মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযান: স্বস্তিতে অভিভাবকরা

, জাতীয়

মুফতি এনায়েতুল্লাহ | 2023-08-24 02:03:08

লেখার শিরোনামের সঙ্গে অনেকেই তীব্র আপত্তি জানাতে পারেন। বলতে পারেন কটূকথাও। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে অনেক অভিভাবক স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। অনেকে বলছেন, একটা ফলাফল না আসা পর্যন্ত অব্যাহত থাকুক এই অভিযান।

আমার পরিচিত অনেক অভিভাবক সন্তানের মাদকসঙ্গ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মাদকের সহজলভ্য সমাজের মাদক প্রসারের জন্য বেশি দায়ী। চলতি অভিযানে, মাদকের বাজারে ক্রাইসিস দেখা দেবে, তাতে অনেকেই মাদকগ্রহণ বা সেবনের মওকা পাবে না। সুতরাং চলুক এই অভিযান, এটা যেনো বন্ধ না হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকের বিরুদ্ধে পরিচালিত সাঁড়াশি অভিযানে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক উদ্ধার, এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার এবং কোনো কোনো মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটেছে। এতে গত এক সপ্তাহে পঞ্চাশের বেশি মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের মাদক।

আগেই বলেছি, মাদকের বিরুদ্ধে এই অভিযান ইতিবাচক হলেও ‘বন্দুকযুদদ্ধ’র ঘটনা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে বন্দুকযুদ্ধের নামে প্রাণহানি কাম্য নয়। অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি বিধান করতে হবে। বন্দুকযুদ্ধ ছাড়া কি মাদক দমনের অন্য কোনো পন্থা নেই? তবে এ কথা অনস্বীকার্য, সারাদেশে মাদক যেভাবে সর্বগ্রাসী রূপ লাভ করেছে, তাতে এমন ‘অ্যাকশন’ ছাড়া গতি নেই।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মাদক ব্যবসার যারা মূল হোতা তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। মাদক ব্যবসার যে ‘চেইন’ সৃষ্টি হয়েছে তাতে কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে কিছু মাদক উদ্ধার ও বন্দুকযুদ্ধের নামে কিছু লোক নিহত হলেও অন্যরা এ সময় সাবধান হয়ে যাচ্ছে। তারা মাদক ব্যবসা আপাতত বন্ধ করে আত্মগোপনে রয়েছে। অভিযান বন্ধ বা সহনীয় পর্যায়ে এলেই তারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে।

দীর্ঘদিন ধরেই দেশে মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে। এক সময় ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে যেমন বানের পানির মতো ফেনসিডিল দেশে প্রবেশ করত, এখন মাদকের নতুন সংস্করণ ইয়াবা প্রবেশ করছে মায়ানমার থেকে। এই মাদক এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সীরা এতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এমনকি শ্রমিক ও গাড়ি চালকদের মধ্যেও ইয়াবার বিস্তার ঘটেছে।

আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশের ভবিষ্যত যে তরুণ শ্রেণী; তাদের মধ্যে ইয়াবা আসক্তি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যে পরিবারের তরুণটি মাদকাসক্ত সে পরিবারে কী অশান্তি ও দুর্দশা সৃষ্টি হয়, তা আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। মাদকাসক্ত পুত্রের হাত থেকে রক্ষা পেতে কোনো কোনো অভিভাবক পুলিশের হাতে পুত্রকে তুলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মাদকের টাকার জন্য ছেলে বাবা-মা-ভাই-বোনকে খুন করেছে। বহু পরিবার পথে বসে গেছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, মাদকের প্রসার এবং এর সঙ্গে জড়িতেদের নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু বছর ধরেই লেখা হচ্ছে। তাতে ফল খুব কমই পাওয়া গেছে, এটা বলার কারণ নেই। মানুষ সচেতন হয়েছে, কোথাও কোথাও পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে হ্যাঁ, ফলাফল কাঙ্খিত হয়নি। এর কারণ হচ্ছে, যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার; তাদেরই একটি শ্রেণির প্রশ্রয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা অবাধে ব্যবসা করে চলেছে। সহযোগী এক পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, খোদ রাজধানীতে প্রায় ৫৪টির মতো স্পটে নিয়মিত মাদকের হাট বসে। এ খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরও এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। লেখালেখি হলে কিছুদিন রাখঢাক করে মাদক বেচাকেনা হয়, তারপর আবার তা পুরোদমে চলতে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির সদস্যর নিয়মিত যোগযোগ এবং মাসোহারার সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি কোনো কোনো সদস্য সরাসরি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে কোনোভাবেই মাদকের আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

কক্সবাজারের এক এমপি তো রীতিমতো ‘ইয়াবা সম্রাট’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ থাকলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বলা হয়ে থাকে, ইয়াবার মূল রুট কক্সবাজার-টেকনাফ তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আমরা মনে করি, মাদক ব্যবসায়ী এবং এদের পৃষ্ঠপোষক ও নেটওয়ার্ক যতই শক্তিশালী হোক না, যে কোনো মূল্যে তা নির্মূল করতে হবে।

মাদক নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্চনীয়। এর কোনো বিকল্প নেই। তবে এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত নয়, যা বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা মনে করি, কথিত বন্দুকযুদ্ধে এ পর্যন্ত যারা নিহত হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের বিস্তারিত বিবরণ জনসম্মুখে তুলে ধরা অপরিহার্য। তারা মাদকব্যবসায়ী বলে ঘোষণা দিয়ে দায় সারলে হবে না। মাদকের সঙ্গে তাদের যথাযথ সম্পৃক্ততা আছে কিনা, তার অনুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরতে হবে। আবার মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে নিরীহ কেউ যাতে এর শিকার না হয়, এদিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। রাজনৈতিক শত্রুতার জের ধরে মাদকের নামে যাতে কাউকে বন্দুকযুদ্ধে পড়তে না হয় এ ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, গুলি করে মাদকের মতো সর্বগ্রাসী একটি সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। এতে সাময়িক স্বস্তি হয়তো পাওয়া যাবে, তবে দীর্ঘমেয়াদে বা পুরোপুরি নির্মূল করা যাবে না। এক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। পরিবার ও সমাজের অভিভাবকদের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সন্তান এবং এলাকার তরুণদের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। তারা কোথায় যায়, কী করে, কাদের সঙ্গে মেলামেশা করে- এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে এলাকাভিত্তিক মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। পাশাপাশি নিজেদের বাহিনীর যারা মাদক ব্যবসাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং নিয়মিত মাসোহারা নিচ্ছে তাদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘সর্ষের মধ্যে ভূত থেকে গেলে, সে ভূত কখনোই তাড়ানো যায় না।’ কাজেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লক্ষ্য হওয়া উচিত মাদকের সঙ্গে যে বা যারাই জড়িত থাকুক এবং যতই প্রভাবশালী হোক, তাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ হওয়া।

মনে রাখতে হবে, মুসলমানদের জন্য মাদক হারাম। ইসলাম মনে করে, মাদক ব্যক্তি, দল, সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য অকল্যাণকর।

এ সম্পর্কিত আরও খবর