বিনা পয়সায় বই বিলাবেন পলান সরকারের উত্তরসূরিরাও

রাজশাহী, জাতীয়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেট, রাজশাহী, বার্তা২৪.কম | 2023-08-27 06:09:03

‘বাবা চলে গেছেন! কিন্তু রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি। মনে পড়ছে, খেয়ে না খেয়ে যখন তখন বাবার বই নিয়ে বেড়িয়ে পড়ার দৃশ্য! চা খাওয়ার জন্য টাকা নিয়ে সেই টাকায় কলম কিনে গ্রামের স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের তা উপহার দেওয়ার দৃশ্য চোখে ভাসছে।’

বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন সদ্যপ্রয়াত পলান সরকারের ছেলে হায়দার আলী। ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ খ্যাত একুশে পদকপ্রাপ্ত পিতার বই নিয়ে যে মহাযযজ্ঞ ছিল তা ধরে রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। বলেন, ‘এখানকার ২০ গ্রামে বাবা বই পড়ার অভিনব যে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, আমরা নয় ভাইবোন তা ধরে রাখব।’

রাজশাহীর বাঘার বাউসা গ্রামে সোমবার (৫ মার্চ) বিকালে পলান সরকারের বাড়িতে কথা হয় ছেলে হায়দার আলীর সঙ্গে। তিনি বর্তমানে স্থানীয় খাগড়বাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং পলান সরকার পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পলন করছেন।

কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করতেই হায়দার মনের অজান্তেই বাবার স্মৃতিচারণ করতে শুরু করেন। বলেন, ‘নিজের পাঠাগার, অসংখ্য বই আর বইপ্রেমীদের ছেড়ে বাবা এখন না ফেরার দেশে। তাই বলে কি জ্ঞান বিলানোর তার সেই পথচলা থেমে থাকবে? সেটা হতে দিব না।’

বাবার মতোই বইপাগল হায়দার আলী বলেন, ‘দূরের পাঠকদের যাতে পড়তে সমস্যা না হয়, সেজন্য ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বই দিয়েছি। মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ানো বাবার মহতী উদ্যোগ ধরে রাখতে এলাকার আরও ৩০ থেকে ৪০টি বাজারে একটি করে দোকানে পলান সরকার স্মৃতি পয়েন্ট গড়ে তুলব।’

তিনি বলেন, ‘বার্ধক্যের কারণে চলতে না পারায় শেষ দিকে বাবার পাঠাগার দেখাশোনার দায়িত্ব আমার ওপরই পড়ে। সেখানে বাবা অসংখ্য বই রেখে গেছেন। তবে নিত্য-নতুন বইয়ের সমারোহে এ পাঠাগারকে আরও বেশি আধুনিকায়ন করতে চাই।’

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Mar/05/1551775989459.jpg

ভাইবোনদের পক্ষে তিনি বলেন, ‘বাবা ছিলেন একজন সাদামনের মানুষ। তিনি কখনো অন্যের দয়াদাক্ষিণ্য পছন্দ করতেন না। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্ঞানের আলো ছড়াতে তিনি জেলার ২০টি গ্রামে গড়ে তুলেছেন অভিনব শিক্ষা আন্দোলন। সেই আন্দোলন চলমান রাখতে ও বাবার নীতি-আদর্শকে ধরে রাখতে আমরা নয় ভাইবোন সবাই আন্তরিক।’

‘আমাদের বাবা ছিলেন একজন বইপাগল মানুষ। জন্মের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তিনি পিতৃহারা হন। আর্থিক অনটনের কারণে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই লেখাপড়ায় ইতি টানতে হয় তাকে। কিন্তু নিজের পড়ালেখা বেশি দূর চালিয়ে নিতে না পারলেও মানুষকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে তিনি নিজের জীবন-যৌবন ত্যাগ করেছিলেন।’

হায়দার বলেন, ‘মানুষকে ভালোবেসে সংসার, পরিবার-পরিজন থেকেও ছিলেন কিছুটা দূরে। নিজের টাকায় বই কিনে বিনামূল্যে পড়তে দিতেন পিছিয়ে পড়া গ্রামের মানুষকে। ওনার লক্ষ্য ছিল- গ্রামের প্রত্যেকটি মানুষ যেন বইয়ের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। কাজেই নিজের জীবন দিয়ে হলেও বাবার এ মহতী লক্ষ্য আমরা ধরে রাখব।’

এদিকে, আলোকিত এই মানুষটির স্মৃতি ধরে রাখতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত হারুনুর রশিদ শাহ উচ্চ বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক এসএম আবদুল কাদের। গত রোববার (৪ মার্চ) স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য প্রদানকালে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বাবা মো. শামসুদ্দীন বাউসায় ‘পলান স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া পলান সরকারের অভিনব এ বই পড়ানোর আন্দোলন ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছেন বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহিন রেজা।

গ্রামে গ্রামে এভাবেই ঘুরে ঘুরে বিনা পয়সায় বই বিলাতেন পলান সরকার (ফাইল ছবি)

 

উল্লেখ্য, ১৯২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নাটোরের বাগাতিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন পলান সরকার। তার আসল নাম হারেজউদ্দিন সরকার। সামাজিকভাবে জ্ঞানবৃদ্ধিতে অবদান রাখায় ২০১১ সালে তিনি পান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘একুশে পদক’।

গত ১ মার্চ বার্ধক্যজনিত কারণে সাদামনের এ মানুষটি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। পরদিন নিজের প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারের অদূরে স্ত্রীর কবরের পাশে বইপ্রেমী মানুষটি চিরনিদ্রায় শায়িত হন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর।

আরও পড়ুন: চলে গেলেন ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ পলান সরকার

স্ত্রীর পাশে চিরনিন্দ্রায় শায়িত হলেন পলান সরকার

আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকার

এ সম্পর্কিত আরও খবর