করোনাভাইরাস বিস্তারের কারণ, প্রতিরোধ ও নির্মূলের উপায়

বিবিধ, জাতীয়

প্রফেসর ড. মু. আলী আসগর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 12:28:38

চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশাল সংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে ফুসফুস প্রদাহ (নিউমোনিয়া) ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। কিউরিয়াস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রথমে এই করোনাভাইরাসের নাম দিয়েছিল ‘‘২০১৯ নভেল করোনাভাইরাস" বা ‘‘২০১৯ - কোভ’’ এবং পরবর্তীতে গবেষকরা "২০১৯ - কোভ’’ এর সঙ্গে ২০০২- ২০০৩ সালে সংঘটিত মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস সার্স-কোভ (পুরো নাম সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম-কোভ) এর বেশ মিল খুঁজে পাওয়ায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই নতুন ভাইরাসটির নামকরণ করেছে সার্স-কোভ-২। ২০০২ সাল থেকে চীনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স-কোভ নামক ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৮০৯৮ জন সংক্রমিত হয়েছিল। সেটিও ছিল এক ধরনের করোনাভাইরাস যা বিশ্বব্যাপী মহামারি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নতুন আবির্ভূত সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটির কারণে সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯ নামে সুপরিচিত। ‘CO’ এর পূর্ণরূপ corona, ‘VI’ এর পূর্ণরূপ "virus" এবং ‘D’ এর পূর্ণরূপ "disease" এবং এই ভাইরাসের বাহিরের প্রোটিনের আবরণ মুকুটের সদৃশ্য হওয়ায় এর নাম করোনাভাইরাস। ধারণা করা হচ্ছে, হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানের সি ফুড মার্কেটে যেখানে অবৈধ বন্যপ্রাণীর কেনাবেচা হতো, সেখান থেকেই এ ভাইরাসটি ছড়িয়েছে। এই ভাইরাসের কারণে শ্বাসযন্ত্রের গুরুতর ও তীব্র সংক্রমণ হয়। এখন পর্যন্ত যার কোন নির্দিষ্ট নিরাময় বা প্রতিষেধক নেই। চীন ছাড়িয়ে পড়া এ মারণ ভাইরাস সারা বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানির কারণ হিসেবে দাঁড়ালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১১ মার্চ ২০২০ তারিখে ব্যাধিটিকে একটি বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

করোনাভাইরাস প্রজাতি চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত- আলফা করোনাভাইরাস, বিটা করোনাভাইরাস, গামা করোনাভাইরাস, ও ডেল্টা করোনাভাইরাস। মানুষের শ্বসনতন্ত্র ও পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণের জন্য দায়ী উল্লেখিত চারটি প্রধান ভাগের অন্তর্ভুক্ত ৬টি করোনাভাইরাস প্রজাতি পূর্বে আবির্ভূত হয়েছিল। ২০১৯ সালে আবির্ভূত সার্স-কোভ-২ হচ্ছে মানুষের জন্য ক্ষতিকর করোনাভাইরাসের ৭ম প্রজাতি। কিউরিঅস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চীনে ২০০২ সালে আবির্ভূত করোনাভাইরাস, সার্স-কোভ এবং ২০১৯ সালে আবির্ভূত সার্স-কোভ-২ উভয়েই বিটা করোনাভাইরাসের অন্তর্ভুক্ত। সার্স-কোভ ভাইরাসের মূল উৎস বাদুড় হলেও, ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষকদের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী মেটাজেনোমিক সিকুয়েনসিংয়ের মাধ্যমে শুধুমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী প্যাঙ্গোলিনে সার্স-কোভ-২ সম্পর্কযুক্ত করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলো থেকে এ প্রাণীটি ব্যাপক হারে চীনে পাচার হয়ে থাকে। দেশটিতে প্যাঙ্গোলিনের গায়ের আঁশ দিয়ে ঐতিহ্যবাহী ওষুধ ও প্রাণীটির মাংসও একটি উপাদেয় খাবার বলে গণ্য করা হয়। সম্প্রতি বৈশ্বিক মহামারির কারণ এই ভাইরাসটি (সার্স-কোভ-২) ইতোপূর্বে কখনও মানবদেহে পাওয়া যায়নি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সার্স-কোভ-২ আক্রান্ত ব্যক্তির সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণগুলো হচ্ছে- জ্বর, ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট ও শুষ্ক কাশি। সার্স-কোভ-২ আক্রান্ত কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে সর্দি, গলা ব্যথা, নাক কনজেশন, এবং শরীরে ব্যাথা বা ডায়রিয়া দেখা যায়। কারও স্বাদ ও ঘ্রাণ পাওয়ার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যেতে পারে। আক্রান্ত ছয় জনের একজন মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে তীব্র শ্বাস কষ্ট সহ ফুসফুস প্রদাহ (নিউমোনিয়া) ব্যাধিতে অসুস্থ হয়। বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস রোগ আছে, তাদের সার্স-কোভ-২ দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার বিশাল ঝুঁকি রয়েছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, যে কোনো বয়সের লোকই নতুন এ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।

সিএনএন হেলথ ৩১ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কিছু শিশুসহ ২০-৫০ বছর বয়স্ক অসংখ্য মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। গবেষকগণের প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে, মানবদেহে সার্স-কোভ-২ বংশবিস্তারে সময় লাগে ৫.১ দিন। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, আক্রান্ত হওয়ার ১১.৫ দিনের মধ্যে প্রায় ৯৭.৫% মানুষের শরীরে সার্স-কোভ-২ এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। আক্রান্ত হওয়া থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত কোন ব্যক্তি সংক্রমণের বিস্তার ঘটাতে পারে। সে কারণে দ্য জার্নাল এনালস অফ ইন্টারনাল মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে (রোগ সংক্রমণের আশঙ্কায় পৃথক রাখা) বা সক্রিয় পর্যবেক্ষণ করা উচিত। তবে মারাত্মক ক্ষেত্রে দীর্ঘতর সময় সক্রিয় মনিটর করা প্রয়োজন। জ্বর, ক্লান্তি ও শুষ্ক কাশির মতো অন্য লক্ষণগুলো সেরে যাওয়ার পর এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুইবার করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এলেই কেবল তারা কোয়ারেন্টাইন থেকে ছাড়া পেতে পারেন।

বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ দ্রুত বিস্তারের কারণ:

দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, সার্স-কোভ-২ ভাইরাস এ্যারোসল অবস্থায় তিন ঘণ্টা পর্যন্ত বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। এ্যারোসল হচ্ছে, এ্যারো (aero অর্থ বাতাস) এবং সল (sol অর্থ সলিউশন বা তরল), অর্থাৎ তরল পদার্থের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা, যা মাইক্রো-ড্রপলেট (micro-droplets) আকারে বাতাসে ভেসে থাকে। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত গবেষণার তথ্য মতে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাস প্ল্যাস্টিকের ওপরে ৭২ ঘণ্টা, স্টেইনলেস স্টিলের ওপরে ৪৮ ঘণ্টা ও পিজবোর্ডের (পুরু ও শক্ত কাগজবিশেষ) উপর ২৪ ঘণ্টা টিকে থাকতে সক্ষম। ভাইরাসটি অন্যান্য বিভিন্ন পৃষ্ঠের ওপর বেঁচে থাকতে পারে। সে কারণে এই মারণ ভাইরাস বাতাসসহ বাড়ি/ঘর/ শপ/প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত জিনিষপত্র, গণপরিবহনে ব্যবহৃত আসন বা বডি পার্টসের মাধ্যমে বিস্তারে সক্ষম। ভাইরাসটি একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমণের প্রধান মাধ্যম হাত। এই ভাইরাসটি মারাত্মক ছোঁয়াচে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি ও মলের মাধ্যমে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সার্স-কোভ-২ ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি বা কাশি দিলে মুখ ও নাক দিয়ে তরল ড্রপলেট নিঃসৃত করে যা ভাইরাস বহন করে। আক্রান্ত ব্যক্তির উক্ত ড্রপলেট নিকটবর্তী সুস্থ ব্যক্তি শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণের ফলে আক্রান্ত হতে পারে। ভাইরাসটি সুস্থ ব্যক্তির ফুসফুসের বাতাস নির্গমন পথ এবং মিউকাস পর্দায় গিয়ে পৌঁছায়। বংশ বিস্তারের কারণে নতুন ভাইরাসের কপি/প্রতিলিপি মানুষের কোষে ধারাবাহিকভাবে বেশি হতে থাকে। ফলে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়ে আরও বেশি মানুষের কোষ আক্রমণ করে। আক্রান্ত ব্যক্তির কাশির তরল ড্রপলেটগুলোই করোনাভাইরাসের মূল বাহক, আর এগুলো ছয়/সাত ফুট পর্যন্ত যেতে পারে।

কোভিড-১৯ প্রতিরোধের উপায়:

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ সার্স-কোভ-২ ভাইরাস প্রতিরোধে ইতোমধ্যে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। উন্নত কিছু দেশের সরকার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ব্যক্তিগণসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের জনগণের একটি বড় অংশ কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। সকল ভাইরাসই মানুষকে আক্রান্ত না করা পর্যন্ত জীবনমৃতের মতো থেকে তারা চেষ্টা করে মানুষের দেহের কর্তৃত্ব গ্রহণে। মানুষের দেহের বাহিরে তারা জীবনবিহীন সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তারা সংস্পর্শ, শ্বাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে মানুষের দেহের প্রোটিন খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের ফলে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং মানুষের কোষগুলোকে আক্রমণ করে। মানুষের দেহে বংশ বিস্তারের পর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমিত করতে থাকে। মানুষের দেহই কোভিড-১৯ সহ সকল ভাইরাসের খাদ্য তথা বেঁচে থাকার উৎস। ৩১ মার্চ ইউএসএ সংবাদমাধ্যম টাইম নিউজ পেপারের তথ্য অনুযায়ী, বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষদের নিরাপদে সামাজিক শিষ্টাচার/ দৈহিক দূরত্ব বা কোয়ারেন্টাইনে রেখে (অর্থাৎ আক্রান্ত মানুষ থেকে অনাক্রান্ত মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে) এ মহামারি প্রতিরোধ সম্ভব।

ইতোমধ্যে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ও সিঙ্গাপুর ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’ অগ্রাধিকার দিয়ে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সাফল্য পেয়েছে। ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’ হচ্ছে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণ এবং যে কোনো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সীমিত সাধ্যের মধ্যে ধরে রাখার মূলনীতি। ফলে সামগ্রিকভাবে অল্প মানুষ সংক্রমিত হয় ও মৃত্যুবরণ করে। ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’ নীতি অনুসরণ করে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া কারণ হিসেবে ২০১৫ সালের মার্স ভাইরাস মোকাবিলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো। দ্রুত সক্রিয়ভাবে ভাইরাস মোকাবিলায় বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিবরণী অনুযায়ী হাজার হাজার মানুষের কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাসের পরীক্ষা করা, অনাক্রান্ত মানুষকে আক্রান্ত মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা, পর্যটক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

সার্স কোভিড-১৯ ভাইরাস তিন ধরনের উপাদান দিয়ে গঠিত−আরএনএ, প্রোটিন এবং লিপিড। প্রোটিনের মাধ্যমে ভাইরাসটি মানবদেহের কোষের সঙ্গে মিশে যায়, আর এর বিস্তার ঘটায়। সেল হোস্ট এন্ড মাইক্রোব জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, উভয় ভাইরাসের (২০০২ সালে আবির্ভূত সার্স-কোভ ও ২০১৯ সালে আবির্ভূত সার্স-কোভ-২) অ্যামাইনো এসিডের (প্রোটিনের উপাদান) মাত্রা প্রায়ই একই হলেও কিন্তু উভয় ভাইরাসের প্রোটিনের গঠনে কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। গাঠনিক এই সামান্য পার্থক্যের কারণে নতুন সার্স কোভ-২ ভাইরাসটি, পূর্বের সার্স কোভ-২ এর চেয়ে বেশি মানুষকে সংক্রমণের ক্ষমতাসম্পন্ন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর