জলকেলিতে বর্ণিল মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব

, জাতীয়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা ২৪.কম, বান্দরবান | 2024-04-17 10:38:34

মারমা সম্প্রদায়ের নববর্ষ বরণ উৎসব “সাংগ্রাই”র জলকেলিতে মেতে উঠেছে সমগ্র বান্দরবান পার্বত্য জেলা। বান্দরবানে মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ‘মৈত্রী পানি বর্ষণ’ (পানি খেলা) ।

বান্দরবান শহরের রাজার মাঠে এই সাংগ্রাই উৎসবকে কেন্দ্র করে বসেছে বিশাল আয়োজন। সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর উশৈসিং প্রধান অতিথি হিসেবে এই উৎসবের উদ্বোধন করেন। নেচে গেয়ে আনন্দ উদ্দীপনায় একে অপরের গায়ে পানি ছিটিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নিল মারমা সম্প্রদায়।

চন্দন পানিতে বৌদ্ধমূর্তি স্নান দিয়ে শুরু হয়েছে মারমা সম্প্রদায়ের তিন দিনব্যাপী সাংগ্রাই উৎসব। সাংগ্রাই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ জলকেলি উৎসব (পানি খেলা)। জেলার রাজার মাঠে তরুণ তরুণীরা একে অপরের গায়ে জল ছিটিয়ে বরণ করে নিয়েছে নতুন বছরকে। মারমাদের বিশ্বাস স্বচ্ছ পানির দ্বারা ধুয়ে মুছে দিবে অতীতের সব দুঃখ গ্লানি। এই উৎসবকে মারমারা বলে ‘রিলং বোয়ে’।


যেভাবে শুরু হয় "সাংগ্রাই" উৎসব

সাংগ্রাইং উৎসবের প্রথম দিনে কিছু নির্দিষ্ট কর্মসূচি পালন করা হয়। তরুণ-তরুণীরা সবাই মিলে বৌদ্ধ মন্দির পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তােলে। এই কাজটিকে একটি পবিত্র কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারপর সমাজের সবাই মিলে বৌদ্ধ মন্দিরে যায় এবং পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণ করে থাকে। তখন বৌদ্ধভিক্ষুর কাছ থেকে ধর্মীয় উপদেশ শুনে থাকে। বুদ্ধমূর্তিকে নতুন চীবর দান করা হয়। সেই সময় মন্দিরে টাকা-পয়সা দান করে ও প্রদীপ জ্বালানো হয়। শেষে বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে ছােয়াইং (খাবার) দান করা হয়।

এই দিনে মন্দিরের বুদ্ধমূর্তিগুলাে নদীর তীরে শােভাযাত্রা সহকারে নিয়ে গিয়ে স্নান করানো হয়। শােভাযাত্রায় বৌদ্ধভিক্ষু, স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ ও সাধারণ লােকজন অংশগ্রহণ করেন। বুদ্ধমূর্তিটিকে নিয়ে যাওয়ার সময় বাদ্যযন্ত্র বাজানাে হয়। এসময় চন্দনের জল ও ডাবের পানি সঙ্গে করে নিয়ে যায়।

বুদ্ধমূর্তিগুলােকে বাঁশের তৈরি সুসজ্জিত একটি মঞ্চে রাখা হয়। এরপর ভক্তরা চন্দন ও ডাবের পানি বুদ্ধমূর্তিগুলাের ওপর ঢেলে দেয়। এই ঢেলে দেওয়া পানিগুলাে লােকজন সংরক্ষণ করে রাখে। এই পানি খেলে রােগ-ব্যাধির নিরাময় ঘটে বলে তাদের বিশ্বাস।

স্নানের পর বুদ্ধমূর্তিগুলােকে ইতােপূর্বে দায়কদের দানকৃত নতুন চীবর পরানাে হয়। একইভাবে আবার বুদ্ধমূর্তিগুলাে মন্দিরে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর বিকেলে মন্দিরে গিয়ে শীল প্রার্থনা করে ধর্মোপদেশ শুনে থাকে এবং প্রদীপ জ্বালানাে হয়। পরবর্তী দুটি দিনে আরাে কিছু কর্মসূচি পালিত হয়। যেমন বিশেষ খাদ্যদ্রব্য ও বিভিন্ন প্রকার পিঠা তৈরি। বৌদ্ধভিক্ষুদের জন্য ছােয়াইং দান এবং বয়ােজ্যেষ্ঠ ও প্রতিবেশীদের জন্য বিশেষ খাবার প্রেরণ। বয়ােজ্যেষ্ঠদের পূজা। মৈত্রী পানি বর্ষণ এবং মন্দিরে প্রার্থনা করা হয়।


যেভাবে হয় সংগ্রাইয়ে মৈত্রী পানি বর্ষণ

মৈত্রী পানি বর্ষণ সাংগ্রাইং উৎসবের একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে বড় একটা মাঠে একটি মণ্ডপ বানানাে হয়। মণ্ডপের দুই দিকে দুটি বড় পানি ভর্তি নৌকা রাখা হয়। একটি নৌকার পাশে তরুণদের একটি দল অবস্থান নেয়। যখন খেলা শুরু হয় তখন উভয় দল তাদের প্রতিপক্ষ দলের দিকে নৌকায় রাখা পানি ছুড়তে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না ফুরিয়ে যায়। নৌকার পানি ফুরিয়ে গেলে তা আবার পানি দিয়ে ভরানাে হয়। একটা ব্যাচ শেষ হলে আরেকটা নতুন ব্যাচ এসে খেলা শুরু করে। মূলত মারমা সমাজ আশা করে পূর্ববর্তী বছরের সমস্ত যন্ত্রণা, দুঃখ, দুর্ভাগ্য এবং মালিন্য এই পানিতে ধুয়ে মুছে যাবে এবং অনাবিল একটি নতুন বছর শুরু হবে।

শুধু বান্দরবান শহরেই নয় বিভিন্ন মারমা পল্লীগুলোতে চলছে এখন উৎসব আয়োজন। উৎসব দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক ও দর্শনার্থীরা ছুটে এসেছেন বান্দরবান শহরে।

জেলা শহরে মঙ্গলবার মধ্যরাতে এই উৎসব শেষ হয়ে গেলেও উপজেলাগুলোতে ১৭ এপ্রিল শেষ হবে সাংগ্রাই অনুষ্ঠান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর