যুগলের পেটের ভাত কেড়ে নিল ‘ধানের ব্লাস্ট রোগ’

, জাতীয়

মৃত্যুঞ্জয় রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সাতক্ষীরা | 2024-04-17 17:47:55

সবাই যখন ইরি ধান কেটে ঘরে তুলতে ব্যস্ত। ঠিক তখনই যুগল মাথায় হাত দিয়ে জমির আলের উপর বসে আছে। এদিকে চোখ দিয়ে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে আর অপার দৃষ্টিতে ধানের দিকে তাকিয়ে একা একা বিরবির করে কি যেনো বলছেন। শুনতে কাছে যেতেই গলা ছেড়ে কান্না করে বলতে লাগলেন, সারাবছর কি খাবো? সমিতি থেকে লোন নিয়ে ইরি ধান করেছি। আশা ছিলো ধান ঝেড়ে ঝুড়ে বিক্রি করে লোন শোধ করবো। কিন্তু ধানে ‘ব্লাস্ট’ রোগে শেষ সব। ধান বাড়ি নিয়ে যাওয়া তো দূরে থাক শুধু খর গুলো শেষ সম্ভল। তিন মাসের শ্রম, কষ্ট সব পুড়ে ছাই। মনে হচ্ছে ধানের শীষে আগুন লেগেছে। কত ভালোই না ধান হয়েছিলো তাকালে যেন খিলখিল করে হাসতো বাতাসে। কিন্তু রাতারাতি ধানে পোকা লেগে সব কিছু শেষ।

সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার কলাগাছি গ্রামে স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে যুগলের সংসার। এই ইরি ধানই সারাবছর তাদের খাবার জোগায়। কিন্তু নতুন চালের ভাত খাওয়ার আগেই ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে সব শেষ।

সরেজমিনে দেখা যায়, যুগলের জমির ধান সব চিটা হয়ে গেছে। ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে ধান গাছের পাতা আছে তবে ধানের ফল নেই। জমির বাঁধে যুগুল মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে আর তার একটু সামনে তার স্ত্রী ধানের অবশিষ্ট খর কাঁচি দিয়ে কাটছে। এদিকে তাদের ছোট্ট শিশুপুত্র আপন মনে একপাশে খেলা করছে।

যুগুলের স্ত্রী বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের বলতে আর কিছু নেই। আমাদের এলাকায় একটাই ফসল হয় আর সেই ইরি ধানে আমরা মাইর খেলাম। কি খাবো না খাবো ভেবে পাচ্ছি না। একদিকে ঋণের বোঝা আর এদিকে পেটের জ্বালা। কিভাবে শোধ করবো ইরি ধান করা লোনের টাকা। এই ফসল ছাড়া আমাদের এদিকে আর কোনো ফসল হয় না। আমরা এই ফসলের উপর ভরসা করে থাকি। কিন্তু সেই ফসল আমাদের পেটের খাবার কেড়ে নিল।

ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে ধান গাছের পাতা আছে তবে ধানের ফল নেই

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ধানের ব্লাস্ট (Blast) একটি মারাত্মক ছত্রাকজনিত রােগ। পাইরিকুলারিয়া গ্রিসিয়া (Pyricularia grisea) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে। হালকা মাটি বা বেলেমাটি যার পানি ধারণক্ষমতা কম সেখানে রােগ বেশি হতে দেখা যায়। জমিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার এবং প্রয়ােজনের তুলনায় কম পটাশ সার দিলে এ রােগের আক্রমণ বেশি হয়। দীর্ঘদিন জমি শুকনা অবস্থায় থাকলেও এ রােগের আক্রমণ হতে পারে। রাতে ঠান্ডা, দিনে গরম এবং শিশির থাকলে এ রােগের প্রকোপ বেড়ে যায়।

এদিকে কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধানের থোর অবস্থায় ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ধানের ফুল অবস্থায় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা চলে গেলে; থোরের ভেতর ভ্রুণের গর্ভপাত হতে পারে। ফলে ধানের থোর থেকে ফুল বের হওয়ার পরপরই সাদা মরা অপরিপক্ক মন্জুরী দেখা যায়।

ধানের থোর বা ফুল অবস্থায় তাপমাত্রা যদি ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি চলে যায় তা হলেও ধান চিটা হয়ে যেতে পারে।

এছাড়া অনাকাঙ্খিত ঝড় ও শিলা বৃষ্টিতে ধানের থোর ও ফুল অবস্থায় আঘাতজনিত ইনজুরির কারণেও ধান সাদা চিটা হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ কোল্ড ইনজুরি বা হিট ইনজুরির কারণেও ধানের থোরের মধ্যে ভ্রুণের গর্ভপাত হয়ে ছড়ার আংশিক সাদা হয়ে মরা বের হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে ধান ক্ষেতে কোনো ওষুধ দিয়েও লাভ হয় না।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনাকাঙ্খিত ঝড়- শিলাবৃষ্টি, অসময়ে অতি শীত, অতি গরম ধান চাষে কৃষকদের নতুন নতুন সমস্যা, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর