চোর-পুলিশ খেলায় বন্ধ হবে না ইয়াবা পাচার

চট্টগ্রাম, জাতীয়

কান্ট্রি ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 22:31:07

কক্সবাজার: সারা দেশে চলছে র‌্যাব-পুলিশের মাদক বিরোধী অভিযান। এতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে প্রায় দুই শতাধিক ইয়াবা কারবারি। এর মধ্যে ইয়াবা রাজ্যখ্যাত কক্সবাজার ও টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে চার ইয়াবা ব্যবসায়ী। তবে এতো কঠোর অভিযানের মধ্যেও থেমে নেই কক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায়ীরা।

প্রতিদিনই কোনো না কোনো পয়েন্ট থেকে ইয়াবাসহ পাচারকারী বা পরিত্যক্ত ইয়াবা উদ্ধার করছে র‌্যাব-পুলিশ। এ অভিযানে সঠিক মাদক ব্যবসায়ীরা ধরা পড়ছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংশ্লিষ্টরা। তবে এ অভিযানে বেশিরভাগ ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মগোপন করেছে।

জানা যায়, গত ২৩ মে কক্সবাজারের কলাতলী বাইপাস সড়কের পাশের একটি পাহাড় থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মো. হাসান নামে এক ইয়াবা ব্যবসায়ীর লাশ পাওয়া যায়। মূলত তখন থেকেই মাদকবিরোধী অভিযানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় কক্সবাজারে। এরপর মহেশখালী ও টেকনাফে দুইদিনের ব্যবধানে দুই ইয়াবা ব্যবসায়ীর লাশ পাওয়া যায়। এরমধ্যে একজন টেকনাফের সাবরাংয়ের ইউপি সদস্য ও এমপি বদির বেয়াই আখতার কামাল। এরপর মেরিনড্রাইভ সড়কে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হন। এ ঘটনায় র‌্যাবের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তুলে তার পরিবার। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে একরামের মৃত্যুর একটি অডিও রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। অডিও রেকর্ড ফাঁস হওয়ার পর সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। এক পর্যায়ে বিতর্কের মুখে অভিযান বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর আবারো বিশেষ অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের মধ্যেও বন্ধ হয়নি টেকনাফ থেকে ইয়াবা পাচার। প্রতিদিনই আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে আটক হচ্ছে বিভিন্ন মাদক পাচারকারী বা ব্যবসায়ী।

মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরুর আগে কক্সবাজারের ১১৫১ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি পাঁচটি সংস্থা। সেখানে ৬০ জনকে গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শুরুর দিকে ওই ৬০ জন গডফাদারকে প্রাথমিক টার্গেট হিসেবে ইঙ্গিতও দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু সেই টার্গেট শুধু টার্গেটই রয়ে যায়।

গত ২১ মে থেকে শুরু হওয়া অভিযান চলাকালের ৩ মাসে ইয়াবাসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে, চলতি মাসের শুরুতে (১ জুলাই) চট্টগ্রাম নগরের শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে বোরহান উদ্দিন (৩২) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় তাকে তল্লাশি করে সঙ্গে থাকা একটি দেয়াল ঘড়ির ভেতর থেকে ৭ হাজার ২০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

গত ১২ জুলাই কক্সবাজারের উখিয়ায় ১৫ হাজার পিস ইয়াবা এবং ১৮ ক্যান বিয়ারসহ যুবককে আটক করেছে র‌্যাব। তার নাম নুর আহম্মেদ (৩৫)। তিনি উখিয়ার পালংখালী আনজুমান পাড়ার মৃত ছগির আহম্মেদের ছেলে।

গত ৯ জুলাই টেকনাফের হ্নীলা পশ্চিম লেদায় অভিযান চালিয়ে ১০ হাজার ইয়াবাসহ দুইজনকে আটক করা হয়। তারা হলেন- হ্নীলার পূর্ব লেদার অজি উল্লাহর ছেলে মফিজুর রহামান (৩০) ও মোচনী নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আই ব্লকের মৃত ফজল করিমের ছেলে মো. ফয়সাল (২২)। গত ১৫ জুলাই চট্টগ্রামে র‌্যাব-৭ শিশুসহ তিন ব্যক্তির পেট থেকে দুই হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে।

কয়েকদিন আগে লক্ষাধিক ইয়াবাসহ ঢাকায় গ্রেফতার হন কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী এলাকার আব্দুল্লাহ খানের ছেলে শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী আরিফ খান। টানা কয়েকদিন আটকে রাখার পর মাত্র ১২ হাজার ইয়াবা দেখিয়ে তাকে চালান দেয় পুলিশ। এ ঘটনায় ঢাকার ওয়ারী থানায় দায়ের হওয়া ইয়াবা মামলায় কক্সবাজারের অনেকে আসামি হয়েছে।

গত ২৬ মে কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে অভিযান চালিয়ে প্রায় ২ হাজার পিস ইয়াবাসহ নেছার আহমদ (৫০) নামে এক পাচারকারীকে আটক করে র‌্যাব। গত ২৩ মে মেরিনড্রাইভ সড়কের টেকনাফের হাবিরছড়া এলাকা থেকে আড়াই লাখ ইয়াবা উদ্ধার করে টেকনাফ থানা পুলিশ।

একই তারিখে কক্সবাজার শহরের কলাতলীর সার্ফিং চত্বর থেকে মিউজিক ভিডিও করতে আসা ‘সরকার প্রোডাকশন হাউস’ এর ১০ সদস্যকে ১ লাখ ৮ হাজার ইয়াবাসহ আটক করেছে র‌্যাব।

ওই সময় ইয়াবা পরিবহনে ব্যবহৃত মাইক্রোবাসটিও জব্দ করা হয়। গত ২৫ মে ১২শ ইয়াবাসহ তিন পাচারকারীকে আটক করে চকরিয়া থানা পুলিশ। একইদিন পেকুয়ায় ইয়াবাসহ এক মাদক পাচারকারীকে আটক করে পুলিশ।

গত ২২ মে টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এলাকা থেকে ৩০ হাজার ইয়াবাসহ আলী উল্লাহ নামে একজনকে আটক করে মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের গোয়েন্দারা। একইদিন কক্সবাজার শহরের বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে আলী জোহর নামে এক পাচারকারীকে ২ হাজার ইয়াবাসহ আটক করে তারা।

গত ২০ মে লিংরোড এলাকা থেকে ৬ হাজার ইয়াবাসহ মো. রিফাত নামে এক যুবককে আটক করে র‌্যাব।
গত ২৪ মে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৬ হাজার ইয়াবাসহ ঈগল পরিবহনের ড্রাইভার আবদুল আজিজ শেখ (৪৭) ও সুপারভাইজার মো. সোহেল রানাকে (২৭) আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

এদিকে কোস্টগার্ডের হিসেব অনুযায়ী, এই সংস্থাটি গত ৭ মাসে ৮০ লাখ ৬০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে। সর্বশেষ গত ১৩ জুলাই টেকনাফের সাইরংখাল এলাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে।

টেকনাফের পৌর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল্লাহ কাউছার জানান, অভিযানের সময় কিছুদিন ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন ধরে আবারও বিচরণ বেড়েছে। এখন পুরোদমে ইয়াবা ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে তারা।
এদিকে সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে আরও ৭টি ক্যাম্প স্থাপন করেছে র‌্যাব। তারা সাঁড়াশি অভিযানের আভাস দিলেও কিন্তু ইয়াবা পাচার বন্ধ হচ্ছে না। তাই এসব অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অভিযান নিয়ে অনেক আশা করেছিলাম। মনে করেছিলাম এবার অন্তত ইয়াবার বদনাম থেকে কিছুটা মুক্তি পাবে কক্সবাজার। কিন্তু যেই লাউ সেই কদু। অভিযান চলে কিন্তু ইয়াবা পাচার বন্ধ হয় না। এভাবে চোর-পুলিশ খেলা খেললে কখনোই ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ হবে না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বার্তা২৪.কমকে জানান, মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। এর মধ্যেও অনেক ব্যবসায়ী আড়াল থেকে বিভিন্ন পাচারকারীর মাধ্যমে ইয়াবা পাচারের চেষ্টা করছে। এসব ইয়াবাসহ বিভিন্ন থানায় আটক হচ্ছে পাচারকারীরা।

র‌্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘গত কয়েকদিনে আমরা অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে আটক করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু এক শ্রেণির ব্যবসায়ী এখনো নিজেদের সক্রিয় রাখার চেষ্টা করছে। আমরা ইয়াবা বা মাদক পাচারের বিরুদ্ধে সজাগ রয়েছি।’

টেকনাফস্থ ২ বিজিরি অধিনায়ক লে. কর্নেল আসাদুজ্জামান চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে জানান, সীমান্তে ইয়াবা পাচার প্রতিরোধে এলাকায় স্কুল-কলেজগুলোতে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। ওই বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ইয়াবা পাচার বা অন্য কোনো মাদক যাতে সীমান্ত দিয়ে না ঢুকে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর