গোলেনুরের উৎসাহে বদলে যাচ্ছে বদলপুরের নারীরা

রাজশাহী, জাতীয়

হাসান আদিব, স্টাফ করেসপন্ডেট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী | 2023-09-01 05:19:14

২০০৯ সালে তানোর উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়নের বদলপুর গ্রামে গৃহবধূ হয়ে আসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেয়ে গোলেনুর বেগম। কৃষক স্বামীর নিজস্ব জমি নেই, পরের ক্ষেতে কৃষিকাজ করে যে আয়; তা দিয়ে সংসার চালানো দায়! বিয়ের এক বছর পর বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ আব্দুল মান্নান নামে এক ব্যক্তির সন্ধান পান গোলেনুর। যিনি নকশি কাঁথার কাজের জন্য নারীদের খুঁজছিলেন। স্বামীর অভাবের সংসারে নিজেও অবদান রাখার প্রত্যয়ে কাজ নেন গোলেনুর। কাঁথা প্রতি মজুরি ঠিক হয় সাড়ে ৪০০ টাকা।

শুরুতে দুই/তিনটি কাঁথা নিয়ে এসে কাজ শুরু করেন তিনি। দুই মাসে তিনটি কাঁথা সেলাই ও ‘ফুল তোলা’র কাজ করে ১৩৫০ টাকা আয় হয় তার। বিষয়টি প্রতিবেশি নারীরা জানার পর তারাও কাজে আগ্রহ প্রকাশ করেন। চাঁপানবাবগঞ্জের আব্দুল মান্নানের কাছ থেকে দ্বিতীয় দফায় নিজের জন্য ৫টি এবং প্রতিবেশি দুই নারীর জন্য ২টি করে ৪টি কাঁথা নিয়ে আসেন গোলেনুর। সংসার সামলে অবসরে নতুনদের শিখিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিজেও সেলাইয়ের কাজ করেন বাড়ির আঙিনায় বসে। শুরু হয় তানোরের প্রত্যন্ত বদলপুর গ্রামের নারীদের ভাগ্য বদলের গল্প।

গোলেনুরের উৎসাহে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে নকশি কাঁথা সেলাইয়ের কারিগর। কৃষি অধ্যুষিত তানোরের বদলপুর ও আশেপাশের গ্রামের অসংখ্য নারী গোলেনুরের কাছ থেকে নকশি কাঁথা নিয়ে সেলাইয়ের কাজে যুক্ত হয়। বর্তমানে দেড় শতাধিক নারী নকশি কাঁথার কাজ করছেন। ২০ থেকে ২৫ দিনে একটি কাঁথা সেলাই করে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় করতে পারেন গ্রামের নারীরা। এতে গৃহবধূ ও্ই নারীরা যেমন খুশি, তেমনি খুশি স্বামীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও।

বৃহস্পতিবার (০৪ জুলাই) বদলপুরে গোলেনুর বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠান, পেছনের পুকুরপাড়সহ চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিশোরী, তরুণী, মধ্যবয়সী নারী এমনকি বয়োবৃদ্ধারাও নকশি কাঁথা সেলাই কাজ করছেন। গভীর মনোযোগ শৈল্পিক হাতে নিপুণভাবে সুঁই-সুতায় কাঁথায় গ্রাম-বাংলার নানা দৃশ্য তুলে ধরছেন তারা। এক-একটা কাঁথা তিন থেকে চার জন করে গ্রুপ করে গোল হয়ে বসে সেলাই করছেন। সেলাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে চলছে স্বামী-সন্তানের নিয়ে গল্প। কখনও সুখের আবার তা কখনও দুঃখের। গোলেনুরের বাড়িতে কাজ করা নকশি কাঁথার কারিগরদের দেখলেই যে কারও মনে পড়বে পল্লীকবি জসিমউদ্দিনের ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ এর কথা।

সেখানে গিয়ে দেখা গেল গোলেনুর বেগম ঘরের সামনে খুপড়ি রান্নাঘরে ভাত-তরকারি রাঁধতে ব্যস্ত। উঠান থেকে এক কিশোরী তাকে ভাবি সম্বোধনে ডেকে জানতে চাইছে, সেলাইয়ের কাজের একটি অংশের খুঁটিনাটি। রান্নায় মনোযোগী গোলেনুর মুখস্ত বিদ্যার মতো কিছু কথা আওড়ালো। তাতেই কাজ বুঝে নিল ওই কিশোরী!

রান্নাঘরে বসেই গোলেনুর বেগম জানালেন, তিনি অভাবে পড়ে এই কাজ শুরু করেন। তবে এখন এটার জন্য এই এলাকার মানুষ তাকে খুব সম্মান এবং শ্রদ্ধা করেন। এতে গ্রামের অসহায় নারীদের জন্য আরও কিছু করার জন্য প্রত্যয়ী হয়ে উঠছেন গোলেনুর।

তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। বাড়ির কর্তা সারাদিন মাঠে খাটে। আমরা বাড়িতে রান্না-বান্না করি। তারপর বসেই থাকি। এই কাজ করলে ক্ষতি কী? আমি শুরু করার পর অনেকে আগ্রহী হয়ে কাজ চেয়েছিল। কাঁথা এনে দিয়েছি, শিখিয়েও দিয়েছি। এখন শুধু বদলপুর না, তানোরের আরও অনেক গ্রামের মহিলারা কাঁথা নিয়ে এসে কাজ করছে।’

গোলেনুর আরও বলেন, ‘কাঁথা এনে দিয়ে আমি একটা কাঁথায় গড়ে ১০০ টাকা করে কমিশন পাই। অথচ তারা (মহাজন) একখান কাঁথা ৫/৭ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকায়ও বিক্রি করে। বিভিন্ন জেলায় চলে যায় এসব কাঁথা। ভালোগুলো দেশের বাইরেও যায়। সেগুলোর দাম ৫০ হাজারেরও বেশি হয়। খেটে মরি আমরা, লাভ খাই মহাজন। শোনা যায়, সরকারের লোকজন নাকি গরীব মহিলাদের সাহায্য দেয় কিংবা লোন দেয়। আমরা চেষ্টা করেও কোনো কিছু পাই না। কিছু পুঁজি হলে নিজেই কাঁথা বানিয়ে সেলাই করে বিক্রি করতাম। তাহলে ভালোভাবে সংসার চলতো।’

বাড়ির দক্ষিণ কোণের উঠানে কয়েকজন কিশোরীকে কাজ করতে দেখা যায়। জানা গেল তারা সবাই সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। সকালে ক্লাস করেন বিকেলে কাজ করে। ছুটির দিনে সারাদিনই কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করে। যে টাকা পায়, তা দিয়ে লেখাপড়ার খরচ হয়েও বাবাকে সহযোগিতা করে করতে পারে।

তাদেরই একজন তাসলিমা খাতুন। এই কিশোরী বলেন, ‘ভাবির (গোলেনুর) কাজ করা দেখে শিখেছি। সহজ কাজ। মাঠে আব্বারা যেমন খাটে, তার চেয়ে তো সহজ। একটু কাজ করলে টাকা পাওয়া যায়। পড়ার খরচটা হয়ে যায়। যা বাঁচে আব্বার হাতে দিয়ে দেই।’

গৃহবধূ লিপি বলেন, ‘আমার দুই ছেলে আর এক মেয়ে। ওদের বাপ বাইরে বাইরে কাজ করে বেড়ায়। এখন নাটোরে আছে। যখন বাড়ি থাকে না, তখন ছেলে-মেয়েদের যে কিছু কিনে খাওয়াবো সেই টাকাও থাকত না। এখন ছেলেমেয়েদের এটা-ওটা খাওয়ার কিছু টাকা তো দিতে পারি।’

গৃহবধূ লিপির মতোই সংসারের খুঁটিনাটি জিনিস কেনা এবং স্বামীকে সহযোগিতার কথা জানালেন সাজিনুর বেগম, লায়লা পারভিন, সুমি আক্তারসহ নকশি কাঁথার অন্যান্য কারিগররাও।

এদিকে, মোবাইলে নকশি কাঁথার মহাজন চাঁপাইয়ের আব্দুল মান্নানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা নকশি কাঁথায় চাহিদানুযায়ী বিভিন্ন ছাপ দিয়ে তার ওপর দিয়ে নানা রঙের সুতোর কাজ করিয়ে থাকি। গ্রামের নারীরা অবসরে এটা সহজেই করতে পারে। তারা চুক্তি করে কাঁথা নিয়ে যায়। তানোরে এখন আমার প্রায় এক হাজার ৪০০ কাঁথা বিভিন্ন গ্রামের মহিলাদের কাছে দেয়া আছে। কাজ শেষে তারা টাকা নেবে আর কাঁথা দিয়ে যাবে।’

আব্দুল মান্নান আরও বলেন, ‘আমরা এই কাঁথা দেশে এবং বিদেশে বিক্রি করে থাকি। আমাদের এজেন্ট আছেন, তারা পাইকারি এবং খুচরা দরে কাজ অর্ডার করেন। সেই অনুযায়ী সরবরাহ করি। ৫ হাজার থেকে ৫০/৫৫ হাজার টাকা পর্যন্ত একটি কাঁথা বিক্রি করেছি আমি। তবে এখন দাম বেশি পেলেও চাহিদা কিছুটা কম।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর