মহাসড়কের বিপদ ও বিড়ম্বনা!

ঢাকা, জাতীয়

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম   | 2023-08-27 22:25:30

এক সময় আরিচা রোডকে বলা হতো ‘মরণ ফাঁদ’। আকছার দুর্ঘটনা ছিল এই মহাসড়কের স্বাভাবিক চিত্র। এখন মরণের ভয় কেবল একটি সড়কে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে গেছে দেশের প্রায়-সকল উল্লেখ্যযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মহাসড়কে।

একই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সীমাহীন যানজটের যন্ত্রণা। প্রাকৃতিক বিরূপতা, ঝড়, বৃষ্টি ও অফিসকালীন সময়ে সেই দুর্ভোগ তীব্রতর হয়। সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে কষ্টকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো এখনো যেন ‘মরণ ফাঁদ’ আর বিপদ-বিড়ম্বনার কেন্দ্রস্থল।

দুর্ঘটনার পাশাপাশি যানজট এখন শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকা শহরের পথগুলোকেই সীমিত নেই, ছড়িয়ে গেছে দেশের সকল প্রধান আন্তঃনগর-আন্তঃজেলা সড়কগুলোতে। সাম্প্রতিক সময়ের মিডিয়া রিপোর্ট ও ভুক্তভোগীদের ভাষ্যে যে ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তাতে সড়ক-যাত্রার নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য লোপ পেয়েছে। আমাদের প্রায়-সকলের অভিজ্ঞতার মধ্যেও বহু তিক্ত উদাহরণ পাওয়া অসম্ভব নয়। বেপরোয়া যানের নিচে প্রাণ হারানোও বাংলাদেশের জন্য বিচিত্র কোনো ঘটনা নয়!

বিশেষত ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের যানজট ও দুর্ভোগ অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। সীমাহীন জ্যাম, ভাঙা রাস্তার কষ্ট, চালকদের দৌরাত্ম্য ইত্যাদি কারণে ভ্রমণ নামের আনন্দময় কাজটি পরিণত হয়েছে দুর্বিসহ কষ্টকর বিষয়ে। এমনই প্রাণান্তকর পরিস্থিতিতে যাতায়াত করতে হচ্ছে মানুষকে। সুস্থভাবে সফর শুরু করে পথে পথে নাকাল হয়ে মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে অসুস্থ শরীরে।

ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পথটি যানজট ও রাস্তার খোঁড়াখুড়িসহ নানাবিধ সমস্যায় এখন চরম ভোগান্তির নামান্তর। নির্ধারিত সময়ে ভ্রমণ শেষ বা শুরু করার মতো অবস্থাও এখন সেখানে নেই। ছয় ঘণ্টার পথ বারো ঘণ্টাতেও পাড়ি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যানজটে নাকাল হয়ে বহুজন চাকরির ইন্টারভিউ, ডাক্তারের অ্যাপয়মেন্টসহ বহু দাপ্তরিক ও ব্যক্তিগত কাজ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

এই পথে কুমিল্লা, সোনারগাঁও ইত্যাদি পয়েন্টসহ সবচেয়ে ভয়াবহ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় কাঁচপুর ও পরবর্তী স্থানে। সারা পথ পাড়ি দিয়ে এসে শত শত বাসে হাজার হাজার মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় ঢাকা প্রবেশের সুযোগ লাভের আশায়। ঢাকার নিজস্ব জ্যাম এবং বাইরে থেকে আসা গাড়িগুলোর চাপে ঢাকার প্রবেশ মুখে কল্পনাতীত স্থবিরতা দেখা দেওয়ায় থমকে থাকে সবকিছু।

একই পরিস্থিতির দেখা পাওয়া যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে। গাজিপুর চৌরাস্তা থেকে উত্তরা-বনানী পযন্ত সড়ক মনে হয় থমকে থাকে। ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, টাঙ্গাইল, জামালপুরসহ উত্তরবঙ্গের যানবাহনগুলো যেন এখানে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে। ঢাকায় পৌঁছার জন্য দমবন্ধ জ্যামে আটকে মানুষের সীমাহীন কষ্ট শেষই হতে চায় না।

ঢাকার নিজস্ব যানজট এমনিতেই একটি প্রবল সমস্যা। এই জটের ফলে সৃষ্ট স্থবিরতার কারণে বাইরের যানবাহন নগরে প্রবেশের সহজ ও বাধাহীন সুযোগ পায় না। ঢাকার সকল প্রবেশ পথেই লম্বা লাইন ধরে হাজার হাজার যান ভিড় করে থাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টাব্যাপী এই বিড়ম্বনা প্রতিদিনের চিত্রে পরিণত হয়েছে।

যানজট ও পথের বিঘ্নের কারণে কতো বিপুল পরিমাণ কর্মঘণ্টা ও জ্বালানি নষ্ট হয়, তা সহজেই অনুমেয়। ব্যক্তি ও সমাজের গতি ও উন্নয়ন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ পায় না এই সমস্যার জন্য। কত সুযোগ ও সম্ভাবনা যে এজন্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং জনদুর্ভোগ বাড়ছে, তার ইয়াত্তা নেই।

আধুনিক দেশগুলো উন্নত ও অগ্রসর হতে পেরেছে মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকাশের মাধ্যমেই। দূরকে তারা কাছে এনেছে। সুযোগকে দ্রুততম সময়ে হাসিল করার ব্যবস্থা করেছে। নিমেষেই দেশের নানা প্রান্তে আসা-যাওয়ার চমৎকার ব্যবস্থা তৈরি হওয়ায় দেশগুলো আধুনিক ও উন্নত হতে পেরেছে।

সেই তুলনায় বাংলাদেশ চরমভাবে পিছিয়ে রয়েছে। পিছিয়ে রয়েছে বললে বরং কম বলা হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ পেছনের থেকে আরও পেছনে যাচ্ছে। যে পথ আগে চার ঘণ্টায় পাড়ি দেওয়া সম্ভব ছিল, সে পথের সফর-সময় দিনে দিনে প্রলম্বিত হচ্ছে। চারের জায়গায় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা করে সময় লাগছে একই পথ পাড়ি দিতে। ফলে আমরা নিকটকে করছি দূরবর্তী। কাছের জায়গাটিকেও দীর্ঘ সময়ের পথে রূপান্তরিত করছি। মানুষের কর্মঘণ্টার অপচয় ঘটাচ্ছি। উন্নয়নের জন্য একান্ত পূর্বশর্ত গতির বদলে পশ্চাৎপদতার প্রতীক স্থবিরতাকে ধারণ করছি।

বাংলাদেশের শত সম্ভাবনা ও উন্নয়নের সুযোগ বিদ্যমান বিপজ্জনক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পথের স্থবিরতার কারণে ভেস্তে যেতে পারে। জ্যাম ও জটে শেষ হতে পারে অযুত আশা ও সম্ভাবনা। মানুষের ব্যক্তিগত কষ্ট ও দুর্ভোগ পৌঁছে যেতে পারে সহ্যের শেষ সীমান্তে। এতে উন্নয়ন, অগ্রগতি, স্থিতি ও গতির বদলে নানামুখী অনুন্নয়ন, অপচয়, অস্থিতিশীলতা ও বিরূপতার আশঙ্কাই বাড়বে। এমনটি মোটেও নয়। দেশ ও মানুষ যখন এগিয়ে যেতে চায়, তখন তাকে পথে পথে আটকে রাখার কোনো মানে হতে পারে না! দেশ ও জাতির স্বাথে পথের বিপদ, বিড়ম্বনা ও বিঘ্ন সরাতেই হবে। বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে বিদ্যমান ‘মরণ ফাঁদ’ উপড়ে ফেলতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর