আজও অরক্ষিত রংপুরের বধ্যভূমিগুলো

রংপুর, জাতীয়

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, রংপুর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 16:02:15

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদাররা আলবদর-রাজাকারদের মাধ্যমে রংপুরের স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ অসংখ্য মানুষকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন ও হত্যা করে। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময় স্মৃতিবিজড়িত সেসব স্থানের মধ্যে কিছু জায়গা চিহ্নিত করে সেগুলোতে বধ্যভূমি হিসাবে গড়ে তোলা হয়। তবে খুব একটা সুরক্ষিত নয় এসব স্থান। এমনকি এখনও চিহ্নিতই হয়নি অনেক জায়গা, যেখানে রয়ে গেছে একাত্তরের শহীদদের স্মৃতি।

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও সেসব বধ্যভূমি সংরক্ষণের আওতায় আসেনি। এখনো অরক্ষিত রয়ে গেছে জেলার অধিকাংশ বধ্যভূমি। অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকা বধ্যভূমির কোথাও কোথাও অবাধে বিচরণ করছে গবাদি পশু। রাতের আঁধারে বসছে অসামাজিক কার্যকলাপ, মদ-জুয়ার আসর। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ সচেতন সমাজ হৃদয় ব্যথিত হলেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে জানা যায়, জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের ঝড়ূয়ার বিল। সেখানে ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল এক সঙ্গে প্রায় এক হাজার ৫০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে হত্যা করে। আজও সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা ভোলেননি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। ঝাড়ুয়ার বিল বধ্যভূমিটি এখনো রয়েছে অরক্ষিত।

এছাড়া রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের হাজীরহাটে জাফরগঞ্জ সেতুতে ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল রংপুর শহরের ব্যবসায়ী অশ্বিনী ঘোষসহ ১৯ জনকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে হত্যা করে। সেখানে আজও স্মৃতিফলকই নির্মিত হয়নি।

অন্যদিকে রংপুর-বগুড়া মহাসড়কে তামপাট দমদমা সেতুর কাছে কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়, তার স্ত্রী মঞ্জু রানী রায়, চিত্তরঞ্জন রায়, রামকৃষ্ণ অধিকারী ও সুনীল চক্রবর্তীসহ অনেক মুক্তিকামী মানুষকে ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। ২০০২ সালের ১৪ ডিসেম্বর সেখানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। এরপর সেই স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিটির দেখভালের দায়িত্ব নেয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি)। কিন্তু সাইনবোর্ড ঝুলিয়িই দায়িত্ব শেষ করেছে কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে সেটি একেবারেই অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, স্মৃতিফলকটির চারপাশে গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখা হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে দখলের নমুনায় টিন দিয়ে ঘিরে নিয়েছে বধ্যভূমির চারপাশ। এখানে সব সময়ই গরু-ছাগল অবাধে প্রবেশ করে। রাতে সেখানে অসামাজিক কার্যকলাপ চলে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

রংপুর টাউন হল এলাকা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর টর্চার সেল। ওই স্থানে রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করতো। সেখানে বধ্যভূমি চিন্থিত করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে সেখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও নাট্যসংগঠনের কার্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Mar/27/1553652309526.jpg

এছাড়া রংপুর সদরের রাজেন্দ্রপুরের বালারখাল, লাহিড়ীরহাট, কাউনিয়ার বলভবিসু, গঙ্গাচড়ার শংকরদহসহ বেশ কয়েকটি বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলকও নির্মাণ করা হয়নি। আবার কোথাও কোথাও স্মৃতিফলক থাকলেও তা রয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে। কিছু অনেক বধ্যভূমি আজ দখলের মুখে।

`প্রজন্ম ’৭১' রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি দেবদাস ঘোষ দেবু বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমার বাবাসহ অনেককে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে জাফরগঞ্জ সেতুতে হত্যা করে। সে স্থানটিতে তৈরি করা হয়নি নামফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ।’

রংপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু আক্ষেপ করে বলেন, ‘অনেক বধ্যভূমি আজও সংরক্ষিত হয়নি। এসব বধ্যভূমি চিহ্নিত করে দ্রুত স্মৃতিফলক নির্মাণ করা দরকার। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে বধ্যভূমির সংরক্ষণ জরুরি।’

স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক দাবানল -এর সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল বলেন, ‘যেসব শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। দেশ ও লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছি। সেই বীর সন্তানদের আত্মত্যাগের রক্তে ভেজা অনেক স্থান এখনও সংরক্ষণ করা হয়নি। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। যেসব বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক তৈরি করা হয়েছে তা সংরক্ষণ এবং যেগুলোতে এখনও স্মৃতিফলক তৈরি হয়নি সেখানে তা তৈরির দাবি জানাই।

এ সম্পর্কিত আরও খবর