ইউক্যালিপটাসে ভরপুর উত্তরাঞ্চল, হুমকিতে পরিবেশ

রংপুর, জাতীয়

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, রংপুর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 09:44:41

নুর হোসেন। গায়ে গতরে খেটে খাওয়া একজন দিনমজুর। সংসারে আপনজন বলতে স্ত্রী আর সন্তান। সম্পদের পরিসীমাও খুব বেশি নয়। বসত-ভিটা আর এর সামনে বেড়ে ওঠা তার স্বপ্নময় বেশ কিছু ইউক্যালিপটাস গাছ।

অনেক দিন ধরে চেষ্টা করেছেন জরাজীর্ণ বসত ভিটেতে নতুন ঘর তুলবেন। কিন্তু অর্থাভাবে সেই কাজ করতে পারেননি। অবেশেষে কয়েক বছর আগে লাগানো ইউক্যালিপটাস গাছ বিক্রি করে এবার নতুন ঘর তুলেছেন। ইউক্যালিপটাস গাছকে ঘিরে স্বপ্নে বিভোর নুর হোসেনের পরিবার।

নতুন ঘর তৈরির কাজ করা শেষে গাছ শূন্যস্থানে আবারো লাগাবে সেই ইউক্যালিপটাস গাছই। কিন্তু নুর হোসেন নিজেও জানেনা তার অজান্তে পরিবেশের কি না ক্ষতি করে যাচ্ছে স্বপ্নময় ইউক্যালিপটাস।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- বেশির ভাগ মানুষই এই ইউক্যালিপটাস এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত নয়। ষাট বছর বয়সী কৃষক আবুল হোসেন সেই কথাটাই জানান। বৃদ্ধ এই কৃষক জানান, ‘তার প্রতিবেশির দেখা দেখি সেও জমির আইলে ৫০-৬০টি ইউক্যালিপটাস লাগিয়েছেন। সাময়িক লাভের আশায় ইউক্যালিপটাস লাগিয়ে এখন তিনি ক্ষতিগ্রস্থ। আগের মতো তার জমিতে ভালো চাষাবাদ হচ্ছে না। দিন দিন পানিশূন্যতায় শুষ্ক হয়ে পড়েছে তার জমি।’

নুর হোসেন আর আবুল হোসেনের মত অগণিত মানুষ ইউক্যালিপটাস গাছকে ঘিরে স্বল্প সময়ে বেশি লাভের স্বপ্ন দেখছেন। একারণে গত দুই দশকে অস্বাভাবিক হারে এই গাছে ছেয়ে গেছে পুরো উত্তরাঞ্চল। রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসভূমি ও কৃষি জমি সবখানেই এর ছড়াছড়ি। যেন দিগন্ত জুড়ে ইউক্যালিপটাসের সমারোহ।

কৃষকরা বলছেন, জমির আইলে ইউক্যালিপটাস রোপণ করার পর থেকে ক্ষেতে আর পানি থাকে না। দিন দিন ফসলের উৎপাদন কমে যায়। কম সময়ে এই গাছ অনেক বড় হয়। ইউক্যালিপটাস গাছ আশপাশে প্রয় ৫০ ফুট এলাকার পানি শোষণ করে ও আকাশে তুলে দেয়। জমির আইল, কৃষি জমি ও পতিত জমিতে লাগানো এই গাছ উপকারের পরিবর্তে অপকারই বেশি করে।

পরিবেশ উপযোগী না হওয়ায় ২০০৮ সালে সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে দেশে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু কৃষকরা না জেনে ইউক্যালিপটাসের চারা রোপন করছেন। এভাবেই গড়ে উঠেছে শত শত ইউক্যালিপটাসের বাগান। এতে হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ।

নিষিদ্ধ গাছটির চারা উৎপাদনের সরকারি নিয়ম-নীতির কথা জানেন না স্থানীয় নার্সারি মালিকরা। অন্যান্য বনজ বা ফলদ চারার চেয়ে এই চারা উৎপাদনে ২ থেকে ৩ গুণ বেশি লাভ হয়। এই লোভে তারা বেশি করে চারা উৎপাদন করছেন। ফলে স্কুল-কলেজ-মাদরাসার, বসত-বাড়ি, অফিস-আদালত, রাস্তা-ঘাটে, খেলার মাঠে, হাট-বাজারসহ ফসলের মাঠজুড়ে অন্যান্য ফসলের সঙ্গে ব্যাপকভাবে শোভা পাচ্ছে ইউক্যালিপটাস গাছ। সবকিছু মিলিয়ে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন বৃক্ষ ও পরিবেশ বিশারদরা।

উত্তর জনপদে ইউকলেক্টর নামে পরিচিতি ইউক্যালিপটাস গাছের চারার অবাধ উৎপাদন, বিপণন ও রোপন বৃদ্ধির ফলে উত্তরাঞ্চল মরুভূমির দিকে যাচ্ছে। দিন দিন এ অঞ্চলে পানির স্তর কমে আসছে। এক সময়ের বেলে দোঁআশ আর কাঁদা মাটিভরা উত্তরাঞ্চল এখন পানি শুষ্কতায় ভুগছে। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষি জমি ও চাষাবাদ। পরিবেশ ভারসাম্যহীন ইউক্যালিপটাস গাছের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বাড়ছে।

সাধারণ গাছ প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারাসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রাণীকূলের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে আর অক্সিজেন সরবরাহ করে সহায়তা করে। কিন্তু ইউক্যালিপটাস তা করে না। বরং এই গাছ অক্সিজেন গ্রহণ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ এবং নাইট্রোজেন নির্গমন করে। ইউক্যালিপটাসের পাতা ও ডালপালা অজৈব পদার্থের মত কাজ করে কৃষি জমিকে অনুর্বর করে। ফলে ফসলের উৎপাদন কমে যায়।

কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক পরিবেশবিদ এম এ রউফ খাঁন বলেন, ‘আমাদের দেশে বর্তমানে বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয় না। গ্রামের বেশিরভাগ বড় বড় নদ-নদী বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে হয়েছে। এতে দেশের কৃষি জমি শুকনো হয়ে যাচ্ছে। এই রকম শুকনো জমিতে ইউক্যালিপটাস গাছটি রোপন করার মানে নেই। কারণ ইউক্যালিপটাস গাছ প্রচুর পানি শোষণ করে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের জলবায়ুর জন্য ইউক্যালিপটাস গাছ মোটেই উপযোগী নয়। উপরন্তু কৃষি জমি এবং আশপাশের মাটি থেকে অতিমাত্রায় পানি শোষন করে মারাত্মকভাবে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে এই রাক্ষুসে গাছ।’

এ বিষয়ে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘কৃষি জমির জন্য ইউক্যালিপটাস মারাত্বক হুমকি। পানি খেকো এই গাছ প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ লিটার পানি শোষণ করে মাটিকে নিরস ও শুষ্ক করে ফেলে। ইউক্যালিপটাস গাছ ৫ বছরে ৯২ মিটার লম্বা হতে পারে। মাটির নিচের গোড়ায় ২০-৩০ ফুট জায়গা নিয়ে চারদিকে থেকে ইউক্যালিপটাস পানি শোষণ করে। ফলে অন্যান্য ফলজ গাছের ফলন ভালো হয় না। পুকুরের পানি দূষণ করে। এ গাছে কোনো পাখি বাসা বাঁধে না। পাতা সহজে পচে মাটিতে মিশে না। ইউক্যালিপটাস গাছের ফলের রেণু নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করলে অ্যাজমা হয়। এমনকি যে বসত-বাড়িতে অধিক পরিমাণে ইউক্যালিপটাস গাছ আছে সেসব বাড়ির শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাসকষ্ট হতে পারে। আমরা কৃষকদের এই গাছের চারা উৎপাদন, রোপন ও সরবরাহে নিরুৎসাহিত করছি।’ 

এ সম্পর্কিত আরও খবর