পদ্মাপাড়ের অদম্য ছাফিয়ার রংপুর বিজয়

রংপুর, জাতীয়

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রংপুর | 2023-08-22 22:47:01

ছাফিয়া খানম। যার ঈর্ষনীয় সফল জীবনে আছে বাল্যবিয়ের অভিশাপ। ঘর-সংসারের কিছু বুঝে ওঠার আগেই বসতে হয়েছিল বিয়ের পিঁড়িতে। তখনও মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোননি। অল্প বয়সেই সংসারের বোঝা সামলাতে শ্বশুরবাড়িকে ঠিকানা মেনে নিতে হয়েছে।

অগোছালো জীবনে হঠাৎ বয়ে যায় ঝড়। সন্তান জন্মের ৯ মাস না পেরোতেই স্বামীর মরামুখ দেখতে হয়েছে ছাফিয়াকে। এরপর শ্বশুড়বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয় এই বিধবা। সন্তান নিয়ে দিশেহারা মেয়েটি ফিরে আসে বিধবা মায়ের কাছে।

অভিভাবকহীন জীবনে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন ছাফিয়া। দিনের বেলায়ও চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা লাগে। এমন দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়ান বন্ধু খালেদা। তিনিই ছাফিয়াকে ষষ্ঠ শ্রেণির বই-পুস্তক দিয়ে স্কুলে ভর্তি করেন। মনোবল বাড়াতে লেখাপড়ার খরচ জোগান দেন।

চার বছর বয়সে বাবাকে হারানো, এরপর বিয়ের স্বাদ না মিটতেই স্বামীর মৃত্যু— এমন পোড় খাওয়া ছাফিয়ার নতুনভাবে পড়ালেখা শুরুর ইচ্ছেশক্তিতে বাদ সাধেন চাচাসহ আত্মীয়-স্বজনরা। সমাজের অজুহাত তুলে মেয়েটির পড়ালেখার আশায় গুড়েবালি দিতে যেন উঠেপড়ে লাগেন সবাই। কিন্তু তার অদম্য শক্তিকে দাবিয়ে রাখা যায়নি।

সম্প্রতি সফল নারী হিসেবে ছাফিয়া খানমকে সংবর্ধিত করেন মাহিগঞ্জ প্রেসক্লাব

আত্নীয়-স্বজনদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন ছাফিয়া। একহাতে বই-খাতা আর অন্য হাতে কন্যাসন্তানকে নিয়ে শুরু হয় তার নতুন জীবনযুদ্ধ। অনেক ঝড়-ঝাপটা, দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনার সঙ্গে প্রতিনিয়ত আর্থিক অনটন তো ছিলই। তবুও দমে যাননি।

১৯৭৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হন ছাফিয়া। চাকরি জোগাড় করে কন্যার ভরণপোষণ মিটিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। এভাবেই অবিরাম সংগ্রাম করা এই মেয়েটি চাকরিকে আঁকড়ে ধরে শিক্ষিত হওয়ার আশা ছাড়েননি।

এইচএসসি পাস করার পর পরিবার কল্যাণ-পরিদর্শিকায় প্রশিক্ষণ নিয়ে লালপুর থানার গোপালপুরে নতুন চাকরিতে নাম লেখান ছাফিয়া। তখন ভর্তি হন বিএ’তে।

এরই মধ্যে মেয়ে বড় হয়ে যাওয়ায় ভাইয়ের শরণাপন্ন হতে রংপুরে চলে আসেন তিনি। রংপুরে আইন নিয়ে বিএ, এমএ এবং এলএলবি সম্পন্ন করেন।

আশির দশকে আইনজীবী হিসেবে এনরোলমেন্ট করার পর কয়েক বছর কোর্টে প্র্যাকটিস চালিয়েছেন ছাফিয়া। কিন্তু একমাত্র কন্যার লেখাপড়া ও সুন্দর ভবিষ্যতের ভাবনায় প্র্যাকটিস ছেড়ে একটি এনজিওতে চাকরি নেন। এভাবে প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধ চলতে থাকে তার।

চাকরির পাশাপাশি পত্রিকায় লেখালেখি করতেন ছাফিয়া। এরপর যুক্ত হন গবেষণা পরিষদে। পদ-পদবিও পেয়ে যান। এ সময় তার কাঁধে আসে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব। নব্বই দশকে নারীদের রাজনীতিমুখী করতে মাঠে নামেন। তাদের একত্র করে গড়ে তোলেন মহিলা আওয়ামী লীগ।

১৯৯৩ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন ছাফিয়া খানম। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর সভাপতি পদে টানা দুই যুগ পার করেন। ২০১৭ সালে রংপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে মনোনয়ন চেয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি। একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীর মধ্য থেকে ছাফিয়াকে বেছে নেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা।

ছাফিয়া খানম

নির্বাচনে  জয়ী হয়ে আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন ছাফিয়া খানম। ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি দেশের প্রথম ও একমাত্র মহিলা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে রংপুর জেলা পরিষদের মসনদে বসেন তিনি।

বাল্যবিয়ের মতো অভিশাপ আর অকালে স্বামীকে হারিয়েও দমে না যাওয়া ছাফিয়া খানম এখন জীবনযুদ্ধে জয়ী। অদম্য ও সফল এই নারীর জীবন কাহিনীর সঙ্গে যেন মিলেমিশে আছে সর্বনাশা পদ্মার ঢেউ।

রাজশাহীর লালপুরে প্রমত্তা পদ্মা নদীর তীরে এক অজপাড়া গাঁয়ে রক্ষণশীল একটি পরিবারে জন্ম ছাফিয়া খানমের। এক ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি ছোট। চার বছর বয়সেই অনাথ হন। অভিভাবকহীন সংসারে দুই মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েন মা। এ সময় দূরসম্পর্কের চাচার সহযোগিতায় ছাফিয়া লেখাপড়া শুরু করেন। কিন্তু পদ্মার ভাঙনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে গেলে তা বন্ধ হয়ে যায়। না-শিশু, না-কিশোরী এমন বয়সে গায়ে হলুদ আর পায়ে আলতা মেখে আর মাথায় ঘোমটা দিয়ে কবুল বলতে হয় তাকে। পরের গল্প তো জানা।

বার্তা২৪.কম’কে পদ্মার ভাঙন থেকে ওঠা আসা জীবনের গল্প শুনিয়ে রংপুর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ছাফিয়া খানম বলেন, ‘আমার প্রবল জেদ আর মনোবলই পুঁজি ছিল। চলার পথে যেমন অবজ্ঞা-অবহেলা থাকবে, তেমনি অনেকের সহযোগিতা আর ভালোবাসাও পাওয়া যায়। তবে বড় হওয়ার জন্য সবসময় নিজের ইচ্ছেশক্তি আর পরিশ্রমই মানুষের বড় অনুপ্রেরণা।’

রংপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে ইতোমধ্যে পীরগঞ্জ ও বদরগঞ্জের জমি উদ্ধারসহ দোকান মার্কেট নির্মাণ করেছেন ছাফিয়া খানম। তার উদ্যোগে রংপুরের প্রাণকেন্দ্রে ১৮ তলা অত্যাধুনিক রংপুর সিটি সেন্টার মার্কেট নির্মাণ কাজ চলছে। এছাড়া মসজিদ, মন্দির, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কবরস্থান উন্নয়নসহ নিয়ম-নীতির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন তিনি।

ব্যক্তিজীবনে ছাফিয়া খানমের চাওয়া-পাওয়ার আর কিছু নেই। দীর্ঘ সংগ্রামমুখর জীবনের শেষান্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া সম্মান তার কাছে অন্যরকম গর্ব।

এ সম্পর্কিত আরও খবর