ওয়াটার ট্যাক্সি ৬টি,  চলে ১টি তাও অনিয়মিত

ঢাকা, জাতীয়

নাজমুল হাসান সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-09-01 19:34:21

২০১৩ সালে সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান গাবতলী ওয়াটার ট্যাক্সি ল্যান্ডিং স্টেশনে ‘গাবতলী টু সদরঘাট’র নতুন চারটি ওয়াটার ট্যাক্সির উদ্বোধন করেন। মোট ছয়টি ওয়াটার ট্যাক্সি এই রোডে চলাচল করার কথা থাকলেও চলছে মাত্র একটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই একটি ওয়াটার ট্যাক্সিও চলে অনিয়মিত।

প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত এক ঘণ্টা পর পর গাবতলী ও সদরঘাট থেকে একটি করে ওয়াটার ট্যাক্সি যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকাল ছয়টা পঞ্চান্ন মিনিটে গাবতলী ওয়াটার ট্যাক্সি ল্যান্ডিং স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, ল্যান্ডিং স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ও বসার আসনগুলোতে বাস্তুহীন মানুষ ও পথ শিশুরা ঘুমাচ্ছে।

তখনও ল্যান্ডিং স্টেশনে ওয়াটার ট্যাক্সি সংশ্লিষ্ট কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারির দেখা মেলেনি কোথাও। ল্যান্ডিং স্টেশনের নিরাপত্তারক্ষী ঘুম থেকে উঠলেন সাতটা ত্রিশ মিনিটে। তার সাথে কথা বলে জানা গেল, ওয়াটার ট্যাক্সি সদরঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় সকাল নয়টা দশ মিনিটে। যাত্রী না হওয়ার কারণে এই অবস্থা জানান তিনি।

এদিকে আটটার ওয়াটার ট্যাক্সি ধরে ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য গাবতলী ওয়াটার ট্যাক্সি ল্যান্ডিং স্টেশনে এসেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্মান দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া রিথিলা তন্বী। দূর থেকে প্ল্যাটফর্মের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ফিরে যাচ্ছিলেন। ওই সময় রিথিলার সঙ্গে কথা হয়।

তিনি জানান, আসলে ওয়াটার ট্যাক্সি করে যাওয়াটা আমার জন্য সহজ। বিগত দুই বছর ধরে নিয়মিত ওয়াটার ট্যাক্সি করে যাওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু ট্যাক্সিই তো ঘাটে আসে না।

ট্যাক্সি ঘাটের পরিবেশ নিয়ে এই যাত্রী বলেন, ‘দেখছেন একবার এখানকার পরিবেশটা? কোথাকার কারা এখানে শুয়ে আছে, কে জানে! এমন অবস্থা দেখলে খুব ইনসিকিউর ফিল করি। তাই চলে যাচ্ছি।’

সাতটা ৫৮ মিনিটে তাড়াহুড়ো করে একজনকে স্টেশনে আসতে দেখা গেল। তিনি এসেই নিরাপত্তারক্ষীকে নির্দেশ দিলেন ঘুমন্ত মানুষগুলোকে ডেকে তুলে প্ল্যাটফর্ম থেকে বের করে দিতে। নির্দেশ শুনে তৎপর নিরাপত্তারক্ষী। একে একে সবাইকে ডেকে তুলে প্ল্যাটফর্ম থেকে বিদায় করে দিলেন। কেনো তাদের সড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এমনটা জানতে চাওয়ায় নিরাপত্তারক্ষীকে নির্দেশকারী জানালেন, ‘বড় স্যার (সচিব) আসবেন’।

এই বলেই হন্তদন্ত হয়ে তিনি চলে গেলেন ল্যান্ডিং স্টেশনের একটি কক্ষে। সেখান থেকে ঝাড়ু হাতে ফিরে, নিজেই পরিষ্কার করলেন সমস্ত স্টেশনসহ প্ল্যাটফর্মে বসার আসনগুলো। অবস্থা দেখে মনে হলো, গত দুই দিন থেকে এই স্টেশন পরিষ্কার করা হয় না। সিমেন্ট দিয়ে বাধানো বসার আসনগুলোতে ছারপোকার অভাব নেই। ছারপোকার কামড়ে এক জায়গায় পাঁচ মিনিটের বেশি বসে থাকা অসাধ্য।

নয়টা বাজার কিছুক্ষণ আগে চার থেকে পাঁচজন যাত্রী এসে হাজির হলেন স্টেশনে। উদ্দেশ্য ওয়াটার ট্যাক্সি ধরে সদরঘাট যাবে। তাদেরই একজন আজীবুল মোল্লা, পেশায় ক্ষুদে কাপড় ব্যবসায়ী। তিনি নয়টার সময় এসেও ওয়াটার ট্যাক্সি ঘাটে না দেখে স্টেশনে লঞ্চ-স্টিমার শাখায় কর্মরত একজন কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলেন ‘এখনো ঘাটে ওয়াটার বাস নাই কেন?’ প্রত্যুত্তরে ওই কর্মকর্তা বললেন, ‘এইডা আর নতুন কি? ওরা তো শুরু থাইকাই মন-মর্জি মতো চলে। যেদিন পকেট ফাহা (খালি) থাকে হেইদিন আয় যাত্রি লইতে।’

আজ আসবে কি না জানতে চাইলে ওই কর্মচারী বলেন, ‘আইলে এতক্ষণে আইসা পড়তো। আইজ আর আইবো না।’

পাশে থেকে আরেক অপেক্ষমান যাত্রী বললেন, ‘খবরে দেখায় এত এত ট্যাক্সি ছাড়ছে,তাহলে এগুলা দিয়া লাভ কি?’

প্রত্যুত্তরে ল্যান্ডিং স্টেশনের নিরাপত্তারক্ষী বললেন, ‘আরে ভাই সাংবাদিকরা আর কি জানে। তারা আহে ফটো তুলে আর ভিডিও কইরা যায়। টিভিতে যা দেহায় তার সবই কি সত্যি না কি! আগের দুইডায় সরকার লোকশানে আছিলো। এহন যেডি ছাড়ছে হেডিতে সরকার ভর্তুকি দেয়। হের লেইগা সকাল-সন্ধ্যা না চইলা, দিনে একটা ট্রিপ দেয় ট্যাক্সি। খবরের কতা বাদ দেন। আমরা যা কই হেইডাই সত্যি।’

ওয়াটার ট্যাক্সির এমন বেহাল দশা নিয়ে যোগাযোগ করা হয় বিআইডব্লিউটিসি’র চেয়ারম্যান সৈয়দ মোঃ তাজুল ইসলামের সাথে। তিনি না থাকায় তার ব্যাক্তিগত সহকারি কল রিসিভ করে প্রশ্নের সুরে বলেন, ‘কেন চলবে না? এটা তো প্রতিদিন চলার কথা। কেন চলছে না সেটার কোনো কারণ এখনও আমরা জানি না। আমরা চট্টগ্রাম আছি। আপনি দুই দিন পর যোগাযোগ করুন, তখন জানানো হবে’।

উল্লেখ্য, গাবতলী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত চলাচল করা এসব ওয়াটার ট্যাক্সির ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ টাকা। যাত্রাপথে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনের ভাড়া ১৫ টাকা। ২০১৩ সালে উদ্বোধন করা ট্যাক্সিগুলোতে যাত্রী আকর্ষণে ভর্তুকি দিয়ে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের ওয়াটার ট্যাক্সিগুলোর যাত্রী ধারণক্ষমতা ৩৫ জন। কেরানীগঞ্জের ‘ঢাকা ডকইয়ার্ডে’ নবনির্মিত চারটি ওয়াটার ট্যাক্সির প্রতিটির যাত্রী ধারণক্ষমতা ৮১ জন। সদরঘাট থেকে যাত্রা করে ওয়াটার ট্যাক্সিগুলো পথে খোলামোড়া, সোয়ারিঘাট, বছিলা ও রায়েরবাজারে যাত্রী ওঠানামা করাবে।

বলে রাখা ভালো, ২০০৪ সালে একটি ওয়াটার ট্যাক্সি নামানো হয়েছিল। এরপর ২০১০ সালের ২৮ আগস্ট দুটি নৌযান দিয়ে দ্বিতীয় ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু করা হয়। তবে গত দুইবারই যাত্রীর অভাব, নৌযানে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এসব সেবা বন্ধ হয়ে যায়। তৃতীয়বারের মতো ওয়াটার ট্যাক্সি সেবা চালু হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনেকেই বলছেন, এই সেবাও বন্ধ হয়ে যাবে খুব দ্রুত। নানা সমস্যার কারণে এসব সরকারি সেবার ধার ধারে না যাত্রীরা। নদীর নোংরা পানির দুর্গন্ধ ও অনিয়মিত যাত্রী সেবার কারণে এমন অবস্থা বলে মনে করেন অনেকেই।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর