বনের জমি দখলের খেলার নাম ‘ডিমার্কেশন’

ঢাকা, জাতীয়

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-12-12 20:19:17

ভালুকা (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে: বনের জমি দখলের নতুন খেলার নাম ডিমার্কেশন। এই খেলায় খেলোয়াড় অনেকেই, আর তাদের গোল হচ্ছে বনের ‘নিষ্কণ্টক জায়গা’ অন্যের হাতে তুলে দেওয়া।

এই ডিমার্কেশনের খেলায় বনের দখলে থাকা নিষ্কণ্টক জমি তুলে দেওয়া হয়েছে প্রভাবশালীদের হাতে। আর  জবরদখলে এবং অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের জমি দেখানো হয়েছে বনের নামে। একদাগে হয়তো দশ একর জমির মধ্যে ২ একর ব্যক্তিমালিকানাধীণ । এখানে দেখা যাচ্ছে আগে থেকেই ৮ একর দখলে রয়েছে। নতুন করে ডিমার্কেশনের নামে নিষ্কণ্টক ২ একর ব্যক্তির নামে দেখানো হচ্ছে। ফলাফল বন বিভাগ সেখানে বাস্তহারা হয়ে যাচ্ছে।

ডিমার্কেশনের খেলায় কখনই বনের স্বার্থ দেখা হয় নি বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবারই বন বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছে। আর এর পেছনে কাজ করেছে কোটি কোটি টাকার খেলা। ২০১১ সালে হবিরবাড়ি মৌজায় এমন একটি খেলা হয়। এখানে শহীদুল ইসলাম শহীদ যিনি বাউন্ডারি শহীদ নামে সর্বজনবিদিত। তার গ্রামের বাড়ি অবস্থিত এই মৌজায়।

 

বিবদমান দাগ ৪৩৮ এ মোট জমির পরিমাণ ১১১.৬৪ একর। এরমধ্যে  ব্যক্তিমালিকানাধীন ১২.৬৪ একর, খাস ১.৮৯ একর, বন্দোবস্তকৃত ১৩.৮৫ একর। অবশিষ্ট ৮৩.৬৩একর জমি বন বিভাগের। তৎকালীন ভালুকা সহকারি কমিশনার ভূমির নেতৃত্বে গঠিত ডিমার্কেশন কমিটি গঠন  করা হয়।

কমিটি শহীদের বাড়ি, খামার, পুকুর জলাশয় দেখিয়েছে বনের নামে। আর বনের জমিগুলো দেখিয়েছে  শহীদের নামে। শহীদের নামে ডিমার্ক করার সঙ্গে সঙ্গেই বনের বিশাল বাগান সাবাড় করে দখল নিয়েছে। বন বিভাগের গজারী বনের জায়গায় শোভা পাচ্ছে বাউন্ডারি শহীদের আমের বাগান।

অন্যদিকে বন বিভাগ কিন্তু তার বাড়িতে হাত দিতে যায়নি। অর্থাৎ ৪৩৮ দাগের প্রায় বেশিরভাগ জায়গা এখন শহীদের দখলে। সম্প্রতি বন বিভাগে কিছু অফিসার এই জায়গা উদ্ধারের উদ্যোগ নিলে শহীদ তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শহীদের বক্তব্য হচ্ছে এই জমিতো আমার পুর্বপুরুষের বসত ভিটা। এটা কি করে বনের হয়। আপাতদৃষ্টিতে শহীদের অকাট্য যুক্তি খণ্ডনের কোনো উপায় নেই। কিন্তু তার আসলে কতটুকু জমি আর তিনি কতটুকু ভোগ দখল করছেন তার হিসেব কিন্তু কেউই নিতে পারেন নি।

বন বিভাগকে বিবাদী করে ডিমার্কেশনের বিরুদ্ধে রিট দায়ের করেছেন। আর এতেই আটকে গেছে বনের ভবিষ্যত। যার ফলে প্রায় পুরো জমিই এখন ভোগ করছেন বিএনপি শহীদ। এই ঘটনার মূল অনুঘটক ছিলেন তৎকালীন ভালুকা রেঞ্জ অফিসার আবুল হাশেম খান। কথিত রয়েছে হাশেম খান এর জন্য মোটা অঙ্কের বাণিজ্য করেছেন। ওই ঘটনার কিছুদিন পরেই অবসরে চলে যান হাশেম। যদিও তার অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা আটকে দিয়েছে বন বিভাগ।

এই ডিমার্কেশনে বন বিভাগকে আরেকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করা হয়েছে। একই দাগের বিপুল পরিমাণ জমি বিচ্ছিন্ন জায়গায় চিহ্নিত করা।  এখানে ব্যক্তিমালিকার জমি একদিকে দিয়ে দিলে বন বিভাগ নিষ্কণ্টক হয়ে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা গেছে ৭টি পৃথক জায়গায় বন বিভাগকে দেখানো হয়েছে। বনের ভেতরে ভেতরে ব্যক্তিমালিককে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে।

বিট অফিসার আব্দুর রফিক বার্তা২৪.কমকে বলেন, শহীদের খামার পুকুর জলাশয় দেখানো হয়েছে বনের নামে। আর যেখানে আমাদের বাগান ছিলো সেই বাগান মার্ক করে দেওয়া হয়েছে শহীদের নামে। বনের জমিগুলো যদি একদিকে দেওয়া হতো তাহলে কিন্তু রক্ষা করতে সুবিধা হতো। কিন্তু তা না করে বিভিন্ন জায়গা দেওয়া হয়েছে। আর মাঝে মাঝে ব্যক্তিমালিক থাকায় তারা একটু একটু করে গিলে খায় বনের জমি।

অতীতে দেখা দেখা গেছে ব্যক্তিমালিক বনের ভেতরে বসে দিনে দিনে তার রাজত্বের প্রসারিত করেছে। এতে করে পরাজিত হচ্ছে বন বিভাগ। ক্ষেত্র বিশেষে অবৈধ সুবিধা নিয়ে বনের জমি অন্যহাতে তুলে দিচ্ছে খোদ বনেরই লোকজন। এভাবেই হয়তো একদিন বাস্তহারা হয়েছে মল্লিকবাড়ি বন বিট। শক্তহাতে দমন করা না গেছে হয়তো অন্য বিটগুলো একদিন শহীদদের ভোগে চলে যাবে।

অভিযোগ রয়েছে, এখানে পুলিশ প্রশাসনও বনের বিষয়ে খুব একটা আন্তরিক নয়। মামলা দিতে গেলেও অনেক সময় তাদের সাড়া পাওয়া যায় না। দখলদাররাও প্রভাবশালী তাদের টাকার গন্ধে অনেকেই বুদ হয়ে যাচ্ছে। অনেকে মনে করেন, সোনার চেয়ে দামী এই বন বিভাগের জমি রক্ষা করতে হলে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্ভব নয়। শহীদকে থামানো গেলে বন আশিভাগ নিরাপদ হয়।

অনেকবারে চেষ্টা করেও শহীদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয় নি। ভালুকা রেঞ্জ সংলগ্ন তার বাসায় গেলেও সাক্ষাৎ পাওয়া যায় নি।

ময়মনসিংহ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা একেএম রুহুল আমিন বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি সম্প্রতি এখানে যোগদান করেছি। এখানে এসে অনেকবার বাউন্ডারি শহীদের নাম শুনেছি। ডিসির সঙ্গে কথা বলেন, তিনিও হয়তো এই নাম জেনে থাকবেন। আগে কি হয়েছে বলতে পারি না। দখলবাজরা খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। দখলবাজ যেই হোক তার রক্ষা নেই। বনের জায়গা রক্ষা করার জন্য যা প্রয়োজন সব উদ্যোগ নেওয়া হবে।

কেন্দ্রীয় বন অঞ্চলের বন সংরক্ষক রকিবুল হাসান মুকুল বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, সারাদেশে বনের জমি ডিমার্কেশন করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এখানে বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সকলে থাকবে। মার্ক করার কাজ শেষ হলে উদ্ধারে বিশেষ অভিযান করা হবে। সেখানে কেউ ছাড় পাবে না। আশা করছি এই কাজটি বন বিভাগের জন্য মাইলফল হয়ে থাকবে।

আশা এবং দুরাশার কথা হচ্ছে সম্প্রতি কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছে ময়মনসিংহ বন বিভাগ। অনেকগুলো অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাদশা টেক্সটাইলকে বনের লোকজন এক সময় সমীহ করে চলতো। সেই বাদশা মিয়ার প্রাচীর গুড়িয়ে দিয়ে প্রভাবশালীদের আস্থানা গুড়িয়ে দিয়ে দখলবাজদের কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে।

যে কারণে দখলবাজদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও দখলবাজরা প্রকাশ্য হাম্বিতম্বি করে বেড়াচ্ছে। তাদের কথা না শুনলে সেই কর্মকর্তার আর এখানে থাকতে হবে না। বদলী হয়ে খাগড়াছড়ি যেতে হবে। শহীদের নামে অনেক মামলা হয়েছে, রহস্যজনক কারণে প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় শহীদের নামে ভুল, না হলে তার বাবার নাম ভুল না হলে তার ঠিকানা ভুল করা হয়েছে। আর সেই ভুলের ফাঁক গলে অধরা থেকে বনবিভাগের এই মূর্তিমান আতঙ্ক।

ডিমার্কেশনের নিয়ম হচ্ছে, কারো আপত্তি থাকলে ডিসির কাছে আবেদন করে ডিমার্কেশনের। ডিসি তখন অফিসার নিয়োগ করেন। সেই অফিসার বন বিভাগের উপস্থিতিতে চিহ্নিত করে দেন ব্যক্তিমালিকানার জমি। এরপর একটি স্কেচ ম্যাপ অনুমোদন করে দেওয়া হয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর