সাবেক শিবির নেতার দাপটে অতিষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা   

রাজশাহী, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, রাজশাহী | 2023-09-01 06:48:50

ঝিনাইদহ জেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন সাইফুল ইসলাম। সেই সুবাদে ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকরি। বয়স অল্প হলেও স্বল্প দিনেই চড়ে বসেছেন বড় পদে। বর্তমানে তিনি রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তার ওপরের পদে আছেন শুধু হাসপাতালের পরিচালক। তবে পরিচালককে কৌশলে চাপে রেখে একক কর্তৃত্বে হাসপাতাল চালাচ্ছেন সাবেক শিবির নেতা সাইফুল।

হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনে ব্যাপক রদবদলের পর হাসপাতালের আয়ের অর্থ সরিয়ে জামায়াত-শিবিরকে দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তবে সাইফুল ইসলাম ব্যাংক হাসপাতাল থেকে বিভিন্নভাবে বড় অংকের টাকা সরিয়ে গোপনে জামায়াত-শিবিরকে সরবরাহ করে আসছেন। প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে হাসপাতালে নিজ কার্যালয়ে বসে প্রকাশ্যে জামায়াত-শিবিরের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বসে বৈঠকও করেন।

কর্মকর্তাদের অভিযোগ, হাসপাতালের আয়ের অর্থের হিসাব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললেই তাকে নানাভাবে হয়রানি শুরু করেন সাবেক শিবির নেতা সাইফুল। হাসপাতালে বসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো বিষয়ে কথা তুলেও অনেক সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তার রোষানলে পড়তে হয়েছে। ভাগ্যে জুটেছে বদলি আর শোকজ। এছাড়া হাসপাতালের নার্সদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। ফলে তার খাম-খেয়ালিপনায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

এদিকে, সম্প্রতি হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলে সাইফুলের অতীত রাজনৈতিক ইতিহাস ও অর্থ কেলেঙ্কারী বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। পুলিশ প্রাথমিকভাবে তদন্তে অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে। তবে এ নিয়ে এখনি কিছুই বলতে রাজি হননি পুলিশ কর্মকর্তারা।

অপরদিকে, সাইফুলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের তদন্ত দলও কিছুদিন আগে রাজশাহী এসে তদন্ত করে গেছেন। তবে এখনও সেই তদন্তের প্রতিবেদন জমা পড়েনি। এর আগেও এমন তদন্ত হলেও ঘুষ দিয়ে তদন্ত টিমকে খুশি করে অনিয়ম, দুর্নীতির চিত্র ঢেকে ফেলেন চতুর প্রকৃতির সাইফুল।

আরএমপি কমিশনারকে দেয়া অভিযোগে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উল্লেখ করেছেন, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তনের পর হাসপাতালটির রাজশাহী শাখার পরিচালক পদেও পরিবর্তন হয়। স্বাধীনতা চিবিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. এসআর তরফদারকে পরিচালক করা হয়। কিন্তু কৌশলে দ্বিতীয় শীর্ষ পদে থেকে যান শিবির ক্যাডার সাইফুল আলম। ফলে পরিচালক হাসপাতালে কী কী কর্মকাণ্ড করেন, সেই খবর গোপনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে পৌঁছে দেন তিনি।

অভিযোগে আরও বলা হয়, কয়েক মাস আগে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে বনভোজনের নামে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে সাইফুল প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন। অথচ বনভোজনের সকল খরচ হাসপাতালের ফান্ড থেকে পরিশোধ করা হয়। ফলে ওই টাকা সাইফুল আত্মসাত করেছেন। টাকার বড় অংশই তিনি গোপনে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের সরবরাহ করেছেন। এসব নিয়ে কথা বললেই সাইফুল সবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। বদলি এবং শোকজ করেন কলমের খোঁচায়। তার কারণে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চেম্বার ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

অভিযোগে বলা হয়, পরিচালক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তি হলেও সাবেক শিবির নেতা সাইফুল তাকে কৌশলে হাত করেছেন। সাইফুল ও তার অনুসারীদের কৌশলে বাধ্য হয়ে সম্প্রতি সাইফুলের বদলি ঠেকিয়েছেন খোদ পরিচালক। ফলে বহাল থাকা সাইফুল আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তার কর্মকাণ্ডে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের রাজশাহীর সবগুলো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

অভিযোগ বিষয়ে ফোনে সাইফুল ইসলাম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘হাসপাতালে প্রায় ৪০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। প্রশাসনিক পদে আছি, সবার সঙ্গে তো সুসম্পর্ক থাকে না। যাদেরকে সুবিধা দেওয়া হয় না তারা হয়তো এ ধরনের অভিযোগ করেছেন। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।’

জানতে চাইলে রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল পরিচালক ডা. এসআর তরফদার বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, “হাসপাতালে আমি ছাড়া সবাই তো প্রায় জামায়াত-শিবির। সবাইকে তো আর ছাঁটাই করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় আমি সাইফুলকে সতর্ক থাকতে বলেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘স্যার, আগে জামায়াত-শিবির করেছি। কিন্তু এখন আর সেসব চলবে না জানি। তবে চাকরি তো করতে হবে, সংসার বাঁচাতে হবে।’ তার এমন কথায় আমি মানবিক দিক বিবেচনা করে তাকে শুধরানোর সুযোগ দিয়েছি।’

সাইফুলের বিরুদ্ধে বলতে অপরাগতা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগে পুলিশ কর্মকর্তারা তদন্ত করতে এসেছিল, আমি তাদেরকে বলেছি ঘটনা সত্য নয়। তাছাড়া আর কী-ই বা বলার ছিল আমার?’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহের হরিনাকুণ্ডু উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের আবদুল করিমের ছেলে সাইফুল আলম। স্থানীয় মানুষ ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরাও তাকে ‘ডেঞ্জারস’ বলে চেনে। ছাত্র জীবনে তিনি মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে অস্ত্র এনে শিবিরকে সরবরাহ করতেন বলেও এলাকায় মানুষের মুখে মুখে। ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজে পড়াশোনার সময়ে কলেজ ভিপি মোসাব্বের হোসেন লাল্টুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে ক্যাম্পাসের মূর্তমান আতঙ্ক ছিলেন সাইফুল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর