টিকইল: দ্যা আলপনা ভিলেজ

ঢাকা, জাতীয়

মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-12-11 17:28:01

তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী, নাচোলের রাণী খ্যাত ইলা মিত্রের স্মৃতিবিজড়িত উত্তরাঞ্চলের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি উপজেলা নাচোল। চাঁপাইনবাবগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম টিকইল।

হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামটিতে প্রায় ৮০টি হিন্দু পরিবার বাস করেন। তাদের সবাই বর্মন গোত্রীয়। এ গ্রামের সব বেশীর ভাগ বাড়িই মাটির তৈরি। আর এর প্রতিটি দেয়াল যেন এক একটি ক্যানভাস। বিভিন্ন পূজা পার্বণে হিন্দু মহিলারা বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে রঙ-বেরঙের আলপনা আঁকেন।

বিশেষ করে শারদীয় দুর্গোৎসবে এ গ্রামের হিন্দু বাড়িগুলো নানান রকম আলপনায় ভরে যায়। গ্রামটির নাম টিকইল হলেও পর্যটকদের কাছে এটি আলপনা গ্রাম হিসাবেই সমধিক পরিচিত।

গ্রামের মানুষ খুবই অতিথি পরায়ণ। হিন্দু বাড়ি হলেও সংস্কারের তেমন বালাই নেই। পর্যটক বাড়ির ভেতর যেতে চাইলে বাড়ির লোকদের বললেই তারা নিয়ে আলপনা দেখান।

টিকইল যাওয়ার পথে দেখা যায় অসংখ্য মাটির তৈরি বাড়ি। এসব বাড়ি দোতলাও হয়ে থাকে। যুগ যুগ ঘরে মাটির ঘরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে নাচোল উপজেলা। দৃষ্টিনন্দন এসব বাড়ির প্রতিবছরই যত্ন নিতে হয়।

হিন্দু বাড়ির প্রতিটি মহিলাই শিল্পী। আগে মাটির ঘরে আলপনা আঁকতে লাল মাটি, সাদা মাটি ভিজিয়ে সেখান থেকে রং নিয়ে আলপনা আঁকা হতো। কিন্তু এসব রং স্থায়ী হতো না। বর্তমানে চক পাওডার, আমের পুরাতন শাঁস চুর্ণ, বিভিন্ন রং, মানকচু, কলাগাছের কস দিয়ে রং স্থায়ী করা হয়। তবু বৃষ্টিতে এসব রং ধুয়ে যায়। তাই কোন কোন বাড়িতে সিনথেটিক রং ব্যবহার করা হয়।

হিন্দু মহিলারা যুগ যুগ ধরে তাদের মাটির ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে আলপনা আঁকেন। এতে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা নেই। বংশ পরম্পরায় তারা এ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

টিকইল গ্রামের আলপনা বাড়ির কর্তী দেখন বর্মন। তিনি বার্তাটোয়েন্টিফোরকে জানান, প্রতিদিন অনেক লোক আসেন এ গ্রাম দেখতে। শীতকালে তারা অনেক দিন রান্না বান্না পর্যন্ত করার সময় পান না। বাড়িতে পর্যটকের আনাগোনা লেগেই থাকে।

কবে থেকে এসব আলপনা আঁকা শুরু করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাড়িতে আলপনা আঁকা হিন্দু বাড়ির ঐতিহ্য। তবে আগে পুরো বাড়িতে আঁকা হতো না। তিনিই প্রথম তার বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য পুরো বাড়িতে আলপনা আঁকেন। পরবর্তীতে গ্রামের অন্য হিন্দু পরিবারও তাদের বাড়িতে আলপনা আঁকা শুরু করেন।

 

আগে অল্প পরিসরে উঠান থেকে ঘরের বারান্দা পর্যন্ত দেয়ালে কিংবা বারান্দায় আলপনা করা হতো। কিন্তু বর্তমানে ঘরের ভেতর ও বাইরের পুরো দেয়ালে আল্পনা আঁকা হয়। শুধু শোবার বা বৈঠক ঘর নয়. পূজার ঘর, রান্না ঘর, সীমানা প্রাচীর, বাথরুমের দেয়াল, গরুর গোহাইল কোন জায়গায় বাদ যায় না।

মাটির তৈরি এসব ক্যানভাসে প্রকৃতির রূপ তুলে ধরা হয়। তাছাড়া তাদের দেবদেবীর ছবিও দেয়ালে স্থান পায়। মনের মাধুরী মিশিয়ে তারা এ আলপনা আঁকেন।

মুখে মুখে আলপনা গ্রামের কথা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়া আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে এর খ্যাতি দেশ বিদেশেও ছড়িয়েছে। গ্রামটি দেখতে দূরদুরান্ত থেকে ছুটে আসেন অসংখ্য পর্যটক।

কখন যাবেন:

শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় টিকইল সাজে নতুন সাজে। এ সময় প্রতিটি বাড়িতে নতুন আলপনা করা হয়। শুধু গ্রামটি দেখতে হলে এ সময় যাওয়া ভালো। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেহেতু আমের জন্য বিখ্যাত সেহেতু আম পাকা শুরু হলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়া উত্তম হবে। এতে একই সাথে আম, লিচু খাওয়া, আলপনা গ্রাম, সোনা মসজিদসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহাসিক স্থানগুলোও দেখা হয়ে যাবে।

যেভাবে যাবেন:

ঢাকার কল্যাণপুর থেকে অনেকগুলো পরিবহনের বেশ কয়েকটি প্রতি পনের মিনিট পরপর বাস চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এছাড়া বনলতা নামক একটি বিরতিহীন ট্রেনও দুপুর সোয়া একটায় ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সিএনজিতে টিকইল গ্রামে যাওয়া যায়। বাসে আমনুরা হয়ে ভেঙে ভেঙেও যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন:

টিকইল কিংবা নেজামপুরে রাতে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই। আপনাকে দিনে দিনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ফিরে আসতে হবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভালো মানের বেশ কয়েকটি হোটেল আছে। বাজেট হোটেলও আছে অনেকগুলো।

কোথায় খাবেন:

টিকইল কিংবা নেজামপুরে তেমন ভালো কোন হোটেল নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সকালে নাস্তা করে দুপুরের জন্য হালকা খাবার সাথে নিতে পারেন। সন্ধ্যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে এসে রাতের খাবার খেতে পারেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর