বুলডোজারে বিলীন রাজ্জাকের ৬০ বছরের স্মৃতি

চট্টগ্রাম, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, চট্টগ্রাম, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 22:23:45

‘এইতো কিছুদিন হইবো, হারাদিন কাম কইরা শরীরটা জিরানির লাইগা এই পানের দুয়ানে আইছিলাম। এনে পান খাইতাম আর গ্রামের পোলা মাইয়ারে টেলিফোন করতাম। আমার লাহান এইরম শত শত মজুর পান খাইতে লাইন লাগাইতো এই দোহানে। আইজ সাহেবরা দুপুরে দোহানটা ভাইঙ্গা দিছে। কেউ না করে নাই।’

বলছিলাম চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর পাড়ের উচ্ছেদে গুড়িয়ে দেওয়া ৬০বছরের ‘রাজ্জাক স্টোরের’ কথা। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়া আলতাফ মিয়া এই দোকানের পানের স্বাদ নিতেন ২৪ বছর ধরে।

আলতাফ মিয়ার কাছে জানতে চেয়েছিলাম দোকানটির কথা। ওই সময়ে অনেকে এসেছিলেন দোকানটি শেষবারের মতো দেখতে, কেউ এসেছিলেন ভেঙে দেওয়া ধ্বংসাবেশ কুড়িয়ে নিতে।

পাকিস্তান আমলে এক প্রকার সৌখিনতার বশে প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক পানের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। দোকানের আয় দিয়ে চলছিল তার পরিবারের প্রয়োজন। ১৯৯৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে আব্দুর রাজ্জাক মারা গেলে ঐতিহ্যগতভাবে তাই এই ব্যবসার হাল ধরেন বড় ছেলে মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। পরিসর বাড়িয়ে বিভিন্ন স্টেশনারী সামগ্রী দিয়ে চালান ব্যবসা। সবকিছু চলছিলো ঠিকঠাক।

পারিবারিকভাবে গড়ে ওঠা মাছিরঘাট গেইটের স্থানে সময়ের পরিধিতে গড়ে ওঠে ইমাম, রুপসা, আহমদিয়া, ফাইভ স্টার, নুর মদিনা, বিসমিল্লাহ, আল ফারিয়ালসহ বেশ কয়েকটি লবণের গুদাম। এসব গুদামে কর্মরত প্রায় ছয়শ’র অধিক শ্রমিকের সুখ-দুঃখের সম্পৃক্ত আব্দুর রাজ্জাকের পান দোকানের স্মৃতি।

সিরাজগঞ্জের বাসিন্দা আলতাফ মিয়া বার্তা২৪.কমকে জানান, আশেপাশের কাজ করা শ্রমিক থেকে নিম্ন পর্যায়ের যে কোনো মজুরি মিয়ার পান খেয়ে কাজে নামেনি এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। অত্যন্ত নিরেট ভদ্র আর মিষ্টাভাষী আব্দুর রাজ্জাকের অনেক গুণ পায় তার ছেলে জসিম। কি রাত দিন, রাজ্জাক ভাই পান না খাইয়ে কাউকে ছাড়তেন না। তিনি মানুষকে পান খাওয়াতে পছন্দ করতেন।

দোকানের পাশে বার বার বাবার ফেলে যেওয়া স্মৃতিতেই যেন খুঁজছিলো জসিম। কখনও তার মনে হয়নি, বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতি একদিন তলিয়ে যাবে।

বার্তা২৪.কমকে জসিম বলেন, বাবার রেখে যাওয়া দোকান দিয়ে আমাদের পরিবার চলতো। বাবা মানুষকে ভালোবাসে পান দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। আমাদের সবাই বাবার ছেলে বলে গর্ব করতাম। আমাদের কষ্ট লাগছে, বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতি আমাদের সাথে আর নেই। কাল থেকে নতুন জীবন যুদ্ধের নামতে হবে আমাদের।

মাঝিরঘাট লোহারগেইটের ওই স্থানে রয়েছে ২৫টির অধিক লবণের গুদাম। এসব গুদামের ভাড়ায় নিয়ে চলে ব্যবসা করছেন ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা। এরা বেশিরভাগেই পারিবারিকভাবে এ পেশায় সমৃদ্ধ। এ ব্যবসায়ের ওপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নির্ভর করছে পরিবারের ভরণ-পোষণ। গুদাম ভেঙে দেওয়ার ফলে ইতিমধ্যে অনেক শ্রমিকের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। অভিযান অব্যাহত থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়বে জসিমের ৫০ হাজারের অধিক পরিবারের আয়ের খাত। একইসঙ্গে গুদামের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মাঠ পর্যায়ের লবণ শ্রমিকরা। তাদের কাছ থেকে লবণ নিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গুদাম নেই; লবণ নিয়ে কোথায় রাখব?

এদিকে উচ্ছেদ কার্যক্রমের চতুর্থ দিনে প্রথমবারের মতো পরিদর্শনে আসেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নান। পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, আমরা চাচ্ছি ঢাকার সঙ্গে মিল রেখে চট্টগ্রামে মানুষের প্রশান্তি ও বিনোদনের জন্য হাতিরঝিলের আদলে একটি পর্যটন স্পট করার। যাতে মানুষ বিনোদনের জায়গা পায় এবং মানসিক প্রশান্তি পায়। এর পাশাপাশি উদ্ধারকৃত জায়গা সংরক্ষণে আমাদের তদারকি রয়েছে। কোনোভাবেই কাউকে এসব জায়গা বেদখল করতে দেওয়া হবে না।

এ সময় তিনি জানান, গত চারদিনে প্রথম ধাপের ৭৫ শতাংশ অবৈধ উচ্ছেদ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। দু একদিনের মধ্যে বাকি ৩০ শতাংশ কাজ শেষ হবে।

এ সময় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন জানান, হাইকোর্টের একটি রায়ে ২ হাজার ১১২টি স্থাপনার মধ্যে সরকারের জনগুরুত্বপূর্ণ ছয়টিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে বন্দরের মালামাল ওঠানামার সুবিধার্থে তাদের লিজ দেওয়া হয়েছে। নৌবাহিনীর একটি স্থাপনা, এয়ারপোর্টের রানওয়ে এমন ছয়টিকে প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ কোনো বিবেচনা নেই, আরএস অনুযায়ী যেগুলো ভাঙার প্রয়োজন, ইনশাআল্লাহ- সবগুলো ভাঙা হবে।

রাতের আড়ালে দুর্বৃত্তরা সীমানা ছড়িয়ে দিচ্ছে এমন প্রশ্নে জেলা প্রশাসক জানান, সেরকম কোনো সুযোগ নেই, সব আমার নখদর্পনে, সব আমাদের মুখস্ত। এর বাইরে কেউ প্রবেশ করলেও তাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোর্পদ করা হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর