'যে বান আইচ্ছে, অ্যালা নৌকাই হামার ভরসা'

রংপুর, জাতীয়

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, রংপুর | 2023-08-30 15:52:01

কুড়িগ্রাম থেকে ফিরে: 'যে বান আইচ্ছে বাহে। অ্যালা নৌকাই হামার ভরসা। নৌকায় বসি কোনো মতে আলগা চুলায় একবেলা রান্না করি। নৌকাতেই ঘুমাই। বানোতে কষ্টের শ্যাষ নাই।'

এভাবেই বন্যার পানিতে নিদারুণ কষ্টে থাকার কথা বর্ণনা করছিলেন কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনাঘাট এলাকার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম। ব্রহ্মপুত্র নদীর কোল ঘেষে শহিদুলের মতো কুড়িগ্রাম জেলার কয়েক লাখ মানুষ এখন গৃহহীন হয়ে যাযাবর দিন কাটাচ্ছে।

উলিপুর উপজেলার শেষ ও চিলমারী উপজেলার শুরুর পথে চোখে পড়ে উঁচু ব্রিজ। এই ব্রিজের উপর ছাউনি করে অর্ধশতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। ভাসমান এসব মানুষের থাকা-খাওয়াসহ রান্না করতে বিড়ম্বনার যেন শেষ নেই।

বান্ধারঘাটের এই উঁচু ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দুর্ভোগের কথা বলছিলেন মেরাজ উদ্দিন ব্যাপারী। তিনি বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, 'বাড়ির ভিতরা কোমর পানি। চকি ডুবি গেইছে। মালামাল সউগ ভিজি গেইছে। বউ বাচ্চা নিয়া ব্রিজে তিনদিন ধরি রাইত কাটোচে। এভাবে থাকা খুবই কষ্টের। রাইত হইলে কাইয়ো নৌকার উপর বসি থাকি।'

অষ্টমীরচর থেকে নৌকায় করে ভাসতে ভাসতে গবাদি পশুপাখি নিয়ে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার চর ঘনশ্যামপুরে এসেছেন রহিম বকস। সঙ্গে স্ত্রী, সন্তান ও প্রতিবেশী একজনের পরিবারও রয়েছে।

বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে দেখে ভেবেছিলেন ত্রাণের নৌকা। কিন্তু কাছে এসে হতাশ হলেন রহিম বকস। অনেকটা আক্ষেপ থেকে বললেন, 'তোমাক দুঃখের কতা কয়া কী হইবে। হামার পেটোত ভোগ। তোমরা দুই কেজি চাইলতো দিবার নন। খালি ফটোক তুলি পেপারোত দিলে হইবে?'

ওই নৌকায় থাকা কুদরত আলী নামে এক বৃদ্ধ তার দুরবস্থার কথা বর্ণনা করছিলেন। তিনি বলেন, 'এরশাদ সাইবের সময় (১৯৮৮ সালে) বানের পানি দেকচুং। আর অ্যালা দেকোচোং। এবার ডবলের ডবল পানি হইচে বাহে। কোনটে যামো? শুকান জাগা দেখানতো দেখি। চাইরোপাকে খালি পানি আর পানি। বাধ্য হয়া নৌকাত ভাসোছি।’

কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর সড়কে যাবার সময় নৌকায় কথা হয় স্কুলছাত্র রাসেল মিয়ার সঙ্গে। অর্ধাহারে-অনাহারে থাকা রাসেল বলেন, ‘আমাদের বাড়ির পাশের সবকটি বাড়ি ডুবে আছে। বেশির ভাগ বাড়িতে লোকজন নেই। টিনের চালটুকু জেগে আছে। আর সব পানির নিচে। ঘরের ধান-চালসহ প্রয়োজনীয় আসবাব সব ভিজে গেছে। অনেকেই যাত্রাপুরের দিকে চলে গেছে। আমরাও যাত্রাপুরের শুকনো স্থানের খোঁজে যাচ্ছি। এখনতো চলাচলের জন্য নৌকার বিকল্প নেই।’

এদিকে যাত্রাপুর সিডির মোড় থেকে এক কিলোমিটার উত্তরে মাদরাসা পর্যন্ত জায়গাটুকু শুকনো আছে। বাকি সব ডুবে আছে। শুকনো ওই জায়গাতে গরু-বাছুর নিয়ে হাজারো মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তবে কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর সড়কটির কোমর পানি এখন হাঁটুতে নেমেছে।

যাত্রাপুরের ইউপি সদস্য রহিমুদ্দিন রিপন জানান, এখন তো সবারই নৌকার প্রয়োজন। নৌকা ছাড়া চলাচল করা সম্ভব না। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে নৌকা সংকটের কারণে অনেককে উদ্ধার করা যাচ্ছে না। শুকনা জায়গার অভাবে রান্নাও করা যাচ্ছে না। তবে তারা ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছেন।

যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী জানান, এই ইউনিয়নে ছয় হাজার ২০০ পরিবার পানিবন্দী থাকলেও সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫০০ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাকিদের কেউ কেউ শুকনো খাবার পেয়েছে। নৌযান সংকটের কারণে যাত্রাপুরের অন্যান্য এলাকার বন্যার্তরাও চাহিদা অনুযায়ী সহযোগিতা পাচ্ছে না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর