শতাব্দীর দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণ দেখুন শুক্রবার রাতের আকাশে

ঢাকা, জাতীয়

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 15:50:17

একসঙ্গে কিংবা আলাদা আলাদা অবয়বে 'সুপার ব্লাড' কিংবা 'সুপার ব্লু মুন' দেখেছে পৃথিবীর মানুষ। এবার আকাশে দেখা যাবে একটি বিরল দৃশ্য, যার সাক্ষী থাকতে অধীর সমগ্র পৃথিবী। একবিংশ শতাব্দীর দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণ হবে শুক্রবার (২৭ জুলাই) রাতের আকাশে।

বাংলাদেশে শুক্রবার রাত ১১ টা ১৩ মিনিট ০৬ সেকেন্ড স্থানীয় সময়ে গ্রহণটি শুরু হয়ে শনিবার সকাল ৫ টা ৩০ মিনিট ২৪ সেকেন্ড শেষ হবে এই গ্রহণ।

শনিবার দুপুর ২ টা ২১ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড কেন্দ্রীয় গ্রহণ ঘটবে। গ্রহণটির সর্বোচ্চ মাত্রা হবে ১.৬১৪। আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে বাংলাদেশ থেকে গ্রহণটি পুরোপুরি দেখা যাবে।

এর আগে গত ১৩ জুলাই শুক্রবার সূর্যের আংশিক গ্রহণ ঘটে। তবে গ্রহণটি বাংলাদেশ থেকে দেখা যায়নি।

মহাকাশ বিষয়ক বিভিন্ন তথ্যসূত্র জানায়, শুক্রবার পৃথিবীর সঙ্গে সূর্যের দূরত্ব হবে সর্বোচ্চ আর চাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্বও হবে সর্বোচ্চ। এবং একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এক সারিতে চলে আসবে পৃথিবী, সূর্য এবং চাঁদ। পৃথিবী সূর্যের আলোকে পুরোপুরি আড়াল করবে, ফলে পৃথিবীর ছায়ায় অন্ধকার হয়ে যাবে চাঁদ। সূর্য-পৃথিবী-চাঁদ পুরোপুরি এক সারিতে চলে আসার এই ঘটনা শতাব্দীতে একবারই হয়। ফলে এই চন্দ্রগ্রহণ দীর্ঘতম হবে। গ্রহণের আগে চাঁদের রং টকটকে লাল হবে। বিজ্ঞানীরা যাকে বলছেন ‘ডিপ রেড ব্লাড মুন।

বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এবারের চন্দ্রগ্রহণ হতে চলেছে প্রায় ১০৫ মিনিট ধরে। এর আগে ২০১১ সালে ১৫ জুন ১০০ মিনিট ধরে চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল। এই শতকের সেটাই ছিল বৃহত্তম চন্দ্রগ্রহণ। গত শতাব্দীতে অবশ্য আরও বড় চন্দ্রগ্রহণ দেখা গিয়েছিল। ১৯৮২ সালে ১০৭ মিনিটের চন্দ্রগ্রহণ হয়।

শতাব্দীর দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণের জন্য অপেক্ষা করছে সারা বিশ্ব। আপনিও চোখ রাখুন শুক্রবার রাতের আকাশে। কারণ, জোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন একটানা ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট ধরে চলবে এই গ্রহণ। উত্তর আমেরিকা মহাদেশ ছাড়া গোটা পৃথিবী থেকেই দেখা যাবে এই বিরল চন্দ্রগ্রহণের দৃশ্য। শুধু তাই নয়, ওইদিন চাঁদের রং হতে চলেছে টকটকে লাল।

শুক্রবার রাতের আকাশে মায়াবী চাঁদটি গ্রহণের আগে ভাসবে ‘সুপারমুন’ হয়ে। কারণ শতাব্দীর দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণের ফলে অপরূপ চাঁদটি পৃথিবীর আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে দীর্ঘস্থায়ী গ্রহণে যাবে। গ্রহণের আগে আগে সেটি অন্যদিনের সাধারণ চাঁদ থাকবে না। পরিণত হবে 'সুপারমুন'-এ।

অবস্থানগত কারণে উত্তর আমেরিকা থেকে ‘সুপারমুন’টি দেখা যাবে না। সবচেয়ে স্পষ্ট দেখা যাবে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে।

নাসার গডডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার শতাব্দীর আলোচিত এই চন্দ্রগ্রহণ ও ‘সুপারমুন’ নিয়ে নানা নিরীক্ষার পর জানিয়েছে অনেক তথ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের গ্রিনবেল্টে অবস্থিত এই সেন্টারের লুনার সাইন্টিস নোয়া পের্টো মহাকাশ বিষয়ক পোর্টাল স্পেসডটকমকে বলেন, ‘সূযগ্রহণের মতো সতর্কতা এই চন্দ্রগ্রহণের সময় নিতে হবে না। ‘সুপার মুন’ কোনও রেডিয়েশন বা তেজষ্ক্রিয়তাও ছড়াবে না। খালি চোখেই দেখা যাবে মায়াবী চাঁদটি এবং চাঁদের গ্রহণ।’  

লুনার সাইন্টিস নোয়া পের্টো জানান, ‘গত এক শতাব্দীতে এতো দীর্ঘ চন্দ্রগ্রহণ আর হয় নি এবং ‘সুপারমুন’ এতো লম্বা সময় ধরে আকাশে দেখাও যায় নি। তবে গ্রহণের চূড়ান্ত দশা হবে এক ঘন্টা ৪৩ মিনিট। পৃথিবীর স্থান ভেদে সে সময়ের তারতম্য হবে। এই সময়ে চাঁদটি থাকবে ভরা যৌবনা এবং এর রঙ হবে রক্তিম-খয়েরী-নীলের মিশ্রিত বর্ণের।’

রাতের আকাশে মাঝে মোঝে ভেসে আসা 'সুপারমুন' পৃথিবীর মানুষের কাছে এক অপার রহস্যের ভান্ডার। ‘সুপারমুন’কে কেউ নাম দিয়েছেন 'ব্লু মুন'। নানা নামে ডাকা হয় বিশালাকৃতির সেই উজ্জ্বল চাঁদকে। এমন অধরা চাঁদের দেখা সব সময় পাওয়া যায় না।

স্পেসডটকম জানিয়েছে, ২০১৮ সালের ২৭ জুলাই ‘সুপারমুন’টি উদিত হয়ে গ্রহণে যাওয়ার ঘটনাটির ছয় মাস আগে ২০১৭ সালের শেষ 'সুপারমুন' আকাশে ভেসেছিল ৩ ডিসেম্বর রাতে। তারও আগে শেষবার ‘সুপারমুন’ দেখা গিয়েছিল ২০১৬-র ১২ ডিসেম্বর। ২০১৫ সালের ‘সুপারমুন’ উদিত হয়েছিল ২৭ সেপ্টেম্বর। 

'সুপারমুন' আসলে অন্য কিছু নয়। চাঁদের পূর্ণ অবয়ব। ‘সুপারমুন’-এর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ‘পেরিগি মুন’। পেরিগি অর্থ হচ্ছে ‘পৃথিবীর নিকটতম’। চাঁদ যখন পূর্ণ পূর্ণিমায় থাকে এবং বার্ষিক প্রদক্ষিণের সময় পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসে তখন একে সবচেয়ে বড়, পরিপূর্ণ ও স্পষ্ট দেখা যায়। সে সময় একে  ‘সুপারমুন’ বা 'ব্লু মুন'  বলা হয়।

তবে ২০১৮ সালের ২৭ জুলাই শতাব্দীর দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণে সময় দৃশ্যমান চাঁদটিকে নাম দেওয়া হয়েছে ‘রেডমুন’। তখন চাঁদের শরীর থেকে বিচ্চুরিত লালাভ বর্ণালীর কথা বিবেচনা করেই রাখা হয়েছে এমন নাম।

নাসার মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ভাষায়, ‘পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদের যে কক্ষপথ রয়েছে তার আকৃতি ডিম্বাকার হওয়ার জন্য কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করার সময় চাঁদ কখনও পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসে, আবার কখনও অনেক দূরে চলে যায়। চাঁদ পৃথিবীর খুব কাছাকাছি আসায় এই চাঁদকে স্বাভাবিক পূর্ণিমার চাঁদের তুলনায় বড়, স্পষ্ট ও বেশি উজ্জ্বল দেখায়। আর তা তখন পরিণত হয় ‘সুপারমুন’এ।’

শুক্রবার  ২৭ জুলাই ২০১৮ চন্দ্রগ্রহণের কালে এমনই ‘সুপারমুন’ বা সবচেয়ে বড় চাঁদ ফের একবার রাতের আকাশে ভাসবে। চাঁদের আগমনে জোছনা ও স্নিগ্ধতার মাখামাখিতে আকাশে আবার ঘটবে বিরল ঘটনা। গ্রহণ লগ্নের 'সুপারমুন' অন্য দিনের চাঁদের তুলনায় আলাদা হবে দেখতে। আলো ও উজ্জ্বলতায় হবে সর্বাঙ্গ সুন্দর। স্বাভাবিকের থেকে অনেক বড় দেখাবে চাঁদকে। মহাকাশ গবেষকরা বলছেন, স্বাভাবিক অবস্থা থেকে প্রায় ১৪ শতাংশ বড় আকারে দেখতে পাওয়া যাবে আসন্ন চাঁদকে। একইসঙ্গে, চাঁদকে আরও উজ্জ্বল আর গোলাকার থালার মত ভরপুর মনে হবে। গ্রহণকালে চাঁদের শরীরে সূর্যের ছায়া দেখা যাবে পৃথিবী থেকে। গ্রহণ লগ্ন শেষে আবার চন্দ্রালোকে উজ্জ্বল হবে রাতের আকাশ ও পৃথিবী।

‘সুপারমুন’ দশায় চাঁদের প্রান্তিক ঔজ্জ্বল্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৩০ শতাংশ। চলতি বছরে এটাই হবে প্রথম ও শেষ ‘সুপারমুন’। মহাকাশ নিয়ে যারা চর্চা করেন, তারা গ্রহণ করবেন নানা আয়োজন। খোলা চোখে বা টেলিস্কোপের মাধ্যমে দেখতে চেষ্টা করবেন মায়াবী ও রহস্যময় চাঁদকে।

বিজ্ঞানীরা জানতে চাইবেন, পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের কোন জায়গা থেকে সবচেয়ে স্পষ্ট দেখা যাবে এই ‘সুপারমুন’কে। কে হবেন সেই সৌভাগ্যবান, যিনি সবচেয়ে নিটোল ও পরিপূর্ণ চাঁদটি দেখতে পাবেন। নাসার গডডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার তথ্য তালাশ করে জানিয়েছে, সর্বশেষ ‘সুপারমুন’টি সবচেয়ে স্পষ্ট, বড় আর ভালো দেখা গিয়েছিল ইতালির পিসা নামক স্থান থেকে। আর সেই চাঁদটি দেখে ছবি তুলেছিলেন জোসেফ প্যাট্রিকা।

বাংলাদেশেও মহাকাশপ্রেমিরা সবচেয়ে দীর্ঘ গ্রহণের চাঁদ দেখার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না! রাতের আকাশে মায়াবী চাঁদের রহস্য ও সৌন্দর্য নিয়ে পৃথিবীর মানুষের সামনে আসছে ২৭ জুলাই এক বিশেষ চন্দ্ররজনী। চাঁদ এবং চিরায়ত গানের মিতালীতে প্রকৃতির অপরূপ বিভায় শিহরিত মানুষ তখন বলতেই পারেন: 'এই রাত তোমার আমার/এই চাঁদ তোমার আমার। শুধু দু'জনার।'

এ সম্পর্কিত আরও খবর