ধর্ষণের ভয়াবহতার শেষ কোথায়?

, জাতীয়

মনি আচার্য্য, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 14:45:48

ঢাকা: চট্টগ্রামে ১৪ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে রুহুল আমিন নামে এক যুবক। ধর্ষণের সময় ভিডিও ও ছবিও তুলে রেখে দেয়। পরে ভিডিও ও অশ্লীল ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে সেই কিশোরীকে টানা তিন বছর ধরে ধর্ষণ রুহুল আমিন।

শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি রুহুল। কিশোরীর পরিবারকে ব্লাকমেইল করে থেকে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। চট্টগ্রামে ১৫ জুলাই র‍্যাবের হাতে ধরা পরে রুহুল আমিন।

ধর্ষণের এই ভয়াবহতা এখন নিত্যদিনের ঘটনা। দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিনিয়ত নারী, কন্যা শিশুর উপর চলছে এমন নির্মমতা। নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষের কল্যাণে ধর্ষণ অনেকে আগেই ভাইরাসের মতো সারাদেশে ছড়িয়েছে। বর্তমানে এই বিভৎসতায় যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা ও কৌশল।  

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, উৎসবের আয়োজনস্থল, গ্রাম, শহর এমনকি নিজের পরিবারেও রক্ষা পাচ্ছেন না নারীরা। প্রতিনিয়ত তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৪০৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৪ জন নারী ও ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৯ জন নারীকে। একই সময়ে ৬৫ জন নারীকে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে এবং ২৩ জন নারী শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে।

নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংগঠনের বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দিন দিন দেশে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে।

ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শান্তি ও যথাযথ আইনি ব্যবস্থার অভাবে ধর্ষকরা আরও উৎসাহিত হচ্ছে বলে মনে করে নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে বর্তমানে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বৃদ্ধির কারণ শুধুমাত্র দু’একটি নয়। সামাজিক বিভিন্ন অসংগতি এবং সমাজিক নৈতিকতার অভাবেও নারী নির্যাতনের হার দিন দিন বেড়ে চলছে। বিগত কয়েক বছরের ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনার মোটিভের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনার ধরণ ও চিত্র পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের প্রধান হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে ইন্টারনেট।

একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ পুরুষ নারীদের অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেটে প্রকাশ করাকে অপরাধ মনে করেন না। তারা বিষয়টিকে মজা হিসেবেই দেখেন।

ফলে গোপনে নারী কিংবা কিশোরীদের স্পর্শকাতর ছবি ও ভিডিও তুলে ফেলছেন এক শ্রেণির অপরাধীরা। পরে এসব ভিডিও ও ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে দিনের পর দিন তাদের ধর্ষণ করা হয়। এছাড়া অনেক সময় ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকাও হাতিয়ে নিচ্ছে।

আর এসব ঘটনার সঠিক বিচার ও তদন্ত হচ্ছে না যেমন, তেমনি ধর্ষকরা প্রভাবশালী হওয়ায় আইনি সহায়তা অনেক ভিকটিম পরিবার মামলা করলেও ভয়ে আবার মামলা তুলে নিচ্ছেন।

মানবাধিকার নেত্রী অ্যাড. এলিনা খান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আইন আছে এর প্রয়োগ নেই। দেশে কোনো জায়গায়ই নারীরা আজ নিরাপদ নেই। যেখানে যাচ্ছেন নারীরা সেখানেই নির্যাতিত ও ধর্ষিত হচ্ছেন। কিন্তু রাষ্ট্র এই বিষয়ে এখনো নীরব রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, শিশু ও কিশোরীদের ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে পরিবার অনেকাংশে দায়ী। কেননা তারা শুধু নিজেদের সন্তানদের জিপিএ ৫ পাওয়ার শিক্ষায়ই দিচ্ছেন। কিন্তু নিজেকে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা থেকে কীভাবে রক্ষা করতে হবে সেই বিষয়ে কোনো শিক্ষাই দিচ্ছেন না।

উগ্রবাদি বাদী গোষ্ঠী ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে ‘নারীর পোশাক ও চলাফেরার ধরণের উপর বরাবরেই দোষ চাপায়  – এতে ধর্ষকরা আরও উৎসাহিত হয় বলে মন্তব্য করেন কন্যা শিশু এ্যাডভোকেসি ফোরাম সাধারণ সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় এই উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো বলে বেড়ান নারীদের পোশাকের জন্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে বেশি। এই ধরণের মন্তব্যের কারণে ধর্ষকরা আরও উৎসাহিত হচ্ছে।

তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, যারা বলছেন পোশাকের জন্য ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে তাদের কাছে জানতে চাই শালীন পোশাকের সংজ্ঞা কি? আসলে পোশাক কোনোভাবে ধর্ষণের জন্য দায়ী নয়। কেননা একটি শিশু বা হিজাব পড়া নারী কেন তাহলে ধর্ষণের শিকার হয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনার কোনো বিচার হয় না বলেই এসব কথা উঠে আসে। একটি ধর্ষণের মামলা বছরের পর বছর ধরে চলেও বিচার শেষ হয় না। পরে ধর্ষকরা জামিনে বেরে হয়ে ভিকটিম ও তার পরিবারকে হুমকি ধমকি দিচ্ছে। ফলে ভিকটিমরা এক পর্যায়ে মলা তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে। ধর্ষণের ঘটনা বন্ধ করতে হলে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি স্পেশাল কোর্টে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর