ময়মনসিংহের ফরেস্ট সেটেলমেন্ট অফিসারের কারবার

ঢাকা, জাতীয়

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 04:11:31

ময়মনসিংহ থেকে ফিরে: ফরেস্ট সেটেলমেন্ট অফিসারের দায়িত্ব হচ্ছে গেজেটভুক্ত বনের জমিকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা। কিন্তু সেই সেটেলমেন্ট অফিসার গণহারে গেজেট থেকে জমি বের করে দিয়েছে।

বিশেষ করে বর্তমান সেটেলমেন্ট অফিসার ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) একেএম গালিভ খানের কর্মকাণ্ড নিয়ে রয়েছে বন বিভাগের অনেক আপত্তি। অভিযোগ হচ্ছে তিনি ঢালাও ভাবে বনের জমি গেজেট থেকে অবমুক্ত করে দিয়েছে। ২০০৮, ২০০৯, ২০১১ সালের ঝুলে থাকা মামলার রায়ও বনের বিপক্ষে দিয়েছেন।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে দায়িত্ব পাওয়ার পর ১৩৪ দশমিক ৩৪ একর জমি গেজেট থেকে বের করে দিয়েছেন। দিশেহারা ময়মনসিংহ বন বিভাগ বাধ্য হয়েছে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের দারস্থ হতে। ফরেস্ট সেটেলমেন্ট অফিসারের দেওয়া ওই রায়ে বন বিভাগ তথা রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবী করেছেন বন অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা।

বন বিভাগ উচ্চতর স্তরের দারস্থ হলে কি হবে, সেটেলমেন্ট অফিসারের রায় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জমির চূড়ান্ত দখল নিয়েছে ব্যক্তিমালিক। দ্রুততার সঙ্গে ভূমি অফিসে নামজারি করে, খাজনা দিয়ে মালিকানা পোক্ত করছেন। বন বিভাগ পরের ধাপে গেলেও তার অবস্থান দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

অনেক ক্ষেত্রে রহস্যজনক কারণে বন বিভাগও শক্ত অবস্থান নেয় নি। যে কারণে বনের গেজেট, এসএ খতিয়ানভুক্ত একইসঙ্গে ৪ ও ৬ ধারায় বনের নামে থাকা জমি অন্যের হাতে চলে যাচ্ছে। সংকুচিত হয়ে পড়ছে বনের জমি। অথচ বন আইনে ফরেস্ট সেটেলমেন্ট অফিসারকে দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে গেজেটভুক্ত জমিকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা। এখানে অবৈধ লেনদেনের সম্ভাবনাও দেখেন অনেকে।

যদিও অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবী করেছেন ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফরেস্ট সেটেলমেন্ট অফিসার একেএম গালিভ খান। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, যেগুলো দেওয়া হয়েছে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেই দেওয়া হয়েছে। এখানে নিয়মের কোনো ব্যতয় ঘটেনি, অভিযোগ তোলারও কোনো সুযোগ নেই।

নামে বেনামে অনেক সম্পদ গড়ার অভিযোগও ভিত্তিহীন বলে দাবী করেন ফরেস্ট সেটেলমেন্ট অফিসার। বলেন, আমার নামে ময়মনসিংহে কোনো জমি বা বাড়ি নেই। কেউ যদি বলেন, সেটি ভূয়া তথ্য। আমি ময়মনসিংহ শহরে একটি বিশাল খাস জমি উদ্ধার করেছি। শিগগিরই জানানো হবে মিডিয়াকে।

জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পরে জমিদারদের যে জমিগুলোতে বনভূমি ছিলো, সেগুলো বনভূমি হিসেবে, জলাশয় মৎস্য সম্পদের নামে, কিছু জমি খাস খতিয়ান হিসেবে জেলা প্রশাসকের নামে অন্যান্যগুলো শ্রেণি অনুযায়ী বিভাজন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। যার ভিত্তিতে সিএস রেকর্ডভুক্ত হয় বনের নামে।

গেজেটভুক্ত বনের ওইসব জমি ২০ ধারা করানোর কথা বলা হয়েছে। ২০ ধারা অর্থ হচ্ছে সংরক্ষিত বন ঘোষণা, যেখানে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে ১৯২৭ সালের বন আইনে। গেজেটভুক্ত সম্পতিতে যদি কারো কোনো আপত্তি থাকে, সে শুনানির মাধ্যমে ২০ ধারা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন ফরেস্ট সেটেলমেন্ট অফিসার।

কিন্তু সম্প্রতি ঢালাওভাবে জমি গেজেট থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বন বিভাগ দাবী করেছে তাদের আপত্তি আমলে নেওয়া হয় নি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। ২০০৮ সালের পেন্ডিং কেসও বনের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন গালিভ খান। মিসকেস নম্বর ১১৯ (xiv) ২০০৮ সালের পাড়াগাঁও মৌজায় ৯৫ একর জমির (দাগ ১৪৫) বিষয়ে আপত্তি দিয়ে আসছিলো বন বিভাগ। কিন্তু সেই জমিটি ২০১৮ সালের ২১ মার্চে ব্যক্তির পক্ষে রায় দিয়েছে সেটেলমেন্ট অফিসার। বন বিভাগ সিভিল রিভিশন দায়েরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে ২০ ধারা সম্পন্ন হওয়া জমিও অবমুক্ত করা কথা।

২০০৯ সালের হবিরবাড়ি মৌজায় মিস মোকদ্দমায় {নম্বর ৯৩ (xiv)} ১৫ একর জমি নিয়ে বন বিভাগের সঙ্গে ব্যক্তিমালিকের রশি টানাটানি চলছিলো। আগের সেটেলমেন্ট অফিসাররা দায় নিতে চান নি। আবার চাপের কারণে বাতিলও করেন নি। ৭৪ ও ৭৫ দাগের ওই জমিটি ব্যক্তিমালিকের নামে অবমুক্ত করেছেন ফরেস্ট সেটেলমেন্ট অফিসার গালিভ খান। বন বিভাগ রিভিশন মামলা দায়েরের প্রস্তাব করা হয়েছে। এরকম অনেকগুলো জমির বিষয়ে বনের বিপক্ষে রায় দিয়েছেন তিনি।

ময়মনসিংহ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা একেএম রুহুল আমিন বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি সম্প্রতি এখানে যোগদান করেছি খুব বেশি বলতে পারবো না। আপনি খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন বন বিভাগ কতটিতে জয়ী হয়েছে। আমার নির্দিষ্ট করে বলার কিছুই নেই। আমরা যেসব মামলায় হেরে গেছি উচ্চ স্তরে আপিল করা হয়েছে। আবার কিছু মামলায় আপিলের প্রস্তুতি চলছে।

ময়মনসিংহ বন বিভাগের নামে ৭৫ হাজার একর জমি গেজেটভুক্ত হয়। মল্লিকবাড়ি বিটের নামে জমি ছিলো ১৫৯৯ একর জমি। পুরোটাই বেদখল হয়ে গেছে। হবিরবাড়ি বিটের প্রায় ৭ হাজার ১০ একর জমির মধ্যে ৪ হাজার ১৪৪ একর জমি বেদখল হয়েছে। কাদিগড় বিটের ৪ হাজার ৬৮৬ একর জমির মধ্যে ৩ হাজার ৬০ একর জমি পাড়াগাঁও মৌজায় বন বিভাগের জমি ছিলো ১ হাজার ৬৪৬ একর ৭২ শতক। এ জমির এক শতকও আর বন বিভাগের দখলে নেই।

তবে সম্প্রতি ময়মনসিংহ বন বিভাগ একটু ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অনেক প্রভাবশালীর স্থাপনা গুড়িয়ে দিয়ে ভূমিদস্যূদের কাপন ধরিয়ে দিয়েছে। সংরক্ষিত বনের জমিও এখন জবরদখলকারির কবলে রয়েছে। প্রতি বছর বনের নতুন নতুন জমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে।

আমলা থেকে শুরু করে পুলিশ-বিজিবি-আনসারের লোক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী নেতা, আওয়ামী লীগ, বিএনপির মাঝারি থেকে পাতি নেতা, সাংবাদিক কেউই ছাড় দেয়নি বনকে। সোনার চেয়ে দামী ভালুকার জমির উপর শকুনের দৃষ্টি এখন অনেকের। যে বন বিভাগ রক্ষা করার কথা, তারাও অনেকে সময় প্রভাবশালীর চাপে গড্ডালিকায় গা ভাসিয়েছে।

কেন্দ্রীয় বন অঞ্চলের বন সংরক্ষক রকিবুল হাসান মুকুল বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, সারাদেশে বনের জমি ডিমার্কেশন করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এখানে বন বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলে থাকবে। মার্ক করার কাজ শেষ হলে উদ্ধারে বিশেষ অভিযান করা হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর