: বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে নড়াইলে কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৯৪ তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে।
শুক্রবার (১০ আগস্ট) সকালে জেলা প্রশাসন ও সুলতান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে কর্মসূচির মধ্যে ছিল শিল্পীর মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণ, কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী। জেলা প্রশাসন, এস এম সুলতান আর্ট কলেজ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, নড়াইল প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শিল্পীর মাজারে পুস্পমাল্য অর্পণ করা হয়।
জেলা প্রশাসক ও এস এম সুলতান ফাউন্ডেশনের সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. এমদাদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ সময় বক্তব্য রাখেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুল আরিফ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কাজী মাহাবুবুর রশীদ, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ারুল ইসলাম, এস এম সুলতান ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান মিকু, চিত্রশিল্পী বলদেব অধিকারী, নড়াইল প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট আলমগীর সিদ্দিকী প্রমুখ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট তৎকালীন মহকুমা শহর নড়াইলের চিত্রা নদীর পাশে সবুজ শ্যামল ছায়া ঘেরা, পাখির কলকাকলিতে ভরা মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শিল্পী এস এম সুলতান। তার বাবা মো. মেছের আলি, মা মোছা. মাজু বিবি। চেহারার সঙ্গে মিলিয়ে বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিলেন লাল মিয়া। চিত্রশিল্পী এস. এম. সুলতানের ৭০ বছরের বোহেমিয়ান জীবনে তিনি তুলির আঁচড়ে দেশ, মাটি, মাটির গন্ধ আর ঘামে ভেজা মেহনতি মানুষের সঙ্গে নিজেকে একাকার করে সৃষ্টি করেছেন। পাট কাটা, ধানকাটা, ধান ঝাড়া, চর দখল, গ্রামের খাল, মৎস শিকার, গ্রামের দুপুর, নদী পারাপার, ধান মাড়াই, মাছ ধরা, নদীর ঘাটে, ধান ভানা, গুন টানা, ফসল কাটার দৃশ্য, শরতের গ্রামীণ জীবন, শাপলা তোলার মতো বিখ্যাত সব ছবি।
১৯৫০ সালে ইউরোপ সফরের সময় যৌথ প্রদর্শনীতে তার ছবি সমকালীন বিশ্ববিখ্যাত চিত্র শিল্পী পাবলো পিকাসো, ডুফি, সালভেদর দালি, পলক্লী, কনেট, মাতিসের ছবির সঙ্গে প্রদর্শিত হয়। সুলতানই একমাত্র এশিয়ান শিল্পী যার ছবি এসব শিল্পীদের ছবির সঙ্গে একত্রে প্রদর্শিত হয়েছে। কালোত্তীর্ণ এই চিত্রশিল্পী ১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্স আর্টিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি, ১৯৮৬ সালে চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা এবং ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়েছিল।
লাল মিয়ার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯২৮ সালে রুপগঞ্জ আশ্রম স্কুলে ভর্তির মাধ্যমে। ১৯৩৩ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে শ্যামা প্রসাদ স্কুল পরিদর্শনে আসেন। এ সময় লাল মিয়া তার একটি সুন্দর ছবি আঁকলে তৎকালীন জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়সহ সকলে মুগ্ধ হন। শুরু হয় শিল্পী লালের রঙ তুলি হাতে নতুন জীবন। শিল্পী হওয়ার মনোবাসনায় লাল মিয়া পাড়ি জমান কোলকাতার উদ্দেশে। কোলকাতার কাশিপুরে নড়াইলের জমিদার বাড়িতে থেকে জমিদারের ছেলে অরুণ রায়ের সহযোগিতায় কোলকাতার আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করলেও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকায় ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হস্তক্ষেপে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান তিনি। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তার অমায়িক আচরণে মুগ্ধ হয়ে লাল মিয়াকে তার বাসায় থাকার সুযোগ করে দেন। এ সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মা তার নাম রাখেন শেখ মো. সুলতান। যা আজ এস এম সুলতান নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
১৯৪৩ সালে সুলতান খাকসার আন্দোলন নামে একটি সেবা মূলক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এস এম সুলতান। শিক্ষাজীবন অসমাপ্ত রেখেই ১৯৪৪ সালে তিনি ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। কাশ্মীরের পাহাড়ে কিছুদিন একদল উপজাতিদের সঙ্গে বসবাস করেন। ১৯৪৬ সালে কাশ্মীর থেকে চলে যান সিমলায়, সেখানে তার প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয়। এই প্রদশর্নী তার শিল্পী জীবনের প্রথম স্বীকৃতি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের লাহোরে ও পরে করাচিতে অবস্থান করেন। এসময় নাগী, চুগতাই, শাকে আলী, শেখ আহম্মেদসহ অনেক পণ্ডিত ব্যক্তিদের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। ইউরোপ ও আমেরিকা জয় করে মহান এই শিল্পী ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে আসেন। কিছুদিন ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রাবাসে অবস্থান করে ফিরে আসেন মাতৃভূমি নড়াইলে।
১৯৫৫ সালে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চাচুড়ী পুরুলিয়ায় নন্দন কানন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। শিল্পী ১৯৫৬ সালে পলী কবি জসিম উদ্দিনের সঙ্গে কয়েকদিন অবস্থান করেন। শিল্পী ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত যশোরের নীলগঞ্জ শশ্মানে মাঝে মাঝে ধ্যান করতেন। ১৯৬০ সালে যশোরের চাঁচড়ার জমিদার বাড়িতে কিছু কাল অবস্থান করেন। ১৯৬৫ সালে সবার অগচরে পুনরায় পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। এরপর হারিয়ে যাওয়া এস এম সুলতানকে ১৯৬৭ সালে নড়াইলের অদূরে এক গ্রামে খুঁজে পাওয়া যায়। যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক এনাম আহম্মেদ চৌধুরী তাকে যশোর নিয়ে আসেন। ১৯৬৮ সালে যশোর-খুলনা ক্লাবে তার একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। জেলা প্রশাসক এনাম আহম্মেদ চৌধুরীর উদ্যোগে ১৯৬৯ সালের ১০ জুলাই সুলতানের মাছিমদিয়ার বাড়িতে দি ইনস্টিটিউট অফ ফাইন আর্টস উদ্বোধন করেন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শিল্পী জেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে যুদ্ধের ছবি আঁকেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিল্পী নিজ শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। সে সময় প্রতিদিন রাতে একটা ঝোলা ব্যাগ কাঁধে তিনি কাটিয়েছেন শহরের বিভিন্ন বাড়িতে। এ সময় তার সঙ্গে থাকত আড়বাঁশি, আর কয়েকটি পোষা বেজি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সুলতান কাছ থেকে দেখেছেন এদেশের মানুষ, প্রকৃতি, মানুষের জীবনাচার। আর নিজের বোধ ও মেধাকে শাণিত করেছেন আবেগ, অনুভূতি ও উপলব্ধির প্রয়াসে।
১৯৭৬ সালে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে তার একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। মূলত এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে এ দেশের সুশীল সমাজের সঙ্গে তার নতুন ভাবে পরিচয় ঘটে। বরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল শিশুদের নিয়ে। নিজের সঞ্চিত অর্থে শহরের মাছিমদিয়া এলাকায় চিত্রা নদীর পাড়ে নিজ বাড়িতে শিশুস্বর্গ নির্মাণ কাজে হাত দেন। নির্মাণ করেন ভাসমান শিশুস্বর্গ নামের একটি নৌকা। শিল্পীর ইচ্ছা ছিল এই নৌকায় করে কোমলমতি শিশুদের সঙ্গে নিয়ে প্রকৃতি দেখবেন। শিশুরা প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত হবেন। প্রকৃতির ছবি আঁকবেন। কিন্তু তার সেই সাধ পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শিল্পী সুলতান মৃত্যুবরণ করেন।