শহরটাই যেন ময়লার ভাগাড়!

ঢাকা, জাতীয়

রেজা উদ্ দৌলাহ প্রধান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-09-01 00:05:01

প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস ঢাকা শহরে। সময়ের প্রয়োজনে, জীবিকার তাগিদে, উন্নত জীবনের আশায় মানুষের ঢল এখন গ্রাম থেকে শহরমুখী। এই জনস্রোতে তরুণদের সংখ্যাই বেশি।

কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে গ্রহণ করতে আদৌ কি সক্ষম এ মহানগরী? বায়ু দূষণ, যানজট, বিশুদ্ধ পানির অভাব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত রাজধানীর মানুষ। তবুও জীবন-জীবিকার তাগিদে শহরের নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যুদ্ধ করে টিকে থাকার অদম্য সংগ্রাম চলছে তাদের।

ঢাকা শহরের নোংরা পরিবেশের জন্য বিশেষভাবে দায়ী নগরের অদক্ষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বেশ নাজুক৷ দুটি সিটি করপোরেশন নগরীর বিপুলসংখ্যক বাসিন্দার প্রতিদিনের বর্জ্য অপসারণে যেমন অদক্ষ, তেমনি শহরের বেশির ভাগ বাসিন্দাই আবর্জনা ফেলার ব্যাপারে অসচেতন ও উদাসীন৷ এ কারণে গোটা নগরীকে মনে হয় বিশাল একটি ময়লার ভাগাড়। রাজধানীর মূল সড়কগুলো যেখানে ময়লার স্তূপে পরিণত হয়েছে সেখানে গলি কিংবা ছোট সড়কের অবস্থা আরও ভয়াবহ।

সোমবার (২২ জুলাই) রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের কয়েকটি ওয়ার্ডের বাসিন্দা, ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এবং সরেজমিনে বেশকিছু এলাকা এসব চিত্র দেখা যায়।

বেলা সাড়ে ১১টায় পশ্চিম শেওরাপাড়া এলাকার বেগম রোকেয়া সরণিতে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার উপরে খোলা জায়গায় ফেলা ময়লার স্তূপ থেকে আবর্জনা ট্রাকে তুলছেন সিটি করপোরেশনের কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। দুর্গন্ধে সেখানে নিঃশ্বাস নেওয়াই দায়। এখান থেকে ময়লা তুলে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে নিয়ে ফেলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ময়লার কন্টেইনার নেই দেখে রাস্তার উপরেই ময়লা ফেলেন এলাকার বাসিন্দারা। তারা জানান, প্রতিদিনের গৃহস্থালি ময়লা-আবর্জনা একটি ঝুড়িতে জমিয়ে ভোর বেলায় নিজ নিজ ফ্ল্যাটের সদর দরজার সামনে রেখে দেন। সেখান থেকে সেগুলো সংগ্রহ করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তাকে মাসিক ভিত্তিতে বেতন দেওয়া হয়। বেতনভোগী ওই ব্যক্তি তার নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের প্রতিদিনের গৃহস্থালি আবর্জনা ভ্যানে করে নিয়ে এসে ফেলেন সড়কের উপরে কিংবা পাশে থাকা কন্টেইনারে অথবা খোলা জায়গায়। সেখান থেকেই কয়েকদিন পর পর সিটি করপোরেশনের গাড়িতে করে সেগুলো ডাম্পিং গ্রাউন্ডে নেওয়া হয়।

এলাকাবাসী জানান, নিয়মিত সিটি করপোরেশনের লোক না আসায়, ভাঙাচোরা কন্টেইনার থাকায় সেগুলো থেকে প্রায় ময়লা-আবর্জনা উপচে পড়ে রাস্তায় ছড়িয়ে থাকে। মানুষের পায়ে পায়ে, গাড়ির চাকায় ঘুরে ময়লাগুলো গোটা রাস্তাতেই ছড়িয়ে যায়। খোলা জায়গায় ময়লা ফেলার কারণে দুর্গন্ধে কষ্ট করে চলতে হয় পথাচারীদের৷ কোথাও কোথাও কটু গন্ধে নাক-মুখ চেপে ধরে চলাচল করতে হয়। শিশু ও বৃদ্ধদের কষ্ট অবর্ণনীয়।

মিরপুর সড়কে ধানমন্ডির শেখ জামাল ক্লাবের মাঠের পাশেই রয়েছে ময়লার বিশাল একটি ভাগাড়। এখানকার বাতাসের কটু গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।

বাসযাত্রী হিমেল সরকার বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, এই রাস্তা দিয়ে নিয়মিত ভার্সিটিতে যাওয়া-আসা করি। সবসময় দোয়া করি যেন এ জায়গায় গাড়ি জ্যামে না পড়ে। বিশেষ করে তীব্র গরমে যখন হাঁসফাঁস অবস্থা তখন এখানকার কটু বাতাস নাকে গেলে প্রায়ই বমি চলে আসতে চায়।

এ তো গেল গৃহস্থালি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র। কিন্তু এর বাইরেও অনেক আবর্জনা আছে যার জন্য নগরবাসীরাও কম দায়ী নন। নগরীকে পরিচ্ছন্ন রাখতে কয়েক বছর আগে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রাস্তার পাশে ফুটপাতের উপরে স্থাপন করেছিল কয়েক হাজার ঝুলন্ত ডাস্টবিন৷ সেগুলো ব্যবহার তো দূরে থাক অল্প দিনের মধ্যেই এ সব ডাস্টবিনের বড় একটি অংশ চুরি হয়ে যায়, পড়ে থাকে শুধু তার স্ট্যান্ডগুলো৷ নগরবাসীর অবহেলা আর সিটি করপোরেশনের যথাযথ তত্ত্বাবধানের অভাবে চুরি যাওয়া ডাস্টবিনের সেসব স্ট্যান্ড এখন পথচারীদের চলাফেরায় ব্যাঘাত ঘটায়।

সরেজমিনে দেখা যায়, সিটি করপোরেশনের বসানো সড়কের পাশের যেসব ডাস্টবিন এখনও টিকে আছে সেসব ডাস্টবিন খালি থাকা সত্ত্বেও ময়লা ফেলা হয়েছে বাইরে।

জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এম এ হামিদ খান বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ঝুলন্ত এসব ডাস্টবিন ছিল পথচারীদের ব্যবহারের জন্য। কিন্তু তাদের ৯০ শতাংশ চোখে দেখেও সেগুলো ব্যবহার করেননি। হাতে যাই থাকে সেটা যেন সড়কে ছুড়ে ফেলাতে তাদের আনন্দ!

নগরীর পরিচ্ছনতার বিষয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ঢাকা মহানগরীকে পরিচ্ছন্ন ও জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা প্রতিনিয়ত তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা কি যত্রতত্র পলিথিন ও ময়লা আবর্জনা ফেলা বন্ধ করেছি?

মেয়রের কথার স্বাক্ষী যেন গোটা রাজধানীর রাস্তাগুলি। সোমবার দুপুরে শিশু হাসপাতালের সামনের ফুটপাত ঘেঁষা রাস্তায় বেশ কয়েক মিটার দীর্ঘ আবর্জনার স্তূপ দেখা গেল। ড্রেনের চিহ্ন বলে কিছু নেই সেখানে।

নীলক্ষেত থেকে হাতিরপুল সড়ক দিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশের ড্রেনগুলো পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক, ভাঙা ইট পাথর, বালি দিয়ে ভরাট হয়ে গেছে। পানি প্রবাহের কোন জায়গা নেই।

শাহবাগ মোড়, মগবাজার মোড়, সাতরাস্তার মোড়সহ নগরীর প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সড়কেই একই চিত্র। পানি প্রবাহের ব্যবস্থা না থাকায় একটু বৃষ্টি হলেই পানিতে ডুবে যায় অধিকাংশ সড়ক। কোথাও কোথাও বাসাবাড়িতে উঠে যায় দূষিত পানি।

তাই রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য নাগরিক সচেতনতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন মেয়র আতিক। তিনি বলেন, নগরবাসী সচেতন হলে রাজধানীর পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

অন্যদিকে নগরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতের জন্য আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাঠামো নিশ্চতকরণ, বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদান, দীর্ঘ মেয়াদে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানোসহ একাধিক পরামর্শ রয়েছে নগরবাসীর।

এ সম্পর্কিত আরও খবর