বিশ্বাসী পুলিশ তৈরি করতে চাই: ডিআইজি

ঢাকা, জাতীয়

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-08-31 05:00:48

‘আমাকে সহযোগিতা করুন। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, পুলিশের আইজি ড. জাবেদ পাটোয়ারী স্যারের নির্দেশনা মোতাবেক আপনাদের উপহার দেব সুন্দর বাসযোগ্য পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ। আজ আইজি স্যারের নেতৃত্বে নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে পুলিশ বাহিনী। সততা, জবাহদিহিতা, স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

পুলিশে কনস্টেবল পদে নিয়োগে এবার বজায় রাখা হয়েছে শতভাগ, স্বচ্ছতা আর নিরপেক্ষতা। যার ফলশ্রুতিতে আগামী দিনে পুলিশ বাহিনীতে সূচনা করবে নতুন ধারার। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি আইজি স্যারের সুদৃঢ় নেতৃত্বে গুজব প্রতিরোধে ৬৪ হাজার গ্রাম, শহর বন্দরে আজ কাজ করছে পুলিশ।

আমার মিশনই হচ্ছে, দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। যেখানে অপরাধীরাই থাকবে আতঙ্কে আর নিশ্চিত করা হবে জনসাধারণের নিরাপত্তা।

বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এমনটিই বলছিলেন, সদ্য যোগ দেওয়া পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান।

পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ডিআইজি (প্রশাসন) থেকে গত ২২ মে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি পদে যোগ দেন তিনি।

ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার পদে কাজের সুবাদেই দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। সাভারে বেদে পল্লীর সমাজ ব্যবস্থা উন্নয়নে থেকে শুরু করে স্কুল, কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার, গাড়ি চালনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও বুটিক হাউসসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে তাদের আত্ন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বেদে পল্লীর অভিশপ্ত বাল্য বিবাহ রোধেও তার ভূমিকা প্রশংসিত হয় দেশে -বিদেশে। নিজের প্রতিষ্ঠিত উত্তরন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিত ও অবহেলিত পিছিয়ে পড়া হিজড়া  জনগোষ্ঠীর জীবন-মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘উত্তরণ কর্ম-সংস্থান প্রশিক্ষণ’ কর্মসূচি চালু করেন এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের জীবনমান উত্তরণ,তাদের পূর্নবাসন ও মানুষ হিসেবে তাদের সামাজিক মর্যাদা সমুন্নোত করতে সাড়া জাগানো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন। যে কারণে এই দুই জনগোষ্ঠির কাছে তার পরিচয় মানবতার ফেরিওয়ালা।

ওই সময়ে তার উদ্যোগে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ পুলিশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। রাজারবাগে প্রতিষ্ঠিত এই যাদুঘর ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ উম্মুক্ত করে দেয়া হয় সর্বসাধারণের জন্য।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর অবদান ও ঢাকায় তাদের প্রথম প্রতিরোধ নিয়ে “মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ” নামের একটি বই-ও লিখেছেন হাবিবুর রহমান।

 

গোপালগঞ্জের চন্দ্র দিঘলিয়া গ্রামে ১৯৬৭ সালে জন্ম।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিটিউট থেকে  স্নাতোকোত্তর  হাবিবুর রহমান ১৭তম বিসিএস দিয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে পুলিশে যোগদানের পর থেকেই কর্মক্ষেত্রে নিজের মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন। সাহস, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার জন্য তিনি তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) এবং  রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন দু’বার।

পেশাগত ও মানবিক কাজের বাইরে সফল ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এবং এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

ঢাকা রেঞ্জের কার্যালয়ে পা রাখতেই পরিবর্তনের দৃশ্যপট। ডিআইজির আগের অফিস কক্ষের ডেকোরেশন ভেঙ্গে আধুনিক ও সুসজ্জিত করা হচ্ছে অফিসের পরিবেশ।

‘এই যে পরিবর্তন দেখছেন তা কিন্তু কেবল আমার অফিসেই নয়, এটা ছড়িয়ে পড়বে রেঞ্জের সকল থানায়। পরিবর্তন আসছে সেবার ধরন আর মানসিকতায়। যে পরিবর্তনটা পুলিশের প্রতি আস্থা আরো বাড়িয়ে দেবে। থানায় প্রবেশ করলে ওয়েলকমিং অ্যাপ্রচটাই থাকবে অন্যরকম’। বলছিলেন,ডিআইজি হাবিবুর রহমান,বিপিএম(বার), পিপিএম(বার)।

দায়িত্ব নেওয়ার সূচনাতেই কোন বিষয়গুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন?

‘পুলিশকে প্রকৃত অর্থেই জনগণের বন্ধু হিসেবে গড়ে তোলা। জনগণ যাতে পুলিশের উপর পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে পারে, সেরকম বিশ্বাসী পুলিশ গড়ে তোলা।সকলের প্রতি এটাই আমাদের প্রধান বার্তা।যেটা আমরা  ইতোমধ্যে সকলকে পৌঁছে দিতে আমরা সক্ষম হয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের জনমুখী, স্বচ্ছ, জবাবদিহি এবং সৎ হিসেবে গড়ে তোলা’।

এত কড়া বার্তা,নানা উদ্যোগ।তারপর-ও তো কতিপয় সদস্যের নেতিবাচক কার্যক্রম বাহিনীর মর্যাদা ক্ষুন্ন করে।তাদের বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটা কেমন?

দেখুন,সবাই তো এই দেশেরই মানুষ।তবে আমি মনে করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে যেখানে পুলিশ সমান সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, সেখানে সততার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করে অন্যকেও সৎ রাখার জন্য কিন্তু যথেষ্ট।

যে ধরনের পুলিশিং প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন,রাজনৈতিক প্রভাবের মুখোমুখি হতে হয়নি কখনো?

একেবারেই না। এটা সত্য।অনেকেই কাজ করতে গিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তবে আশার কথা হচ্ছে,আমি কিন্তু সেই পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে এনে দিয়েছি।

যখন সরকার গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক।তখন আমি বলবো না কাজ করতে গিয়ে কোন রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি হয়। বরং  বলতে চাই, রাজনৈতিক ভাবে কিছু ডিমান্ড তৈরী হয়  কিংবা হয়ে  থাকতে পারে। তবে আমি চেষ্টা করি  সেটা যাতে যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে।

সেটার জন্য কোথাও যাতে বঞ্চনার তৈরি না হতে পারে। দল-মত নির্বিশেষে সেটা কিন্তু দেখার দায়িত্ব আমার।

পুলিশের পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা উন্নয়নে কোন বিষয়টিতে  অগ্রাধিকার দিচ্ছেন ?

আইন তো বইয়ে লেখা থাকে। কিন্তু সেটা যারা প্রয়োগ করবেন, তাদের যদি মানবিক বা পেশাদারিত্বে দক্ষতা উন্নয়ন না হয়, তাহলে কিন্তু কোন লাভ নেই।

সেজন্য পুলিশ সদস্যদের আগে নিজেদের সচেতন হতে হবে।পাশাপাশি মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি। আর সেই লক্ষ্যেই আমি কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। আমি চেয়েছি, আমার অফিসাররা আগে নিজে সচেতন হোক। জ্ঞান সমৃদ্ধ হোক এবং নিজেদের জানাশোনা পর্যায়টা আরো বিস্তৃতি লাভ করুক। তবেই তারা অন্যকে সচেতন করতে পারবে এবং তৃণমূলে আইন প্রয়োগের বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে পারবে।

ইতিমধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার সার্কেল অফিসারদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে সকল থানার ওসিদেরকে-ও এই প্রশিক্ষণ নিতে হবে। অফিসার ইনচার্জ পর্যায়েই প্রশিক্ষণটা কিন্তু আগে ছিল না। আমি দায়িত্ব নেবার পর সেটার উপর বেশি জোর দিয়েছি এবং প্রথমবারের মতো এখানে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি।

এসব প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু গুলো কি?

প্রশিক্ষণে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে আইন, সততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা আর মানবাধিকারের বিষয়ে।

বাংলাদেশি ক্রিমিনাল জুডিশিয়াল যে  সিস্টেম রয়েছে, সেখানে পুলিশি কিন্তু গেটওয়ে।

আপনারা জানেন, একটি অপরাধ সংঘঠনের পর মামলার তদন্ত থেকে মামলার সাক্ষী হাজির করা। এভাবে বিচারের রায় পর্যন্ত পুলিশের ভূমিকা রয়েছে।

বলতে পারেন,পুলিশের কাজের জন্য যে বিষয়গুলো প্রয়োজন তার সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে প্রশিক্ষণ সূচীতে।

পাশাপাশি অপরাধ সংগঠন থেকে  অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ করে  ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জোর দেয়া ব্যবহারের বিষয়ে। থানায় আসা জনসাধারণের সাথে কি ধরনের ব্যবহার করতে হবে সে বিষয়টিও প্রশিক্ষণ সূচীতে অন্তভূক্ত করা হয়েছে।

আপনার এসব পদক্ষেপের সাথে যারা তাল মেলাতে পারবে না,তাদের কি হবে?

আমার এখানে কাজ করতে হলে,কিভাবে করতে হবে, কিভাবে চলতে হবে- সেটা তাদের আমি আগেই বলে দিয়েছি। আমার বিশ্বাস,আমাকে কোন ব্যবস্থা নিতে হবে না। আমার কাজের সাথে যারা তাল মেলাতে পারবে না তারা একাই চলে যাবে।

ঢাকা রেঞ্জে  কাজের চ্যালেঞ্জ কেমন?

যেহেতু রাজধানী পরিবেষ্টিত পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ। সে  হিসেবে এর গুরুত্ব অনেক।এই রেঞ্জের মধ্যেই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাড়ি। সুতরাং এটি একটি বড় বিষয়।  আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধ,টুঙ্গীপাড়ায় বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধীসৌধসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা  ছাড়াও আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে এই রেঞ্জে। তাই রেঞ্জের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে অনেক কিছুই।

অন্যদিকে রাজধানী পরিবেষ্টিত হওয়ায় ঢাকার অপরাধের ধরণ মাল্টি টাইপ। এ ধরনের  ক্রাইম সংঘটিত হলে সেটার রেশ  কিন্তু গিয়ে পড়ে পাশ্ববর্তী জেলাগুলোতে। এ রেঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ঠিকঠাক রাখার পাশাপাশি  আবার মেট্রোপলিটন পুলিশ কে সাপোর্ট দেওয়াটাও কিন্তু আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

বর্তমানে আপনার রেঞ্জের কাজের গতি কেমন?

একটা সিস্টেমের মধ্য দিয়ে এখানকার কাজগুলো পরিচালিত হয়। আমার লক্ষ্য কাজের  এই  গতিকে আরো বাড়িয়ে দেয়া।  সেটাই আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

পূর্ববর্তী কর্মকর্তা হিসেবে আমি  স্থলাভিষিক্ত হয়েছি, চৌধুরি আব্দুল্লাহ আল মামুন স্যারের। তিনি অনেক ভালো কাজ করে গেছেন। রেঞ্জের কার্যক্রমকে একটি সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসার বিষয়ে অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। যা আমার কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। এই ধারাকে স্থায়িত্ব করার পাশাপাশি আরও কি করে গতিশীল এবং ত্বরান্বিত করা যায়, কি করে পুলিশকে আরো জনমুখী এবং জনবান্ধব  করা যায়-  সে বিষয়েই আমি কাজ করছি।এ ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত সুবিধাটা হচ্ছে, এখানে যারা অফিসার আছেন তাদের বেশিরভাগই আমার অত্যন্ত পরিচিত।আশিভাগ অফিসার ইনচার্জ আমার পূর্ব পরিচিত। এদের সবাই আমার চেনা জানার গণ্ডিতে। এটা না থাকলে নতুন পরস্পরকে চিনতে এবং জানতেই বেশ সময় চলে যায়।সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, কাকে দিয়ে কোন কাজটা ভাল ভাবে করানো যায় এবং কে কোন জায়গায় সে যোগ্য।

এ সম্পর্কিত আরও খবর