আইজ শীত পড়ছে, বাঁশিত কড়া সুর উঠব না

ময়মনসিংহ, জাতীয়

রাকিবুল ইসলাম রাকিব, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ), বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 22:09:11

‘আট বৎস্যর আগের কথা। ভাদ্র মাইস্যা চাঁদনী রাত। হেই রাইতে বাড়ির পেছনে ইশকুলের বারিন্দাত বইয়্যা একলা বাঁশি বাজাইতাছিলাম। হুট কইরা বিরাট আওয়াজ হইল। ওই সময় মনে অইল ইশকুলের পাশে থাহা কড়ই গাছটা ভাইঙ্গা পড়তাছে। মেলা ভয় পাইছিলাম। বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। কিন্তু বাঁশি বাজানি থামাই নাই। বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে বাড়িত আইয়্যা পড়ি। হেরপর অসুখে পইর‌্যা গেলাম। নাক-মুখ ফুইল্যা গেলো। এক হপ্তাহ কবিরাজি ওষুধ খাইয়্যা ভালা অইলাম। পরে খবর লইয়্যা জানলাম হেই রাইতে কড়ই গাছের কোনো ডাইল ভাঙে নাই। গাছটার ডাইলপালা ঠিকই আছে। হের পরের থেইক্যা আর রাইতের বেলা একলা বাঁশি বাজাই না।’

বার্তা২৪.কমের কাছে নিজের ৪০ বছরের বাঁশি বাজানো জীবনের একটি ভয়ার্ত অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন আব্দুল কদ্দুস (৫৩)। তার বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার সহনাটি ইউনিয়নের কাশিচরণ গ্রামে। সে ওই গ্রামের মৃত তালেব হোসেনের ছেলে।

৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বাঁশিওয়ালার দেখা মিলে গৌরীপুর পৌর শহরের বঙ্গবন্ধু চত্বরে। চত্বরের পামগাছের নিচে বাঁশির পসরা সাজিয়ে বসে আছেন তিনি। একই সঙ্গে বাঁশি বাজিয়ে চলেছেন একমনে। আর শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছে তার সেই সুর।

সুর থামলে এ প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় আব্দুল কদ্দুসের। কথায় কথায় জমে গল্প। তার বাঁশিতে বেজে ওঠে নানা রকম সুর। সেই সুরে মন্ত্রমুগ্ধ হয় দর্শনার্থীরা।

কীভাবে বাঁশিওয়ালা হয়ে উঠলেন জানতে চাইলে আব্দুল কদ্দুস বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। লেহাপড়া করবার পারি নাই। তয় বাঁশি বাজানির লেইগ্যা আমি উতলা ছিলাম। তাই একদিন বাজান আমারে লইয়্যা গেলো সরিষাহাঁটি গ্রামের বিখ্যাত বংশীবাদক ওস্তাদ রইছ উদ্দিনের কাছে। পরে ওস্তাদের বাড়িত থাইক্যা কাইজ-কাম করি। আর রাইতে ওস্তাদ আমারে বাঁশি বাজানির তালিম দিতো। হেরপর ১৩ বৎস্যর বয়সেই আমি বাঁশি বাজানি শিইখ্যা ফেলি। আস্তে আস্তে বাঁশি বানানির কামও শিহি।’

মোহন বাঁশি, নাগিনী বাঁশি, কল বাঁশি, পাতা বাঁশি সহ বিভিন্ন ধরনের বাঁশি তৈরি করতে পারেন কদ্দুস। এসব বাঁশি তৈরির জন্য সুসং দুর্গাপুরের পাহাড়ি এলাকা থেকে ‘তরলা’ বাঁশ কিনে আনেন তিনি। ওই বাঁশ কেটে, রোদে শুকিয়ে, গরম লোহার শলাকা দিয়ে ছিদ্র করে, বার্নিশ করে এক একটি বাঁশি তৈরি করা হয়। প্রতিদিন স্থানীয় হাট-বাজারে ৫ থেকে ৬শ টাকার বাঁশি বিক্রি করেন তিনি। তবে রাজধানী ঢাকায় গেলে প্রতিদিন ২ হাজার টাকার বাঁশি বিক্রি হয় তার।

এক সময় অভাব-অনটনে থাকলেও বাঁশি বিক্রি করে কদ্দুস এখন গ্রামে জমি-বাড়ি করেছে। তার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। দাম্পত্য জীবনে কদ্দুসের স্ত্রী ও তিন মেয়ে রয়েছে। এর মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে।

কথা প্রসঙ্গে কদ্দুস জানান, বাঁশি বাজানো শেখানোর জন্য কেন্দুয়া থানার বেকুরহাটি গ্রামে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন। ৭-৮ জন যুবক প্রতিমাসে ৫শ টাকা দিয়ে বাঁশি বাজানোর তালিম নেয় তার কাছে। এছাড়াও দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোকজনও অগ্রিম অর্ডার দিয়ে তার কাছ থেকে বাঁশি কিনে নিয়ে যায়।

এরই মাঝে সন্ধ্যা নেমেছে। শীতের প্রকোপের সঙ্গে বইছে ঠান্ডা হিমেল হাওয়া। এমন সময় দর্শনার্থীদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বলে, ‘কদ্দুস ভাই বাঁশিতে গরম একটা সুর তোলো।’

কথার রেশ টেনে কদ্দুস বলেন, ‘আইজ শীত পড়ছে, শইলডাও জুইত নাই। কড়া সুর উঠবো না।’ এই কথা বলেই বাঁশি হাতে নেয় কদ্দুস। করুণ সুরে বাঁশিতে বেজে উঠে ‘পূবালী বাতাসে, বাদাম দেইখ্যা চাইয়্যা থাকি, আমারনি কেউ আহে রে।’

বাঁশির সুরের মূর্ছনায় বঙ্গবন্ধু চত্বরে সন্ধ্যার আলো রাতের আঁধারে মিলে যেতে থাকে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর